সৌহার্দ্য ও শিষ্টাচারঃ ইসলামি দৃষ্টিকোণ
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
আজকাল পথে-ঘাটে
পথচারীদের ভিড়ে, চায়ের দোকান ও রাস্তার মোড়ে, টিভি-পেপারের সংবাদ শিরোনামে,
নাটক-উপন্যাস, ফিল্ম-টেলিফিল্ম ইত্যাদির ভিলেন চরিত্রে মুখে পান বা গুটখা, পরনে
বিশেষ ধরণের পাঞ্জাবী-পায়জামা, দেশ বিরোধী ইস্যু হলে যত্ন করে পরানো টুপি, মুখে
উর্দু-বাংলা মিশ্রিত বুলি ইত্যাদি দিয়ে একটা ছবি তৈরি করা হচ্ছে সমাজের মননে-
মুসলিমরা এমনই। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বৃহত্তর সমাজের মনে মুসলিমদের প্রতি ঘৃণার একটা
আবহ প্রতিনিয়ত ঘনীভূত হয়ে চলেছে। হ্যাঁ সত্যিই, কিছু
মুসলিম নানান অসামাজিক ও অকল্যাণকর কাজে জড়িয়ে। তাই বলে কি তার খেসারৎ পুরো মুসলিম জাতিকে দিতে হবে!
আমি মনে করি, সবার
জানা দরকার যে- প্রকৃত মুসলিম কে বা কারা? খোদ নবি (সা)-র ভাষায়- ‘যার কথা ও কাজে
অন্য কোনো মানুষ আঘাত পায় না সে-ই প্রকৃত মুসলিম’ (আহ্মাদ ৭০৮৬, নাসায়ি ৪৯৯৫)। হয়তো তারই জন্যে এই
‘পিছিয়ে পড়া’ মুসলিম সমাজে এখনো বহু ইতিবাচক দিক রয়েছে। বিশেষত আদব-কায়দা,
সৌহার্দ্য ও শিষ্টাচারের দৃষ্টিকোণ থেকে মানব সমাজের জন্য বহু শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে
এই অবহেলিত মুসলিম মানসের কাছে। তাঁদের পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা, পিতামাতার প্রতি
শ্রদ্ধা ও দায়িত্ববোধ, নিজের সর্বস্ব দিয়ে অপরের সাহায্য করা ইত্যাদি গুণগুলির কথা
উনিশ শতকে যেমনটা শরৎ বাবু ‘পল্লীসমাজ’-এ লিখে গেছেন, হয়তো তারই এক ঝলক কেরলের
বন্যায় হানান হামিদের উদারতায় লক্ষ্য করা গেল। এমন বহু নজির আমাদের চারিপাশেই
রয়েছে; শুধু একটু ঘৃণা ও অবজ্ঞার চশমা খুলে তাকালেই দেখা মিলবে।
যদিও আজকাল বহু
মুসলিম যুবককে বৃদ্ধ মা-বাবাকে অবহেলা করতে দেখা যায়; কিন্তু মুসলিম সমাজে মা-বাবাকে
বৃদ্ধাশ্রমে পাঠাবার মত নিন্দনীয় ঘটনা তেমন নজরে আসেনি। কারণ মুসলিম মানসপটে কোথাও
গেঁথে রয়েছে “লোকেদের মধ্যে উত্তম সাহচর্যের সর্বাপেক্ষা অধিকারী তোমার মা (তিনবার)। তারপরে তোমার বাবা। তারপরে তোমার অন্যান্য নিকটবর্তীরা”
(মুস্লিম ২৫৪৮) এবং এ কথাও “মা-বাবা সন্তুষ্ট থাকলে স্রষ্টাও সন্তুষ্ট হন। আর
তাঁরা মনঃক্ষুণ্ণ হলে স্রষ্টাও মনঃক্ষুণ্ণ হন” (তির্মিযি ১৮৯৯)। এমনকি হিজ্রত
(সত্যের জন্য দেশান্তরী হওয়া) ও জিহাদ (সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম
করা)-এর সমতুল্য ধার্য করা হয়েছে পিতামাতার সেবা করাকে (মুস্লিম ৪৬৩০)। ইসলামি
সাহিত্যে, শুধু মা-বাবা নয়, মা-বাবার বন্ধুবান্ধব ও সমস্তরীয় লোকেদের সাথে
সুসম্পর্ক রাখা ও উত্তম সাহচর্য প্রদান করাকে সর্বাধিক পুণ্যময় কাজ ঘোষণা করা
হয়েছে (মুস্লিম ৪৬৩৮)। আর ভালো ব্যবহার,
উত্তম চরিত্র ইত্যাদিকে পুণ্য ও মনে সংশয় উদ্রেককারী ঘৃণ্য কাজগুলোকে পাপ বলে
পরিভাষিত করা হয়েছে (মুস্লিম ২৫৫৩)। শুধু পিতামাতা নয়, সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায়
রাখার আদেশও দেওয়া হয়েছে; আত্মীয়তার বন্ধন ও সম্পর্ক ছিন্ন করা-কে হারাম (নিষিদ্ধ)
করা হয়েছে (মুস্লিম ২৫৫৪)। প্রতিবেশীর প্রতি যত্নশীল হতে বলা
হয়েছে (মুস্লিম ৪৮৮৬)। তবে যদি বাস্তবোচিত ও শরিয়তসম্মত কোনো কারণ থাকে,
সেক্ষেত্রে সম্পর্কের ইতি টানা বৈধ (বুখারি ৫৭২৭)। হিংসা, বিদ্বেষ ও পশ্চাদ্ধাবন-এর মত যে কাজগুলি সম্পর্ক নষ্ট করে সে-সবকে
বর্জন করে ভ্রাতৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করার বিধানও দেওয়া হয়েছে (বুখারি ৫৭১৮)। সালাম ও সম্ভাষণের মাধ্যমে সম্পর্ককে দৃঢ় করা (মুস্লিম ৫৪) ও ছিন্ন-সম্পর্ককে
পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার প্রতি উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে (মুস্লিম ২৫৬০)। বিভিন্ন রীতিনীতি,
আচারঅনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে সম্পর্ক বলিষ্ঠ করা সামাজিক ইসলামের একটা বড়
অধ্যায়। তাই অসুস্থদের সেবা-শুশ্রূষা (মুসলিম ২৫৬৮), পীড়িতদের সাহায্য-সহযোগিতা (মুস্লিম
৪৮৭৩), অনাথদের প্রতিপালন (বুখারি ১৪৬৭), দরিদ্র-অভাবীদের অর্থায়ন (সূরাতুল্ ইন্সান
৮) ইত্যাদি-কে সর্বাধিক পুণ্যময় কাজগুলির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যাতে একটি সুষ্ঠু
সমাজ গড়ে ওঠে। এবং সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করতে কিছু পারস্পরিক অধিকার ও
দায়দায়িত্বের বিধিবিধানও প্রদত্ত হয়েছে। অতএব ঔদার্য, দানশীলতা ও বিনয় প্রদর্শন (মুস্লিম
২৫৮৮)-এর পাশাপাশি পরস্পরের খোঁজ-খবর রাখাও ঈমানি দায়িত্বগুলির একটি।
জীবন-পথ চলতে, কোনো ইস্যুকে কেন্দ্র করে মতানৈক্য ও বিতর্ক জন্মাতেই পারে। তবে
বিতর্ক যাতে দীর্ঘস্থায়ী না হয় তার জন্য বাতলে দেওয়া হয়েছে বিনম্রভাবে আলোচনা-সমালোচনার
মাধ্যমে সমাধান-অন্বেষণের পথ ও পদ্ধতি। অতএব তর্ক-বিতর্কের সময় একজন প্রকৃত
মুসলিমের ভাষা কখনই মর্যাদার সীমাকে লঙ্ঘন করবে না (মুস্লিম ২৫৮৭)। কণ্ঠস্বর হবে নমনীয় (সূরা ত্বহা ৪৪)। আলোচনা হবে বুদ্ধিদীপ্ত ও যুক্তিপূর্ণ। যুক্তিখণ্ডন হবে উত্তম ও প্রাসঙ্গিক
পন্থায় (সূরা আন্-নাহাল ১২৫)। একজন প্রকৃত মুসলিম দ্বিচারিতাকে
বর্জন করে প্রমাণিত ও বাস্তবোচিত সিদ্ধান্তের উপর মনকে স্থির করবে। সর্বদা সত্যকে আঁকড়ে থাকবে (মুস্লিম ২৬০৭)। যাতে সমাজে ঐক্যের সুর অটুট থাকে। কারণ, লোকেদেরকে ঐক্যের
মন্ত্রে গেঁথে ন্যায় ও সততার উপর প্রতিষ্ঠিত একটি সুশীল সমাজ গঠন করা ইসলামের মৌল
সিদ্ধান্তগুলির একটি (সূরাতু আলে-ইম্রান ১০৩-১০৫, মুস্লিম ২৫৬৪)। যাতে সকলে মিলে আর্থসামাজিক অধঃপতন, মানবিক অবক্ষয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ-এর মত
বিপর্যয়গুলির মুকাবেলা করতে পারে। আর তাই সুশীল সমাজকে মানব দেহের সাথে তুলনা করা
হয়েছে (মুস্লিম ২৫৮৬); যাতে তারা একে অপরের ব্যথা-বেদনা অনুভব করে সাহায্যার্থে
এগিয়ে আসে (সূরাতুল্ মায়েদাহ্ ২)। কেউ কারুর প্রতি বিন্দু মাত্র অবিচার না করে। বরং সমস্বরে রুখে দাঁড়ায় যে-কোনো নিপীড়ক-শোষক-অত্যাচারীর বিরুদ্ধে (সূরাতুল্ হুজ্রাত ৯, মুস্লিম ২৫৭৭,
বুখারি ২৩১২)।
বৃহত্তর সমাজের কথা মাথায় রেখে, প্রত্যেককে ব্যক্তিজীবনে সৎ, সত্যবাদী,
আমানতদার, প্রতিশ্রুতি পূরণকারী, অতিথি পরায়ণ, ধৈর্যশীল, সহিষ্ণু, লজ্জাশীল,
ন্যায়পরায়ণ, বিনয়ী, দয়ালু ও দানশীল হওয়ার আদেশ দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তিজীবন, গৃহ ও
সমাজ-আচারের পাশাপাশি মানুষকে শেখানো হয়েছে পথচারিতার মত বহিরঙ্গানের আদব-কায়দাও। যেমন- পথে দৃষ্টি সংযত রাখা, পথিককে সাহায্য করা, ঠিক পথের দিশা দেওয়া, বিনয়
ও ভদ্রভাবে লোকেদের জিজ্ঞাস্যর উত্তর দেওয়া (মুস্লিম ২১২১)। রাস্তা পরিষ্কার (মুস্লিম ১৬৬৮) ও প্রশস্ত রাখা (মুস্লিম ১৯১৪)-র নিয়ম মেনে
স্বচ্ছ পথ ও সমাজ গঠন করা প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব ।
মানব সমাজের আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে বহু গৃহপালিত ও অহিংস প্রাণী। তাই ইসলামি
সাহিত্যে মানুষের পাশাপাশি অহিংস্র প্রাণীর প্রতিও যত্নশীল হতে বলা হয়েছে। এধরণের
প্রাণীকে হত্যা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ (প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইসলামে যাবাহ্ ও
ক্বাত্ল দুটি পৃথক জিনিস)। আর তাই, একটি বিড়ালকে বেঁধে রেখে মেরে ফেলার জন্য এক
গৃহিণী নরকের সাজা পায় (মুস্লিম ২২৪২)। অন্যদিকে, এক পাপাচারী মহিলা এক তৃষ্ণার্ত কুকুরকে জল পান
করিয়ে স্বর্গলাভ করে (বুখারি ৩২৮০)। হয়তো এজন্যই, নবি
(সা) প্রতিদিন ফজরের পর প্রথমে মুরগী-খামারের দরজা খুলে দিতেন। নিজ ঘোড়াটির ঘাড়ে
হাত বোলাতেন। এমনকি, বিড়ালের সাথে এক অনুগামীর সখ্যতা দেখে তাঁকে ‘আবু হুরায়রাহ্’
(বিড়ালের পিতা) বলে ডাকতে আরম্ভ করেন। অতএব একজন প্রকৃত মুসলিমের
সৌহার্দ্য-ক্যানভাসে ব্যক্তিজীবন, পরিবার, সমাজ ও পরিবেশ- সবার জন্য অতিযত্নে
বরাদ্দ থাকবে নির্দিষ্ট স্থান এবং সৌজন্য ও শিষ্টাচারের সেই ছবি প্রকট থেকে
প্রকটতর হতে থাকবে প্রতিনিয়ত। এটাই আমার প্রত্যাশা।
(দৈনিক পূবের কলম, ১২-১০-২০১৮-তে প্রকাশিত)