Saturday 2 October 2021

জাহেলি বা প্রাক-ইসলামী আরবি কবিতাঃ স্বরূপ, সংরক্ষণ ও বৈশিষ্ট

 

জাহেলি বা প্রাক্‌-ইসলামী আরবি কবিতাঃ স্বরূপ, সংরক্ষণ ও বৈশিষ্ট
 
জাহেলি বা প্রাক্‌-ইসলামী কবিতা
ইসলামের আবির্ভাব কালে আরবে বিদ্যমান ছিল জাহেলিয়াতের অন্ধকার। জাহেলিয়াত শব্দটির মূল হল জাহাল (جهل), এর আভিধানিক অর্থ মূর্খতা, অজ্ঞতা ও রূঢ়তা ইত্যাদি। আল্‌-‘আস্‌রুল্‌ জাহেলি বা জাহেলি যুগ-এর মধ্যে জাহাল শব্দটি হিল্‌ম (حلم)-এর বিপরীত বলে সাহিত্যিকগন উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ এখানে জাহ্‌ল শব্দের অর্থ মূর্খতা নয় বরং এর অর্থ তমসা, অজ্ঞতা, বর্বরতা ও কুসংস্কার । ৫০০ থেকে ৬১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালকে আল্‌-আইয়াম আল্‌-জাহেলীয়াহ্‌ বা জাহেলি যুগ বলা হয়।
 
জাহেলি যুগের আরবদের মাঝে সুস্থ ও উন্নত জীবন যাত্রা, সুসংহত ও সুশৃংখল শাসন ব্যবস্থা, নীতি ও মানবতাবোধ এবং ধর্মীয় চেতনার অভাব থাকলেও তাঁরা ছিলেন সাহিত্যামোদী। সাহিত্য চর্চাই ছিল তাঁদের বিনোদনের মূল উপকরণ। তাঁরা খুব দক্ষ সাহিত্যিক ছিলেন। এমন কি জাহেলি যুগের শ্রেষ্ঠ কবি ইম্‌রাউল কায়েসকে প্রফেসর আর এ নিকলসন “Shakespeare of the Arabs” বলে উল্লেখ করেছেন
 
পৃথিবীর সম্মৃদ্ধ ভাষা গুলোর মধ্যে আরবি একটি অন্যতম ভাষা। আরবি জাহেলি যুগের আরবদের সাহিত্য চর্চার প্রধান ভাষা। জাহেলি যুগের আরব জাতি যুদ্ধ বিগ্রহ, সামাজিক অনাচার-অবিচারে লিপ্ত থেকে ইতিহাসের পাতা কলংকিত করলেও পক্ষান্তরে তারা আরবি ভাষার চর্চা করে আরব জাতির সংস্কৃতির ইতিহাসে এক অপূর্ব উজ্জল অনুচ্ছেদের সংযোজন করেছে। সাবলীলতার অধিকারী আরবি ভাষায় রচিত প্রাচীন কবিদের কবিতায় ব্যাপক শব্দ প্রকরণ এবং বাক্য বিন্যাস, বিস্ময়কর ভাব সৃষ্টি ও অর্থবৈচিত্রের অসাধারণ ক্ষমতা যে ভাবে পরিলক্ষিত হয় অন্য কোন ভাষায় সেরূপটি পাওয়া যায় না। প্রথমত কাব্যের দ্বারাই তাদের সাহিত্যিক প্রতিভার বিকাশ ঘটেছিলমুহালহিল বিন রাবীয়া ছিলেন জাহেলি যুগের প্রথম কবি।
 
জাহেলি যুগে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের একাধিক কবি ছিলেন। তাঁরা তাদের প্রচলিত জীবনধারা সম্পর্কে অধিক ওয়াকিবহাল ছিলেন। কবিতার মাধ্যমে তারা স্বাধীন ভাবে নিজেদের মনোভাব ব্যক্ত করতেন। আরব সামাজে কবিগণ সর্বত্র সম্মানিত ও পুরষ্কৃত হতেন। কোন পরিবারে কবির আবির্ভাব হলে পাশ্ববর্তী সপ্রদায় ও লোকজন ওই পরিবারকে শুভেচ্ছা জানাতেন এমনকি আনন্দে বিবাহোৎসবের ন্যায় ভোজের আয়োজন করা হতো। কারণ কবি তাদের সকল গৌরব রক্ষা করবেন, এবং কলংক অপনোদন করে মহৎ কার্যাদির দ্বারা চিরতরে তাদের যশ প্রতিষ্ঠিত করবেন।
 
প্রাচীন আরবি কবিতা দুই শ্রেনীতে বিভক্ত। কিত্‌‘আ বা খণ্ড কবিতা এবং কাসীদা বা গীতিকবিতাকিত্‌‘আ বা খণ্ড কবিতাগুলি সাধারণতঃ কাসীদার কিয়দাংশ পৃথক করে বর্ননা করা, আবার কখনো কখনো ভিন্ন কবিতাও হতো। যুদ্ধই এর প্রধান উপাদান ছিল। আর গীতি কবিতার ধারায় রচিত দীর্ঘ কবিতাগুলোকে কাসীদা হিসেবে অভিহিত করা হয়।  কাসীদাগুলি পঁচিশ পংক্তির কম বা একশ’র বেশী নয়। বিশেষ করে মু‘আল্লাকাতগুলি। সে সময়েরঅধিকাংশ কাসীদাই ছিল হিদা, হিজা, রাজাজ ও কাসাস কেন্দ্রীক।
 
হিদা বা কাফেলা-সঙ্গীত
উষ্ট্রের শকট চালকগনের মুখেই এ গান গীত হতো। গানের বিষয়বস্তু  সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না, প্রেম, বিরহ ইত্যাদি ছিলগানের সুর মাধুর্যে এমন ব্যাঞ্জনা ব্যাপ্ত ছিল যে, মরুভুমীতে দীর্ঘ  পথ পরিক্রমায় আরোহীরা ক্লান্তিবোধ করত না এমনকি উষ্ট্রের পদচালনায় গানের অনুপ্রেরণা ছিল অতিমাত্রায়।
 
হিজা বা দ্বন্দ্ব-সঙ্গীত
গোত্রে গোত্রে লড়াই ছিল আরবদের নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। এ লড়াইয়ে অনুপ্রেরণার উদ্দেশ্যে রচিত ও গীত হতো এ হিজা কবিতালড়াইয়ে জিততে পারলে কবিকে পুরষ্কৃত করা হতো। এই বিশ্বাসে যে কবির কবিতায় রয়েছে অধিকমাত্রায় সারবস্তু। সুতরাং তিনি শ্রেষ্ট কবি।  ব্যাঙ্গধর্মীতা হিজার অন্যতম বৈশিষ্ট।
 
রাজাজ বা রণ-সঙ্গীত
রাজাজ ও হিজা প্রায় সমধর্মী। তবে তফাৎ এই যে রাজাজ এ প্রতীপক্ষীয় শৌর্য-বীর্য, সম্মান-খ্যাতি, এমন ভাবে কীর্তিত থাকত যে, প্রতিপক্ষীয় যোদ্ধারা তাদের স্বগৌরবের কথা স্মরণ রেখেই যুদ্ধ পরিচালনা করত। যুদ্ধ জয়ের অর্থ হলো তাদের রাজাজ অক্ষুন্ন রাখা।
 
কাসাস বা লোক-গীতি
কাহিনী-নির্ভর গীতি কবিতাই এর বিষয়বস্তু। কাসাস এর আভিধানিক অর্থ কেচ্ছা বা কাহিনী।
 
জাহেলি যুগের অসংখ্য কবি আরবি ভাষায় কবিতা রচনা করে গেছেন । তাঁদের রচিত কবিতা গুলি ছিল খুবই উন্নত মানের। তৎকালে রচিত গীতিকাব্যের সম্ভার আজও বিপুল ভাবে সমাদৃতকিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, যুদ্ধ বিগ্রহ ও কালের আবর্তনে আরবদের সেই বিশাল কাব্য ভাণ্ডারের খুব কমই আমাদের নিকট এসে পৌঁছেছে। এ সমস্ত গীতি কাব্য গুলি রাবী বা বর্ণনাকারীদের মাধ্যমে শত শত বৎসর ধরে বর্ণীত হয়ে এসেছেপরে আব্বাসীয় খলিফা মাহ্‌দীর শাসনামলে বিখ্যাত সংকলক হাম্মাদ আর্‌-রাবিয়া এগুলোকে মুআল্লাকা নাম দিয়ে গ্রন্থাকারে সংকলন করেন
 
মুআল্লাকা শব্দটির অর্থ ঝুলন্ত। এসব গীতি কবিতাকে মুআল্লাকা বা  ঝুলন্ত গীতিকাব্য বলার কারণ হল, প্রাক-ইসলামী যুগে কাবা ঘরের অনতি দূরে অবস্থিত নাখলা ও তায়েফের মধ্যবর্তী উকাজ নামক স্থানে প্রতি বৎসর বিরাট একটা মেলা বসতএতে ঘোড়দৌড়, জুয়া খেলা, নাচ গান সহ কবিতা প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা থাকত। বার্ষিক সাহিত্য উৎসবে দেশের বিভিন্ন কবিগণ স্বরচিত কবিতা পাঠ করে শুনাতেনবিচারকদের বিচারে যে কবিতা প্রথম স্থান অধিকার করত তা মিসরীয় মসৃণ কাপড়ে স্বর্ণাক্ষরে লিখে কাবা গৃহের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা হত যাতে হজ্জ মরসুমে এবং সারা বছর কাবা গৃহে আগমনকারী দর্শকরা তা পড়তে পারে
 
মুআল্লাকার প্রধান বৈশিষ্ট হচ্ছে তাশবীব। অর্থাৎ মুআল্লাকার ভুমিকায় কবিরা তাদের অতীত কালের কোন এক প্রিয়ার বাড়ির ভগ্নাবশেষের নিকটে দাড়িয়ে তার প্রিয়তমার বিদায় ও বিরহের কথা স্মরণ করে আকুল হয়ে পড়ে। আরবদের বেদুঈন জীবনের সাথে এ জাতীয় ভুমিকা সত্যিই চমকপ্রদ। প্রায় প্রতিটি কাসীদাই প্রেয়সী ও তার পরিত্যক্ত বাসু্তভিটার স্মৃতিচিহ্ন দিয়ে আরম্ভ হয়তারপর কবি তার প্রিয়তমার প্রতি প্রেম নিবেদন, বিরহ ব্যাথা ও প্রিয়তমার সৌন্দর্য বর্ণনা দেনঅতঃপর বন্য গাভী, বন্য গর্ধব ও উটপাখীর সাথে তুলনা করেন। অবশেষে আত্মপ্রশংসা বা স্ববংশের প্রশংসা, ভ্রমণ, যুদ্ধ, অথবা আমোদ প্রমোদের দৃশ্য, ব্যঙ্গ, কুৎসা ইত্যাদি বর্ণনা করেন।
 
বিখ্যাত এসব গীতিকাব্যের রচয়িতা সাত জন এজন্য তাকে মুআল্লাকাতুস সাব্‌আ বলা হয়। মুআল্লাকাতুস সাব্‌আর কবিরা হলেন— ইম্‌রাউল কায়েস, তারাফা, যুহাইর, লাবীদ বিন রাবীআ (রাঃ), আনতারা, আমর বিন কুলসূম এবং হারিস বিন হিল্লিযা। কেউ কেউ আরো তিন জন কবির নাম এর সাথে সংযোজন করেন। তাঁরা হলেন— নাবিগা, আশা ও ওবাইদ বিন আব্‌রাস। আর এভাবে মুআল্লাকার সংখ্যা দশে উপনীত হয়েছে। তাই একে  মুআল্লাকাতু আল-আশারা বলা হয়ে থাকে। এই কবিতাগুলি আরব জীবনের মূর্ত প্রতীক। জাহেলি যুগের আরবদের জীবনধারায় মুআল্লাকার একটি বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে মুআল্লাকা ছাড়াও জাহেলি যুগের কাব্যসংকলনের মধ্যে মুফাদদালিয়াত ও হামাসা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
 
হাতেম তাই, উমাইয়া ইবনু আবিস্‌-সালত, তাআব্বতা শররান, শানফারা প্রমুখ খ্যাতনামা কবিদের অসংখ্য কবিতা সেযুগের সমাজ ও ইতিহাসকে সংরক্ষিত করেছে। কাব্য জগতে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। জাহেলি আরব কবিদের মধ্যে মহিলা কবিও ছিলেন। আরবের মহিলা কবিদের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন খানসা। আবার কিছু কিছু কবি ছিলেন যারা জাহেলি যুগে জন্মগ্রহণ করেন এবং ইসলাম প্রচারের পরেও বেঁচে ছিলেন। তাঁরা মুখাযরাম নামে পরিচিত। তাঁদের মধ্যে হাসসান বিন সাবিত, কা’আব বিন যুহাইর, মুতাম্মিম বিন নুওয়ারা, আবু মিহজান, আল-হুতাইয়া প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
 
প্রাচীন আরবদের জীবন ধারা সম্পর্কে জানতে গেলে কবিতার আশ্রয় নিতে হয়একমাত্র কবিতাই আরবদের সামগ্রিক জীবন ধারা সম্পর্কে অবহিত হওয়ার মূল অবলম্বন। যে কারণে বলা হয়ে থাকে আশ্‌-শে’রু দীওয়ানুল্‌ আরব (الشعر ديوان العرب) অর্থ্যাৎ কবিতা আরবদের জীবন দর্পন। সাহিত্যিক রস আস্বাদন ছাড়াও প্রাচীন আরবি কবিতা তথা মুআল্লাকা থেকে জাহেলি যুগের আরবদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় সকল বিষয়ের সম্যক ধারণা লাভ করা যায়। মুআল্লাকার কবিতাসমূহ আরবি সাহিত্য অলংকারে পরিপূর্ণ। তাছাড়া পবিত্র কুরআন ও হাদীস বুঝার ক্ষেত্রে এ সমস্ত কবিতা সহায়ক। তাই হযরত ওমর ফারুক (রাঃ) বলেছেন—
"خذوا أشعار الجاهلية فإن فيها تفسير كتابكم ومعانى كلامكم"
অর্থাৎ তোমরা জাহেলি যুগের কবিতা সমূহকে দৃঢ় ভাবে ধারণ কর। কেননা এতে তোমাদের কিতাবের তাফসীর ও তোমাদের কথার অর্থ নিহিত রয়েছে।
 
জাহেলি কবিতা সংরক্ষন ও সংকলন
প্রাক-ইসলামী আরবি কবিতা রচিত হয়েছিল ৬ষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দিকে। অথচ সেই সময়ে আরবে কোনো লিখন পদ্ধতির প্রচলন ছিল না। মুসলিম সমাজে সর্ব প্রথম লিখন পদ্ধতির প্রচলন দেখা যায় ৮ম শতাব্দীর শেষের দিকে। এই দীর্ঘ দু’শত বছর ধরে প্রাক-ইসলামী আরবি কবিতাগুলি আরবের রাবী অর্থাৎ বর্ণনাকারী ম্প্রদায়ের মুখে মুখে রক্ষিত হয়ে এসেছেতাই প্রশ্ন জাগে যে, এই প্রাচীন আরবি কবিতাগুলি বিভিন্ন প্রকার ভূল ভ্রান্তি হতে মুক্ত ছিল কি?  কেননা এতদিন ধর আরবি কবিতাগুলি বংশ পরম্পরায় মনে রাখা সত্যই জটিল ব্যাপার। তাছাড়া বর্ণনাকারীদের বিভিন্ন প্রকার দূর্ণীতিরও অবকাশ রয়েছেতাই অনেকে প্রাক ইসলামী আরবি কবিতার মৌলিকত্বকে সন্দেহের চোখে দেখ থাকেন, যেমন ড ত্বহা হুসাইন তাঁর ‘ফিশ-শি’রিল জাহেলী’ (পরবর্তীতে, ফিল্‌-আদাবিল জাহেলী)-তে সন্দেহের কথা প্রকাশ করেছেন।
 
তবে বহু পণ্ডিত মনে করেন, বর্ণনাকারীরা যতই দুর্নীতি পরায়ন হোক না কেন ৮ম শতাব্দীতে শহরে বন্দরে বসবাস করে কোনো কবির পক্ষে মরুভূমির বর্ণনা দেওয়া মোটেও সম্ভবপর ছিল না। অতএব কবিতার বিষয়বস্তুগুলিই প্রমাণ করে যে, প্রাক ইসলামী আরবি কবিতাগুলি সত্যই মৌলিক।
 
৬ষ্ঠ শাতব্দীতে রচিত যে সমস্ত আরবি কবিতা আজ আমাদের হস্তগত হয়েছে সেগুলি নিঃসন্দেহে মৌলিক। যেহেতু প্রাক ইসলামী যুগে লিখন পদ্ধতির সাধারণ প্রচলন ছিল না। সেহেতু সেই যুগের কবি ও তাদের লেখকগণ মুখে মুখে দীর্ঘ ২০০ শত বছর ধরে প্রাচীন আরবি কবিতাগুলি রক্ষনাবেক্ষন করে এসেছেন। পরবর্তী সময়ে  যখন ইসলামের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ও নানবিধ কারণে আরবি ব্যাকরণ প্রণয়ন ও চর্চা প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয় তখন ধীরে ধীরে প্রাচীন কবিতা সংকলনের ভাবনা আরম্ভ হয়। কেননা কুফা ও বসরার ব্যাকরণ বিদগণ এই প্রাচীন আরবি কবিতাগুলি আরবি ব্যাকরণ সৃষ্টির মুল উৎস হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। ফলে অনেকে উমাইয়া যুগের শেষের দিকে এবং আব্বাসীয় যুগের প্রথম দিকে আরবি কবিতাগুলি সংগ্রহের জন্য মুসলিম জাহানের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়েন। তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে ঘুরে তৎকালীন জীবিত বর্ণনাকারীদেরকে খুঁজে বের করেন। এবং তাদের থেকে প্রাক-ইসলামী আরবি কবিতাগুলি সংগ্রহ করে বিভিন্ন পদ্ধতিতে সংকলন করেন। তাদের এই সংকলনগুলিকে মোটামোটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়— (ক) দীওয়ান (২) সংকলন গ্রন্থ (৩) আরবি গদ্য গ্রন্থ
 
(ক) দীওয়ান
কোনো বিশেষ কবির কবিতাগুলি অথবা কোনো বিশেষ গোত্রের একাধিক কবির কবিতাগুলিকে সংকলন করে কুফা ও বসরার ব্যাকরণবিদগণ নাম দিয়েছেন দীওয়ান।
 
(খ) সংকলন গ্রন্থ
বিভিন্ন কবির বিভিন্ন ধরণের কবিতাগুলিকে সংগ্রহ করে ব্যাকরণ বিদগণ তার নাম দিয়েছেন সংকলন গ্রন্থ। যেমন আস্‌-সাবউল্‌ মু‘আল্লাকাৎ, হাসাসাতুল্‌ বুহতারী ইত্যাদি।
 
(গ) আরবি গদ্য গ্রন্থ
দীওয়ান ও সংকলন গ্রন্থ ছাড়াও অনেক আরবি কবিতা পরবর্তী কালে গদ্যে সাহিত্যের গ্রন্থে স্থান লাভ করেছে যেমন কিতাবুল আগানী।
 
জাহেলি কবিতার বৈশিষ্টসমূহ
সাহিত্যিক ও সমালোচকদের নিকট জাহেলি যুগের কবিতাসমূহ অত্যন্ত সমাদৃতএই কবিতাগুলি নিজস্ব বৈশিষ্টের কারণে অনন্য। বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে জাহেলি কবিতার নানান বৈশিষ্ট রয়েছে। শব্দের ক্ষেত্রে তার বৈশিষ্ট হল— (১) জাহেলি কবিতায় শব্দের মিষ্টতা ও অন্তরের মমতা অপেক্ষা গৌরব ও রুক্ষতা বেশি। আর এটাই জাহেলি জীবন ও বিষয়ের চিত্র। (২) জাহেলি কবিতাগুলি রচনার ক্ষত্রে ভূলত্রুটি, অনারবী শব্দ থেকে মুক্ত। কারন আরবগন অন্যদের সাথে মিলিত হত না। আরবি অভিধানগুলি জাহেলি কবিতার আলোকে রচিত। (৩) কবিতাগুলি সুন্দর রচনা, বানোয়াট ও কৃত্রিমতা এবং চাকচিক্য থেকে মুক্ত। (৪) কবিতাগুলোর শব্দের তুলনায় প্রশস্ত চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ততার দিকেই ইঙ্গিত বহন করে।
 
আর অর্থের দৃষ্টিকোণ থেকে তার বৈশিষ্টসমূহ হল— (১) জাহেলি কবিতার অর্থ কাঠিন্যতা ও দূর্বাধ্যতা থেকে মুক্ত। (২) জাহেলি কবিতাগুলো হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ার মত। নেই তাতে গভীরতা, না আছে দর্শন ও বন্ধন। (৩) কবিতাগুলো একটির সাথে অন্যটির কোনো মিল ছিল না; ফলে জাহেলি কবিতা ছিল একক অর্থবোধক। (৪) কবিতার অর্থ ছিল অস্থিরতা সম্পন্ন, একই অর্থে স্থির ছিল না।
 
আর চিন্তা-চেতনার দিক থেকে বৈশিষ্টগুলি হল— (১) জাহেলি কবিতা ছিল প্রশস্ত ও প্রাচুর্য চিন্তা-চেতনার অধিকারী, যা আরবদের নিকট সূক্ষ্ম বৈশিষ্টে বিদ্যমান। (২) জাহেলি কবিতায় মরু পরিবেশের কথা প্রকাশ পেয়েছে। (৩) জাহেলি যুগের চিত্রগুলোতে ছিল না কোনো কৃত্রিমতা, ফলে সেগুলো ছিল পরস্পর মিলিত ও ছন্দোবদ্ধ। আর এ ধরনের কবিতার সংখ্যা কম।
-আব্দুল মাতিন ওয়াসিম 

No comments:

Post a Comment