যায়েদ বিন্ হ়ারিসাঃ মনিবকে ভালোবেসে মা-বাবাকে ফিরিয়ে
দিয়েছিল যে দাস
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
সু’দা বিনতু সা’লাবা শিশু পুত্র যায়েদকে সঙ্গে নিয়ে
পিতৃগোত্র বানু মা’আনের নিকট যাওয়ার জন্য রওয়ানা হলেন। পিতৃগোত্রে
পৌঁছানোর পূর্বেই একদিন রাতে বানু কায়ানের ডাকাত
দল তাঁদের তাঁবু আক্রমণ করল। কিছু বর্ণনায় রয়েছে, সু’দা সন্তান সহ নিজ মাতুলালয় বানু
মা’আনে অবস্থান করছিলেন এমন সময় একদিন একদল ডাকাত বানু মা’আনের উপর চড়াও হল। ওই
ডাকাত দল তাঁদের ধনসম্পদ, উট-মেষ সহ যা কিছু পেল লুঠ করে নিয়ে চলে গেল। যাবার বেলা গুটি কতক শিশুও বন্দী করে
নিয়ে গেল। ওই
বন্দী শিশুদের মধ্যে শিশু যায়েদ বিন্ হারিসাও ছিল। তখন তার বয়স ছিল আট
বছর।
ক’দিন বাদে ডাকাতের দল তাঁকে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে তাঁকে নিয়ে ‘উকাজ মেলায় গেল। সেখানে
হাকীম ইব্নু হিযাম ইব্নু
খুয়াইলিদ নামের এক কোরায়েশ
নেতা চার শ’ দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা) দিয়ে তাঁকে কিনে নিলেন। সেই সাথে তিনি আরও কিছু দাস খরিদ করলেন। অতঃপর গৃহস্থালির ও
অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনা হয়ে গেলে ফিরে এলেন মক্কায়।
হাকীম ইবন হিযামের প্রত্যাবর্তনের খবর শুনে তাঁর ফুফু (পিসি) খাদীজা বিনতু খুয়াইলিদ দেখা করতে আসলেন। কুশল বিনিময়ের পর ফুফুকে তিনি বললেন, ফুফু এবার উকাজের মেলা থেকে আমি বেশ কিছু দাস কিনে এনেছি। স্থির করেছি, তার থেকে একটা আপনাকে হাদিয়া (উপঢৌকন) স্বরূপ দেবো। তাই এদের মধ্যে কোনটা আপনার পছন্দ
হয়, কোনটা ভালো লাগে
আপনি বেছে নিন।
মা
খাদীজা দাসগুলির চেহারা গভীরভাবে নিরীক্ষণ করার পর, তাঁর মনে এক অদ্ভুত রকমের মায়া
জন্মাল এক শিশু দাসের প্রতি। তিনি তাকেই বেছে নিলেন। হয়তো
তিনি যায়েদের মলিন চেহারা ও নিবিড় চোখ দুটোয় তীক্ষ্ণ মেধা ও বুদ্ধির ছাপ প্রত্যক্ষ করেছিলেন। অতঃপর তিনি তাঁকে সঙ্গে করে বাড়ি ফিরে এলেন।
এই ঘটনার কিছু দিন পরেই মা খাদিজার বাণিজ্য কাফেলা
নিয়ে সিরিয়া পাড়ি দিলেন মক্কার এক সৎ, নিষ্ঠাবান ও কর্মঠে যুবক। নাম মুহাম্মদ, পিতার নাম
আবদুল্লাহ। মরসুম শেষে বানিজ্য-কাফেলা নিয়ে ফিরে
এলেন তিনি। সেই সাথে ঢের মুনাফা। মা খাদিজা অবাকই হলেন। নিজ দাসের মুখে সব
ইতিবৃত্ত শুনলেন। যুবক মুহাম্মদের (সাঃ) সততা, নিষ্ঠা, বুদ্ধিমত্তা ও নম্র
আচরণের কথা দাসের জবানী শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলেন তিনি। বান্ধবী নাফিসাকে দিয়ে বিয়ের
প্রস্তাব পাঠালেন। কথা হল, দু’পক্ষেই আলাপআলোচনা হল। অতঃপর ৪০ বছর বয়সে বছর ২৫-এর যুবকের সাথে প্রণয়
সূত্রে আবদ্ধ হলেন। বিয়ের পর
স্বামীকে কিছু উপহার দেবে ঠিক করলেন। কিন্তু কী দেবেন? ভেবে দেখলেন, যায়েদ অপেক্ষা আর ভালো কোনো হাদিয়া তাঁর কাছে নেই। তাই প্রিয় ক্রীতদাস যায়েদকে স্বামীর হাতে তুলে দিলেন।
দাস হয়েও যায়েদের সৌভাগ্যের তারা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। ক্রীতদাস হয়ে সে মনিব রূপে পেল এক সৎ, বিনয়ী, দয়ালু ও মানবিক
যুবককে। তাঁরই স্নেহ ছায়া ও মা খাদিজার মমতার আঁচলে সে তরতরিয়ে বড় হতে লাগলো।
তাদের স্পর্শে এসে সে চারিত্রিক সৌন্দর্যকে ছুঁয়ে দেখার সুযোগ পেল।
অন্যদিকে, তার স্নেহময়ী জননী পুত্র শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন। সারাক্ষণ এক অদ্ভুত রকমের
অস্থিরতা তাঁকে গ্রাস করে থাকতো।
চোখের পানি কখনও বাঁধ মানত না। রাতের ঘুম কোথাও যেন উধাও হয়ে গিয়েছিল। তাঁর ছেলেটি বেঁচে আছে না
ডাকাতদের হাতে মারা পড়েছে, তিনি জানতেন না। তাই মাঝেমধ্যেই ডুকরে ডুকরে কেঁদে
উঠতেন। পিতা হ়ারিসা সন্তানের খোঁজে জমিন এফোঁড়ওফোঁড়
করেদিয়েছিলেন। সম্ভাব্য
সব স্থানেই ছেলের খোঁজ করেছেন। পরিচিত-অপরিচিত সবার কাছে ছেলের সন্ধান জানতে চেয়েছেন। যেহেতু তিনি ছিলেন একজন কবি, তাই বহু কবিতায় পুত্র হারানোর বেদনা ফুটিয়ে তুলেছেন; যেন পাঠক ও
শ্রোতাদের কাছে যায়েদের সন্ধান খোঁজ করছেন। একটি কবিতায় তিনি বলেছেন—“যায়িদের
জন্য আমার অশ্রু ঝরছে
অবিরত/ জানিনে তার কী হয়েছে, সে কি জীবিত?/ তবে
তো ফেরার আশা আছে, নাকি সে মারা
গেছে!/ আল্লাহর কসম! আমি জানি না, তবে জিজ্ঞেস করে চলেছি সবাইকে।/ তাকে
অপহরণ করেছে যারা/ তারা কি সমতলের লোক, না কি কোনো
পার্বত্য ভূমির?/ উদয়ের সময়
সূর্য স্মরণ করিয়ে দেয় তার কথা/ আর যখন
অস্ত যায়, নতুন করে মনে করিয়ে
দেয়।/ আমি দেশ থেকে দেশান্তরে, তার সন্ধানে/ উট হাঁকিয়ে ফিরবো, কখনও ক্লান্ত হবো না/ আমার বাহন উটটিও ক্লান্ত হবে না।/ আমি নিরন্তর খুঁজতে থাকবো, যতদিন বেঁচে আছি/ আর যদি তার আগেই মৃত্যু হানা দেয়/ দেবে, প্রতিটি মানুষই তো মরণশীল।”
মাঝে, মরুভূমির চর ধরে সময়ের স্রোত বয়ে গেছে। বর্ষাও কেটে গেছে
বেশ ক’টা, বালি ও বৃষ্টির মিলন
ঘটেনি। বাতাসের সাথে মেঘেরও দেখা হয়নি দীর্ঘ দিন। এরপরে হজ্জের এক মরসুমে যায়েদের গোত্রের কিছু লোক হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কায় এলো। কা’বার চতুর্দিকে তাওয়াফ (প্রদক্ষিণ ও
পরিক্রমা) করার সময় হঠাৎ করে তারা যায়েদের
মুখোমুখি হলো। পরস্পরকে চিনতে পারল তারা।
কুশল বিনিময় করলো। হজ্জ আদায়ের পর বাড়ি ফিরে গিয়ে তারা যায়েদের পিতা হারিসাকে তাঁর
হারানো সন্তানের সন্ধান দিল।
ছেলের সন্ধান পেয়ে হারিসার মন বন্যার জলের মতো থৈ থৈ করে উঠল। তড়িঘড়ি সফরের প্রস্তুতি সেরে ফেললেন। কলিজার
টুকরো,
নয়নের মণি যায়েদের মুক্তিপণের অর্থও জোগাড় করলেন। তারপর ভাই কা‘আবকে সাথে নিয়ে মক্কার পথে বেরিয়ে পড়লেন। ক’দিন লাগাতার-বিরামহীন যাত্রার পর মক্কায় পৌঁছলেন। যুবক মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সাথে দেখা করে বললেন— “আপনি আব্দুল মুত্তালিবের বংশধর! আপনারা আল্লাহর ঘরের প্রতিবেশী। আপনারা অসহায়দের
সাহায্য করেন। ক্ষুধার্তকে অন্ন দান করেন।
আশ্রয়প্রার্থীকে আশ্রয় দেন। আপনার কাছে যে ছেলেটি আছে আমরা তার ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি। তার মুক্তিপণও সঙ্গে নিয়ে এসেছি। আমাদের প্রতি
অনুগ্রহ করুন এবং মুক্তিপণ নিয়ে আমাদেরকে আমাদের ছেলে ফিরিয়ে দিন।”
— “আপনারা কোন্ ছেলের কথা বলছেন?” মুহাম্মদ (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন।
— “আপনার দাস যায়েদ ইব্নু হারিসার।”
— “মুক্তিপণের পরিবর্তে মুক্তিপণের চেয়ে উত্তম কিছু যদি নির্ধারণ করি?”
— “কী সেটা?” যায়েদের পিতা তৎক্ষণাৎ জিজ্ঞেস করলেন।
— “আমি তাকে আপনাদের সামনে ডাকবো। তাকে এখতেয়ার দেওয়া হবে, সে নিজেই ঠিক করবে আমার সাথে থাকবে,
না আপনাদের সাথে যাবে।
যদি আপনাদের সাথে যেতে চায়,
মুক্তিপণ ছাড়া তাকে নিয়ে যাবেন। আর যদি আমার সাথে থাকতে চায়, তাহলে আমারও করার কিছুই
নেই।”
— “আপনি অত্যন্ত ন্যায় সঙ্গত
কথা বলেছেন।”, তাঁর এই প্রস্তাবে
সায় দিয়ে তারা বলল।
মুহাম্মদ (সাঃ) যায়েদকে ডেকে পাঠালেন। মুহূর্তের মধ্যেই সে এসে হাজির। জিজ্ঞেস করলেন— এই দু’জনকে চেনো? এরা কারা?
যায়েদ উত্তর দিল— হ্যাঁ, চিনি। ইনি আমার পিতা হ়ারিসা ইব্নু শুরাহ্বীল।
আর উনি হলেন আমার চাচা কা’আব।
এবার মুহাম্মদ (সাঃ) বললেন— যায়েদ, তুমি ইচ্ছা
করলে নির্দ্বিধায় তাঁদের সাথে যেতে পারো।
আর যদি চাও, আমার সাথে এখানে থাকতে পারো। তোমার
যা ভালো মনে হয় করো, কোনো বাধ্যবাধকতা
নেই।
কোনো
রকম ইতস্ততঃ না করে যায়েদ সোজাসাপটা উত্তর দিল। বলল—
আমি আপনার সাথেই থাকবো।
পিতা হ়ারিসা বললেন— যায়েদ, এ কি সর্বনাশ করলে তুমি, মা-বাবাকে ছেড়ে দাসত্ব বেছে নিলে!
যায়েদ উত্তর দিল— বাবা, এই ব্যক্তির মাঝে
আমি এমন কিছু পেয়েছি,
যে আমি তাঁকে
কখনও ছেড়ে যেতে পারবো না।
যায়েদের এই উত্তর শুনে নবীজি মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তার সিদ্ধান্তকে সাদরে গ্রহণ করে তার হাত ধরে কা’বা ঘরের
কাছে নিয়ে গেলেন। সেখানে হাজরে আস্ওয়াদের পাশে দাঁড়িয়ে উপস্থিত কোরায়েশদের লক্ষ্য করে ঘোষণা করলেন, “হে কোরায়েশের লোকেরা! তোমরা সাক্ষী থাকো, আজ থেকে যায়েদ
আমার ছেলে। সে হবে আমার উত্তরাধিকারী এবং আমি হবো তার উত্তরাধিকারী।”
এই ঘোষণা শুনে যায়েদের বাবা হ়ারিসা ও চাচা কা‘আব খুবই
খুশী হলেন। তাঁরা যায়েদকে নবীজির কাছে রেখে
প্রশান্ত চিত্তে নিজ গৃহে ফিরে গেলেন। সেই দিন থেকে যায়েদ ইব্নু হ়ারিসা হয়ে গেলেন যায়েদ ইব্নু মুহাম্মদ। সবাই তাঁকে মুহাম্মদের ছেলে
হিসেবেই সম্বোধন করতে লাগলো। অবশেষে যখন সূরাতু আল্-আহ্যাবের
“তাদেরকে তাদের পিতার নামেই ডাকো।” বিষয়ক আয়াতটি অবতীর্ণ করে আল্লাহ্ তা'আলা ধর্মপুত্র গ্রহণের প্রথা বাতিল করলেন, তখন থেকে লোকজন যায়েদকে আবার যায়েদ
ইব্নু হ়ারিসা নামেই ডাকতে লাগলো।
তখনও ইসলামের আগমন ঘটেনি। তাই যায়েদ জানতেন না, তিনি যাকে অভিভাবক
রূপে বেছে নিয়েছেন তাঁর কাঁধে বিশ্বমানবতার অভিভাবকত্বের ভার রয়েছে। তিনি সাইয়্যেদুল আওয়ালীন ওয়াল্-আখেরীন (পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের সর্দার)। তিনি ইমামুল্ আম্বিয়া ওয়াল্ মুর্সালীন (নবী-রসুলদের ইমাম)। তিনি রাহ্মাতুল্
লিল্-‘আলামীন (সৃষ্টিজগতের জন্য
করুণার স্বরূপ)। তিনিই মরুভূমির
রুক্ষ বালুচরের উপর একটি শীতল ছায়াসুনিবিড় আশ্রয় প্রতিষ্ঠা করবেন। এমন একটি রাষ্ট্র কায়েম করবেন, যার পূর্ব থেকে পশ্চিম সর্বত্র কল্যাণ ও ন্যায়বিচারে ভরে উঠবে। এই
ঘটনার ক’ বছর বাদেই
মুহাম্মদ (সাঃ) নবুওয়াত (নবিত্ব) লাভ করলেন। আর যায়েদ পুরুষ দাসদের মধ্যে সর্বপ্রথম তাঁর আদর্শকে গ্রহণ করলেন। পরবর্তীকালে তিনি নবীজির
বিশ্বাসভাজন আমীন, তাঁর সেনাবাহিনীর কমাণ্ডার এবং তাঁর
অনুপস্থিতিতে মুরায়সী’ অভিযানের সময় মদীনার অস্থায়ী তত্ত্বাবধায়কও হন।
যায়েদ নিজ পিতা-মাতাকে ছেড়ে নবীজিকে বেছে নিয়েছিলেন। নবিজীও যায়েদকে খুবই ভালোবাসতেন। তাঁকে আপন সন্তান ও পরিবারবর্গের মধ্যে
শামিল করে নিয়েছিলেন। যায়েদ দূরে কোথাও গেলে নবীজি
উৎকণ্ঠিত হতেন। ফিরে এলে তাঁকে দেখে উৎফুল্ল হতেন। এবং এত
আনন্দের সাথে তাঁকে গ্রহণ করতেন যে অন্য কারো সাক্ষাতের সময় তেমন উৎফুল্লতা তাঁর
চেহারায় দেখা যেত না। স্বভাবতই কোনো এক অভিযান শেষে যায়েদ মদীনায় ফিরে এলে নবীজি তাঁকে অধিক আগ্রহ ও উৎফুল্লতার সাথে
গ্রহণ করেন। মা আয়েশা (রাঃ) সেই ঘটনার বর্ণনা
দিতে গিয়ে বলেছেন— “যায়েদ ইব্নু হ়ারিসা মদীনায় ফিরে এলো; নবীজি (সাঃ) তখন আমার ঘরে। যায়েদ দরজায় কড়া নাড়লো। নবীজি (সাঃ) প্রায় খালি গায়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর দেহে
নাভী থেকে হাঁটু পর্যন্ত একপ্রস্থ কাপড় ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এ
অবস্থায় কাপড় টানতে টানতে দরজার দিকে ছুটে
গেলেন। দরজা খুলে যায়েদের সাথে কোলাকুলি করলেন।
চুমু খেলেন। আল্লাহর কসম করে বলছি, এর আগে বা এর পরে আর কখনও নবীজিকে আর কারোর সাথে এমন ভাবে কোলাকুলি করতে আমি দেখিনি।” যায়েদের প্রতি নবীজির গভীর ভালোবাসা ও মমত্ববোধের কারণেই
লোকে যায়েদকে বলতো “হিব্বু রাসূলিল্লাহ” (রসুলের প্রীতিভাজন)।
চাচা
হামযা (রাঃ) ইসলাম গ্রহণ করলে নবীজি (সাঃ) তাঁকে ও যায়েদকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেন। তাঁদের মাঝে মুওয়াখাত (ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক) প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে
তাঁদের দু’জনের মধ্যে আত্মীয়তার এক দৃঢ় বন্ধন তৈরি হয়। আর
সে জন্যই হামযা (রাঃ) কখনও সফরে গেলে নিজ
দ্বীনি ভাই যায়েদকে অসী বানিয়ে সাথে নিয়ে যেতেন।
উম্মু আয়মান বারাকাহ্, এক আবিসিনিয়ান দাসী।
নবীজি আজীবন তাঁকে মা বলে ডেকেছেন।
একদিন সাহাবীদের ডেকে তিনি বললেন— কেউ যদি কোনো
জান্নাতী মেয়েকে বিয়ে করতে চায়, সে উম্মু আয়মানকে
বিয়ে করুক। যায়েদ নবীজির এই বিবৃতিতে
প্রীত হয়ে নবীজিকে খুশী করলেন। উম্মু আয়মানকে বিয়ে করে নিলেন।
আর এভাবেই যায়েদ নবীজির দাস থেকে পুত্র এবং পুত্র থেকে পিতা হয়ে গেলেন। ভালোবাসার
কী অদ্ভুত বাঁধন! পরবর্তীতে মক্কাতেই তাঁরই ঔরসে উম্মু আয়মানের গর্ভে বিখ্যাত
সেনানায়ক উসামা বিন যায়েদ জন্মগ্রহণ করেন।
হিজ্রতের পর, মদিনায় পৌঁছে যায়েদ কুলসুম ইব্নু হিদ্মের ঘরে উঠেন। অতঃপর উসাইদ ইব্নু হুযায়েরের (রাঃ) সাথে তাঁর
ভ্রাতৃ-সম্পর্ক কায়েম করা হয়। এতদিন নবী পরিবারের একজন সদস্য হিসাবে এক বাড়িতেই থাকতেন। মদিনায়
আসার পর তাঁকে পৃথক বাড়ী করে দেওয়া হল। নবীজি আপন ফুফাতো (পিসতুতো) বোন যায়নাব
বিন্তু জাহাশের সাথে তাঁর বিয়ে দিলেন। কিন্তু যায়নাবের সাথে দাম্পত্যের সম্পর্ক ও বোঝাপড়ায় কিছু সমস্যা ও মনোমালিন্য দেখা
দিল। আলাপআলোচনার পরে তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটল। অতঃপর আল্লাহর নির্দেশে নবী (সাঃ)-এর সাথে যায়নাব (রাঃ)-এর বিয়ের ব্যবস্থা করা হল। এবং এর মাধ্যমে আরবের একটি দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত প্রথাকে
বিলুপ্ত করে দেওয়া হল।
যায়েদ (রাঃ) ছিলেন তৎকালীন আরবের এক অন্যতম তীরন্দাজ। বদর থেকে মূতা পর্যন্ত সকল অভিযানেই তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন। একমাত্র মুরায়সী’ অভিযানে যোগদান করতে পারেননি। কারণ এই অভিযানের সময় নবীজি তাঁকে মদিনার
দেখভালের দায়িত্ব দেন। সহজ করে বললে, তাঁকে ওই ক’দিনের জন্য মদিনার প্রশাসক নিযুক্ত করেন।
অষ্টম হিজ্রিতে রাসূল (সাঃ) পত্র মারফৎ পার্শ্ববর্তী শাসক, সম্রাট ও
রাষ্ট্রনেতাদের ইসলাম গ্রহণ এবং শান্তি ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। একটি পত্রসহ তিনি হারিস ইব্নু ‘উমায়ের আল্-আয্দী (রাঃ)-কে
বসরার শাসকের নিকট পাঠান। হারিস জর্ডনের
পূর্ব সীমান্তে মূতা নামক স্থানে পৌঁছলে গাস্সানী সাম্রাজ্যের এক শাসক শুরাহ্বীল ইব্নু ‘আমর তাঁর
পথ আটকায়। অতঃপর তাঁকে বন্দী বানিয়ে হত্যা করে। রাসূল (সাঃ) খবরটা শুনে খুবই
মর্মাহত হন। যেহেতু সে যুগেও রাষ্ট্রদূতের নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
ছিল। তাই এই জঘন্য ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে তিনি সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নেন।
মূতায় অভিযান পরিচালনার জন্য তিন হাজার
সৈন্যের একটি সেনাবাহিনী
প্রস্তুত করেন এবং পরিচালনার দায়িত্ব যায়েদ ইব্নু হ়ারিসা (রাঃ)-এর কাঁধে অর্পণ
করেন। রওয়ানার পূর্ব-মুহূর্তে রাসূল (সাঃ) সেনাবাহিনীকে
উপদেশ দেন, “যদি যায়েদ শহীদ হয়ে যায়, তাহলে পরবর্তী সেনাধক্ষ্য
হবেন জা’ফর ইব্নু
আবী তালিব। জা’ফর শহীদ হলে সেনাপ্রধান হবেন ‘আবদুল্লাহ
ইব্নু রাওয়াহা। তিনিও যদি শহীদ হন
তাহলে তোমরা নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে সেনাপ্রধান নির্বাচন করে নেবে।”
যায়েদ (রাঃ)-এর
নেতৃত্বে সেনাবাহিনী মদীনা থেকে যাত্রা করে জর্ডনের পূর্ব সীমান্তে তৎকালীন সিরিয়ার মাআন নামক স্থানে পৌঁছলো। অন্যদিকে রোম-সম্রাট হিরাক্ল
গাস্সানীদের পক্ষে প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে এক লাখ সৈন্যের এক বিরাট বাহিনী নিয়ে
অগ্রসর হলো। তাদের সাথে যোগ দিল পৌত্তলিক ও খ্রিস্টান আরবদের আরও এক লাখ সেনা। তাদের সম্মিলিত বাহিনী মুসলিম বাহিনীর অনতি দূরে
অবস্থান করলো। সেখানে দু’রাত অবস্থান করে,
নিজেদের মধ্যে সলাপরামর্শ করে মুসলিম বাহিনী
স্থির করলো, তাঁরা শত্রু পক্ষের মোকাবেলায় সংখায় যতই কম
হোক না কেন পিছু হটবে না। অতঃপর এই দুই অসম বাহিনী মুখোমুখি সংঘর্ষে অবতীর্ণ হল। দু’লাখ সেনার বিরুদ্ধে
মাত্র তিন হাজার সেনার বীরত্ব ও সাহসিকতা দেখে রোমান বাহিনীর পাশাপাশি ইতিহাসও বিস্মিত হল।
যায়েদ ইব্নু হ়ারিসা (রাঃ) শক্ত হাতে ইসলামের পতাকাকে
সমুন্নত করে ধরে রাখলেন। তীর ও বর্শার অসংখ্য আঘাতে তাঁর দেহ ঝাঁঝরা
হয়ে গেল। শরীরের শেষ রক্তবিন্দুও উৎসর্গ করলেন নবীজির ভালোবাসায়। অবশেষে
তিনি যখন
রণক্ষেত্রে ঢলে পড়লেন, একে একে জাফর ইব্নু আবী তালিব ও ‘আবদুল্লাহ ইব্নু রাওয়াহা পতাকা হাতে তুলে নিলেন
এবং বীরত্বের সাথে লড়তে লড়তে শাহাদাত বরণ করলেন। অতঃপর
মুসলিম বাহিনীর সম্মিলিত সিদ্ধান্তে খালিদ ইব্নু
ওয়ালিদ কমাণ্ডার নির্বাচিত হলেন। তাঁর বীরত্ব, রণকৌশল ও
নেতৃত্বে মুসলিম বাহিনী অনিবার্য পরাজয় ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেল। এভাবে, অষ্টম হিজরীতে ৫৫ বছরে বয়সে মূতার রণক্ষেত্রে নবীজির পতাকাকে বুকে আঁকড়ে নবীজির প্রাণপ্রিয় যায়েদ ইব্নু হ়ারিসা শেষ নিঃশ্বাস
ত্যাগ করে শাহাদাত বরণের সৌভাগ্য অর্জন করলেন— রাযি আল্লাহু ‘আন্হু।
মূতার এই দুঃখজনক সংবাদ নবীজির নিকট পৌঁছল। তিনি
শোকাতুর হয়ে পড়লেন। শহীদ কমাণ্ডারদের বাড়ী গিয়ে তাঁদের
পরিবারবর্গকে সমবেদনা জ্ঞাপন করলেন। যখন যায়েদের বাড়ি
পৌঁছলেন তাঁর ছোট্ট মেয়েটি কাঁদতে কাঁদতে নবীজিকে জড়িয়ে ধরল। তার কান্না দেখে নবিজীও উচ্চস্বরে কেঁদে ফেললেন। নবীজিকে কাঁদতে দেখে সা‘আদ ইব্নু ‘উবাদা বলে উঠলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, একি?” নবীজি উত্তর
দিলেন, “এটা ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।”
তারপর, বিদায় হজ্জ
থেকে ফিরে নবীজি যায়েদ সহ
অন্যান্য যোদ্ধাদের হত্যার বদলা
নেওয়ার জন্য সেনাবাহিনী প্রস্তুত করলেন। এবং সেই
সেনাবাহিনীর প্রধান করলেন যায়েদের অল্পবয়সী ছেলে উসামাকে। এক অল্পবয়সী ছেলের নেতৃত্ব অনেকের পছন্দ হলো না। রাসূল (সাঃ) তা জানতে পেরে বললেন— “তোমরা পূর্বে এর পিতা যায়েদের নেতৃত্বের সমালোচনা করেছিলে। এখন তার পুত্রের নেতৃত্বে সন্তুষ্ট হতে পারছো না।
আল্লাহর কসম, যায়েদ নেতা হওয়ার যোগ্য ছিল এবং সে ছিল আমার সর্বাধিক প্রিয়। তারপর আমার
সবচেয়ে প্রিয় তাঁর পুত্র উসামা।”
আর উসামা (রাঃ) ছিলেন পিতার উপযুক্ত সন্তান। একেবারেই যোগ্য উত্তরসূরি। তিনি নিজ পিতা যায়েদ সহ অন্যান্য যোদ্ধাদের হত্যার বদলা নিয়েই মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। যায়েদ (রাঃ) নবীজিকে খুবই ভালোবাসতেন। নবীজির প্রতিটা আদেশ-নিষেধ কোনোরকমের দ্বিধাদ্বন্দ্ব, প্রশ্ন ও ব্যখ্যা ছাড়াই হুবহু অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন। নবিজীও তাঁকে খুব ভালোবাসতেন। তাঁর ও তাঁর সন্তানদের প্রতি নবীজির এই সীমাহীন ভালোবাসা দেখে মা আয়েশা (রাঃ) প্রসঙ্গে-অপ্রসঙ্গে, মাঝেমধ্যেই বলতেন— “যদি যায়েদ জীবিত থাকতেন, নবীজি মৃত্যুর সময় হয়তো তাঁকেই স্থলাভিষিক্ত করে যেতেন।”