Sunday 19 May 2019

আল-কুরআনের ভাবানুবাদঃ (৮২) সূরাতু আল্‌-ইন্‌ফ়িত়ার (বিদারণ)


৮২) সূরাতু আল্‌-ইন্‌ফ়িত়ার (বিদারণ)
মক্কায় অবতীর্ণ, আয়াত ১৯, রুকু’ ১

 

بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمـَنِ الرَّحِيمِ

আল্লাহ্‌র নামে (শুরু করছি), তিনি পরম করুণাময় ও অতি দয়ালু।

إِذَا السَّمَاء انفَطَرَتْ

যখন আকাশ বিদীর্ণ হবে

وَإِذَا الْكَوَاكِبُ انتَثَرَتْ

যখন নক্ষত্রসমূহ ঝরে পড়বে

وَإِذَا الْبِحَارُ فُجِّرَتْ

যখন সমুদ্রকে উত্তাল করে তোলা হবে

وَإِذَا الْقُبُورُ بُعْثِرَتْ

এবং যখন কবরসমূহ উম্মোচিত হবে

عَلِمَتْ نَفْسٌ مَّا قَدَّمَتْ وَأَخَّرَتْ

তখন প্রত্যেকে জেনে যাবে, সে পূর্বে (ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য) কী প্রেরণ করে রেখেছে এবং পশ্চাতে কী ছেড়ে এসেছে (ভালো না মন্দ, সৎ না অসৎ কর্ম)।

يَا أَيُّهَا الْإِنسَانُ مَا غَرَّكَ بِرَبِّكَ الْكَرِيمِ

হে মানুষ, কোন্‌ বিষয়টি তোমাকে তোমার মহান পালনকর্তা সম্পর্কে বিভ্রান্ত ও উদাসীন করে রেখেছে?

الَّذِي خَلَقَكَ فَسَوَّاكَ فَعَدَلَكَ

যে পালনকর্তা তোমাকে সৃষ্টি করেছেন, অতঃপর তোমাকে সুবিন্যস্ত করেছেন এবং সুষম করেছেন।

فِي أَيِّ صُورَةٍ مَّا شَاء رَكَّبَكَ

তিনি তোমাকে তাঁর ইচ্ছা মতো আকৃতিতে গঠন করেছেন।

كَلَّا بَلْ تُكَذِّبُونَ بِالدِّينِ

না, কখনই বিভ্রান্ত হয়ো না; উপরন্তু, তোমরা প্রতিদান দিবসকে মিথ্যা মনে করো।

وَإِنَّ عَلَيْكُمْ لَحَافِظِينَ

(তবে মনে রেখো,) তোমাদের উপর তত্ত্বাবধায়ক ও সংরক্ষকগণ নিযুক্ত রয়েছেন;  

كِرَامًا كَاتِبِينَ

তাঁরা অত্যন্ত সম্মানিত, তাঁরা (তোমাদের প্রতিটা কৃতকর্মই) নথিভুক্ত করে রাখছেন।

يَعْلَمُونَ مَا تَفْعَلُونَ

তারা জানেন তোমরা যা কিছু করো।

إِنَّ الْأَبْرَارَ لَفِي نَعِيمٍ

নিশ্চয় সৎকর্মশীলগণ অবস্থান করবেন আনন্দে (অর্থাৎ জান্নাতে)।

وَإِنَّ الْفُجَّارَ لَفِي جَحِيمٍ

আর অসৎ ও দুষ্কর্মকারীদের ঠাই হবে গনগনে আগুনের ভেতর (অর্থাৎ জাহান্নামে)।  

يَصْلَوْنَهَا يَوْمَ الدِّينِ

তারা ওই গনগনে আগুনে প্রবেশ করবে (এবং তার তীব্র দাহকে আস্বাদন করবে) প্রতিদান দিবসে (যে দিন প্রত্যেককে তার কৃতকর্মের বিনিময় প্রদান করা হবে)।

وَمَا هُمْ عَنْهَا بِغَائِبِينَ

তারা তা থেকে (কোনোভাবেই) পৃথক হতে পারবে না।

وَمَا أَدْرَاكَ مَا يَوْمُ الدِّينِ

তুমি কি জানো, বিচার দিবস কী?

ثُمَّ مَا أَدْرَاكَ مَا يَوْمُ الدِّينِ

আবারও (বলছি,) তুমি কি জানো, বিচার দিবস কী?

يَوْمَ لَا تَمْلِكُ نَفْسٌ لِّنَفْسٍ شَيْئًا وَالْأَمْرُ يَوْمَئِذٍ لِلَّهِ

(বিচার দিবস হল) যে দিন কেউ কারও কোনো উপকার করতে পারবে না; এবং সর্বময় কর্তৃত্ব ও ক্ষমতা থাকবে (কেবল মাত্র) আল্লাহ্‌র হাতে।

ভাবানুবাদ- আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

মসজিদ নির্মাণ এবং আমরাঃ কোন্‌ পথে


মসজিদ নির্মাণ এবং আমরাঃ কোন্‌ পথে
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
 
কিছু দিন আগে আমি এক অনুষ্ঠানে গেছিলাম। মঞ্চ থেকে মুসলিম সমাজের পিছিয়ে পড়ার কারণ, উত্তরণের পথ ও উপায় ইত্যাদি নিয়ে নানা জন নানা মত দিচ্ছিলেন। অধিকাংশেরই বক্তব্য, মুসলিম সমাজের পিছিয়ে পড়ার মূল কারণগুলির অন্যতম হল মাদ্‌রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা। এখান থেকে পাশ করা ছেলেমেয়েরা সমাজের কোনো কাজে লাগে না। মাদ্‌রাসা থেকে কখনো ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার-উকিল-ডিএম-বিডিও-এসডিও বের হয় না, ইত্যাদি। এসব বস্তাপচা আলোচনা শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, চর্বিতচর্বণের গাঁজা-সেবন কত ব্যাপকতা লাভ করেছে। এদের এই সব বক্তব্য যে অযৌক্তিক তা আমি অন্য এক লেখায় বিশদে আলোচনা করেছি। তাই এখানে সে বিষয়ে কিছুই বলবো না ওই অনুষ্ঠানের কোনো একটা সেশনের প্রশ্ন-উত্তর পর্ব চলছে। একজনের এক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এক বক্তা বললেন, আমরা মুসলিমরা কোথাও একটা বসত গড়ে উঠলে সর্ব প্রথমে কী করি, সেখানে একটা মসজিদ তৈরি করি। কখনো এমনটা ভাবি না, আগে স্কুল করি তারপর অন্য কিছু। এই কথা শুনে আমার পাশের এক শ্রোতা লাফিয়ে উঠল। জোরে জোরে হাত তালি দিতে লাগলো। সম্বিৎ পাত্রার যুক্তি শুনে কোনো ভক্ত যেমন করে লাফিয়ে উঠে, খানিকটা তারই মতো।
 
এ প্রসঙ্গে আমার যেটা মনে হয়েছে, বক্তা ও শ্রোতা উভয়েরই ইসলামে মসজিদের কনসেপ্ট কী, সে সম্বন্ধে সঠিক ধারণা নেই। তাই নির্বোধের মতো কথার পীঠে কথা রেখে বক্তব্য দেয় বা শোনে। যদি ইসলামের ইতিহাসের পাতা ওলটাই খুব সহজেই চোখে পড়ে, নবী (সাঃ) ও তাঁর অনুগামীদের করা মদিনার মসজিদের কথা, যাকে আমরা নবীর মসজিদ বলে জানি। ওই মসজিদের এক পাশে একটা চালা লাগানো হয়েছিল। সেখানে অসহায়-আশ্রয়হীন লোকেরা থাকতো, যাদের চালচুলো ছিল না। এবং সময়-সুযোগ পেলেই নবীজির থেকে ইসলামের পাঠ গ্রহণ করতো। ওই চালার সেরা ছাত্র হলেন আবু হুরায়রাহ্‌ (রাঃ), যিনি পরবর্তীতে সবচেয়ে বেশি হাদিস বর্ণনা করেছেন। বিভিন্ন মরসুমে মসজিদের প্রাঙ্গণে শিশুকিশোরদের জন্য ক্রীড়াকৌতুকের অনুষ্ঠান হতো। কুস্তি ও তিরন্দাজির মতো ইভেন্টও থাকতো। রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা নিয়ে হঠাৎ কোনো সমস্যা তৈরি হলে মসজিদের ভেতরেই বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধিদের নিয়ে বিতর্ক ও আলোচনার ব্যবস্থা করা হতো। জল সংকট থেকে সামরিক সংকটের মুকাবেলার জন্য অর্থ জোগাড় করা, সৈন্য প্রস্তুত করা সবই হতো মসজিদ চত্বরেই। বিদেশ-বিভূঁই থেকে কোনো রাজা বা সম্রাটের প্রতিনিধি দঃ, আসলে তাঁদের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক, শান্তি চুক্তি সবই হতো মসজিদের ফরশে বসে। দু’একটা বিশেষ ক্ষেত্রে রাজবন্দীদের রাখার ব্যবস্থাও মসজিদে করা হয়েছিল। মসজিদের কার্যকারিতার ও মসজিদ কেন্দ্রিক সমাজ গড়ার এমন অনেক নজীর রেখে গেছেন নবীজি (সাঃ)।
 
পরবর্তীতে যদিও মসজিদের ব্যবহার ও কার্যকারিতা সীমিত হয়ে পড়েছে, তবে তা একেবারেই নবীজির আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি। এর একটা উদাহরণ হল বিশ্ববিখ্যাত আয্‌হার বিশ্ববিদ্যালয়। যা মূলত একটি জামে’ মসজিদ ছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে জামে’ আয্‌হারের ভেতরে ফজর ও আসর নামায বাদ বিভিন্ন জনের হাদিস, তাফ্‌সীর, ফিক্‌হ ও ইতিহাসের পাঠদানের আসর বসতো। ধীরে ধীরে তা বিদ্যাচর্চার পীঠস্থানে পরিণত হয়। এমন নজীর বহু রয়েছে, বিশেষ করে দামেস্কাস, ইরাক, তিউনিসিয়া ও মুসলিম স্পেনে। এমনকি এখনো মসজিদে নববী ও কাবা চত্বরে ওপেন স্কুলের মতো করে সকাল সন্ধ্যা পাঠদানের আসর বসে। সেখানে পাঠদান করেন নিকটবর্তী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপকেরা ও উভয় মসজিদের ইমাম ও খাতীবেরা। সেখানে যে কেউ পছন্দ মতো শায়েখের আসরে বসে পাঠ গ্রহণ করতে পারে। তবে এটা ঠিক যে ভারত বর্ষের মসজিদগুলোতে এমন দৃশ্য খুবই কম দেখা যায়। হাতে গোনা কিছু মসজিদে এমন আসর বসে। কিছু মসজিদ কমিটি ইদানীং শিক্ষণমূলক কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু অধিকাংশই ধর্ম-শিক্ষা কেন্দ্রিক। তবে ভালো খবর হল কিছু মসজিদ কমিটি ব্যতিক্রমী ভাবনা গ্রহণ করেছে। এমন মসজিদের সংখ্যাটা খুব কম হলেও তার একটা বেশ ইতিবাচক প্রভাব সমাজের বিভিন্ন প্রান্ত পড়েছে। আর তাই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু মসজিদ কমিটি মেডিকেল প্রবেশিকা পরীক্ষা ও ইউপিএসসির ফ্রি বা স্বল্প খরচে কোচিংয়ের ব্যবস্থা করেছে। আল্‌-হাম্‌দু লিল্লাহ, তারা তার সুফলও পেতে শুরু করেছে।
 
এ প্রসঙ্গে নারী শিক্ষা আন্দোলনের অন্যতম কাণ্ডারি বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হুসাইনের একটা ঘটনার উল্লেখ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক মনে করি। একদিন এক নারীবাদী কর্মী বেগম রোকেয়াকে বললেন, আপনি নারী শিক্ষার পক্ষে আওয়াজ তোলেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে মুসলিম মেয়েদেরকে স্কুলে পাঠানোর জন্য অনুরোধ করেন। আপনি মনে করেন, শিক্ষাই পারে নারীর প্রতি যে কোনো রকমের উৎপীড়ন ও অত্যাচারকে বন্ধ করতে। নারীকে স্বাধীনচেতা করে গড়ে তুলতে। অথচ আপনি নিজেই মাথায় ওড়না, কখনো ঘোমটা টেনে এর ওর বাড়ি গিয়ে মেয়েদেরকে স্কুলে পাঠানোর জন্য আকুতি করেন। আজব ব্যাপার না! বেগম রোকেয়া মৃদু হেসে ডিপ্লোম্যাটিক কিন্তু বাস্তব একটা উত্তর দিয়েছিলেন তাঁকে। বলেছিলেন, আমি যদি প্রথমেই আমার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করে ফেলি, তাঁর ও তাঁর পরিবারের কাছে আমার গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলি তাহলে আমার কথা, আমার বক্তব্য তাঁকে বোঝাবো কীভাবে?!
 
আমারও ঠিক তেমনই মনে হয়, কোথাও গিয়ে আপনি যদি প্রথমেই বলেন, গ্রামে মসজিদের কোনো দরকার নেই। আগে স্কুল গড়ে তুলুন। তারপর না হয় ছোটমোটো একখানা মসজিদ বানাবেন। তাহলে অধিকাংশ লোক আপনার বক্তব্যকে সমর্থন করবে না। বরং উলটো রিয়েকশন হবে। তা না করে, আপনি যদি ইসলামে মসজিদের গুরুত্ব তুলে ধরেন। মসজিদের প্রকৃত রূপ কেমন হওয়া উচিৎ, নবীজির মসজিদ কেমন ছিল, তার ব্যবহার ও কার্যকারিতা কত ব্যাপক ছিল সেসব কথা তুলে ধরেন তা হলে হয়তো নিকট ভবিষ্যতে সংখ্যায় কম হলেও কিছু মসজিদের চত্বর শুধু মক্‌তবে আটকে থাকবে না। সেখানে কোথাও মন্টেসরী তো কোথাও নার্সারি ও কিশলয় গড়ে উঠবে, ইন্‌ শা আল্লাহ্‌।
 
আমার এমন ধারণা যে একেবারেই অমূলক নয়, তা আমার জেলার কিছু মানুষ বহু বছর আগে করে দেখিয়েছেন। আমার গ্রাম থেকে আট-দশ কিমি দূরে তা ঘটেছে। গ্রামের নাম বেলপুকুর। গ্রামে একটা ছোট্ট মাটির মসজিদ ছিল, আমি নিজেও তা দেখেছি, যদিও এখন আর মাটির নেই, বেশ ঝা চকচকে ইমারৎ সেখানে। পাশেই বিশাল মাঠ। ওই এলাকার ঈদগাহ। ঈদগাহের পূর্ব প্রান্তে একটি নিজামিয়া মাদ্‌রাসা। যেটা এক সময় গড়ে উঠেছিল ওই ছোট্ট মসজিদের মুসাল্লীদের প্রচেষ্টায়। পরবর্তীতে সত্তরের দশকে ওই মাদ্‌রাসার পাশে এলাকার কিছু মানুষ মিলে তৈরি করেন একটি হাই মাদ্‌রাসা। ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল সমাজ। এরপর ১৯৮৪-র কোনো এক সময়ে এলাকার কিছু যুবক মিলে মসজিদের ভেতরেই গড়ে তুললেন একটি লাইব্রেরী। বই কিনতে বাড়ি-বাড়ি চাঁদা তুললেন তারা। ভালো ইসলামী বইয়ের সন্ধানে তারা ওপার বাংলার রাজধানী ঢাকা অবধি গেলেন। পাঠক তৈরি হল। চেতনা সঞ্চারিত হল। আরও উদ্যোগ, আরও উদ্যম নিয়ে আরও অনেকে এগিয়ে এল। দিনদিন বইয়ের চাহিদা বাড়তে লাগলো। সমাজের উপর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে লাগলো। তাই এবার শক্ত হাতে হাল ধরলেন কিছু মানুষ। সেখান থেকে প্রেরণা নিয়ে সংলগ্ন জমিতে ১৯৮৯ সালে মইনুদ্দিন সাহেবের নেতৃত্বে তারা গড়ে তুললেন একটি ইসলামিক নার্সারি। এলাকার ছেলেমেয়েরা দলে দলে স্কুলে ভর্তি হল। শিক্ষার চর্চা ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়ল। মইনুদ্দিন আহমেদ, সিরাজুল ইসলাম, রুহুল আমীন, দিদার মণ্ডল, আব্দুল লতিফ প্রমুখ মিলে আরও বড় স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। নার্সারিটিকে বৃহৎ রূপ দিতে তৎপর হয়ে উঠলেন। দীর্ঘ দশ বছরের সাধনার ফল মিলল। ওই নার্সারিটি আল-আমীন মিশনের প্রথম শাখা রূপে উঁচু উঁচু বিল্ডিং, বিশাল মাঠ, ঘন সবুজ দৃশ্য, মনোরম পরিবেশ নিয়ে ইদানীং স্বমহিমায় সমাজকে হাঁকিয়ে নিয়ে চলেছে সামনের সারিতে। যদিও পার্থিব ও পারলৌকিক চিন্তার সেতুবন্ধনটা তেমন গভীর ভাবে এখনো তৈরি করা সম্ভব হয়নি। তবে মইনুদ্দিন সাহেব একাই নিরলস ভাবে তার চেষ্টা করে চলেছেন।
 
মুসলিমরা বর্তমানে মসজিদ নির্মাণে কতটা আগ্রহী, কতটা অনাগ্রহী তা নিয়ে উভয় পক্ষেই বেশ কিছু ভ্যালিড পয়েন্ট রয়েছে। শেষে এখানে যে কথাটার উল্লেখ জরুরী মনে করি, তা হল মসজিদ-মন্দির-গির্জা নির্মাণ রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়। বিশেষে করে ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দেশে। কিন্তু শিক্ষা যেহেতু প্রত্যেকের মৌলিক অধিকার তাই স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করা রাষ্ট্রের একান্ত কর্তব্য, তা আমরা সবাই জানি। এবং এই শুভ কাজে মুসলিম সমাজ যে এগিয়ে এসে বিভিন্ন সময়ে নানা ভাবে রাষ্ট্রের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তা কিন্তু একেবারেই বাস্তব যদিও সে বিষয়ে তেমন আলোচনা বা লেখালেখি চোখে পড়ে না। আমার জেলার এক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান বেস আন্‌ নূর এরকম একটা উদ্যোগ নিয়েছিল। সংস্থার সম্পাদক খাদেমুল ইসলাম সাহেব নিজেও এ বিষয়ে গবেষণায় বেশ আগ্রহী ছিলেন। তিনি তার লোকজন নিয়ে কাজে নেমেও পড়েছিলেনকিন্তু অর্থ ও উপযুক্ত লোকের অভাবে মাঝ পথে গবেষণার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তবে তারা দক্ষিণ দিনাজপুরের একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের স্কুলগুলোর ইতিহাস ঘেঁটে যে তথ্য পেয়েছিলেন তা সত্যিই বিস্ময়কর। কুশমুণ্ডি, বংশিহারি, হরিরামপুর, গঙ্গারামপুর ও গাজলের সিনিয়ার মাদ্‌রাসা-হাই মাদ্‌রাসার পাশাপাশি বহু স্কুল-কলেজ এমন রয়েছে যার জমিদাতা ও প্রতিষ্ঠাতা মুসলিম। তাই আমি মনে করি, আমরা যদি সম্বিৎ পাত্রা স্টাইল ছেড়ে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে আলোচনা-সমালোচনা করি। তাহলে হয়তো ভালো কিছু, গঠনমূলক কিছু তৈরি করতে সমাজকে অনুপ্রাণিত করতে পারবো। আল্লাহু ওয়ালিউত্‌ তাওফীক।   
 

Friday 17 May 2019

আল-কুরআনের ভাবানুবাদঃ (৬৬) সূরাতু আত্‌-তাহ়্‌রীম (নিষেধ)


৬৬) সূরাতু আত্‌-তাহ়্‌রীম (নিষেধ)

মদীনায় অবতীর্ণ, আয়াত ১২, রুকু’ ২
 
بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمـَنِ الرَّحِيمِ

আল্লাহ্‌র নামে (শুরু করছি); তিনি পরম করুণাময় ও অতি দয়ালু।

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ لِمَ تُحَرِّمُ مَا أَحَلَّ اللَّهُ لَكَ تَبْتَغِي مَرْضَاتَ أَزْوَاجِكَ وَاللَّهُ غَفُورٌ رَّحِيمٌ

হে নবী (সাঃ), আল্লাহ তোমার জন্য যে জিনিস হালাল করেছেন নিজ স্ত্রীদেরকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে তুমি তা নিজের জন্য হারাম করছ কেন? (মনে রেখো,) আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াময়।

قَدْ فَرَضَ اللَّهُ لَكُمْ تَحِلَّةَ أَيْمَانِكُمْ وَاللَّهُ مَوْلَاكُمْ وَهُوَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ

(হে পুরুষেরা) আল্লাহ তোমাদের জন্য তোমাদের কসম থেকে অব্যহতি লাভের উপায় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। (মনে রেখো,) আল্লাহ্‌ই তোমাদের অধিপতি, অভিভাবক ও ত্রাতা। এবং তিনি সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়।

وَإِذْ أَسَرَّ النَّبِيُّ إِلَى بَعْضِ أَزْوَاجِهِ حَدِيثًا فَلَمَّا نَبَّأَتْ بِهِ وَأَظْهَرَهُ اللَّهُ عَلَيْهِ عَرَّفَ بَعْضَهُ وَأَعْرَضَ عَن بَعْضٍ فَلَمَّا نَبَّأَهَا بِهِ قَالَتْ مَنْ أَنبَأَكَ هَذَا قَالَ نَبَّأَنِيَ الْعَلِيمُ الْخَبِيرُ

(মনে করো, একবার) নবী (সাঃ) নিজ স্ত্রীদের মধ্যে একজনকে (হাফ্‌সা রাঃ-কে) গোপনে কিছু কথা বলেছিলেন। অতঃপর যখন তিনি (হাফ্‌সা রাঃ) অন্য এক স্ত্রীকে (আয়েশা রাঃ-কে) সেই কথাগুলো জানিয়ে দিলেন এবং আল্লাহ নবী (সাঃ)-এর নিকট তা প্রকাশ করলেন, তখন নবী (সাঃ) সে বিষয়ে কিছু কথা ব্যক্ত করলেন এবং কিছু অব্যক্ত রাখলেন। অতঃপর নবী (সাঃ) যখন বিষয়টি তাঁর ওই স্ত্রীকে (হাফ্‌সা রাঃ-কে) জানালেন, তখন তিনি (হাফ্‌সা রাঃ) (নবীজিকে) জিজ্ঞেস করে বসলেন, কে আপনাকে এ সম্পর্কে অবহিত করল? নবী (সাঃ) বললেন, সর্বজ্ঞ ও সম্যক অবহিত সত্ত্বা (মহান আল্লাহ্‌) আমাকে অবহিত করেছেন।

إِن تَتُوبَا إِلَى اللَّهِ فَقَدْ صَغَتْ قُلُوبُكُمَا وَإِن تَظَاهَرَا عَلَيْهِ فَإِنَّ اللَّهَ هُوَ مَوْلَاهُ وَجِبْرِيلُ وَصَالِحُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمَلَائِكَةُ بَعْدَ ذَلِكَ ظَهِيرٌ

(হে হাফ্‌সা ও আয়েশা রাঃ) যেহেতু তোমাদের অন্তর (নবীজির পছন্দের বিরোধিতায়) অন্যায়ের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, তাই যদি তোমরা উভয়ে (অনুতপ্ত হয়ে) আল্লাহ্‌র দিকে প্রত্যাবর্তন করো (তাহলে আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন)। কিন্তু যদি নবী (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে একে অপরকে সাহায্য করো, তাহলে জেনে রাখো যে, আল্লাহ, জিব্‌রায়িল (আঃ) এবং সৎকর্মপরায়ণ মুমিনগণ তাঁর সহায় ও সাহায্যকারী। উপরন্তু, ফেরেশতাগণ তো তাঁর সাহায্যের জন্য (সর্বদা প্রস্তুত হয়ে) আছেন।

عَسَى رَبُّهُ إِن طَلَّقَكُنَّ أَن يُبْدِلَهُ أَزْوَاجًا خَيْرًا مِّنكُنَّ مُسْلِمَاتٍ مُّؤْمِنَاتٍ قَانِتَاتٍ تَائِبَاتٍ عَابِدَاتٍ سَائِحَاتٍ ثَيِّبَاتٍ وَأَبْكَارًا

(হে নবীর স্ত্রীগণ) যদি নবী (সাঃ) তোমাদের সকলকে পরিত্যাগ করেন (অর্থাৎ তালাক দেন), তাহলে তাঁর পালনকর্তা তাঁকে তোমাদের পরিবর্তে তোমাদের চাইতে উত্তম স্ত্রী প্রদান করতে পারেন, আর তাঁরা হবেন মুসলমান, ঈমানদার, আজ্ঞাবহ, তওবাকারিণী, এবাদতগুজার, রোযাদার, অ-কুমারী (বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা) এবং কুমারী।

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَارًا وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ عَلَيْهَا مَلَائِكَةٌ غِلَاظٌ شِدَادٌ لَا يَعْصُونَ اللَّهَ مَا أَمَرَهُمْ وَيَفْعَلُونَ مَا يُؤْمَرُونَ

হে বিশ্বাসী লোকেরা! তোমরা নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে ওই (ভয়ানক) আগুন হতে রক্ষা করো, যার ইন্ধন হবে মানুষ ও পাথর, যাতে নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয় ও কঠোর স্বভাবের ফেরেশতাগণ, যারা (কখনই) আল্লাহ্‌র আদেশ অমান্য করে না। বরং তারা তা-ই করে যা তাদেরকে আদেশ করা হয়।

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ كَفَرُوا لَا تَعْتَذِرُوا الْيَوْمَ إِنَّمَا تُجْزَوْنَ مَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ

(মহাপ্রলয়ের দিনে বলা হবে,) তোমরা যারা (আলাহর দ্বীনকে) অস্বীকার করো, তোমরা আজ আর কোনো প্রকার অজুহাত পেশ করো না। তোমরা (পার্থিব জীবনে) যে সব কাজ করতে (আজ) তোমাদেরকে তারই প্রতিফল দেওয়া হবে।

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَّصُوحًا عَسَى رَبُّكُمْ أَن يُكَفِّرَ عَنكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَيُدْخِلَكُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِن تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ يَوْمَ لَا يُخْزِي اللَّهُ النَّبِيَّ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ نُورُهُمْ يَسْعَى بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا أَتْمِمْ لَنَا نُورَنَا وَاغْفِرْ لَنَا إِنَّكَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর কাছে আন্তরিকভাবে এবং বিশুদ্ধরূপে তওবা-অনুশোচনা করো। তাহলে হয়তো তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মন্দ কর্মসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবেন এমন জান্নাতে, যার তলদেশে নানা ধরণের নদনদী প্রবাহমান। সেদিন মহান আল্লাহ নবী (সাঃ) এবং তাঁর মুমিন সহচরদেরকে অপদস্থ করবেন না। তাদের নূর (অর্থাৎ জ্যোতি) তাদের সম্মুখে ছুটোছুটি করবে এবং তাদের ডান হাতে (তাদের সৎকর্মসমূহের উজ্জ্বল খতিয়ান থাকবে)। তারা বলবে— প্রভু, তুমি আমাদের নূরকে আমাদের জন্য পূর্ণ করে দাও (এবং আমাদের আলোকে নিভিয়ে দিও না যতক্ষণ না আমরা নরকের উপরের ওই অত্যন্ত পিচ্ছিল পুলটা নির্বিঘ্নে অতিক্রম করি) এবং আমাদেরকে ক্ষমা করে দাও। নিশ্চয় তুমি সকল বিষয়ে ক্ষমতাবান।

يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِينَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ

হে নবী (সাঃ)! তুমি কাফের (অবিশ্বাসী) ও মুনাফিকদের (দ্বিচারীদের) বিরুদ্ধে জেহাদ করো (অর্থাৎ তাদের অনিষ্ট থেকে সমাজ ও পৃথিবীকে বাঁচানোর জন্য সংগ্রাম করো) এবং তাদের প্রতি কঠোর হও। তাদের ঠিকানা হবে জাহান্নাম; আর তা কতই না নিকৃষ্ট প্রত্যাবর্তন স্থল।

ضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا لِّلَّذِينَ كَفَرُوا اِمْرَأَةَ نُوحٍ وَاِمْرَأَةَ لُوطٍ كَانَتَا تَحْتَ عَبْدَيْنِ مِنْ عِبَادِنَا صَالِحَيْنِ فَخَانَتَاهُمَا فَلَمْ يُغْنِيَا عَنْهُمَا مِنَ اللَّهِ شَيْئًا وَقِيلَ ادْخُلَا النَّارَ مَعَ الدَّاخِلِينَ

মহান আল্লাহ কাফেরদের জন্য নূহ-পত্নী ও লূত-পত্নীর দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন। তারা আমার বান্দাদের মধ্যে দু’জন সৎকর্মপরায়ণ বান্দার অধীনে ছিল। কিন্তু তারা তাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করল (তাদের নিয়ে আসা ধর্মমতকে অস্বীকার করে)। ফলে নূহ (আঃ) ও লূত (আঃ) তাদেরকে (অর্থাৎ নিজ নিজ স্ত্রীকে) আল্লাহ তা’আলার শাস্তি থেকে রক্ষা করতে পারলেন না এবং তাদেরকে বলা হল, জাহান্নামীদের সাথে তোমরাও জাহান্নামে প্রবেশ করো।

وَضَرَبَ اللَّهُ مَثَلًا لِّلَّذِينَ آمَنُوا اِمْرَأَةَ فِرْعَوْنَ إِذْ قَالَتْ رَبِّ ابْنِ لِي عِندَكَ بَيْتًا فِي الْجَنَّةِ وَنَجِّنِي مِن فِرْعَوْنَ وَعَمَلِهِ وَنَجِّنِي مِنَ الْقَوْمِ الظَّالِمِينَ

(অন্যদিকে,) মহান আল্লাহ মুমিনদের জন্য ফেরাউন-পত্নীর (ফারাও-এর স্ত্রীর) দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন, যখন সে দু’আ করেছিল, প্রভু! তোমার নিকটে জান্নাতে আমার জন্য একটি গৃহ নির্মাণ করো এবং আমাকে ফেরাউন ও তার দুস্কর্ম থেকে উদ্ধার করো; এবং আমাকে জালিম (অর্থাৎ অত্যাচারী, অংশবাদী ও অসৎ) সম্প্রদায় হতে মুক্তি দাও।

وَمَرْيَمَ ابْنَتَ عِمْرَانَ الَّتِي أَحْصَنَتْ فَرْجَهَا فَنَفَخْنَا فِيهِ مِن رُّوحِنَا وَصَدَّقَتْ بِكَلِمَاتِ رَبِّهَا وَكُتُبِهِ وَكَانَتْ مِنَ الْقَانِتِينَ

(আরও দৃষ্টান্ত বর্ণনা করেছেন) ইমরান-তনয়া মরিয়মের, যে তার সতীত্ব বজায় রেখেছিল। অতঃপর আমি তার মধ্যে (তার জামার আস্তিন দিয়ে) আমার পক্ষ থেকে (জিব্‌রিল আঃ মারফৎ) জীবন ফুঁকে দিয়েছিলাম এবং সে তার পালনকর্তার শব্দাবলী (অর্থাৎ তার বিস্ময় দেখে জিব্‌রিল আঃ আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে তাকে যে কথাগুলো বলেছিলেন [সূরা মার্‌ইয়াম ১৬ – ২৬]) ও গ্রন্থসমূহকে সত্য বলে গ্রহণ করেছিল। প্রকৃতার্থেই সে ছিল বিনয়ী ও অনুগতদের একজন।

ভাবানুবাদ- আব্দুল মাতিন ওয়াসিম