ইংরেজি শেখা
বদিউর রহমান
শহরতলি
থেকে কলকাতায় পড়তে এসে ইংরাজিতে কথা বলা শেখার প্রবল ইচ্ছা হল। হোস্টেলের কাছাকাছি ওয়েলেস্লি স্ট্রীটের এক কমার্শিয়াল
কলেজে ভর্তি হলাম। এক ঘণ্টা করে সপ্তাহে দু দিন ক্লাস।
রুচিসম্মত স্কার্টে, হাল্কা হিলতোলা পামসু পরা মধ্যবয়সি এক মহিলা আমাদের ইংরাজি শেখাবেন।
ববকাট চুলে এবং সরু ফ্রেমের চশমায় তাঁকে বেশ সপ্রতিভ ও ব্যক্তিত্ব সম্পন্না দেখাত। দু একটা ক্লাস
করে বেশ ক’টা কথা বার বার শোনা ও বলার জন্য কথাগুলো বেশ রপ্ত করতে পারছিলাম। জড়তাটাও
দূর হচ্ছিল। ম্যাডাম পক্ষপাতহীনভাবে সকলকে সমান গুরুত্ব দিয়ে বেশ সুন্দর শেখাতেন।
একদিন যথারীতি ক্লাস করছি; ম্যাডাম ক’টা শব্দ দিয়েছেন বাক্য তৈরি করতে। সেগুলি মন দিয়ে করছি হঠাৎ
দেখি তিনি আমার হাতের আংটিটার দিকে এক দৃষ্টিতে লক্ষ্য করছেন। আংটিটা সেদিনই এক বন্ধুর কাছ থেকে নিয়ে প্রথম বার পরেছি।
আংটির পাথরটা ছিল অপূর্ব সুন্দর। তার দ্যুতি দেখে হিরে বলে ভুল করা ছিল খুব
স্বাভাবিক। আমি আবার লেখায় মন দিয়েছি। পরক্ষণে একটা মিষ্টি গন্ধ খুব কাছ থেকে অনুভব
করি। দেখি ম্যাডাম আমার মাথার পিছন থেকে ঝুঁকে আমার খাতার দু’পাশে তাঁর হাত দুটো
রেখে আমার লেখা দেখছেন। তাঁর শরীরের মৃদু স্পর্শ আর হালকা নিঃশ্বাস প্রশ্বাসে আমার
অস্বস্তি হতে থাকে। একটু পরে উনি নিজের চেয়ারে ফিরে সকলের খাতা দেখে সেদিনের মত
পড়ানো শেষ করলেন। সকলে ক্লাসরুম থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে ম্যাডাম আমার নাম করে ডাকলে
ওঁনার কাছে গেলাম। বললেন যে তোমার প্রোগ্রেস ঠিকই আছে তবে আরও কথা বলা ও শোনা দরকার।
তুমি এক কাজ কর। আগামী শনিবার বিকেল চারটেয় আমার বাসায় এসো। এই নাও আমার ঠিকানা।
রিপন লেনের বাসাটা খুঁজে পেতে কোন আসুবিধা হলনা। দরজায় বেল দিতে বছর কুড়ির এক
মেয়ে দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কাকে চাই?’। ম্যাডামের নাম বলতে বসার ঘরের সোফাতে বসতে দিয়ে সে ম্যাডামকে
ডেকে দিল। স্মিত হাসি মুখে এগিয়ে এসে সামনের সোফায় বসে কুশল বিনিময় করলেন। চায়ের
জন্য সেই মেয়েটিকে ডাকলেন। নামটা শুনলাম লারা।
কিছুক্ষণের মধ্যে দু’ কাপ চা নিয়ে এল লারা। আমার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিয়ে ম্যাডাম
বললেন ওঁর হাতে কয়েকটা জরুরি কাজ আছে। লারাকে বললেন আমার সঙ্গে গল্প করতে।
কিছুক্ষণ কথা বলার পরই লক্ষ করি যে সে আমার আংটিটা নিরীক্ষণ করছে। আমি একটু ভনীতা
করে সেদিনের মত বিদায় চাই। সে অনুরোধ করে পরের দিন সাক্ষাৎ করতে।
পরের দিনও লারাই দরজা খুলে আমাকে সোফায় বসতে বলে। দু’চারটে কথা ব’লে সে চা করতে উঠে যায়। চা নিয়ে ফিরে এসে অনর্গল কথা বলতে থাকে। আমার কিছুদিনের শেখা ইংরেজিতে কথা বলার ভাণ্ডার অনতিবিলম্বে শূন্য হয়ে যায়। লারা আমার অস্বস্তিকর অবস্থা দেখে মিটি মিটি হাসতে হাসতে আমার আংটিটার প্রশংসায়
পঞ্চমুখ হয়ে ওঠে। আগে থেকেই সে রকম কিছু একটা ঘটবে ভেবেছিলাম। কেন জানিনা ইতিমধ্যেই আংটিটার প্রতি
আমার আসক্তি জন্মেছিল। সেটা হাতছাড়া করার কথা ভাবতে পারছিলাম না। লারার জন্যও না। লারা আংটিটা হাতে নিয়ে দেখতে চায় । দোনামনা করে ওটা তার হাতে খুলে দিলাম। সে ওটা খুব মনোযোগ সহকারে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে
দেখতে লাগল। তার চোখ দুটো দেখি জ্বল জ্বল করছে। দীর্ঘক্ষণ ওটা হাতে রাখার পর যেন অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমার
দিকে হাত বাড়িয়ে ফেরত দিল। আমিও সেটা তার হাত থেকে নিলাম। ও কিন্তু সে রকম আশা করেনি। প্রত্যাশা করেছিল ওটা আর ফেরত নেবনা। সেদিন লারার সুন্দর মুখটার ওপর এক প্রকারের হতাশার ছায়া আমার চোখ এড়ায়নি।
তারপর উঠে পড়লাম । দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসে লারা বলেছিল
আবার একদিন তাদের বাসায় যেতে। কিন্তু এবার কোনও দিনক্ষণ নির্দিষ্ট ছিল না। ফিরতে ফিরতে ভাবলাম আংটিটা দিয়ে দিলেই হত। পরক্ষণেই মনে হল আংটিটাত আমার নয়; ওটা
অন্য কাউকে দিয়ে দেওয়ার আমি কে। ভাবলাম দেখিনা ব্যাপারটা কতদূর গড়ায়।
এবার যেদিন ক্লাসে গেলাম লক্ষ্য করলাম ম্যাডাম আমাকে আগের
মত আর প্রশ্রয় দিচ্ছেন না। ছোট খাটো ভুল ভ্রান্তিতেও জুটতে লাগল
তর্জন গর্জন। বুঝতে পারছিলাম যে তিনি আমার ওপর বেশ ক্ষুণ্ণ। অবশ্য তার কারণটাও সহজেই অনুমান করতে পারছিলাম। তাই একটু ভারাক্রান্ত মনে হস্টেল
ফিরলাম।
আমার পাশের রুমের ছেলেটি দর্শনের ছাত্র। সে দেখি আমার
রুমে এসে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসল। দু একটা কথা বলার পর বলল যে সে ক’দিনের জন্য বাড়ি
যাবে। সেই ক’দিনের জন্য আমার আংটিটা দুম করে চেয়ে বসল। ওকে অনেক করে বললাম, ওটা
আমার নয় অন্য জনের, তাই দেওয়া যাবেনা।
কিন্তু কে কার কথা শোনে। তার কথা হল পাশের গ্রামে তার বান্ধবীর
সঙ্গে যখন দেখা করবে ওটা তখন পরে থাকতে চায়। কথাও দিল ও নিশ্চিত আমাকে আংটিটা ফেরত
দেবে। অগত্যা সেটা দিলাম ওকে। দু দিনের মধ্যেই আংটিটা ফেরত দেওয়ার সময় ছেলেটার
মুখটা বিবর্ণ দেখাচ্ছিল। জিজ্ঞাসা করে জানতে পারি যে তার বান্ধবী অনেক পীড়াপীড়ি
করেছিল ওটা তাকে উপহার স্বরূপ দেওয়ার জন্য। তাকে ওটা দিতে পারেনি আমার কাছে
অঙ্গিকারবদ্ধ ছিল বলে। এমনকি তার কারণে দু’জনকার বিচ্ছেদও হয়ে যায়। শুনে কষ্ট হল
তবুও আংটিটা তার থেকে নিলাম।
একদিন কলেজের কয়জন বন্ধুর সঙ্গে আউত্রামঘাটে বেড়াতে
যাওয়ার প্রোগ্রাম হল । সকলে বেশ ফুর্তিতেই বেড়াচ্ছি। চা খাওয়ার জন্য গে রেস্টুরেন্টের উপরে বসে ছিলাম। রত্না
হঠাৎ আমার হাতের আঙুলটা তুলে নিয়ে বলল “আংটিটা ত দারুন সুন্দর; এটা আমায় দে”। অনেক
বুঝিয়ে সুঝিয়ে সে যাত্রা রক্ষা পেলাম কিন্তু তারপর থেকে তার সঙ্গে সম্পর্কটা কোনোক্রমেই
আগের মত থাকল না। আংটিটার প্রতি আমার যে আসক্তি ছিল সেটায় ভাটা পড়া সুরু হয়ে ক্রমে
নিরাসক্তি দেখা দিতে থাকল। যে বন্ধুর আংটি, তার সঙ্গে দেখা হতে তাকে ওটা ফেরত দিতে
চাইলে সে বলল ওটা সে ফেরত নেবেনা। কারণ কি জানতে চাইলে সে বলল, যেকদিন ওটা তার হাতে ছিল সে কদিন তার সুখকর হয়নি। বেশ কয়েক জনের সঙ্গে চূড়ান্ত মনোমালিন্য
হয়। তাই ওটা আর সে চায়না। সব শুনে আমি নির্বাক। অনভিপ্রেত অশুভ কিছুর আশঙ্কায় আংটিটা
বিদায় করতে মনস্থির করলাম। ভাবনাটা মাথায় আসার সঙ্গে সঙ্গে ওটা
গঙ্গায় ফেলে দিতে বের হলাম। একটা বাসে চড়েছি, কিছুদূর যাওয়ার পর বাসটা খারাপ হয়ে গেল; অন্য একটা বাসে চড়ে গঙ্গার ধারে নামার সময় আচমকা বাঁ পায়ে বেশ চোট পেলাম। কেন জানিনা মনের মধ্যে কু গাইতে শুরু করল। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গঙ্গার ধারে
এক নিঃশ্বাসে পৌঁছে আঙুল থেকে আংটিটা খোলার সময় দেখি সেটা থেকে এক ধরনের লাল রশ্মি
বের হচ্ছে। যেন আমাকে রক্তচক্ষু দেখাচ্ছে। অভূতপূর্ব কাণ্ড দেখে ভয়ে শিওরে
উঠে আংটিটাকে গায়ের জোরে গঙ্গায় ছুড়ে ফেলে দিই। আর তখনি আচমকা একটা বড় ঢেউ আমার হাঁটু
অবধি এসে আছড়ে পড়ল। আর ফিরে তাকাইনি। সোজা হস্টেলে গিয়ে বিছানা নিই। তিনচারদিন বেঘোর জ্বরে পড়েছিলাম।
সুস্থ হলে ইংরাজি ক্লাসে গিয়েছি আংটিবিহীন। প্রশ্ন-উত্তরের মাধ্যমে ইংরেজি কথা বার্তা চলার সময়ে
দেখলাম আমাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। শরীর এবং মন দুটোয় বেশ ভাল ছিলনা। ক্লাস শেষ হওয়ার
মুহূর্তে ম্যাডাম আমাকে উদ্দেশ করে বললেন যে প্রিয়জনকে বিশেষ বস্তুটা দিয়ে দেওয়ায়
আমি নাকি অস্বাভাবিক অন্যমনস্ক। আমি কিছু বলতে চাইলে থামিয়ে দিয়ে বললেন আজকের মত
আপনারা আসতে পারেন। আর কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে বের হয়ে হস্টেল। তারপর কেন জানিনা ঐ ক্লাসে আর যেতে ইচ্ছা করেনি। ইংরেজিতে
কথা বলাটা আর শেখা হল না।
অসাধারণ গল্প বলার ভঙ্গি।শুরু করলে শেষ না করে ওঠা যায় না।
ReplyDeleteসুন্দর লাগলো,তবে আংটিটা ফেলে দেওয়ায় আমি খুব ব্যথিত।
ReplyDeleteখুবই চমৎকার গল্প,একটি আংটিকে কেন্দ্র করে পুরো গল্পটি দারুন লাগলো৷
ReplyDeleteআংটির উপাখ্যান খুব সুন্দর !
ReplyDeleteWaw,fantastic
ReplyDelete