Thursday 21 December 2023

উসমান (রাঃ)-এর হত্যার কারণ ও ফলাফল


 
উস্মান (রাঃ)-এর হত্যার কারণ ও ফলাফল

ভূমিকা
৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে হযরত উস্‌মান (রা.) ইসলামের তৃতীয় খলিফা নির্বাচিত হন। খলিফা নির্বাচনের পরপরই নানা কলহ-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। ফলে মুসলিম বিশ্বে ঘটে মারাত্মক রক্তপাত।

হত্যার কারণ
() গণতান্ত্রিক শাসন
মদীনায় হযরত মুহাম্মদ (স) গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। খোলাফায়ে রাশেদীনের সময়েও তা পূর্ণভাবে চালু ছিল। যে গণতন্ত্র এই যুগেও অনেক ৰেত্রে এবং অনেক দেশে অচল হয়ে পড়েছে, তা যে মধ্যযুগে কিছুটা অসুবিধার সম্মুখীন হবে; তাতে আশ্চর্যের কি আছে? অবাধ মেলামেশা, বাক-স্বাধীনতা, সমালোচনার পূর্ণ অধিকার ইত্যাদির সাহায্যে বিদ্রোহীরা ওসমানের খিলাফতে নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য সাম্রাজ্যের সর্বত্র অশান্তির অগ্নি প্রজ্বলিত করে তোলে।

() হাশেমী ও উমাইয়া গোত্রের বিদ্বেষ
মহানবীর জন্মের পূর্ব হতেই কুরাইশ বংশের হাশেমী ও উমাইয়া গোত্রের মধ্যে কাবার পৌরোহিত্য এবং মক্কার শাসনব্যবস্থা নিয়ে দ্বন্দ্ব-বিদ্বেষের সূচনা হয়েছিল। মহানবীর আমলে মক্কা বিজয়ের সময়ে আবু সুফিয়ান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলে অন্যান্য উমাইয়াগণও তাঁকে অনুসরণ করে। হযরত ওমরের খিলাফত পর্যনত্ম মোটামুটিভাবে এই গোত্রদ্বয়ের মধ্যে সদ্ভাব বজায় ছিল। কিন্তু ওসমানের খিলাফতে এই গোষ্ঠীকলহ পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। উস্‌মান উমাইয়া বংশের লোক। উমাইয়া বংশের লোক খিলাফতে প্রতিষ্ঠিত থাকবে তা হাশেমীয়রা কিছুতেই যেন সহ্য করতে পারছিল না। বিশেষ করে আলী সমর্থক দলটি হযরত ওসমানের শাসনকালে প্রত্যেকটি গোলযোগের পিছনে ইন্ধন যোগাতে তৎপর ছিল। কুফা ও বসরার বিদ্রোহে এদের কিছুটা প্ররোচনা ছিল বলে অনেকে সন্দেহ করেন।

() কুরাইশ এবং অকুরাইশদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
ইসলামের বিজয় অভিযানসমূহে সাধারণ মুসলমানগণ কুরাইশদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রাণপণে যুদ্ধ করে। কিন্তু কুরাইশগণ কখনও এদের ত্যাগের কথা বিবেচনা করেনি। তারা বরাবরই সকল বিষয়ে কর্তৃত্ব করতে থাকে এবং সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করতে থাকে। তাছাড়াও যে সমসত্ম কুরাইশ মক্কা ছেড়ে সিরিয়ায় গিয়েছিল খলিফা উস্‌মান তাদেরকে ইরাকে মক্কার পরিবর্তে জমি প্রদান করেন। এরূপভাবে সাধারণ মুসলমানগণ খলিফাকে পৰপাতিত্বের দোষে অভিযুক্ত করে খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। কিন্তু এই সঙ্কটপূর্ণ সময়ে কুরাইশগণ খলিফাকে ঐক্যবদ্ধভাবে সমর্থন করেনি, বরং হাশেমী গোত্রের কার্যকলাপ বিদ্রোহীদেরকেই প্রকারানত্মরে সমর্থন যোগায়।

() কতিপয় স্বার্থান্ধ লোকের দুশমনী
সাম্রাজ্যে এমন একশ্রেণীর লোক ছিল, যারা ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য তারা মুসলমান হয়েছিল। সুবিধা লাভে ব্যাঘাত ঘটাবার জন্য তারা খলিফার বিরম্নদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। ইয়েমেনের জনৈকা নিগ্রো মাথার গর্ভজাত ইহুদি সনত্মান আবদুলস্নাহ ইবনে সাবা ছিলেন ঐরূপ স্বার্থপর একজন লোক। বসরার শাসনকর্তা আবদুলস্নাহ-বিন-আমিরের নিকট এসে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তাঁর মতে আলী জ্ঞাতিসূত্রে এবং বৈবাহিক সম্বন্ধে মহানবীর (স) একমাত্র যথার্থ উত্তরাধিকারী। ঐশী বিধানানুসারে খিলাফত তাঁর এবং তাঁর উত্তরাধিকারীগণের প্রাপ্য। এটাই ছিল তাঁর মতবাদ এবং তাঁর অনুচরদেরকে সাবাইত বলা হতো। ইবনে সাবা ওসমানের খিলাফতে তার এই মতবাদ প্রথমে কুফা ও পরে বসরায় প্রচার করতে থাকেন। ঐ দুই প্রদেশের গভর্ণরদ্বয় বিপদের আশঙ্কায় তাকে স্ব-স্ব প্রদেশ হতে বহিষ্কার করে দেন। এরপর তিনি মিশরে গিয়ে ওসমানকে খিলাফতে অন্যায়ভাবে অধিষ্ঠিত বলে এবং তাঁর নিযুক্ত সকল কর্মচারীকে অত্যাচারী বলে প্রচার করতে থাকেন। ফলে বহু স্বার্থান্বেষী, যারা ওসমানকে সহ্য করতে পারছিল না তারা তার দলে যোগদান করে ওসমানের ধ্বংসসাধনে তৎপর হন।
হাকিম-বিন-জাবালা এবং মুহাম্মদ-বিন-আবু বকরও ইবনে সাবার দলে যোগদান করে। ফলে কুফা, বসরা এবং মিশরে খলিফা-বিরোধী আন্দোলন অত্যনত্ম জোরদার হয়ে ওঠে।

() অমুসলমানদের অসন্তোষ
ইহুদি, ম্যাজিয়ান, খ্রিস্টান প্রভৃতি অমুসলমান তাদের পূর্ণ ধমর্ীয় স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার থাকা সত্ত্বেও ইসলামের বিরম্নদ্ধে সব সময় বিদ্বেষ পোষণ করত। হযরত ওসমানের আমলে কুরাইশদের লোভনীয় সুযোগ-সুবিধা এবং প্রাধান্য তাদেরকে ঈর্ষান্বিত করে তোলে। খলিফার সরলতার সুযোগে তারাও নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বিদ্রোহীদেরকে সর্বপ্রকার সাহায্য ও উস্কানি প্রদান করে।

() খলিফার উদারতা
খলিফা ওসমানের উদারতা এবং সরলতা তাঁর দুর্ভাগ্যের প্রধান কারণ ছিল। এরূপ সঙ্কটপূর্ণ মুহূর্তে খলিফা যদি ওমরের (রাঃ) মত বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিতে পারতেন তা হলে তিনি নিজেকে এবং খিলাফতকে অনায়াসে দুর্যোগের হাত হতে রৰা করতে পারতেন। মানুষকে তিনি অবিশ্বাস করতে পারেননি এবং প্রায় কঠিন অপরাধীকেও ৰমা করতেন। ফলে দুষ্কৃতকারীগণ অনায়াসে খলিফার বিরোধিতা করতে সাহস পায়। অন্যদিকে সঙ্কটময় মুহূর্তে নেতৃত্বদানের চারিত্রিক দৃঢ়তা অনত্মত বৃদ্ধ বয়সে ওসমানের ছিল না। আত্মীয়গোষ্ঠীর বাইরে তাঁর প্রকৃত বন্ধুও তেমন কেউ ছিল না। বার্ধক্যজনিত সঙ্কীর্ণতা ও অনমনীয়তার কারণে তিনি এমনসব লোকের মর্যাদা ৰুণ্ন করলেন যাঁদের ছত্রচ্ছায়ায় তিনি অনায়াসে বিপদকাল উত্তীর্ণ হতে পারতেন। বনি হাশিম ও প্রভাবশালী সাহাবাদেরকে তিনি তাঁর প্রশাসনে গুরম্নত্ব দিলেন না; তাঁরাও অসহযোগিতা করে বা বিপদের দিনে নীরব থেকে এর প্রতু্যত্তর দেন।

() কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও যুগের পরিবর্তন
অবস্থার পরিবর্তন ও কেন্দ্রীয় শাসনের বিরম্নদ্ধাচরণ বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। কেন্দ্রীয় শাসনে অনভ্যসত্ম আরববাসীকে দেশ জয়ে নিয়োজিত রেখে অভ্যনত্মরীণ শানত্মি রৰা করা যেত। কিন্তু ওসমানের খিলাফতের শেষার্ধে সীমানত্ম যুদ্ধ স্থগিত হয়ে যায়। এ সঙ্গে তাদের আয়ের প্রধানতম উৎসও (গণিমাত) বন্ধ হয়ে যায়। তাদের আয়ের অন্য উৎস (ফায় ভূমি) ওমরের সময়েই রাষ্ট্রায়ত্ত হয়ে গিয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে আরব যোদ্ধারা বিৰুব্ধ হয়ে ওঠে এবং ফায় ভূমির সমুদয় আয় দাবি করে বসে। প্রকৃতপৰে আরবদের এই দাবি ছিল ওমরের শাসন ব্যবস্থার বিরম্নদ্ধে এক মারাত্মক প্রতিবাদ। উস্‌মান পূর্ববতর্ী (ওমরের) রাজস্ব নীতির গুরম্নত্বপূর্ণ পরিবর্তন করেছিলেন, কিনত্মু আরব-যোদ্ধাদের এই দাবি মেনে নিতে পারলেন না; পরিণামে বিৰোভ বিদ্রোহের রূপ ধারণ করে। বার্নাড লুইস যথার্থই বলেছেন, “এই বিদ্রোহ ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের বিরম্নদ্ধে যাযাবরদের বিদ্রোহ। এটা শুধু ওসমানের দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রের বিরম্নদ্ধে নয়_ যে কোন ব্যক্তির পরিচালিত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ

() আর্থ-সামাজিক কারণ
উল্লেখ্য যে, তাঁর পূর্ববর্তী খলিফা প্রথম ওমরের শাসনামলে মরম্নবাসী যাযাবরগণ পারস্য, সিরিয়া, জেরম্নজালেম ও মিশর বিজয়কালে কুরাইশদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু এই বিজয়ের আর্থ-সামাজিক সুযোগ-সুবিধা ভোগের অধিকার হতে তারা বঞ্চিত হলো। আল সাওয়াদ (উর্বর-অর্ধচন্দ্র অঞ্চল) এবং অন্যান্য উর্বর অঞ্চলে কুরাইশ বংশোদ্ভূত ব্যক্তিবর্গকে উপভোগের অধিক সুযোগ প্রদান করা হয়। তদুপরি সমাজেও যাযাবরদের কুরাইশদের ন্যায় পদমর্যাদা ও অধিকার স্বীকৃত হয়নি। এই আর্থ-সামাজিক অসাম্যের কারণে এই বঞ্চিত যাযাবর শ্রেণী বিদ্রোহীদের সাথে হাত মিলিয়ে ওসমানের ধ্বংস সাধনে তৎপর হয়ে ওঠে।

() মারওয়ানের ধ্বংসাত্মক নীতি
খলিফা ওসমানের খিলাফতে তাঁর জামাতা ও চাচাত ভাই মারওয়ান ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা। এই মারওয়ানের পূর্ব পরিচয় প্রশংসনীয় ছিল না, বিশ্বাসভঙ্গের দায়ে একবার মহানবী তাঁকে মদীনা হতে বহিষ্কার করেছিলেন। স্বার্থপর ও কূটনীতিবিদ মারওয়ান খলিফার দুর্বলতার সুযোগে রাষ্ট্রের সমসত্ম ৰমতা করায়ত্ত করেন। তাঁর জন্য উমইয়াগণ রাষ্ট্রের সকল উচ্চ রাজপথে নিযুক্ত হন এবং রাষ্ট্রের সম্পত্তি আত্মসাত করেন। হাশেমিগণকে ধনে-মানে দুর্বল করে উমাইয়াগণকে সুপ্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তার একমাত্র উদ্দেশ্য। মারওয়ানের কুচক্রানত্ম ও স্বার্থপর নীতি খিলাফতের বিরম্নদ্ধে বিদ্রোহের মূলে ছিল এবং খলিফার পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল।

হত্যার ঘটনা
উপরুল্লেখিত অভিযোগ ও কারণসমূহের পরিপ্রেক্ষিতে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশ হতে বিশেষ করে কুফা, বসরা ও মিশর হতে প্রায় ৭০০ বিদ্রোহী মদীনায় উপস্থিত হয়। তারা খলিফার নিযুক্ত প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের স্বার্থপরতা ও দুর্নীতিপরায়ণতার বিরম্নদ্ধে খলিফার নিকট অভিযোগ ও প্রতিবাদ করে। খলিফা তাদের অভিযোগ শ্রবণ করে প্রতিকারের ওয়াদা প্রদান করেন। কিন্তু কুচক্রী মারওয়ানের প্রতারণার ফলে পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। গনত্মব্যস্থলে পৌঁছা মাত্র যেন অভিযোগকারীদেরকে হত্যা করা হয়_এরূপ আদেশসম্বলিত, মারওয়ান কর্তৃক লিখিত এবং খলিফার সীলযুক্ত একখানা পত্র বিদ্রোহীরা এক অশ্বারোহী দূতের নিকট হতে উদ্ধার করে। এতে তারা ক্রোধে জ্বলে ওঠে এবং তৎৰণাৎ মদীনায় প্রত্যাবর্তন করে খলিফার নিকট ঐ পত্রের কৈফিয়ত দাবি করল। খলিফা শপথ করে বলেন যে, তিনি তার বিন্দুবিসর্গও অবগত নন। বিদ্রোহীরা এবার পরিষ্কার বুঝতে পারল যে, তা মারওয়ানের কারসাজি। তারা মারওয়ানকে তাদের হসত্মে সমর্পণের দাবি করলে খলিফা তা প্রত্যাখ্যান করেন। ফলে বিদ্রোহীরা খলিফার বাসগৃহ অবরোধ করল। তারা ওসমানকে অযোগ্য খলিফা বলে পদত্যাগ করার দাবি করে। হজ মৌসুমের জন্য অনেক মদীনাবাসী মক্কায় চলে গিয়েছিল। আলী, তালহা, যুবায়ের এবং নবী (সাঃ)-এর স্ত্রী উম্মে হাবিবা বিদ্রোহীদেরকে শানত্ম করতে বৃথা চেষ্টা করেন। আলী, তালহা এবং যুবায়েরের পুত্রগণ দ্বারা গঠিত ১৮ জন দ্বাররৰী বাহিনী মারমুখী বিদ্রোহীদেরকে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়। তারা গৃহে প্রবেশ করে মুহাম্মদ-বিন-আবু বকরের নির্দেশক্রমে কুরআন পাঠরত ৮২ বছরের বৃদ্ধ খলিফা ওসমানকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ নৃশংসা ঘটনা ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই জুন (১৮ই জিলহজ্ব, ৩৫ হিজরী) সংঘটিত হয়। খলিফার স্ত্রী নাইলা খলিফাকে রৰা করতে গিয়ে তাঁর হাতের অঙ্গুলি হারালেন। ঐতিহাসিক হিট্টি বলেন, ‘এরূপে তিনিই প্রথম খলিফা মুসলমানদের হাতে যাঁর রক্তপাত ঘটান হলো।

হত্যার ফলাফল
উস্মান (রাঃ)-এর হত্যার ফলাফল ছিল অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী। এটা ইতিহাসের গতিকে গভীরভাবে প্রভাবান্বিত করেছে। জার্মান ঐতিহাসিক ওয়েলহাউসেন বলেন, “ওসমানের হত্যা ইসলামের ইতিহাসের যে কোন ঘটনা অপেৰা অধিকতর যুগানত্মকারী।

১। ঐতিহাসিক জোসেফ হেল বলেন, “উস্‌মান হত্যা ছিল গৃহযুদ্ধের বিপদসংকেত স্বরূপ। এর ফলে মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি নষ্ট হয়। মুসলিম জাহান বনু হাশিম ও বনু উমাইয়া এই দুই গোত্রে বিভক্ত হয়ে আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়ে। উস্ট্রের ও সিফফিনের যুদ্ধ এবং কারবালার মর্মানত্মিক কাহিনী উস্‌মান হত্যারই পরিণতি। উমাইয়া বংশের প্রতিষ্ঠা এবং পতনের পরও এই দ্বন্দের শেষ হয়নি। ওয়েলহাউসেন যথার্থই বলেন_ “গৃহযুদ্ধের ফটক খুলিয়া যায়, যা আর কখনও বন্ধ হয়নি।এজন্য ওসমানকে উন্মুক্ত ফটকবলা হয়। এ দুষ্টৰত যেন এ কালেও মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে রাখতে সৰম হয়েছে।

২। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরবর্তী কালে বিভিন্ন মতাবলম্বী রাজনৈতিক দল এবং ধর্মীয় সম্প্রদায়েরও উদ্ভব হয়েছিল। ঐতিহাসিক ওয়েলহাউসেন এবং নিকলসনের মতে, শিয়া সম্প্রদায় ঐশী অধিকার নীতি ইবনে সাবার নিকট হতে প্রাপ্ত হয়েছে। সুন্নী, খারিজী প্রভৃতি দলগুলোরও উৎপত্তির সূচনা এই ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সম্পন্ন হয়েছিল। এরূপে শতধাবিভক্ত মুসলিম জাহানে অশানত্মির কালমেঘ নেমে আসে।

৩। উস্মান (রাঃ)-এর হত্যাতে খিলাফত ও খলিফার প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও অনুরাগ শিথিল হয়ে পড়ে। এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক বার্নাড লুইস বলেন, “বিদ্রোহী মুসলমানগণ কর্তৃক একজন খলিফার প্রাণহানি দ্বারা যে বেদনাবিধুর দৃষ্টানত্মের সৃষ্টি হলো, তা ইসলামের ঐক্যের প্রতীক খিলাফতের ধর্মীয় ও নৈতিক মর্যাদাকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করেছে।এখন হতে জোর যার খিলাফত তারএই নীতিই হলো খিলাফত লাভের প্রকৃষ্ট পথ।

৪। উস্মান (রাঃ)-এর হত্যার ফলে গণতন্ত্রের সমাধির পথ প্রশসত্ম হলো। মুয়াবিয়া উমাইয়া বংশ প্রতিষ্ঠা করে রাজতন্ত্রের প্রবর্তন করেন। মদীনা-তুন-নবী শহরেরও প্রাধান্য উত্তরোত্তর লোপ পেতে থাকে। পরবর্তীকালে কুফা, দামাস্কাস, বাগদাদ মুসলিম জাহানের রাজধানীতে পরিণত হয়ে অধিক প্রাধান্য লাভ করে।
-আব্দুল মাতিন ওয়াসিম 


Wednesday 13 December 2023

উসমান (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণ ও তাঁর হত্যা

 

উসমান (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহের কারণ ও তাঁর হত্যা
 
হযরত ওসমান (রাঃ) ছিলেন ইসলামের তৃতীয় খলিফা। তিনি খিলাফতের প্রথম ছয় বৎসর সু-খ্যাতির সঙ্গে কাটালে পরবর্তী ছয় বৎসর কুরাইশদের মধ্যে পারস্পরিক ঈর্ষা-কলহ, বিশেষভাবে বানু-হাশিম ও বানু-উমাইয়াদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মনোভাব খলিফা ওসমানের ক্ষমতাকে দূর্বল করে দিয়েছিল। বানু-হাশিম ও বানু-উমাইয়াদের মধ্যে গোত্র-কলহ প্রকট হয়ে উঠেছিল। দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলি উমাইয়াদের অধিকারে চলে যায়। ফলে হাশিমীয় গোত্র এর বিরুদ্ধচারন করে ওসমান (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং নানা ভাবে খলিফাকে বিভ্রান্তি করে হত্যা করার জন্য উদ্যত হয়।
 
হযরত ওসমানের উপর বিদ্রোহের কারণঃ
হযরত ওসমানের উপর বিদ্রোহের প্রধান কারণগুলি নিম্নে আলোচনা করা হলো
 
১/ কুরাইশ ও অকুরাইশদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাঃ
হযরত ওসমান (রাঃ) কুরাইশদেরকে হযরত ওসমান (রাঃ) এর আমলে কুরাইশ ও অকুরাইশ জনগণের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গুরুতর রূপ ধারন করেছিল। এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা বসরা, কুফা ও ফুস্তাতে চরম আকার ধারন করে। এ স্থানগুলি ছিল ওসমান (রাঃ) এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের কেন্দ্রস্থল। কুরাইশগণ সকলে ওসমান (রাঃ)-এর সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ্য হলে খলিফার কতৃত্ত্বে হস্তক্ষেপকারী আরব দলগুলিকে দমন করা সম্ভব হতো কিন্তু হাশেম বংশীয়গণ উমাইয়া বংশের ক্ষমতা-বরদাস্ত করতে না পেরে দুশমনদের পক্ষ সমর্থন করেছিল। প্রথম দুই খলিফার আমলে আনসার ও মোহাজেরদের  সমন্বয়ে যে একটি দক্ষ শাসক গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল, ওসমান (রাঃ) এর আমলেও তাও বিশেষ কার্যকর হতে পারেনি।
 
২/ অনারব মুসলমানদের অসন্তোষঃ
ওসমান (রাঃ)-এর শাসনামলে কুরাইশদের লোভনীয় সুযোগ-সুবিধা ও প্রতিপত্তি অনারব মুসলমান সম্প্রদায়সমূহ ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে। ওসমান (রাঃ)-এর আমলে ইসলামী সাম্রাজ্যের ভিত্তিতে আরবীয় মুসলমানদের সমকক্ষতা দাবি করে, তারা আরবীয় মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্ব গ্রহণ করতে অসমর্থিত জানায় ও হযরত ওসমান (রাঃ)-এর দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে  বিদ্রোহে উসকানি দিতে থাকে।
 
৩/ আরবদের কেন্দ্রবিমুখতাঃ
কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা আরবদের একটি পরিচিত ঘটনা। পরবর্তী খলিফাদের আমলের কঠোর শাসনের এ কেন্দ্রবিমুখতা মাথাচাড়া দিতে সাহসী হয়নি। কিন্তু হযরত ওসমান (রাঃ)-এর দূর্বল শাসনামলে এটি প্রবল শক্তি সঞ্চয় করেছিল। বার্নাড লুইয়ের মতেঃ- তাঁর (ওসমান) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কোনো ধর্মীয় বা ব্যক্তিগত কারণে হয়নি। এ বিদ্রোহ ছিল কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে যাযাবরদের বিদ্রোহ
 
৪/ কাবাঘর সম্প্রসারণ ও কুরআন ভস্মীভূতঃ
হযরত ওসমান (রাঃ) কাবা ঘরের অসমাপ্ত কাজ করার জন্য অগ্রসর হন এবং ভগ্ন বাড়ির মালিকেরা ক্ষতিপূরণ নিতে অস্বীকার করায় তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করেন, এতে জনসাধারণ ক্ষিপ্ত হয়, অন্যদিকে বিভিন্ন দেশ কুরআনের বিভিন্ন প্রকার ভূল পাঠের কথা শুনে ত্রুটিযুক্ত কুরআন পুড়িয়ে ফেলেন। এতে জনগণ তাঁর প্রতি ক্ষেপে যায়।
 
৫/ মারওয়ানের ধ্বংসাত্মক নীতিঃ
স্বার্থপর কূটনীতিবিদ মারওয়ান ওসমান (রাঃ)-এর দূর্বলতার সুযোগে রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা করায়ত্ব করেন। মারওয়ান চক্রান্ত ও ধ্বংসাত্মক নীতি ওসমান (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও তাঁর হত্যার জন্য অনেকাংশ দায়ী ছিল।
 
৬/ আব্দুল্লাহ ইবনে সাবাহার অপপ্রচারঃ
ঈয়েমেনী ইহুদী ভণ্ড মুসলমান আব্দুল্লাহ ইবনে সাবাহ ব্যাক্তিস্বার্থে অপপ্রচার করেন যে, হযরত আলী (রাঃ) জাতিসূত্রে এবং বৈবাহিক সম্পর্কে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর একমাত্র প্রকৃত উত্তরাধিকারী। এ অপপ্রচার ওসমান (রাঃ)-এর হত্যা ত্বরান্বিত করে।
 
 ওসমান (রাঃ)-র হত্যার ঘটনা/রহস্যঃ
হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যার পিছনে যে সমস্ত কারণ ছিল তা নিম্নে তুলে ধরা হলো
 
১/ বিদ্রোহীদের দাবিঃ
দুস্কৃতকারীদের ব্যাপক প্রচার কার্যের ফলে দেশের সর্বত্রই ওসমান (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা যায়। জোরালো প্রচার কার্যের ফলে মহানবী (সাঃ)-এর অনেক সাহাবা ঘটনার সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে মনে করেন যে, প্রাদেশীক শাসন কর্তাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সত্য। তারা এর প্রতিকারের উদ্দেশ্যে খলিফার কাছে আবেদন জানায় খলিফা প্রতিত্তুরে জানায়, প্রাপ্ত রিপোর্ট অনুযায়ী প্রাদেশীক শাসনকর্তারা ঠিকই কার্য করেছেন।
 
২/ খলিফা কতৃক বিদ্রোহীদের মনোনীত ব্যক্তিকে নিয়োগঃ
হজ্ব যাত্রার ছলে বসরা, কুফা ও মিশরের দুস্কৃতীরা মদিনায় এসে তাঁবু ঘাটায়। মদিনা বাসীদের সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়ে বিদ্রোহী নেতারা মিশরের শাসনকর্তাকে সরিয়ে তদস্থলে মুহাম্মদ বিন আবু বকর-কে নিয়োগ করার জন্য খলিফা অনুরোধ জানায়। এই অনুরোধ খলিফা অত্যন্ত ভদ্রতার সাথে মেনে নেন এবং তাদের হাতে মনোনীত লোকের নিয়োগ পত্র তুলে দেন।
 
৩/ বিদ্রোহীদের মদিনায় উপস্থিতিঃ
কয়েকদিন পরে দুস্কৃতকারীদের তিনটি দলই একই দিনে এবং সময়ে মদিনাবাসীদের বিস্মীত করে মদিনায় উপস্থিত হয়। হযরত আলী (রঃ) তাদের এ আগমন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তারা মিশরের শাসন কর্তার  কাছে খলিফার লিখিত একটি মোহরযুক্ত চিঠি দেখায়।
 
৪/ খলিফার পদত্যাগ দাবিঃ
হযরত আলী (রাঃ) দুস্কৃতকারী দলের নেতাদেরকে খলিফার নিকট নিয়ে গেলেন ওসমান (রাঃ) শপথ করে বললেন যে, তিনি এ পত্র লেখেননি অথবা এটা সম্পর্কে কিছু জানেন না। ষড়যন্ত্রকারীরা কোনো কিছু শুনতে রাজী হলনা। তারা খলিফার পদত্যাগ দাবি করল। খলিফা এর  উত্তরে বলল, আমি পদত্যাগ করবোনা।
 
৫/ খলিফার বাসগৃহ অবরোধঃ
একদিন মসজিদে খলিফা ওসমান (রাঃ) বক্তৃতা দিতে যাচ্ছিলেন এমন সময় তাঁকে বক্তৃতা দিতে দেওয়া হয়না। তাঁকে লাঞ্ছিত করে পাথরের উপর পাথর মারতে থাকে, খলিফা বেহুশ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে তাঁকে গৃহে নিয়ে গিয়ে অবরোধ করে রাখেন।
 
৬/ খলিফাকে হত্যাঃ
বিদ্রোহী আর অপেক্ষা করা সমীচীন মনে করলোনা। তারা খলিফাকে হত্যা করার জন্য তৎপর হয়ে উঠে। সম্মুখের দরজার দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে না পেরে প্রতিবেশীর গৃহের দেয়াল টপকিয়ে গৃহে প্রবেশ করে, ওসমান (রাঃ) তখন কুরআন পাঠ করছিলেন, এ অবস্থায় দুজন ব্যক্তি তাঁর উপর চড়াও হয় এবং হত্যা করে, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর ,সালটি ছিল,৬৫৬ খৃষ্টাব্দের ১৭ জুন।
 
উপসংহারঃ
খলিফার সরলা, সহিষ্ণুতা ও নিরীহ প্রকৃতিকে চক্রান্তকারীরা তাঁর দূর্বলতা ও অক্ষমতা মনে করে সমগ্র কুফা, বসরা ও মিশরের ষড়যন্ত্রের একটি দূর্গে জাল বিস্তার এবং বিদ্রোহ দেখা যায়, খলিফা যদি প্রথম থেকে দৃঢ়ভাবে এসব বিদ্রোহের মূলোৎপাটন করতো তাহলে কখনই একটি ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়ে ইসলামের সংহতি ধ্বংস করতে পারতনা, এবং খলিফাকে হত্যার একটি ঘৃণ্য নজিরও সৃষ্টি হতো না।
-আব্দুল মাতিন ওয়াসিম 

Friday 8 December 2023

আবু বাকর (রাঃ)-এর গুণাবলী ও ইসলামের সংকটের মুহুর্তে তাঁর অবদান


 
আবু বাক্‌র (রাঃ)-এর গুণাবলী ও ইসলামের সংকটের মুহুর্তে তাঁর অবদান
 
নিসন্দেহে বড় বড় নবীরসূলদের জন্য কিছু হাওয়ারী বা সতীর্থ ছিল যারা নবীদের দীক্ষাকে অনুকরণ করে নিজেরাও হয়েছিলেন অনুকরনীয়। এমনকি ঈমান ও ইসলামের সঠিক মাপকাঠি হলেন সাহাবাগন। কারণ ইসলাম প্রবর্তন ও পালনের প্রথম ধাপ শুরু হয় এই মহান গোষ্ঠীর অনুকরনের মাধ্যমে।
 
সাহাবাদের মধ্যে সব চেয়ে বেশী মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তি হলেন আবু বাক্‌র (রাঃ) বলা বাহুল্য আল্‌-কুর্‌আনে আবু বাক্‌র (রাঃ)-কে রাসূল (সাঃ)-এর “সাহেব” বা সাথী বলে অভিহিত করা হয়েছে। মাক্বী ও মাদানী জীবনে রাসূল (সাঃ)-এর শ্রদ্ধাভাজন বন্ধু ও ইসলামের পরম খেদমতকারী ছিলেন আবু বাক্‌র (রাঃ)। নবীজির প্রিয়তমা স্ত্রী মা আয়েশা (রাঃ)-এর পিতা। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অমায়িক, সাবলীল, দৃঢ়, মিতব্যয়ি, দানশীল ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তিকুরাইশদের সর্দার ও প্রথম সারির নেতাও বটে। কেবল ইসলাম গ্রহনের খাতিরে তাকে অন্য কাফের শ্রেনীরা অবাঞ্চিত করেছিলমুহাম্মদ (সাঃ)-এর ওফাতের পর যে চারজন খলিফা ইসলামের পতাকা অতি উচ্চে তুলে ধরেছিলেন তাদের মধ্যে আবু বাক্‌র (রাঃ) ছিলেন অন্যতম। তিনি নবী (সাঃ)-এর বাল্যবন্ধু ও খেলার সাথী ছিলেন।
 
মুহাম্মদ (সাঃ) যখন ইসলামের দাওয়াত প্রচার শুরু করলেন তখই আবু বাক্‌র (রাঃ) রা ইলাম ধর্ম গ্রহন করেন। আবু বাক্‌র (রাঃ) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ইসলামের সেবায় নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেন। আবু বাক্‌র (রাঃ) ইসলামের ইতাহাসে একজন ক্ষণজন্মা হিসেবে স্মরনীয় হয়ে থাকবেন। রাসূল (সাঃ)-এর ওফাতের পর আবু বাক্‌র (রাঃ)  খোলাফায়ে রাশেদীনের প্রথম খলীফা হিসেবে ইসলামের এক সংকটময় মুহূর্তে ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
   
একদিকে নব্যুয়তের প্রতি ইর্ষান্বিত বেদুইণদের হিংষা, অমুসলিমদের চক্রান্ত, ভন্ড নবীদের প্রাদুর্ভাব, অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও ধর্মদ্রোহী কার্যকলাপ, ভণ্ড নবীদের আবির্ভার ও বহিঃশত্রুর আক্রমন, ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের ষড়যন্ত্র ইত্যাদি ইসলাম ধর্ম এবং নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়।
   
অপরদিকে সদ্য গ্রহন করা মুসলিম সমাজ মনোবৃত্তির পাছে পড়ে ইসলামকে বিকৃত ও কাটছাট করার লিপ্সায় লিপ্ত হয়ে জাকাত-ওশর সদকা ইত্যাদিকে অস্বীকার করে বসে। মোটকথা ভিতর ও বাহির থেকে ইসলামের এক চরমযূগসন্ধিক্ষনে আবু বাক্‌র (রাঃ)-এর খেলাফাতকাল আরম্ভ হয়। রাসূল (সাঃ)-এর ওফাতে উৎসাহ পায় চক্রান্তকারী বিধর্মীরা রোম-পারস্য ও বেদুঈন সর্দারদের অশুভ চক্রান্তের মোকাবিলা করতে হয় আবু বাক্‌র (রাঃ)-কে। আর তিনি ত্রাণকর্তারূপে সকল বিরূপ পরিস্হিতির মোকাবিল করেন এবং ইসলাম ও মুসলিম জাতিকে মহান আল্লাহর রহমতে অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন।
 
মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ওফাতের পূর্বে আবু বাক্‌র (রাঃ)-এর অবদান
মুহাম্মদ (সাঃ) ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে আল্লাহর নিকট থেকে ঐশীবাণী লাভ করে উদাত্ত কণ্ঠে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্হাপনের জন্য আহ্বান জানালে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সর্বপ্রথম আবু বাক্‌র রা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি শুধু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেই ক্ষন্ত থাকেনি বরং নবী করীম (সাঃ)  এর সাথে ইসলাম প্রচারেও আত্মনিয়োগ করেন। তার প্রচেষ্টায় ওসমান, যুবাইর, আবদুর রহমান ইবনে আউফ, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) প্রমুখ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি নবী (সাঃ)-এর মিরাজের ঘটনাকে সর্বাগ্রে এবং নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে ছিলেন। আর তাই তাকে রাসূল (সাঃ) “সিদ্দিক” উপাধিতে ভূষিত করেন।
  
আবু বাক্‌র (রাঃ) কুরাইশদের মধ্যে অন্যতম সম্পদশালী ব্যাক্তি ছিলেন। যিনি তার সমুদয় সম্পদ ইসলামের সেবায় উংৎসর্গ করে আতীক উপাধি লাভ করেছিলেন। ধন-সম্পত্তি ইসলামের সেবায় উৎসর্গ করে আবু বাক্‌র (রাঃ)  তৃপ্তিবোধ করতেন। এ প্রসজ্ঞে নবী (সাঃ) বলেছেন, আবু বাক্‌রের ধন-সম্পত্তি অপেক্ষা অন্য কারো সম্পদ অধিক উপকারে আসেনি । আবু বাক্‌র (রাঃ)-এর সম্পদ সাধারণত যুদ্ধের ব্যবস্থাপনায় ও দাসমুক্তির কাজে ব্যবহৃত হয়েছে  
   
আবু বাক্‌র (রাঃ) প্রকাশ্যভাবে ইসলাম প্রচারের জন্য কুরাইশদের দ্বারা অসংখ্যবার নির্যাতিত হয়েছেন। তবুও তিনি কখনো নবী করীম (সাঃ)  এর সাহচর্য ত্যাগ করেন নি । বরং শত অত্যাচার র্নিযাতন সহ্য করে মহানবী (সাঃ)-এর পাশে থেকে তাকে ইসলাম প্রচারে সাহস ও উৎসাহ জুগিয়েছেন।
   
৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায় হিজরতের সময় আবু বাক্‌র (রাঃ) নবী (সাঃ)-এর সঙ্গী হিসেবে গমন করেন এবং সাওর পাহাড়ের গুহায় উভয়ে একত্রে আত্নগোপন করেন। নবী (সাঃ)-কে রক্ষা করতে তাঁর সাপের গুহা নিজ হাতে আটকে দেওয়ার কথা আমাদের সবার জানা
 
নবী (সাঃ)-এর ওফাতের পর আবু বাক্‌র (রাঃ)-এর অবদান
নবী (সাঃ)-এর মৃত্যু সাহাবাদের জীবনে চরম অনাকাংঙ্খিত একটি ঘটনা, এ ঘটনার শোক ও আকাষ্মকিয়তায় সাহাবাদের মধ্যে চরম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। অপরদিকে মুনাফিক্ব এবং অমুসলিম সমাজে নুতন ষড়যন্ত্রের পায়তারা দানা বেধে উঠেছিল। তেমনি ভাবে খিলাফতেকে কেন্দ্র করে চরম রাজনৈতিক অচলাবস্হার সৃষ্টি হয় । এ অচলাবস্হার ফলে নকল প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলাম ধর্ম চরম হুমকূর সম্মুখীন হয়। এ অবস্হায় আবু বাক্‌র (রাঃ) তার অসাধারণ মেধা ও মননকে কাজে লাগিয়ে অন্যান্য বিশিষ্ট সাহাবীদের সংঙ্গে নিয়ে অচঅবস্হার শান্তিপূর্ণ সমাধান করেন। সকলের সম্মতিতে তিনি খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করে ইসলাম ধর্মও ইসলামী রাষ্ট্রকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেন।
 
মুহাম্মদ (সাঃ) এর মৃত্যু পরবর্তিতে নব্য মুসলিম আরব বাসীদের মধ্যে ধর্মত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়। ঐতিহাসিকরা বলেন, সমগ্র উপদ্বীপের লোক স্বধর্মে ফিরে যাওয়া ছিল নব প্রতিষ্ঠিত মদিনা ইসলামী প্রজাতন্ত্র এবং ইসলাম ধর্মের প্রতি একটি বিরাট হুমকি। আবু বাক্‌র (রাঃ) কঠোর এ ব্যাপারে কঠোর নীতি অবলম্বন করে স্বধর্মত্যাগীদের আন্দোলন দমন করেন এবং তাদেরকে ইসলাম ধর্মে ফিরিয়ে আনেন।
 
আবু বাক্‌র (রাঃ) বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলায় ব্যস্ত থাকার সুযোগে একদল লোক যাকাত প্রদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেএমনকি তারা যাকাত বিরোধীতা আন্দোলন শুরু করলে কোনো কোনো প্রভাবশালী লোক যাকাত প্রথা উচ্ছেদের সুপারিশ করেন। কিন্তু দূরদর্শী আবু বাক্‌র (রাঃ) শরীয়তের সিদ্ধান্তে অটল থেকে আন্দোরনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্হা গ্রহণ করেন। ফলে তারা যাকাত প্রদানে বাধ্য হয়।
   
গোত্র সর্দার প্রভাবশীল ভণ্ড নবী মুসায়লামাকে দমন করতে গিয়ে রক্তক্ষয়ী ইয়ামামার যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করলেও ৬০০ মুজাহিদ শহীদ হন। ওদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন কুরআনের হাফিজ। ফলে ভবিষ্যতে কুরআন সংরক্ষন হুমকির সম্মুখীন হয়এমতাবস্হায় আবু বাক্‌র (রাঃ) উমার (রাঃ)-এর পরামর্শে জায়েদ বিন সাবিত (রাঃ)-কে কুরআনের বাণীগুলো সংগ্রহ করে পুস্তকাকারে লিপিবদ্ধ করার র্নিদেশ দেন। আর এই সংকলতি কুর্‌আনকে মুস্‌হাফুল্‌ আক্‌বার বা আল্‌-জামে’-ও বলা হয়। ইতিপূর্বে লিখিত কুর্‌আনের সকল আয়াতকে তিনি যোগ্য সাহাবাদের জামা‘আতের মাধ্যমে একত্রিত ও সংকলিত করেন।
   
মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ওফাতের পর ভণ্ড নবীরা মদিনাভিমুখে অগ্রসর হওয়ার প্রয়াস পেলে আবু বাক্‌র (রাঃ) ওদের দমনের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন। তিনি তাদেরকে আত্মসর্মপণ করার কঠোর নির্দেশ দান করেন। অন্যথায় যুদ্ধ অনিবার্য বলে ঘোষণা করেন। এ সময় তিনি নিজে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অপরদিকে ওসমানকে ভন্ডনবী আসওয়াদকে দমনের জন্য সিরিয়া অভিযানের র্নিদেশ দান করেন। আসওয়াদ ছিল আনাস জাতির নেতা সে তার অনুচরদের নিয়ে দক্ষিণ আরবের ইয়েমন নগরে বাস করতো গ্রামের সরদারদের প্রভাবান্বিত করে আসওয়াদ এক বিরাট সৈন্যদল গঠন করে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। কিন্তু শেষ র্পযন্ত ওসমানের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে তার মৃত্যু হয়।
   
আসওয়াদের মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং মুসলমানদের রাজধানী মদিনা অবরুদ্ধ করার প্রয়াস পায়। আবু বাক্‌র (রাঃ) তাই মদিনা নগরীকে সুরক্ষিত করেন এবং সৈন্যবাহিনীকে ১১টি ভাগে বিভক্ত করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভণ্ড নবী ও ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে তাদের প্রেরণ করে। সেনাপতি খালিদ ৩৫০০ সৈন্য নিয়ে ভণ্ড নবী তোলায়হার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তোলায়হা বনু তাইম বংশের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু তায়িম বংশের নেতা আদি বিন হাতিম হযরত খালীদের পরার্মশে স্বীয় সম্প্রদায়কে তোলায়হার বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য বলেন। এভাবে খালিদ তোলায়হাকে র্দুবল করে ফেলেন এবং সহজেই পরাজিত করেন। তেলায়হা প্রথমত সাইবেরিয়াতে পলায়ন করে অবশেষে পুনরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
 
আবু বাক্‌র (রাঃ)-কে ইসলামের ত্রাণকর্তা বলার কারণ
আবু বাক্‌র (রাঃ)-এর আড়াই বছর খিলাফতকাল ইসলামের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মহানবী (সাঃ)-এর সহচর হিসেবে এবং নবী (সাঃ)-এর ওফাতের পর প্রথম খলিফা হিসেবে আবু বাক্‌র (রাঃ)-এর অবদান ছিল অপরিসীম। অরাজকতা, প্রতারণা, ভন্ডামি, ধর্ম ও দেশ দ্রেহীদের তিনি যোগ্যতার সাথে মোকাবিলা করে। তিনি নবী (সাঃ)-এর সাথে বদর, ওহুদ, খন্দক, তাবুক ও অন্যান্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং যুদ্ধের ব্যয়ভারের বড় একটা অংশ বহন করেন।
   
আবু বাক্‌র (রাঃ)-এর খেলাফত কালে মদিনা নগরীতে নবী (সাঃ)-এর বাণী শিক্ষা দেওয়ার জন্য সর্ব প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। আবু বাক্‌র (রাঃ) অনেক ক্রীতদাসকে নিজের অর্থ দিয়ে ক্রয় করে মুক্ত করে দেন। আবু বাক্‌র (রাঃ) ভণ্ড নবীদের পরজিত করে সমগ্র আরব উপদ্বীপে শন্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন।
   
স্বাধীনচেতা আরব জাতি ইসলামের কঠোর বিধি নিষেধ, কঠোর নৈতিক অনুশাসন ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপন সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ইন্তেকালের পর তারা উপর্যুক্ত বিধানসমূহের বিরুদ্ধে দলবদ্ধ বিদ্রোহ করে র্পূবর্বতী জীবন ধারায় ফিরে যায়খলিফা আবু বাক্‌র (রাঃ) তাদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্হা গ্রহণ করে তাদেরকে ইসলামী জীবনধারায় ফিরিয়ে আনেন।
    
খলিফা হিসেবে আবু বাক্‌র (রাঃ)-এর অবদান সত্যিই অনবদ্য। অভ্যন্তরীণ বিশৃংঙ্খলা দূর, জাতীয় সংহতি অর্জন এবং ইসলামের প্রভাবসম্প্রসারণের পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করে তিনি পরবর্তী অগ্রগতির পথ সুগম করেন। ইসলামি জীবন ব্যবস্থা ও ইসলামি রাষ্ট্রের একনিষ্ঠ সেবা এবং বহুবিধ কৃতিত্বের জন্য তাকে ইলামের ত্রাণকর্তা বলা যায়। অধ্যাপক মূর-এর ভাষায়— “ইসলামের জন্মলগ্নে আবু বাক্‌র (রাঃ) বেদুঈন এবং মুর্‌তাদদের আক্রমণ থেকে ইসলামকে রক্ষা করেছেন”

- আব্দুল মাতিন ওয়াসিম