Friday 23 August 2019

প্রতিবেশী ও ইসলাম

প্রতিবেশী ও ইসলাম
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

প্রতিবেশী। সমাজ ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাই ইসলামে প্রতিবেশীর অধিকারকে অনেক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। রাসূল (সা) বলেছেন, জিবরীল (আ) আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে এত বেশি তাগিদ করতেন যে, আমার মাঝেমধ্যে মনে হতো হয়তো প্রতিবেশীকে সম্পদের উত্তরাধিকারী করা হবে। [বুখারী ৬০১৪, মুসলিম ২৫২৪] কিন্তু বর্তমান সমাজ এ বিষয়ে চরম উদাসীন। বিশেষ করে আমরা যারা শহরে থাকি, বছরের পর বছর কেটে যায় পাশের বাড়ির লোকেদের সাথে কোনো কথা হয় না, খোঁজ-খবর নেয়া হয় না; বরং অনেক সময় আমাদের আচরণে প্রতিবেশীরা কষ্ট পায়। অথচ প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ একজন মুসলিমের নৈতিক দায়িত্ব। রাসূল (সা) বলেছেন যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌ পরকালকে বিশ্বাস করে সে যেন প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করে”। [মুসলিম ১৮৫] যে আল্লাহ্‌ পরকালকে বিশ্বাস করে সে যেন প্রতিবেশীকে কষ্ট না দেয়। [মুসলিম ১৮৩]   
আরবি শব্দ জার (বহু বচন জীরান)-এর অর্থ প্রতিবেশী। আমাদের আশেপাশে যারা বাস করে তারাই আমাদের প্রতিবেশী। ধর্ম, বর্ণ বা জাতিতে ভিন্ন হলেও। তারা আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয়, মুসলিম হোক বা অ-মুসলিম প্রতিবেশীর দৃষ্টিকোণ থেকে সবাই সমান। তাদের খোঁজ-খবর রাখা, বিপদ-আপদে এগিয়ে যাওয়া, সুখ-দুঃখে শরিক হওয়া, উপঢৌকন আদান প্রদান করা, সেবা-শুশ্রষা করা, তাদের প্রয়োজন ও অধিকারকে গুরুত্ব দেয়া, কোনোভাবে তাদেরকে কষ্ট না দেওয়া একজন মুসলমানের নৈতিক দায়িত্ব।
পবিত্র আল্‌-কুর্‌আনে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করা হয়েছে। মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন ও এতিমের পাশাপাশি প্রতিবেশীর অধিকারের কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে— “তোমরা আল্লাহর উপাসনা করো এবং কোনো কিছুকে তার সাথে শরিক করো না। পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতি, অভাবগ্রস্ত, নিকটস্থ-প্রতিবেশী, দূরবর্তী-প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের দাস-দাসীদের সাথে ভালো ব্যবহার করো। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না”। [সুরাহ আন্‌-নিসা ৩৬] যারা প্রতিবেশীর সাথে ভালো আচরণ করে, যথাযথভাবে তাদের হক আদায় করে তাদেরকেই প্রকৃত এবং উত্তম প্রতিবেশী অভিহিত করা হয়েছে—“যে ব্যক্তি নিজ প্রতিবেশীর দৃষ্টিতে ভালো সেই সর্বোত্তম প্রতিবেশী। [ইবনু খুযাইমা ২৫৩৯, বায়হাকী ৯৫৪১, মুস্‌নাদ আহমদ ৬৫৬৬] আর যারা নিজ প্রতিবেশীর খেয়াল রাখে না তাদেরকে তিরস্কার করা হয়েছে— “ঐ ব্যক্তি মুমিন হতে পারে না যে পেটপুরে খায় অথচ তার প্রতিবেশী না খেয়ে কষ্ট পায়[মুসনাদ আবু ইয়ালা ২৬৯৯, ল্‌-আদাবুল মুফ্‌রাদ ১১২]
অনেক সময় প্রতিবেশী অভাবে দিন কাটে। কিন্তু সে লজ্জায় কারোর কাছে হাত পাতে না, কাউকে বুঝতেও দেয় না। আল্‌-কুর্‌আনের ভাষায় এরা ‘মাহ্‌রূম’ (বঞ্চিত)। এদের ক্ষেত্রে আল্‌-কুর্‌আনের নির্দেশ হল—“এবং তাদের সম্পদে রয়েছে অভাবগ্রস্ত ও মাহরূমের অধিকার[সূরা আয্‌-যারিয়াত ১৯] তাই আমাদের উচিৎ, তাদের খোঁজ খবর নিয়ে এমন ভাবে সাহায্য করা যাতে তারা লজ্জা না পায়। যেমন, সে যাকাত গ্রহণে যোগ্য কি না তা বিবেচনা করে, প্রয়োজনে তাকে না-জানিয়েই যাকাত দেওয়া। মনে রাখতে হবে, “যে তার ভাইয়ের প্রয়োজন পূরণ করে আল্লাহ্‌ তার প্রয়োজন পূরণ করেন[বুখারী ২৪৪২, মুসলিম ২৫৮০] কারণ তা-ই ঈমানের দাবি। নবী (সা) বলেছেন—“যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌ এবং আখেরাতের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন নিজ প্রতিবেশীকে সম্মান করে মুসলিমের বর্ণনায়, “সে যেন নিজ প্রতিবেশীর সাথে সদাচরণ করে”। [বুখারী ৬০১৮, মুসলিম ৪৮]  
শুধু তাই নয়, পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও দৃঢ় ও সুন্দর করার বিধানও দিয়েছে, তোমরা হাদিয়া (উপঢৌকন) আদান-প্রদান করোতাতে তোমাদের মাঝে হৃদ্যতা সৃষ্টি হবে”। [ল্‌-আদাবুল্‌ মুফ্‌রাদ ৫৯৪] বড় বা দামী কিছু দিতে না পারলে, অন্তত “ভালো কিছু রান্না করলে তার ঝোলটা তাকে দিয়ে এসো এবং তাতে তাকে শরীক করো”। [মুসলিম ২৬২৫] এবং গৃহিণীদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, “তোমাদের কেউ যেন প্রতিবেশীকে হাদিয়া দিতে সংকোচ বোধ না করে। যদিও তা বকরীর খুরের মত কোনো নগন্য বস্তু হয় [বুখারী ৬০১৭] কারণ, রান্নার ঘ্রাণ দেয়াল-দরজা পেরিয়ে বাতাসের কাঁধে চেপে প্রতিবেশী শিশুর মনে জায়গা করে নেয়! আর তাই সামান্য কিছু পাঠিয়ে যদি ঐ ছোট্ট শিশুর মনের ইচ্ছা পূরণ করা হয় নিশ্চিত আল্লাহ খুশি হবেন এবং আমাদের রুজিরোজগারে বরকত দেবেন। পরিচারক ও রাঁধুনির ক্ষেত্রেও একই বিধান ইসলামের, “তোমাদের খাদেম (পরিচারক) যখন তোমাদের জন্য খাবার তৈরি করে নিয়ে আসে তখন তাকে যদি সাথে বসিয়ে খাওয়াতে না পারো, অন্তত তাকে দু-এক লুকমা হলেও দাও (অর্থাৎ সামান্য কিছু দিয়ে হলেও তাকে ঐ খাবারে শরিক করো) কারণ, সে-ই তো কষ্ট করে, আগুনের তাপ সহ্য করে ঐ খাবার তৈরি করেছে”। [বুখারী ৫৪৬০]
প্রতিবেশীদের মধ্যে যে যত কাছে থাকে তার অধিকার ততো বেশী। মা আয়েশা (রা) একবার নবী (সা)-কে জিজ্ঞেস করলেন, “আমার দুই প্রতিবেশী। এদের মধ্যে আমি কাকে হাদিয়া দেবো? রাসূল (সা) বললেন, যে তোমার বেশি কাছে থাকে তাকে”। [বুখারী ৬০২০] যদি সে ভিন্ন ধর্মের হয় তবুও। বিখ্যাত তাবেয়ি মুজাহিদ (রহ) বলে, একবার আমি আব্দুল্লাহ্‌ বিনম্‌র (রা)-এর কাছে বসে ছিলাম। তার খাদেম বকরীর ছাল ছাড়াচ্ছিল। তিনি তাকে বললেন, তোমার এ কাজ শেষ হলে প্রথম আমাদের ইহুদী প্রতিবেশীকে দেবে। তখন এক ব্যক্তি বলল, আল্লাহ্‌ আপনাকে সুমতি দিন, আপনি ইহুদীকে আগে দিতে বলছেন! ইব্‌নু আম্‌র বললেন, হ্যাঁ, কারণ রাসূল (সা) প্রতিবেশীর অধিকারকে এত বেশি গুরুত্ব দিতেন যে, আমার মনে হতো, হয়তো প্রতিবেশীকে সম্পদের উত্তরাধিকারী করে দেওয়া হবে[ল্‌-আদাবুল্‌ মুফ্‌রাদ ১২৮]
তাই, একজন মুমিনের প্রাথমিক দায়বদ্ধতাগুলির একটি হল নিজ প্রতিবেশীর সুবিধা-অসুবিধার খেয়াল রাখা। যদি কেউ খেয়াল না রাখে, তার দরিদ্র, অভাবী প্রতিবেশীর ক্ষুধা নিবারণ না করে, তাকে “সাক্বার” নামক জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে—“(জাহান্নামীদেরকে জিজ্ঞেস করা হবে) কোন্‌ বিষয়টি তোমাদেরকে ‘সাক্বার’ নামক জাহান্নামে নিক্ষেপ করেছে? তারা উত্তরে বলবে, আমরা নামায পড়তাম না এবং দরিদ্র ও অভাবীদের খাবার দিতাম না। [সূরা আল্‌-মুদ্দাস্‌সির ৪২-৪৪] প্রয়োজন পূরণের পাশাপাশি তাদের অসুবিধা দূর করার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে—“কোনো প্রতিবেশী যেন অপর প্রতিবেশীকে তার দেয়ালে কাঠ, খুঁটি ইত্যাদি স্থাপন করতে বাধা না দেয়[বুখারী ২৪৬৩, মুসলিম ১৬০৯] এবং দৈনন্দিন জীবনে নিত্যপ্রয়োজনীয় ছোট-খাট জিনিসের আদানপ্রদানের ক্ষেত্রেও প্রতিবেশীর প্রতি যত্নশীল হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যারা দেয় না আল্লাহ্‌ তাদেরকে ভর্ৎসনা করে বলেছেন, দুর্ভোগ এমন নামাযীদের জন্য, যারা তাদের সালাত সম্বন্ধে উদাসীন, যারা লোক-দেখানোর জন্য সেসব কাজ করে, এবং গৃহস্থালীর প্রয়োজনীয় ছোট-খাট জিনিস অন্যদের দিতে অস্বীকৃতি জানায়[সূরা আল্‌-মা’ঊন ৪-৭]
এসবের পাশাপাশি, কেউ যদি নিজের জায়গা বা বাড়ি বিক্রি করতে চায়, সেক্ষেত্রেও ঐ জমি বা বাড়ির পার্শ্ববর্তী প্রতিবেশী হক সবচেয়ে বেশি তাই প্রথমে তাকেই প্রস্তাব দিতে হবে। যদি সে কিনতে না চায় তাহলে অন্যের কাছে বিক্রি করতে কোনো আপত্তি নেই। তবে তাকে না জানিয়ে অন্যের কাছে বিক্রি করা যাবে না। কারণ, তাতে সে অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। এটাই আইনসিদ্ধ ও শরিয়ৎ-সম্মত। একেই শরীয়তের পরিভাষায় ক্কে শুফ্আ বলে। এই মর্মে রাসূল (সা) আদেশ দিয়েছেন, যদি কেউ তার জমি বিক্রি করতে চায় তাহলে সে যেন (প্রথমে) তার প্রতিবেশীকে জানায়[ব্‌নু মাজাহ্‌ ২৪৯৩] এমনকি প্রতিবেশীর জন্য অপেক্ষা করার নির্দেশও দিয়েছেন, “শুফ্আ’-র বিষয়ে প্রতিবেশীর হক সবচেয়ে বেশি। প্রতিবেশি উপস্থিত না থাকলে তার অপেক্ষা করতে হবে। বিশেষ করে যখন তাদের উভয়ের যাতায়াত একইথে হয়।” [ইব্‌নু মাজাহ্‌ ২৪৯৪, তির্‌মিযী ১৩৬৯]
প্রতিবেশীর সাথে মানুষের সম্পর্ক সকাল-সন্ধ্যা বা রাত-দিনের নয়; বরং তা মাস ও বছর বা সারা জীবনের। তাই শান্তিপূর্ণ বসবাসের জন্য প্রতিবেশীর সৎ ও ভালো হওয়া অত্যন্ত জরুরী। যদি প্রতিবেশী মন্দ হয় তাহলে ভোগান্তির শেষ থাকে না। তাই ভালো প্রতিবেশী পাওয়াকে রাসূল (সা) সৌভাগ্যের ব্যাপার বলেছেন, উত্তম প্রতিবেশী ব্যক্তির সৌভাগ্যের কারণ[মুসনাদ আহমাদ ১৫৩৭২, ল্‌-আদাবুল মুফরাদ ১১৬] এবং ভালো প্রতিবেশীর জন্য প্রার্থনাও করতে বলেছেন, “তোমরা মন্দ প্রতিবেশী থেকে আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাও[নাসায়ী ৫৫০২, বায়হাকী ৯১০৬] কারণ একজন মন্দ প্রতিবেশী সাধারণ জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে। তাই সুকৌশলে এমন সমস্যার সমাধান করতে হবে। যেমনটা রাসূল (সা) করেছিলেন।এক ব্যক্তি রাসূল (সা)-এর কাছে এসে তার প্রতিবেশীর ব্যাপারে অভিযোগ করল। রাসূল (সা) তাকে বললেন, তুমি ধৈর্য ধরো। এভাবে তিনবার আসার পর তৃতীয় বা চতুর্থ বারে নবীজী তাকে বললেন, তোমার বাড়ির আসবাবপত্র রাস্তায় বের করে দাও। সাহাবী তা-ই করলেন। অতঃপর মানুষজন সেই রাস্তা দিয়ে যচ্ছিল এবং ঐ প্রতিবেশীকে অভিশাপ দিচ্ছিল। তখন ঐ প্রতিবেশী নবী (সা)-এর কাছে গিয়ে বলল, আল্লাহর রাসূল! মানুষ আমাকে যা তা বলছে। নবী (সা) বললেন, মানুষ তোমাকে কী বলছে? সে বলল, মানুষ আমাকে অভিশাপ দিচ্ছে। রাসূল (সা) বললেন, তার আগেই আল্লাহ তোমাকে লানত করেছেন। সে বলল, আল্লাহর রাসূল! আমি আর প্রতিবেশীকে কষ্ট দেবো না। তারপর নবী (সা) অভিযোগকারীকে ডেকে বললেন, তুমি (প্রতিবেশীর অনিষ্ট থেকে) নিরাপদ হয়েছ। [মুসতাদরাক হাকিম ৭৩০৩, আল-মুজামুল কাবীর তবারানী ৩৫৬, হীহ ইবনে হিববান ৫২০]
আমরা যেমন নিজ প্রতিবেশীর কাছ থেকে ভালো ব্যবহার, সদাচরণ ও সহমর্মিতা আশা করি, ঠিক তেমনি সেও আমাদের থেকে ভালো ব্যবহার প্রত্যাশা করে। তাই প্রতিবেশীর হক আদায়ের পাশাপাশি তাদেরকে কষ্ট দেওয়া থেকে বেঁচে থাকাও অত্যন্ত জরুরী। কারণ “কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম বাদী-বিবাদী হবে দুই প্রতিবেশী। [মুসনাদ আহমাদ ১৭৩৭২, ল্‌-মুজামুল্‌ কাবীর- তবারানী ৮৩৬] তাছাড়া, প্রতিবেশীকে কষ্ট দেওয়ার বিষয়টিকে নবী (সা) ঈমানের দুর্বলতা বলে চিহ্নিত করেছেন। কোনো প্রকৃত মুমিন কখনই প্রতিবেশীকে কষ্ট দিতে পারে না। রাসূল (সা) বলেছেন, “আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়! আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়! আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়! সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, কে? নবীজি বললেন, যে ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়। [হীহ বুখারী ৬০১৬]
 শুধু তা-ই নয়, প্রতিবেশীর সাথে মন্দ আচরণ করলে ব্যক্তির সব কৃতকর্ম বরবাদ হয়ে যায়। “এক ব্যক্তি রাসূল (সা)-কে এমন এক নারীর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল, যে নফল নামায পড়ে, রোযা রাখে, দুহাতে দান করে, কিন্তু কথার মাধ্যমে প্রতিবেশীকে কষ্ট দেয়, “তার কী হবে?” রাসূল (সা) বললেন, তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে।” [মুসনাদ আহমাদ ৯৬৭৫, আল-আদাবুল মুফরাদ ১১৯] এমনকি প্রতিবেশীর ক্ষেত্রে কোনো অন্যায় করলে অন্যের তুলনায় সেই অন্যায়ের কদর্যতা ও ঘৃণ্যতা দশ গুণ বেড়ে যায়। রাসূল (সা) বলেছেন—“কোনো ব্যক্তি দশজন নারীর সাথে অবৈধ যৌনাচার করলে যে গুনাহ হয় প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে করলে তার চেয়েও বেশি গুনাহ হয়...দশ বাড়িতে চুরি করা যত বড় অন্যায় প্রতিবেশীর বাড়িতে চুরি করা তার চেয়েও বড় অন্যায়[মুসনাদ আহমাদ ২৩৮৫৪, আল-আদাবুল মুফরাদ ১০৩, বায়হাকী ৯৫৫২]
গ্রামগঞ্জে প্রতিবেশীরা অধিকাংশ সময় একে অপরের সাথে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে তাদের বাড়ির সীমানা অথবা জমির আল বাঁধা নিয়ে। এবং অপেক্ষাকৃত সবল জন জোরপূর্বক নিজের সীমানা বাড়িয়ে নেয়। এই মর্মে তার মনে রাখা উচিৎ, “যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে এক বিঘত জমি দখল করল, কিয়ামতের দিন ঐ জমির সাত-তবক জমিন তার গলায় বেড়ি আকারে পরিয়ে দেয়া হবে[হীহ মুসলিম ১৬১১]  
পাশাপাশি বসবাস করার কারণে উভয়ের ভালো-মন্দ এমনকি বহু গোপন বিষয় একে অপরের দৃষ্টিগোচর বা কর্ণগোচর হয়। সকল বিষয় পরস্পরের জন্য আমানতস্বরূপ। আর আমানতের গোপনীয়তা বজায় রাখা একজন মুমিনের মুখ্য বৈশিষ্ট। এবং তার সুফলও সে পাবে, “যে ব্যক্তি তার মুসলিম ভাইয়ের দোষ ঢেকে রাখে আল্লাহ্‌ও কিয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন। [হীহ মুসলিম ২৫৮০]  
একজন প্রকৃত মুসলিম সর্বাবস্থায় নিজ প্রতিবেশীর খেয়াল রাখবে। তার হক আদায় করবে। নিজ কথা ও কর্মের অনিষ্ট থেকে তাকে নিরাপদ রাখবে। যদি তার প্রতিবেশী খারাপ হয় এবং তাকে কষ্ট দেয় তবুও। কারণ, একজন মুমিন প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও সত্য, ন্যায় এবং মঙ্গলের পথকে আঁকড়ে ধরে থাকে। সর্বদা ভালো আচরণ করে। তার তো স্বভাবই হল “তোমার সাথে যে মন্দ আচরণ করে তুমি তার সাথে ভালো আচরণ করো”। এবং ধৈর্য ও সদাচরণের মাধ্যমে ঐ প্রতিবেশীর অনিষ্টকে প্রতিহত করতে চেষ্টা করবে। যেমনটা আল্‌-কুর্‌আন শিখিয়েছে—“উত্তম আচরণের মাধ্যমে মন্দকে প্রতিহত করো; তাহলে তোমাদের শত্রুতা পরম মিত্রতায় রূপান্তরিত হবে”। [সূরা ফুস্‌সিলাত ৩৪–৩৫] এবং এর ফলস্বরূপ সে আল্লাহ্‌র প্রিয়পাত্র হয়ে উঠবে, “আল্লাহ্‌ তিন ব্যক্তিকে পছন্দ করেনতাদের একজন হল ঐ ব্যক্তি, যার একজন মন্দ প্রতিবেশী রয়েছে। এবং সেই প্রতিবেশী তাকে কষ্ট দেয়। কিন্তু ঐ ব্যক্তি ধৈর্য ধরে এবং আল্লাহর আশীর্বাদ ও করুণা আশা করে”[মুসনাদ আহমাদ ২১৩৪০, মুসতাদরাক হাকিম ২/৮৯, বায়হাকী ৯১০২]
আমার বিশ্বাস, প্রতিবেশী মুসলিম হোক বা-মুসলিম, আত্মীয় হোক বা অনাত্মীয় সবার প্রতি যত্নবান হওয়া একজন মানুষের মানবিক দায়বদ্ধতা এবং একজন মুসলিমের ঈমানি দায়িত্ব। যদি আমরা এই দায়িত্ব পালন করি তাহলেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করা এবং সম্প্রীতি সহমর্মিতার বাতাবরণ তৈরি করা সম্ভব হবে। এবং ‘এক পৃথিবী এক পরিবার’ বাস্তব রূপ লাভ করবে।
[পূবের কলম, ২৩ আগস্ট ২০১৯-এ প্রকাশিত]