Thursday 31 March 2022

আব্দুর রাহমান শুকরীঃ জীবন ও কর্ম



‘আব্দুর্রাহ়্মান শুক্রী
(১৮৮৬১৯৫৮)
 
জন্ম পরিচিতি
কবি শুক্রী ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দের ১২ই অক্টোবর মিসরের পোর্ট সায়িদে জন্ম গ্রহণ করেন তাঁর পূর্বপুরুষগণ উত্তর আফ্রিকার মরক্কো থেকে মিশরে এসেছিলেন তাঁরা নিজেদেরকে আইয়াদ বলতেন পিতামহ আহ্মাদ শুক্রী আইয়াদ পিতা মুহাম্মদ শুক্রী আইয়াদ উভয়েই মিসরের জাতীয়তাবাদী নেতা ছিলেন পিতা কর্মসূত্রে আলেকজান্দ্রিয়া পৌরসভার একজন পদাধিকারী ছিলেন ১৮৮১ সালের উরাবী বিদ্রোহে শামিল হয়েছিলেন পরে বিদ্রোহ পরাস্ত হলে তাঁকেও বন্দী করা হয়  মুক্তি পেয়ে অল্প কিছু দিন তিনি কর্মহীন ছিলেন পরে পোর্ট সায়িদের প্রশাসনিক বিভাগে যুক্ত হয়ে আজীবন ওই পদে বহাল ছিলেন এখানেই কবির জন্ম কবির অগ্রজ ভাইয়েরা একে একে মারা যাওয়ায় পিতা কবিকে সবিশেষ স্নেহ করতেন
 
প্রতিপালন শিক্ষা
তিনি আশ্‌-শায়েখ মুহাম্মদ হিজাযী মক্তবে ভর্তি হন। তারপর আল্‌-জামে’ আত্‌-তাওফীকী প্রাথমিক বিদ্যালয় হতে ১৯০০ সালে প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করেন। অতঃপর আলেকজান্দ্রিয়ার রাসুত্‌ তিব্‌ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় হতে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। তারপর ১৯০৯ সালে আল্‌-মু‘আল্লামীন হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল থেকে সর্বোচ্চ নম্বর নিয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেন। সে সময় তিনি ইংরেজি ভাষায় বিশেষ বুৎপত্তি ও দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। ফলে সরকারী ভাবে তাঁকে ইংল্যান্ডের শেফাল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয় উচ্চ শিক্ষার জন্য। সেখানে তিনি তিন বছর যাবৎ অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস ও দর্শনের পাঠ গ্রহণ করেন। পাশাপাশি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অধিক পারদর্শী হয়ে ১৯১২ সালে নিজ দেশে ফিরে আসেন।
 
কর্মব্যস্ততা
ইংল্যান্ড থেকে ফিরেই মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক রূপে তাঁর কর্ম জীবন আরম্ভ হয়। তিনি বিদ্যালয়ে ইতিহাস, ইংরেজি এবং অনুবাদ সাহিত্য পড়াতেন। অতঃপর তাঁকে স্কুল পরিদর্শক ও পর্যবেক্ষক করা হয়। উক্ত পদে তিনি ১৯৩৮ পর্যন্ত অতি দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি প্রায় ছাব্বিশ বছর মিশরের শিক্ষা ও সংস্কৃতি দপ্তরে চাকরি করেছেন। অতঃপর তিনি যখন “আক্‌ওয়াম বাদু” নামক একটি কবিতা লেখেন, শাসক সমাজ তাঁর উপর চটে যায়। তাঁর বিরুদ্ধে নানা ধরণের ষড়যন্ত্র আরম্ভ করে দেয়। ফলে একটা সময় তিনি বাধ্য হয়ে খুব সামান্য পেনশন নিয়ে স্বেচ্ছা অবসর গ্রহণ করেন। তাঁর পেনশন এতোই সামান্য ছিল যে তা তাঁর ও তাঁর অধিনস্ত ফ্যামেলির জন্য যথেষ্ট ছিল না। সেজন্যই তিনি আজীবন বিয়ে করেননি। উল্লেখ্য যে, তিনি তাঁর সহোদরের পুরো ফ্যামেলির ভরণপোষণের দায়িত্ব পালন করতেন।
 
মৃত্যু
তিনি আশা করেছিলেন, জনসমাজ তাঁর পাশে দাঁড়াবে। তাঁকে সাহায্য ও সমর্থন করবে। কিন্তু কেউই তাঁর পাশে দাঁড়ায়নি। কোনোরকম সাহায্যও করেনি। ফলে হতাশ হয়ে তিনি একদিন তাঁর অপ্রকাশিত বহু দীওয়ান ও গ্রন্থ জ্বালিয়ে দেন। মানসিক চাপের পাশাপাশি তিনি হাই ব্লাড প্রেশারে আক্রান্ত হন, যা একসময় তাঁর পক্ষাঘাতের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি সবার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে একাকী জীবন যাপন আরম্ভ করেন। কথা বলা ও লোকেদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ করাও ছেড়ে দেন। এভাবেই ২৫ ডিসেম্বর ১৯৫৮ সালে আলেকজান্দ্রিয়াতে মৃত্যু বরণ করেন।
 
সাহিত্য-সমালোচনা 
মাদ্‌রাসাতুদ্‌ দীওয়ান নামক বিখ্যাত সাহিত্য সংঘের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। আক্কাদ ও মাযিনীকে সাথে নিয়ে আরবি কাব্য জগতে এক বিপ্লবের সূচনা করেন। আরবি কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে উপস্থাপন করেন। অনেকেই মনে করেন এই সাহিত্য সংঘের মূল উদ্যোক্তা তিনি। তিনিই এর প্রাণপুরুষ। আরবি কবিতাকে জীবনমুখী করার ব্যাপারে তাঁর অনস্বীকার্য অবদান রয়েছে। তাঁর কাছে, কবিতা বিনোদন নয় বরং জীবনের প্রয়োজন। কবিতা জীবনের সুখদুঃখ, ভালোমন্দ, আলোঅন্ধকারের কথা বলে। সামাজিক সমস্যা উপস্থাপন করে সমাধানের পথে আহ্বান জানায়। মনুষ্য অভিব্যক্তির নিখাদ মাধ্যম। এছাড়া তিনি মনে করতেন, কবিতার অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল চিত্রায়ন, কল্পনা, অনুভূতি ও চেতনা। এবং কবিতায় যে কোনোরকমের অতিরঞ্জন ও কৃতিমতা বর্জন অপরিহার্য।
 
কাব্যকবিতা
আরবি কবিতায় কাফিয়া ও অন্তমিলের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। একই কবিতায় একাধিক কাফিয়া ব্যবহার করেছেন। নিজ কবিতায় তিনি সামাজিক ইস্যুগুলো সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। নানা অপসংস্কৃতি নিয়ে সরব হয়েছেন। শিশুশ্রম, অনাথদের অসহায়তা ও অপুষ্টি ইত্যাদি বিষয়কে কবিতায় তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি দারিদ্র্য, অজ্ঞতা এবং অরাজকতাকে নিয়ে নিজ কবিতায় শাসক সমাজকেও বিঁধেছেন। আল্‌-ইয়াতীম নামক কবিতায় তিনি বলেছেন—
وما اليُتم إلا غربة ومهانة      وأي قريب لليتيم قريب؟
(অনাথ জীবন যেন প্রবাসী জীবন, লাঞ্ছনা ও অবহেলায় ভরা। কোনও আত্মীয়ই অনাথের আত্মীয় হতে চায় না)
 
তিনি মনে করতেন, জীবনের এই সৌন্দর্য বিশ্বনেতা, সমাজ-সংস্কারক ও মনীষাদের উপহার ও উপঢৌকন তাঁদের অনস্বীকার্য অবদান রয়েছে মানব সভ্যতার ইতিহাসের গতিপথ নির্ণয় ও পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে মাস়ারিউন্নুজাবানামক কবিতায় তিনি লিখেছেন
إن الحياة جمالها وبهاؤها         هبة من النجباء والشهداء
(জীবনের এই সৌন্দর্য ও উৎফুল্ল শহীদ ও পণ্ডিতদের উপহার)
 
তিনি স্বাধীনচেতা ও মুক্তমনা মানুষ ছিলেন স্বাধীন ভাবে জীবন যাপন ও স্বাধীন ভাবে কর্ম সম্পাদনকে প্রাধান্য দিতেন  সারাক্ষণ স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করতেন তিনি মনে করতেন, একজন স্বাধীন মানুষের ভুল ভ্রান্তি কোনো দাসের সঠিক কাজ ও মত অপেক্ষা শ্রেয় তিনি তাঁর এক কবিতায় বলেছেন
إذا ما أصاب العبد في بعض فعله        فما الفضل إلا للذي هو آمره
وإن أخطأ الحر الأبي فإنه        لأفضل من عبد تهون مصادره
(যদি কোনো দাস কোনো ভালো কাজ করে ফেলে, তাতে তার কোনো কৃতিত্ব নেই; বরং কৃতিত্ব তার যে মনিব তাকে ওই কাজের আদেশ দিয়েছে তাই কোনো স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি যদি কোনো ভুল করে ফেলে, সে ওই দাস ও ভৃত্য অপেক্ষা উত্তম যে অন্যের মর্জির অধীনস্থ)
 
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

Thursday 17 March 2022

আবুল ফারাজ আল-আস্ফাহানীঃ আশআব ও তাঁর কৃপণ বন্ধু


 
আশ্‌আব ও তাঁর কৃপণ বন্ধু
আবুল্‌ ফারাজ আল্‌-আস্ফাহানী
 
আশ্‌আব[1] বর্ণনা করেছেন, বলেছেনআমির বুন্‌ লুয়াই বংশের এক ব্যক্তি মদিনার শাসক নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত কৃপণ এবং চরম সংকটময় জীবন যাপনে অভ্যস্থ। সেই সাথে আমার প্রতি ভীষণই দুর্বল, সবই আল্লাহ্‌র কৃপা, দিনরাত আমার খোঁজ করতেন, আমাকে সঙ্গে রাখতেন। আমি কখনো তাঁর থেকে দূরে কোথাও চলে গেলে বা পালিয়ে গেলে একেবারে পুলিশ নিয়ে আমার বাড়ি হাজির হতেন। আমি যদি অন্য কোনো ব্যক্তির কাছে থাকতাম, তাঁর কাছ থেকে আমাকে ডেকে পাঠাতেন। অতঃপর আমাকে অনুরোধ করতেন, আমি যেন তাঁকে মজার মজার গল্প শোনাই, তাঁকে একটু হাসাই, তাঁর মনোরঞ্জন করি। তবে একবার আরম্ভ করলে আমি আর চুপ হওয়ার সুযোগ পেতাম না, না তিনি ঘুমোতে যেতেন, না আমাকে কিছু খেতে দিতেন আর না কোনো পারিশ্রমিক দিতেন। ফলে আমি তাঁর জন্য চরম বিপদে পড়েছিলাম এবং ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিলাম। এরই মধ্যে হজ্জের মরসুম চলে আসলো। তিনি আমাকে বললেনআশ্‌আব, আমার সাথে (হজ্জে) চলো। আমি বললামআমার মা বাবা আপনার প্রতি উৎসর্গ হোক! আমি অসুস্থ, তাছাড়া এবার আমার হজ্জের কোনো পরিকল্পনা নেই। তিনি বললেনতুমি যাবে না, তোমার বাপ যাবে।      
 
আরও বললেননিঃসন্দেহে কাবা অগ্নিগৃহ, যদি তুমি আমার সাথে না যাও তাহলে আমি তোমাকে আমার ফিরে আসা পর্যন্ত কারাগারে বন্দী করে রাখবো। ফলে আমি তাঁর সাথে বেরোতে বাধ্য হলাম। চলতে চলতে আমরা এক জায়গায় অবতরণ করলাম। তিনি জাহির করলেন, তিনি রোজা রেখেছেন। তারপর আমি ব্যস্ত হয়ে পোড়া পর্যন্ত তিনি ঘুমোতে যাওয়ার ভান করতে লাগলেন। অতঃপর উঠে পাথেয়তে যা কিছু ছিল সবই খেয়ে ফেললেন। এবং তাঁর দাসকে আদেশ দিলেন, আমাকে লবণ দিয়ে দুটো রুটি খাওয়ানোর। আমি ফিরে এলাম, আমি জানতাম, তিনি রোজা আছেন, মাগ্‌রিবের (সূর্যাস্তের) অপেক্ষা করতে লাগলাম, তাঁর সাথে আমিও ইফ্‌তার (নাশ্তা) করবো। অতঃপর যখন মাগ্‌রিবের নামাজ সম্পন্ন হল, আমি তাঁর দাসকে জিজ্ঞেস করলামখাবারে কী কী আছে? সে বললতিনি তো অনেক আগেই খেয়ে নিয়েছেন। জিজ্ঞেস করলামতিনি রোজা ছিলেন না? বললনা। বললামআমি কি তাহলে না খেয়ে থাকবো! বললনা, না। তিনি আপনার জন্য খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। আপনি খেয়ে নিন। অতঃপর সে আমাকে দুটো রুটি এবং একটু লবণ বের করে দিলো। আমি তাই খেলাম। কিন্তু ক্ষুধার জ্বালায় প্রাণ প্রায় ওষ্ঠাগত। অতঃপর সকালে আমরা আবার যাত্রা আরম্ভ করলাম। দীর্ঘক্ষণ চলার পর এক জায়গায় অবতরণ করলাম।
 
অবতরণ করে তিনি তাঁর দাসকে বললেনযাও আমাদের জন্য এক দিরহাম দিয়ে মাংস কিনে আনো। সে কিনে আনল। তিনি বললেনআমাদের জন্য কিছুটা কাবাব বানাও। সে তাই করলো। তিনি তা খেলেন। তারপর হাঁড়ি চাপাল। যখন হাঁড়ির মাংস টগবগ করে ফুটতে লাগলো, বললেনআমার জন্য এক অঞ্জলি মাংস বার করো। সে তাই করলো। তিনি পুরোটা খেলেন। তারপর বললেনএবার তাতে একটু লঙ্কা ও লবণগুড়ো মেশাও এবং তার একটু আমাকে দাও। সে তাই করলো। তারপর তিনি বললেনএবার তাতে মশলা মিশিয়ে আমাকে দাও। সে তাই করলো। আমি বসে বসে সবই দেখছিলাম। তিনি একবারও আমাকে ডাকলেন না। যখন তাঁর খাওয়াদাওয়া শেষ হল, দাসকে বললেনএবার আশ্‌আবকে খাওয়াও। এবং আমার দিকে দুটো রুটি ছুঁড়ে দিলেন। তা নিয়ে আমি হাঁড়ির কাছে গেলাম। দেখলাম, তাতে হাড় ও ঝোল বাদে আর কিছুই নেই। আমি তা-ই দিয়ে রুটি দুটো খেলাম।   
 
তারপর তিনি তাঁর একটা থলে বার করলেন। তাতে কিছু ড্রাই ফ্রুটস ছিল। সেখান থেকে এক মুঠ নিয়ে প্রায় সবটাই খেয়ে ফেললেন। শুধু কটা খোসা যুক্ত বাদাম অবশিষ্ট ছিল। এবার তাঁর আর কোনো বাহান খাটল না, বাধ্য হয়ে তা আমার দিকে ছুঁড়ে দিলেন। আর বললেনআশ্‌আব তুমি এটা খেয়ে নাও। আমি তার থেকে একটা বাদাম ভাঙ্গতে গেলাম; কিন্তু বাদামটা ভাঙল না, উল্টে আমার মাড়ির দাঁতের একটা অংশ ভেঙ্গে থুপ করে সামনে পড়লো। এরপর আমি বাদাম ভাঙ্গার জন্য একটা পাথরের সন্ধান করতে করতে একটু দূরে চলে গেলাম। একটা পাথর পেয়েও গেলাম। তা দিয়ে খুব জোরে বাদামটার উপর বাড়ি মারলাম, আল্লাহ্‌ই ভালো জানেন কত জোরে মেরেছিলাম, বাদামটা ছিটকে বহু দূরে চলে গেলো। আমি দ্রুত তার খুঁজে ছুটলাম। আমি খোঁজাখুঁজি করছিলাম এরই মধ্যে সেখানে মুস্‌আবের বংশধরেরা উঁচু ভূমির গা বেয়ে তাল্‌বিয়া পাঠ করতে করতে হাজির হলেন। তাঁদেরকে দেখে আমি চিৎকার করে উঠলামআমাকে বাঁচাও, আমাকে রক্ষা করো। আমি আল্লাহ্‌র আশ্রয় চাইছি, অতঃপর তোমাদের সাহায্য চাইছি। হে জুবায়েরে বংশধরেরা, আমাকে তোমাদের সাথে নিয়ে চলো, আমাকে উদ্ধার করো। আমার আওয়াজ পেয়ে তাঁরা ছুটে আসলো। আমাকে দেখে বললআশ্‌আব কী ব্যাপার, তুমি এখানে! এ কী অবস্থা তোমার?
 
বললামআমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো। আমাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করো। তাঁরা আমাকে তুলে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে গেলো। আমি হাত পা ছুড়তে লাগলাম, খিদে পেলে পাখীর ছানারা মাকে দেখে যেমনটা করে। তাঁরা জিজ্ঞেস করলোকী হয়েছে? বললামএখন কোনো কথা বলতে পারবো না। তোমাদের কাছে যা আছে আগে আমাকে কিছু খাওয়াও। আমি তিন ধরে না খেয়ে প্রায় মরতে চলেছি। তাঁরা আমাকে খাওয়ালেন। খেয়েদেয়ে খানিকটা প্রাণ ফিরে পেলাম। এরপর তাঁরা আমাকে কাঁধে করে তুলে নিয়ে গেলেন। তারপর আমাকে বললেনএবার বলো, কী হয়েছে? আমি আমার পুরো কাহিনীটা তাঁদেরকে শোনালাম। আমার ভেঙ্গে যাওয়া দাঁতটা দেখালাম। তাঁরা হো হো করে হাসতে লাগলো। কেউ কেউ তালি বাজাতে লাগলো। আর বললতুমি কীভাবে এই লোকের পাল্লায় পড়েছিলে? এ তো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বখিল। এর মতো ছোট মনের দ্বিতীয় কেউ নেই। অতঃপর আমি তাঁর থেকে মুক্তির প্রতিজ্ঞা করলাম। স্থির করলাম, যতদিন তিনি মদিনার শাসক থাকবেন আমি মদিনায় ফিরবো না। এবং তাঁর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেই আমি মদিনায় ফিরেছিলাম।
 
অনুবাদ- আব্দুল মাতিন ওয়াসিম  

 

 

أشعب والبخيل

أبو الفرج الأصفهاني

حدّث أشعب[2] فقال: ولي المدينة رجل من ولد عامر بن لؤي، وكان أبخل الناس وأنكدهم، وأغراه الله بي يطلبني في ليله ونهاره، فإن هربت منه، هجم على منزلي بالشرطة، وإن كنت في موضع بعث إلى من أكون معه أو عنده يطلبني منه، فيطالبني بأن أحدّثه وأضحكه، ثم لا أسكت ولا ينام، ولا يطعمني ولا يعطيني شيئاً، فلقيت منه جهداً عظيماً وبلاء شديداً. وحضر الحج، فقال لي: يا أشعب كن معي. فقلت: بأبي أنت وأمي، أنا عليل، وليس لي نية في الحج. فقال: عليه وعليه.

وقال: إن الكعبة بيت النار، لئن لم تخرج معي لأودعنك الحبس حتى أقدم. فخرجت معه مكرهاً، فلمّا نزلنا المنزل، أظهر أنه صائم ونام حتى تشاغلت، ثم أكل ما في سفرته وأمر غلامه أن يطعمني رغيفين بملح، فجئت وعندي أنه صائم، ولم أزل أنتظر المغرب أتوقع إفطاره، فلمّا صُليتْ المغرب قلت لغلامه: ما يُنتظر بالأكل؟ قال: قد أكل منذ زمان؟ قلت: أولم يكن صائماً؟ قال: لا! قلت: أفأطوي أنا. قال: قد أعدّ لك ما تأكله فكل، وأخرج إليّ الرغيفين والملح، فأكلتهما، وبتّ ميتاً جوعاً، وأصبحت فسرنا حتى نزلنا المنزل.

فقال لغلامه: ابتع لنا لحماً بدرهم، فابتاعه، فقال: كبّب لنا قطعة، ففعل، فأكله ونصب القدر، فلما نغرت. قال: أغرف لي منها قطعاً ففعل، فأكلها، ثم قال: أطرح فيها دقة وأطعمني منها، ففعل، ثم قال: ألق توابلها وأطعمني منها، ففعل، وأنا جالس أنظر إليه لا يدعوني؟ فلمّا استوى اللحم كله قال: يا غلام أطعم أشعب. ورمى إليّ برغيفين. فجئت إلى القدر وإذا ليس فيها إلا مرق وعظام، فأكلت الرغيفين.

وأخرج له جراباً فيه فاكهة يابسة، فأخذ منها حفنة فأكلها، وبقي في كفه لوز بقشره، ولم يكن فيه حيلة، فرمى به إليّ وقال: كل هذا يا أشعب .فذهبت أكسر واحدة منها، فإذا بضرسي قد انكسرت منه قطعة فسقطت بين يدي، وتباعدت أطلب حجراً أكسره به، فوجـدته فضربت بـه لـوزة، فطفـرت يعلم الله مقدار رمية حجر، وعدوت في طلبها، فبينما أنا كذلك إذ أقبل بنو مصعب يلبون بتلك الحلوق الجهورية، فصحت بهم الغوث الغوث، العياذ بالله وبكم، ياآل الزبير ألحقوني أدركوني. فركضوا إليّ فلما رأوني قالوا: أشعب، مالك؟ ويلك!

قلت: خذوني وتخلصوني من الموت. فحملوني معهم، فجعلت أرفرف بيدي، كما يفعل الفرخ إذا طلب الزق من أبويه. فقالوا: ما لك ويلك! قلت: ليس هذا وقت الحديث، زقّوني مما معكم، فقد متّ  ضرا وجوعا منذ ثلاث. قال: فأطعموني حتى تراجعت نفسي، وحملني معهم في محمل ثم قالوا: أخبرنا بقصتك. فحدثتهم وأريتهم ضرسي المكسورة، فجعلوا يضحكون ويصفقون. وقالوا: ويلك من أين وقعت على هذا؟! هذا من أبخل خلق الله وأدنئهم نفسا. فحلفت بالطلاق أني لا أدخل المدينة ما دام بها سلطان. فلم أدخلها حتى عُزل.  


[1] আশ্‌‘আব জুবায়ের তনয়, প্রকৃত নাম শুয়া’য়েব, উপনাম আবুল ‘আলা, মায়ের নাম উম্মুল জালান্দাহ। মদিনায় প্রতিপালিত। ১৫৪ বছরের দীর্ঘ সময় অতিক্রম করে খলিফা আল-মাহদির আমলে পৃথিবী ত্যাগ করেন । তাঁকে ঘিরে সমাজে প্রচলিত রয়েছে অনেক মজার ও হাস্যরসিক গল্প। তাঁর এই গল্পটি সাহিত্যিক আবুল্‌ ফারাজ আল্‌-আস্ফাহানী কর্তৃক রচিত কিতাবুল্‌ আগানী হতে সংকলিত।  

[2] هو أشعب بن جبير. واسمه شعيب، وكنيته أبو العلاء وأمه أم الجلندح، ونشأ أشعب بالمدينة في دور آل أبي طالب، وكفلته وتولت تربيته عائشة بنت عثمان. وعمّر أشعب عمرا طويلا. وحكي عنه أنه قال: كنت مع عثمان رضي الله عنه يوم الدار لما حصر، فلما جرد مماليكه السيوف ليقاتلوا كنت فيهم، فقال عثمان: من أغمد سيفه فهو حر. فلما وقعت في أذني كنت والله أول من أغمد سيفه فعتقت. وكانت وفاته في أيام المهدي، بعد سنة أربع وخمسين ومائة، ولأشعب نوادر مستظرفة وحكايات مستحسنة، منها هذه. وأخذ هذا من كتاب الأغاني لأبي الفرج الأصبهاني.

Wednesday 9 March 2022

আহমাদ বিন হুসাইন আল-মুতানাব্বীঃ রাজমাতার মৃত্যুতে শোক জ্ঞাপন


রাজমাতার মৃত্যুতে শোক জ্ঞাপন

আহ্‌মাদ বিন্‌ হুসাইন আল্‌-মুতানাব্বী 

نُعِدّ المَشرَفيّةَ والعَوالي                      وتَقْتُلُنا المَنُونُ بِلا قِتالِ

আমরা (যুদ্ধের জন্য) তরবারি বর্শা প্রস্তুত করে রেখেছি। অথচ মৃত্যু (অর্থাৎ সাইফুদ্দৌলার মায়ের মৃত্যু) কোনো রকমের যুদ্ধ ছাড়াই আমাদেরকে হত্যা (ও পরাজিত) করেছে

ونَرْتَبِطُ السّوابِقَ مُقرَباتٍ                 وما يُنْجينَ مِنْ خبَبِ اللّيالي

আমরা উৎকৃষ্ট মানের দ্রুতগামী ঘোড়াগুলিকে সদাপ্রস্তুত রেখেছি, কিন্তু রাতের চক্রান্ত থেকে সেই ঘোড়াগুলো (আমাদেরকে) বাঁচাতে পারেনি

ومَنْ لم يَعشَقِ الدّنيا قَديماً                ولكِنْ لا سَبيلَ إلى الوِصال

এমন কে আছে যে পৃথিবীকে ভালোবাসেনি, আদিকাল থেকেই? (কোথাও কেউ নেই, সকলেই পৃথিবীকে ভালোবেসে অনন্ত কাল বাঁচতে চায়) কিন্তু এখানে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে (অনন্ত কাল বেঁচে) থাকার কোনও উপায় নেই।

نَصيبُكَ في حَياتِكَ من حَبيبٍ          نَصيبُكَ في مَنامِكَ من خيَالِ

(শোনো) জীবনে তোমার বন্ধুর কাছে তোমার প্রাপ্যাংশ ততটুকুই বা ঠিক তেমনই, যেমনটা তোমার স্বপ্নে কল্পনার থেকে তোমার প্রাপ্যাংশ (অর্থাৎ স্বপ্ন ভেঙ্গে গেলে যেমন যাবতীয় কল্পনার ইতি ঘটে ঠিক তেমনই জীবনেরও অবস্থা, চোখ বন্ধ হলেই সব শেষ)

رَماني الدّهرُ بالأرزاءِ حتى         فُؤادي في غِشاءٍ مِنْ نِبالِ

যুগ আমার প্রতি বহু বিপদ নিক্ষেপ করেছে (অর্থাৎ নানা ভাবে আমার পরীক্ষা নিয়েছে); আর (এখন) এমন অবস্থা যে, আমার হৃদয় তীরের আচ্ছাদনের মধ্যে অবস্থান করছে।

فَصِرْتُ إذا أصابَتْني سِهامٌ         تكَسّرَتِ النّصالُ على النّصالِ

সুতরাং তীরগুলি যখন আমাকে আঘাত করছিল আমি এমন (লৌহমানবে পরিণত) হয়ে গেছিলাম যে, ফলার উপর ফলা পড়ে তা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে পড়ছিল (অর্থাৎ বিপদ ও তীরের সেই আচ্ছাদন ভেদ করে নতুন কোনও বিপদ বা তীর আর আমাকে ছুঁতে পারেনি)

وهانَ فَما أُبالي بالرّزايا        لأنّي ما انْتَفَعتُ بأنْ أُبالي

অতঃপর (সময়ের প্রবাহে) সেই আঘাত দুর্বল হয়ে পড়েছে, আর তাই (ইদানীং) আমি দুর্যোগকে কোনোরকম গ্রাহ্য করি না, কেননা দুর্যোগের পরওয়া করে আমি কোনও উপকার পাইনি

وهَذا أوّلُ النّاعينَ طُرّاً     لأوّلِ مَيْتَةٍ في ذا الجَلالِ

সকল মৃত্যু-সংবাদ প্রদানকারীদের মধ্যে এই ব্যক্তিই প্রথম (অর্থাৎ আমিই প্রথম এই ব্যথাতুর সংবাদ পরিবেশন করছি), মন আভিজাত্যের মধ্যে প্রথম মৃতার মৃত্যু-সংবাদ (অর্থাৎ এমন আভিজাত্য এবং সম্মান ও মর্যাদা সহ মৃত্যু বরণ করেছেন আমাদের সভ্যতার ইতিহাসে দ্বিতীয় কেউ নেই)  

كأنّ المَوْتَ لم يَفْجَعْ بنَفْسٍ      ولم يَخْطُرْ لمَخلُوقٍ بِبالِ

(সবার অবস্থা এমনই বিহ্বল যে) যেন এর পূর্বে কোনও আত্মাকেই মৃত্যু আতঙ্কিত করেনি (অর্থাৎ এর পূর্বে কোনও মৃত্যুই ঘটেনি) এবং সৃষ্টিকুলের কারও অন্তরেইতিপূর্বে তা উদয় হয়নি।

صَلاةُ الله خالِقِنا حَنُوطٌ      على الوَجْهِ المُكَفَّنِ بالجَمَالِ

(অতঃপর কবি রাজমাতার জন্য দু’আ ও প্রার্থনা করে বলছেন,) আমাদের স্রষ্টা মহান আল্লাহ্‌র করুণা ও অনুগ্রহ হানূত সুগন্ধি রূপে (যা মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হয়) বর্ষিত হোক সৌন্দর্যের কাফনে মোড়া রাজমাতার উপর।

على المَدْفونِ قَبلَ التُّرْبِ صَوْناً      وقَبلَ اللّحدِ في كَرَمِ الخِلالِ

(অনুগ্রহের হানূত বর্ষিত হোক) সেই সমাহিত ও সমাধিস্থ ব্যক্তির প্রতি, কবরের পূর্বে তিনি (এক অদ্ভুত) সুরক্ষার মধ্যে অবস্থান করতেন এবং লাহাদ কবরে শায়িত হওয়ার পূর্বে এক মর্যাদাপূর্ণ অবস্থায় বিরাজমান ছিলেন!

فإنّ لهُ ببَطْنِ الأرْضِ شَخْصاً       جَديداً ذِكْرُناهُ وهْوَ بَالِ

এই ভূপৃষ্ঠে নিঃসন্দেহে তাঁর এমন এক উত্তরসূরি ব্যক্তি রয়েছেন, আমাদের যাকে স্মরণ করাই হচ্ছে এক নতুন ব্যাপার, যদিও তিনি আমাদের অত্যন্ত পুরাতন ও চেনা এক ব্যক্তিত্ব

و ما أحد يُخلّد في البرايا     بل الدنيا تؤول إلى زوال

(শোনো,) এই সৃষ্টিজগতে কেউই স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে পারে না, বরং এই পার্থিব জগত নিজেই (ধীরেধীরে) ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয়ে চলেছে।

أطابَ النّفسَ أنّكِ مُتِّ مَوْتاً       تَمَنّتْهُ البَوَاقي والخَوَالي

(আপনার মৃত্যু আমাদের সবার জন্য অত্যন্ত হৃদয় বিদারক, তবে) এই একটি বিষয় মনকে আনন্দ দিয়েছে যে, আপনি এমন (মর্যাদাপূর্ণ ও সম্মানজনক অবস্থায়) মৃত্যু বরণ করেছেন যার কামনা পূর্ববর্তী লোকেরাও করেছিল এবং পরবর্তী লোকেরাও করছে এবং (ভবিষ্যতেও) করবে

وزُلْتِ ولم تَرَيْ يَوْماً كَريهاً       تُسَرّ النّفسُ فيهِ بالزّوالِ

আপনি মৃত্যু বরণ করেছেন, তবে আপনি (যতদিন বেঁচে ছিলেন) কোনও মন্দ দিন প্রত্যক্ষ করেননি, যেই মন্দ দিনের বিলুপ্তিতে আত্মা তৃপ্তি লাভ করে (মনে ও মুখে প্রশান্তির আভা ছড়িয়ে পড়ে)

رِواقُ العِزّ حولك (فَوْقَكِ) مُسْبَطِرٌّ       ومُلْكُ عَليٍّ ابنِكِ في كمَالِ

(আর এখন) মর্যাদা ও সম্মানের পর্দা আপনার চতুর্দিকে বিস্তৃত ও বিরাজমান। এবং আপনার পুত্র আলী (অর্থাৎ সাইফুদ্দৌলাহ)-এর সাম্রাজ্য ও শাসনা ব্যবস্থা পূর্ণতার মধ্যে বিরাজ করছে।

سَقَى مَثْواكِ غادٍ في الغَوادي       نَظيرُ نَوَالِ كَفّكِ في النّوالِ

(অতঃপর কবি প্রার্থনা করে বলছেন,) প্রভাতে আগমনকারী প্রভাতকালীন মেঘ আপনার কবরকে সিক্ত করুক, যে মেঘের বর্ষণ সকল দানের মধ্যে আপনার হাতের দানের মতো (পর্যাপ্ত এবং উপাদেয়) 

لِساحيهِ على الأجداثِ حَفْشٌ       كأيدي الخَيلِ أبصَرتِ المَخالي

(এবং) আপনার কবরের উভয় পাশের কবরগুলির উপর প্রচুর বর্ষণ হোক, যে কবরগুলি ওই ঘোড়ার হাতের ন্যায় (আগ্রহী ও অপেক্ষমাণ), যে ঘোড়াটি তার খাবারের থলি দেখতে পেয়েছে।

أُسائِلُ عَنكِ بعدَكِ كلّ مَجدٍ      وما عَهدي بمَجدٍ عَنكِ خالِ

আমি আপনার মৃত্যুর পর প্রতিটি মহত্বকে আপনার সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করি, কারণ আমার প্রতিটি মর্যাদা সম্পন্ন অবস্থানে আপনার অবদান রয়েছে (আমার কোনও মহৎকাল আপনার করুণা ও অনুগ্রহ শূন্য নয়)

يَمُرّ بقَبرِكِ العافي فيَبكي      ويَشغَلُهُ البُكاءُ عَنِ السّؤالِ

যে ব্যক্তি ভিক্ষা প্রবৃত্তি হতে বিরত ও দূরে থাকে, সেও যখন আপনার কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করে, (আপনার কবর দেখে এবং আপনার কথা স্মরণ করে) কেঁদে ফেলে। আর তার এই কান্নাকাটি তাকে কোনও কিছু জিজ্ঞাসা করা হতে নিবৃত রাখে

وما أهداكِ لِلْجَدْوَى عَلَيْهِ       لَوَ انّكِ تَقدِرينَ على فَعَالِ

অথচ তাঁর প্রতি অনুগ্রহ ও অনুকম্পা করার ব্যাপারে আপনাকে কেউ উৎসাহিত করেনি, এমনকি দিশাও দেয়নি (তবুও আপনি তাঁর প্রতি অনুগ্রহ করেছেন এবং প্রচুর করেছেন); হায় যদি আপনি (আজও) তেমন অনুগ্রহ করতে সক্ষম হতেন (তাহলে কতই না ভালো হত)!

بعَيشِكِ هلْ سَلَوْتِ فإنّ قَلبي      وإنْ جانَبْتُ أرْضَكِ غيرُ سالِ

আপনার জীবনের শপথ, আচ্ছা আপনি কি (আপনার বর্তমান জীবনকে নিয়ে) সন্তুষ্ট?! যদিও আমি আপনার ভূমির (অর্থাৎ কবরের) পাশে আছি, তবে আমি অসন্তুষ্ট এবং আমার অন্তর অতৃপ্ত।

نَزَلْتِ على الكَراهَةِ في مَكانٍ     بَعُدْتِ عنِ النُّعامى والشَّمالِ

(আমরা জানি,) আপনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও এমন এক স্থানের অতিথি হয়েছেন (বা এমন এক জায়গায় অবতরণ করেছেনে), যেখানে (গিয়ে) আপনি দক্ষিনা বাতাস ও উত্তুরে বায়ুর (কোমল ও স্নিগ্ধ স্পর্শ) হতে বিদূরিত (ও বঞ্চিত)

تُحَجّبُ عنكِ رائحَةُ الخُزامَى     وتُمْنَعُ منكِ أنْداءُ الطِّلالِ

(ওই জায়গায় অবতরণ করার ফলে আজ) টিউলিপ ফুলের (মনমাতানো সৌরভ ও) সুগন্ধ আপনার থেকে বহু দূরে এবং হালকা শিশির বিন্দুও আপনার নিকট পৌঁছতে বাধাপ্রাপ্ত (কোনোটাই আপনার নিকট পৌঁছচ্ছে না)।

بدارٍ كلّ ساكِنِها غَريبٌ     طويل الهجر (بَعيدُ الدّارِ) مُنْبَتُّ الحِبالِ

(সেখানে) আপনি এমন এক গৃহে (অবস্থান করছেন), যেখানকার প্রত্যেক অধিবাসীই (আপনার) অপরিচিত, (প্রত্যেকই) দীর্ঘ অনাবাসী এবং (সাক্ষাৎ ও মিলনের সকল) উপায়-উপকরণ হতে বিচ্ছিন্ন।

حَصانٌ مثلُ ماءِ المُزْنِ فيهِ     كَتُومُ السّرّ صادِقَةُ المَقالِ

তিনি (অর্থাৎ রাজমাতা) একজন সতীসাবিত্রী ও পুণ্যময়ী নারী। তাঁর মধ্যে মেঘের জলের (অর্থাৎ বৃষ্টির জলের মতো স্বচ্ছতার) দৃষ্টান্ত বিদ্যমান। তিনি রহস্য গোপনকারিনী ও সত্যবাদিনী (অর্থাৎ তিনি কারও গোপন বিষয় জনসমক্ষে প্রকাশ করেন না এবং সর্বদা সত্য কথা বলেন)

يُعَلّلُها نِطاسِيُّ الشّكايَا     وواحِدُها نِطاسِيُّ المَعَالي

যারা (অত্যন্ত জটিল ও নানা ধরণের দুরারোগ্য) ব্যাধির চিকিৎসা করেন তাঁরাই তাঁর (অর্থাৎ রাজমাতার অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে) চিকিৎসা করেন। আর তাঁদের মধ্যে একজন হলেন জ্ঞান ও মর্যাদার চিকিৎসক (আর তিনি হলেন মহামান্য ও সুপণ্ডিত ব্যক্তিত্ব রাজমাতার সুযোগ্য উত্তরাধিকারী সাইফুদ্দৌলাহ)

إذا وَصَفُوا لهُ داءً بثَغْرٍ     سَقاهُ أسِنّةَ الأسَلِ الطِّوالِ

যখন জনসাধারণ তাঁর (অর্থাৎ সাইফুদ্দৌলাহ্‌র) সম্মুখে কোনো সীমান্ত ব্যধি (অর্থাৎ সীমান্ত বিদ্রোহ) সম্পর্কে বর্ণনা করে, তখন তিনি তাদেরকে (অর্থাৎ ওই সীমান্ত অঞ্চলের বিদ্রোহীদেরকে) দীর্ঘ ও তীক্ষ্ণ বর্শার ফলা পাণ করান (অর্থাৎ তাদেরকে পরাজিত করে শাস্তি দেন এবং তাদের বিদ্রোহকে কঠোর হাতে দমন করেন)

ولَيسَتْ كالإناثِ ولا اللّواتي      تُعَدّ لها القُبورُ منَ الحِجالِ

তিনি (অর্থাৎ রাজমাতা আর পাঁচটা) সাধারণ মহিলাদের মতো ছিলেন না আর না তিনি ওই সমস্ত মহিলাদের মতো, যাদের সমাধিকে (তাদের জন্য) বাসরঘরের আস্তরণের মতো গণ্য করা হয়।

ولا مَنْ في جَنازَتِها تِجارٌ     يكونُ وَداعُها نَفضَ النّعالِ

আর না তিনি এমন কোনো নারী ছিলেন, যার জানাযাহ্‌ ও বিদায় যাত্রায় এমন বণিকদল উপস্থিত হয় যাদের কাছে জানাযাহ্‌র বিদায় দেওয়াটা জুতো ঝাড়ার মতো (অত্যন্ত লঘু ও সাধারণ বিষয়, অর্থাৎ রাজমাতার জানাযায় যারাই শামিল ও শরীক হয়েছে, কী বণিক কী সাধারণ মানুষ সকলেই কেঁদে বিহ্বল হয়ে পড়েছে)

مَشَى الأمَراءُ حَوْلَيها حُفاةً     كأنّ المَرْوَ من زِفِّ الرّئَالِ

তাঁর (অর্থাৎ রাজমাতার জানাযায় তাঁর শববাহী খাটিয়ার) উভয় পাশে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ (অর্থাৎ গভর্নর, সেনাধ্যক্ষ ও শাসক সকলেই) খালি পায়ে হাঁটছিলেন; আর (ওই যাত্রাপথের) পাথরগুলি (তীক্ষ্ণ হওয়া সত্ত্বেও বিহ্বলতার কারণে) উট পাখির ছোটছোট পালকের মতো (মসৃণ মনে হচ্ছিল)

وأبْرَزَتِ الخُدورُ مُخَبّآتٍ     يَضَعْنَ النِّقْسَ أمكِنَةَ الغَوالي

(তাঁর অর্থাৎ রাজমাতার মৃত্যু শোকে বিহ্বল হয়ে সমাজের) পর্দাপরিহিতা মহিলা ও যুবতীরা (তাদের) লুকোনো জিনিসগুলি প্রকাশ করে ফেলেছিল; তাছাড়া তারা (তাদের শরীরের) মূল্যবান জায়গাগুলিতে (রাজমাতার মৃত্যু শোক প্রকাশ করতে) কালী লেপন করেছিল।

أتَتْهُنّ المُصيبَةُ غافِلاتٍ     فدَمْعُ الحُزْنِ في دَمعِ الدّلالِ

তাদের অজান্তেই তাদের উপর এক ভয়ানক দুর্যোগ আপতিত হয়েছিল; অতঃপর (তাদের) ভণিতার অশ্রুর মাঝেই দুঃখের অশ্রু নির্গত হতে লাগলো (অর্থাৎ তারা ছিল পেশায় কাঁদুনে, অর্থ লাভের লোভে কাঁদতে এসেছিলো, কিন্তু এসে যখন দেখল, রাজমাতা মারা গেছেন, তারা সত্যি সত্যিই কাঁদতে আরম্ভ করলো)।

ولوْ كانَ النّساءُ كمَنْ فَقَدْنا     لفُضّلَتِ النّساءُ على الرّجالِ

যাকে আমরা হারিয়েছি (অর্থাৎ রাজমাতা) নারী জাতি যদি তাঁর মতো (বা তাঁর সমতুল্য) হতো, তাহলে অবশ্যই নারীরা পুরুষদের উপর প্রাধান্য লাভ করতো।  

وما التأنيثُ لاسمِ الشّمسِ عَيبٌ     ولا التّذكيرُ فَخْرٌ للهِلالِ

আশ্‌-শাম্‌স (অর্থাৎ সূর্য) বিশেষ্যটির (আরবি ভাষায়) স্ত্রী লিঙ্গ হওয়াতে কোনও দোষ নেই; আর না আল্‌-হিলাল (অর্থাৎ চাঁদ) বিশেষ্যটির (আরবিতে) পুরুষ লিঙ্গ হওয়ার মধ্যে কোনও গৌরব আছে।

وأفجَعُ مَنْ فَقَدْنا مَن وَجَدْنا      قُبَيلَ الفَقْدِ مَفْقُودَ المِثالِ

সর্বাপেক্ষা দুঃখজনক ঘটনা হল এই যে আমরা (রাজমাতার মতো) একজন গুণী ব্যক্তিত্বকে হারালাম; তবে (তাঁকে) হারানোর পূর্বে আমরা যাকে পেয়েছি (অর্থাৎ রাজমাতার সুযোগ্য উত্তরসূরি সাইফুদ্দৌলাহ), তিনিও এক অতুলনীয় ও দৃষ্টান্তহীন ব্যক্তি।

يُدَفِّنُ بَعْضُنا بَعضاً وتَمْشِي     أواخِرُنا على هامِ الأوالي

(তাঁর মৃত্যুতে আমরা এতটাই বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম, মনে হচ্ছিল যেন) আমাদের এক অংশ অপর অংশকে সমাহিত করছে (বা আমরা নিজেদের একটা অংশকে সমাহিত করছি), আর আমাদের পরবর্তীরা পূর্ববর্তীদের মাথার খুলির উপর দিয়ে হাঁটছে।

وكَمْ عَيْنٍ مُقَبّلَةِ النّواحي     كَحيلٌ بالجَنادِلِ والرّمالِ

(আমাদের চারপাশে) এমন অনেক চক্ষু আছে যার পার্শ্বদ্বয় চুম্বনযোগ্য (অর্থাৎ তাঁরা মর্যাদাবান এবং অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তি, কিন্তু (আজ রাজমাতার মৃত্যু শোকে) তাঁদের চোখগুলি যেন প্রস্তর খণ্ড ও বালুরাশি দ্বারা সুরমা রঞ্জিত হয়েছে (অর্থাৎ অধিক কান্নাকাটির জন্য লাল হয়ে গেছে)।

ومُغْضٍ كانَ لا يُغْضِي لخَطبٍ     وبالٍ كانَ يَفكُرُ في الهُزالِ

(আমাদের চারপাশে আজ) অনেকে (রাজমাতার মৃত্যু শোকে) চোখ বুজে রয়েছে, অথচ তারা চরম বিপদের সময়েও চোখ বন্ধ করতো না। অনেকে আবার জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে, অথচ তারা কেবল দুর্বলতায় অমন উদ্বিগ্ন ও চিন্তাগ্রস্ত হতো।

أسَيْفَ الدّوْلَةِ اسْتَنجِدْ بصَبرٍ     وكيفَ بمِثْلِ صَبرِكَ للجِبالِ

হে সাইফুদ্দৌলাহ, আপনি ধৈর্য ও সহনশীলতার মাধ্যমে (আপনার প্রভুর নিকট) সাহায্য প্রার্থনা করুন। কেননা (আপনি অত্যন্ত ধৈর্যশীল, এমনকি) পাহাড়ও আপনার মতো ধৈর্যশীল নয়।

وأنتَ تُعَلّمُ النّاسَ التّعَزّي     وخوْضَ الموْتِ في الحرْبِ السِّجالِ

আপনিই তো লোকেদেরকে সান্ত্বনা লাভের শিক্ষা দেন (এবং তাদেরকে ধৈর্যধারণ করতে বলেন ও সহনশীল হতে উদ্বুদ্ধ করেন); আর (আপনিই তাদেরকে শিক্ষা দেন) তুমুল যুদ্ধে মৃত্যুকে অন্বেষণ করার।  

وحالاتُ الزّمانِ عَلَيكَ شتى     وحالُكَ واحدٌ في كلّ حالِ

যদিও আপানার বিরুদ্ধে কালের অবস্থান বিভিন্ন রকমের, কিন্তু আপনি (কী প্রতিকূল কী অনুকূল) সকল অবস্থায় একই রকম অটল ও আত্মপ্রত্যয়ী।

فلا غِيضَتْ بحارُكَ يا جَمُوماً     على عَلَلِ الغَرائبِ والدِّخالِ

হে (কল্যাণ ও দানশীলতার) ফল্গুধারা, আপনার দানের সাগর যেন শুকিয়ে না যায় বিদেশী ও স্বদেশীদের সংকট মোচনের সময় (যাতে সকলেই আপনাকে তাদের প্রয়োজনের সময় পাশে পায়, কারণ রাজমাতার পর আপনি ছাড়া তাদের খোঁজখবর নেওয়ার, পাশে দাঁড়ানোর আর কেউই নেই)।

رأيتُكَ في الّذينَ أرَى مُلُوكاً     كأنّكَ مُسْتَقيمٌ في مُحالِ

আমি আপনাকে ওই সমস্ত লোকেদের মধ্যে গণ্য করি, যাদেরকে আমি প্রকৃতার্থে সম্রাট মনে করি। কেননা আপনি অসাধ্য সাধনেসঠিক পন্থা অবলম্বন করে থাকেন।

فإنْ تَفُقِ الأنامَ وأنْتَ مِنهُمْ     فإنّ المسكَ بَعضُ دَمِ الغزالِ

আপনি সৃষ্টিকুলেরই একজন, তবে আপনি (এ সময়ের) সকল সৃষ্টির উপর প্রাধান্য লাভ করেছেন, ঠিক যেন কস্তূরী বা মৃগনাভি, যা হরিণের রক্তেরই একটা অংশ (কিন্তু অন্যান্য সকল অংশের চেয়ে মূল্যবান)।

অনুবাদ- আব্দুল মাতিন ওয়াসিম