Friday 12 June 2020

এক আফ্রিকান দাসীঃ যাকে নবীজি (সা) মা বলে ডাকতেন


এক আফ্রিকান দাসীঃ যাকে নবীজি (সা) মা বলে ডাকতেন
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

নবীজির পিতা আব্দুল্লাহ একদিন মক্কার বাজারে গেলেন কিছু কেনাকাটা করার জন্য সেখানে আর পাঁচটা দোকানের মতো একটা লোক রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে দাস-দাসী বিক্রি করছিল আব্দুল্লাহ লক্ষ্য করলেন, একটা ছোট্ট নয় বছরের কালো আফ্রিকান আবিসিনিয়ান মেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে সেখানে বদন মলিন দেহ রুগ্ন  হালকা-পাতলা চেহারা অসহায় ও মায়াবী দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে রয়েছে মেয়েটাকে দেখে খুব মায়া হল আব্দুল্লাহ্ তিনি মনে মনে ভাবলেন, ঘরে আমিনা একা থাকে, একটা মেয়ে পাশে থাকলে তার ভালো লাগবে, একজন সঙ্গী পাবে, টুকিটাকি কাজে সাহায্য করবে এই ভেবে তিনি মেয়েটাকে কিনে নিলেন কিছু বর্ণনায় রয়েছে, তিনি বিয়ের আগেই তাকে কিনে এনেছিলেন এবং বিয়ের পর আমিনার একমাত্র পরিচারিকা ছিল এই মেয়েটি।    

আব্দুল্লাহ আমিনা দুজনেই মেয়েটিকে খুব ভালোবাসতেন খুব স্নেহ-যত্ন করতেন; যেন আপন করে নিয়েছিলেন তাকে দিন যেতে না যেতেই তারা লক্ষ্য করলেন, তাদের সংসার আগের চেয়েও বেশি স্বচ্ছল, অধিক সুখী কোনো অদৃশ্য জায়গা থেকে যেন রহমত বরকত নেমে আসছে তাই তাঁরা দুজনে মিলে আদর করে মেয়েটির নাম রাখলেনবারাকাহ্‌” আর এভাবে একটি অবহেলিত প্রাণ একটু কদর পেল, সেই সাথে পেল একটা আইডেন্টিটি, নিজের নাম এবং একটু সামাজিক পরিচয়

তারপর একদিন, আব্দুল্লাহ ব্যবসার জন্য সিরিয়ার পথে রওনা হলেন আমিনার সাথে সেটাই ছিল তাঁর শেষ দেখা, ছিল তাঁদের আখেরি মুলাকাত। আব্দুল্লাহ্ রওয়ানা হওয়ার দুএকদিন পর আমিনা এক রাতে স্বপ্নে দেখলেন, আকাশের একটা তারা আলোয় ঝলমল করতে করতে তার কোলে এসে পড়লো রের দিন ভোরবেলা তিনি বারাকাহ্কে স্বপ্নের কথা বললেন  উত্তরে বারাকাহ্মৃদু হেসে বলল, “আমার মন বলছে, আপনার একটা সুন্দর সন্তান হবে   

আমিনা তখনও জানতেন না তিনি গর্ভধারণ করেছেন কিন্তু কিছু দিন পর তিনি বুঝতে পারলেন, বারাকাহ্ ধারণাই সত্যি এই খুশির খবরটা স্বামীকে কীভাবে জানাবেন তা নিয়ে আমিনা মনে মনে অনেক কৌশল, অনেক অভিমানী সংলাপ ভেবে ঠিক করে রাখলেন, আর পাঁচটা মহিলার মতোই কিন্তু তা আর সম্ভব হল নাআমিনার সেসব অভিমানী সংলাপ কণ্ঠ পেল নাঅনুযোগ-মেশানো তাঁর মৃদু হাসি ঠোঁটের প্রাচীর ভেদ করার আগেই আহাজারিতে রূপান্তরিত হলকারণ, আব্দুল্লাহ পরিবর্তে ঘরে ফিরল তাঁর মৃত্যু সংবাদ সিরিয়া থেকে ফেরার সময় মাঝপথে মদিনায় তাঁর রূহ দেহের খোলস ত্যাগ করলো  আর এভাবে অনাথ বিশ্বের ত্রাতা জন্মানোর আগেই অনাথ হয়ে গেলেন 

মাত্র তিন-চার মাস স্বামীর সোহাগ পেয়েছিলেন আমিনা সেই সোহাগকে স্মৃতিতে নিয়ে বহু কষ্টে দিন কাটছিল তাঁর সেই বিরহ কষ্টের দিনগুলিতে সর্বদা তাঁর পাশে ছিল বারাকাহ্‌, তাঁর সবচেয়ে কাছের সঙ্গী, আক্ষরিক অর্থেই ছায়াসঙ্গী হয়ে দুজনে মিলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলেন নতুন অতিথির অবশেষে ৫৭১ খ্রিসাব্দের ২০শে এপ্রিল, অর্থাৎ ৯ই রবিউল আউয়াল সোমবার আমিনার অপেক্ষার অবসান হল কোল আলো করে জন্ম নিল এক ফুটফুটে শিশু কিছু বর্ণনা অনুযায়ী, শিশু মুহাম্মদ (সা)-কে সর্বপ্রথম স্পর্শ করে ছিলেন বারাকাহ্‌, আফ্রিকার সেই কৃষ্ণকায় দাসীটি নবীজিকে তিনি নিজ হাতে মা আমিনার কোলে তুলে দিয়েছিলেন আর খুশিতে টগবগ করে ফুটতে ফুটতে বলেছিলেনআমি ভেবেছিলাম সে হবে চাঁদের মতো কিন্তু এখন দেখছি, সে তো চাঁদের থেকেও সুন্দর

নবীজির জন্মের সময় বারাকাহ্ বয়স ছিল তেরো বছর মা আমিনার সাথে তিনিও শিশু মুহাম্মদের (সা) যত্ন নিতেন তাঁকে গোসল দিতেন খাওয়াতেন আদর করে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন শিশু মুহাম্মদকে (সা) তিনিও পরম স্নেহ করতেন সেজন্যেই, মৃত্যুর সময়, আব্ওয়ার নির্জন প্রান্তরে মা আমিনা বারাকাহ্‌র হাত ধরে অনুরোধ করলেন, সে যেন তাঁর শিশুসন্তানকে দেখেশুনে রাখে বারাকাহ্ আজীবন তা মনে রেখেছিলেন

বাবা-মা দুজনকেই হারিয়ে অনাথ শিশুটির আশ্রয় জুটল দাদু আব্দুল মুত্তালিবের ঘরে এবং উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি (সা) হলেন বারাকাহ্‌র নতুন মনিব একটু বড় হয়ে কৈশো বেলাতেই তিনি একদিন বারাকাহ্কে মুক্ত করে দিয়ে বললেনআপনি যেখানে ইচ্ছা চলে যেতে পারেন, আপনি স্বাধীন, আপনি মুক্ত যেন শিশু কাল থেকেই তিনি এই ক্রীতদাস প্রথাকে দূর করতে চাইছিলেন চাইছিলেন, মানুষ মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত হোক কিন্তু মা বারাকাহ্নবীকে ছেড়ে যেতে রাজি হননি থেকে গেছিলেন মায়ের ছায়া হয়ে, আজীবন নবীজির পাশে

নবীজির দাদু আব্দুল মুত্তালিব বারাকাহ্‌র বিয়ে দেয়ার বেশ কয়েক বার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু বারাকাহ্কিছুতেই রাজি হননি তাঁর একটাই বক্তব্য ছিলআমি আমিনাকে কথা দিয়েছি, আমি মুহাম্মদকে (সা) ছেড়ে কোথাও যাবো না

তারপর নবীজির বয়স যখন পঁচিশ হল, খাদিজা (রা)-এর সাথে নবীজি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন বিয়ের দিন নবীজি (সা), খাদিজা (রা)-এর সাথে বারাকাহ্‌র পরিচয় করিয়ে দিলেন, বললেন— “ইনি হলেন আমার মায়ের পরে আমার আর একজন মা

বিয়ের দিন পরে নবীজি (সা) একদিন বারাকাহ্কে ডেকে বললেন— “উম্মি (হে আমার মা)! আমার দেখাশুনা করার জন্য এখন খাদিজা আছে, আপনাকে এবার বিয়ে করতেই হবে উল্লেখ্য যে, নবীজি বারাকাহ্কেউম্মি” (আমার মা) বলে ডাকতেন, কখনো নাম ধরে ডাকতেন না অতঃপর নবীজি (সা) মা খাদিজা (রা) উভয়ে মিলে উবাইদ বিন্আল্‌-হারিস-এর সাথে বারাকাহ্‌র বিয়ে দিলেন বিয়ের কিছু দিন পর বারাকাহ্‌র নিজের একটা ছেলে হলো, নাম রাখা হলো আয়মান সেই থেকে বারাকাহ্‌র নাম হয়ে গেলউম্মে আয়মান 

তারপর যে-দিন বারাকাহ্‌র স্বামী উবাইদ বিন আল্‌-হারিস মারা গেলেন, নবীজি গিয়ে আয়মান বারাকাহ্কে সাথে করে নিজের বাড়ি নিয়ে আসলেন এবং তাঁদের দুজনকে নিজের বাড়িতে থাকতে দিলেন কিছু দিন পর নবীজি কয়েকজন সাহাবীকে ডেকে বললেনআমি একজন নারীকে জানি, যার কোনো সম্পদ নেই, বয়স্ক এবং সাথে একটা এতিম সন্তান আছে, কিন্তু তিনি জান্নাতি তোমাদের মধ্যে কেউ কি একজন জান্নাতি নারীকে বিয়ে করতে চা?
এই কথা শুনে যায়েদ বিন্হারিসা (রা) নবীজির কাছে এসে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন নবীজি উম্মে আয়মানের সাথে কথা বলে বিয়ের আয়োজন করলেন বিয়ের দিন নবীজি (সা) যায়েদকে বুকে জড়িয়ে ধরে আনন্দ ভালোবাসায়, ভেজা চোখে, কান্নাজড়ানো কণ্ঠে বললেনতুমি কাকে বিয়ে করেছো, জানো যায়েদ?
হাঁ, উম্মে আয়মানকে যায়েদ বিন্হারিসা উত্তর দিলেন
নবীজি বললেননা, তুমি কোনো সাধারণ মহিলাকে বিয়ে করছ না, তুমি যাকে বিয়ে করছ তিনি আমার আরেক মা তুমি আমার মাকে বিয়ে করেছো 

বেশ কিছু বর্ণনায় রয়েছে, নবীজিকে (সা) খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কখনো কেউ জোর করতে পারত না, বলা ভালো, জোর করা যেত না নবীজি পছন্দ করতেন না কিন্তু উম্মে আয়মান একমাত্র নারী, যিনি নবীজিকে (সা) খাবার দিয়ে  “খাও, খাওবলে তাড়া দিতেন খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাশে বসে থাকতেন আর নবীজি মৃদু হেসে, চুপচাপ খেয়ে নিতেন

নবীজি (সা) দুধ-মা হালিমাকে দেখে নিজের গায়ের চাদর খুলে বিছিয়ে তার উপর মা হালিমাকে বসতে দিয়েছিলেন, আমরা সে-কথা জানি ঠিক তেমনি হিজরতের সময় দীর্ঘ যাত্রা শেষে মদিনায় পৌঁছে উম্মে আয়মান যখন ক্লান্ত হয়ে পড়লেন নবীজি নিজের গায়ের চাদরের একটা অংশ পানিতে ভিজিয়ে উম্মে আয়মানের মুখের ঘাম ধুলোবালি নিজ হাতে মুছে দিয়ে বললেন, “মা! জান্নাতে আপনার এই রকম কোনো কষ্ট হবে না

নবীজি মৃত্যুর আগে সাহাবীদের অনেক কথা বলেছিলেন, নানা বিষয়ে অসিয়ত করেছিলেন সেই সব কথার মধ্যে একটা ছিল, উম্মে আয়মানের কথা নবীজি বলেছিলেনতোমরা উম্মে আয়মানের যত্ন নেবে তিনি আমার মায়ের মত তিনিই একমাত্র নারী, যিনি আমার জন্ম থেকে শেষ পর্যন্ত দেখাশোনা করেছেন আমার পরিবারের একমাত্র সদস্য, যিনি সারা জীবন আমার পাশে থেকেছেন  

নবীজির (সা) মৃত্যুর পর তাঁর অনুগামীরা, সাহাবীরা (রা) সেই কথা রেখেছিলেন তাই, গায়ের রং নয়, কোনো এক সময়ে তিনি ক্রিতদাসী ছিলেন তা নয়, উম্মে আয়মান বারাকাহ্ পরিচয় তিনি নবীজীর মা, যে মা নবীজিকে সারা জীবন আগলে রেখেছেন আর তাই সাহাবীরা (নবীজির সহচরেরা) মায়ের মতোই এই বৃদ্ধা নারী উম্মে আয়মান বারাকাহ্কে ভালোবেসে আগলে রেখেছিলেন এবং ১ম ২য় খলিফা আবু বাক্ উমার (রা) মাঝে মাঝে তাঁর সাথে দেখা করতে যেতেনতাঁর খোঁজখবর নিতেন অবশেষে নভেম্বর ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে, তৃতীয় খলীফা উস্মান (রা)-এর খেলাফতে ২৪ হিজ্রি সনে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেনরাযি আল্লাহুআন্হা

-------------------

  • তথ্যসূত্রসহিহ মুসলিম ২৪৫৪, ৬৪৭২, সীরাতু ইব্নে হিশাম /৩৪৭, তাবাকাতু ইব্নে সাআদ, উসুদুল্গাবাহ্‌, আল্‌-ইসাবাহ্ফি-তাম্য়িযিস্সাহাবাহ্/১৭০