ওদের বিবাহ বার্ষিকী
আব্দুল
মাতিন ওয়াসিম
ঘুম থেকে উঠেই গতর
মোচড়াতে মোচড়াতে রফিক পূব-দেয়ালের দিকে তাকাল। দেয়ালের বুকে ঈষৎ ঝুলে থাকা
কাঁচবিহীন ঘড়িটায় তখন সকাল ছ’টা। রাহানুমা অনেক
আগেই বিছানা ছেড়ে রান্না ঘরে গেছে। আলোকচুলোয় সেমটা ঘুসি দিয়ে কোন রকমে আগুনটা জ্বেলেছে। রফিক
যাতে দুটো ডাল ভাত খেয়েই কাজে বেরোতে পারে।
সকাল বেলা কলতলায় একটু
বেশি ভিড় হয়; তাই রফিক লুঙ্গিটা হাতে নিয়ে নীমের দাঁতনটা চিবোতে চিবোতে পুন্যাদীঘির
দিকে হাঁটতে লাগলো। মাঝে মুদি দোকানি হুচেনের সাথে তাঁর দেখা। হুচেন কোন রকম কুশল
জিজ্ঞাসাবাদ ছাড়াই বলল- হা মামু, গত মাসের টাকাটা কুনদিন দিবু তে? আইজকা না আগস্টের পাঁচ তারিখ বো।
রফিক প্রতি মাসে দশ
তারিখের মধ্যে মুদির বকেয়া টাকা মিটিয়ে দেয়। এখনো পাঁচদিন তাঁর হাতে আছে। সে-কথা
হুচেনকে বলে সে এগিয়ে গেল পুকুরের দিকে। ঘাটে বসে ঝামা দিয়ে পা ঘোষতে ঘোষতে তাঁর
মনে পড়ে গেল।
এক বছর আগে আজকের
দিনেই সে বিয়ে করেছিল তাঁরই মত
এক গরীব ঘরের মেয়ে রাহানুমাকে। অভাবের সংসার। বেশ
আঁটোসাঁটো। খুব
কষ্ট করে সাজিয়ে তুলেছে দু’জনে মিলে। রাহানুমাও ওকে খুব ভালোবাসে। যখন
রিকশা নিয়ে বাড়ি ফেরে ওর জন্য গোছলের পানি তুলে
দেয়। মাঝেমাঝে সেও তুলে দেয়। বাড়িতে কারেন্ট নাই,খেতে বসলে পাখা দিয়ে বাতাস করে। গরমের রাতে দু’জনে অদল বদল করে
পাখা দিয়ে বাতাস করে। ভবিষ্যৎটাকে সাজানোর গল্প করে, স্বপন দেখে। আর গল্প
করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে আবার বের হয় তাঁর ময়ূরপক্ষী নিয়ে। তাঁর
রিক্সায় তাঁর মতো বয়সী কলেজ-ভার্সিটির পড়ুয়ারা ওঠে; নিজেদের মধ্যে কত রকমের গল্প
করে। রফিক সব শুনে আর ভাবে, তাঁর জীবনটা যদি এরকম হতো! কখনো প্রজাপতি যুগল ওঠে;
একে অপরকে চকলেট খাওয়ায়, আইসক্রিম খাওয়ায়। রফিকেরও মন চায় একটা আইসক্রিম কিনে
রাহানুমার সাথে ভাগাভাগি করে খেতে! অনেক সময় স্বামী-স্ত্রী ওঠে; সংসার সাজানোর
গল্প করে। প্ল্যান করে, কীভাবে এবারের বিবাহ বার্ষিকীর অনুষ্ঠানটা করবে। কাকে কাকে
নেমন্তন্ন করবে, ইত্যাদি। রফিকেরও ইচ্ছা জাগে, বউকে নিয়ে এমন কোন রিক্সায় চেপে
বাজারে যাবে। দু’জনে মিলে কেনাকাটা করবে। হ্যারাকিন জ্বালিয়ে তো
রোজ ভাত খায়; একদিন না হয় মোমবাতি জ্বালায় রাতের বেলা ট্যাংরা মাছের ঝোল-ভাত খাবে!
কিন্তু যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় সেখানে ক্যান্ডেল লাইট-ডিনার আর ম্যারেজ
অ্যানিভার্সারি শব্দগুলোর সঠিক উচ্চারণও তো দূর-অস্ত...!
কিন্তু, রফিক যে দমে যাবার ছেলে নয়! সে একটা
মাটির ভাঁড় কিনেছিল। রোজ তাতে দু'চার টাকা করে জমাতো। দীঘি থেকে ফিরে সোজাসুজি ঘরে ঢোকে। মাটির
ভাঁড়টা ভেঙে দেখে, তাতে আটশো পনেরো টাকা জমেছে। খেয়েদেয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
যাবার বেলা বউকে বলে গেল, আজ ফিরতে একটু দেরী হবে। বউ বলল- ভালো করি থাকেন।
সাবধানে রিক্সা চালাবেন। কারো সাথে ঝামেলাত জোড়াবানেন।
দিনভোর রিক্সা চালিয়ে সন্ধ্যা সাতটায় গেল
মার্কেটে। এ-দোকান
সে-দোকান ঘুরে অনেক শাড়ি দেখল। পছন্দও করল; কিন্তু দামে পোষাল না। অবশেষে মার্কেট
থেকে বেরিয়ে ফুটের এক দোকান থেকে ছশ টাকায় একটা শাড়ি নিল। আর মোক্সু চাচার দোকান
থেকে এক প্যাকেট বিরিয়ানি; সঙ্গে এক প্লেট ভুনা। ফেরার পথে মহল্লায় ঢোকার মুখটায়
হুচেনের দোকান থেকে চারটা মোমবাতিও নিল সাথে।
রিক্সা চালানোর সময় মাঝে মাঝে এই ফুটের
দোকানগুলো দেখে তাঁর খুব রাগ হতো। এদের কারণে রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে গেছে। ভিড় লেগে
থাকে সব সময়। যাতায়াতে খুব অসুবিধা হয়। আজ ফেরার সময় সে ভাবছিল, এই দোকানগুলো যদি
না থাকত,তাহলে তাঁর মতো গরীবদের কী কষ্টটাই না হত!
বেশ ফুরফুরে মেজাজে বাড়িতে ঢুকল। অনেকদিন পরে রাহানুমাকে কিছু কিনে দিতে পারছে, ভেবেই তাঁর বুকের ভেতরটা খুশিতে দল খেতে লাগল।
ঘরে ঢুকে হাত-মুখ ধুয়ে একটা ভালো লুঙি পরল।
খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে মেঝেতে মাদুরটা পাতল। একটা ভাঙা থালা উপুড় করে তার উপর
মোমবাতি গুলো একটা একটা করে জ্বালিয়ে রাখল। দু’টো প্লেটে
সমানভাবে বিরিয়ানি আর ভুনা বেড়ে দিয়ে বারান্দার দিকে গেল। একটু পরেই ফিরে আসল বাম
হাতে কালো একটা প্যাকেট নিয়ে। ঘরে ঢুকে রাহানুমাকে বলল- এক বছর আগে আইজ্কার দিনত্
মুই তোক্ বেহা করি আনিছুনু। অভাবের সংসার, কিছুই দিবা পারোওনি; কুনোরকমে এই
শাড়িটা আনিছু।
রাহানুমা ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছে। বড় ভাই
বিয়ে করে আলাদা থাকে; দেখে না। মা-ই চেয়ে-মেঙ্গে, এ-বাড়ি ও-বাড়ি থালাবাসন মেজে
রাহানুমাকে মাধ্যমিক পাশ করিয়েছে। পয়সার অভাবে আর ভর্তি করাতে পারেনি। তাই
দেখেশুনে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে।
রাহানুমা এখন ষোড়শী। গায়ের রং একটু চাপা হলেও
মুখে লাবণ্যের কোনো কমতি নেই। চোখ দু’টো টানাটানা। তার
উপর আজকে হালকা কাজল লাগিয়েছে। রফিকের কথা শুনে এক লহমায় অতীতের কত কথা মনে পড়ে
গেল তার। বাবা জন খেটে সংসার চালাত। সেখান থেকে দু’চারটে
টাকা বাঁচিয়ে মেয়ের জন্য নতুন ফ্রোক কিনত...। রফিক
তার হাতে শাড়িটা রাখতেই সম্বিৎ ফিরে পেল সে। ততক্ষণে দীঘল চোখের কোণ বেয়ে অশ্রুরা
গাল অবধি পথ খুঁজে নিয়েছে। আর মোমবাতি আলোয় চিকচিক করছে সেই রেখাপথ। যেন
গোধূলি আলোয় স্নাত কোনো মেঠো প্রান্তরে এক ছোট্ট নালা বয়ে চলেছে।
কিছুক্ষণ পরে রাহানুমা উঠে ঘরের কোণে রাখা
ট্রাংকটার কাছে গেল। শাড়িটা ট্রাংকে রেখে একটা প্লাস্টিকের থলে নিয়ে ফিরল। রফিক
কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই থলেটা রফিককে ধরাল। খুলে দেখে তো রফিক অবাক- এ কি! এ জামা
তুমি পেলে কোথায়...?
রাহানুমা বলল- খালেক চাচার বেটাটা আছে না, বাব্লু।
ওঁয় এইবার ক্লাস ফোরে। চাইর মাস হলি ওক বিকালে টিউশন পড়াছু। চাচি একশ টাকা করি
দেয়। আর এক মাসের টাকা আগাম নিছু। কাইলকা চাচিই সাড়ে চাইরশ টাকা দি বাজার থাকি
এইটা কিনি আনি দিছে।
বেশ কিচ্ছুক্ষণ দু’জনেই নির্বাক...।
তারপর রফিক এক লুকমা বিরিয়ানি তুলে দিল রাহানুমার মুখে। রাহানুমাও তুলে দিল। কেক কেনার
সামর্থ্য তাঁদের ছিল না। তাই মোক্সু চাচার এক প্যাকেট বিরিয়ানি আর হুচেনের
দোকানের মোমবাতি দিয়েই সাজিয়ে তুলেছিল তাঁদের সাধের ক্যান্ডেল লাইট-ডিনার। তাঁরা
যখন ভাগাভাগি করে বিরিয়ানি খাচ্ছিল, ঠিক তখনই টিনের চালার ফুটোফাটা দিয়ে ঠিকরে
ঠিকরে ভেতরে ঢোকা চাঁদের আলোয় বিবাহ বার্ষিকীর এই ক্ষুদ্র আয়োজন অধিক উজ্জ্বল ও
মনোহর হয়ে উঠেছিল।
No comments:
Post a Comment