Sunday 9 December 2018

ইমরাউল কায়েসঃ জীবনী ও সাহিত্য কর্ম


ম্‌রাল্‌ ক়ায়েসঃ জীবনী ও সাহিত্য কর্ম

আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

 

প্রাক-ইসলামী যুগে আরবী কাব্য জগতে যে জন কবি কাব্যমোদীদের তৃষ্ণা নিবারন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে ইম্‌রাল্‌ ক়ায়ে অন্যতম। নিকলসন তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “ম্‌ল্‌ ক়ায়েস প্রাক্‌-ইসলামী যুগের সবচেয়ে বড় কবি রূপে বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। তাঁর পুরো নাম আবুল্‌ হ়ারি জুন্দুহ় িন্‌ হ়ুজ্‌র বিন্‌ আল্‌-হ়ারি ল্‌-কিন্দ উপাধি ল্‌-মালিকুদ় দ়িল্লী (ভবঘুরে রাজকুমার), জ়ুল্‌-ক়ুরূহ় (ক্ষতবিক্ষত) তবে ম্‌ল্‌ ক়ায়ে (কায়েস দেবতার সেবক, কায়েস দেবতার নামে উৎসর্গিত) নামেই তিনি ধিক পরিচিততাঁর পিতা হ়ুজ্‌ ছিলেন বানু আসাদ গোত্রের প্রধান। আর মা ফাত়িমা বিন্‌তু রাবীহ্‌ তাগ়্লিব গোত্রের খ্যাতনামা বীর ও আরবী সাহিত্যের সর্বপ্রথম ক়াস়ীদা (দীর্ঘ কবিতা, গীত কবিতা) রচয়িতা কবি মুহালহিলের বোন ছিলেন

 

তিনি ইয়ামেনের সম্ভ্রান্ত রাজ পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। নাজরান-সম্রাট কীন্দার বংশধর ছিলেন। তাঁর জন্ম তারিখ সম্পর্কে বিস্তারিত এবং সুনিশ্চিত কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তাই ঐতিহাসিকদের ধারণা, তিনি ৪৮০ খ্রিস্টাব্দ  হতে ৫৪০ খ্রিস্টাব্দের মর্ধবর্তী কোনো এক সময়ে দক্ষিন আরবে অবস্থিত প্রাচীন ইয়ামানের এক সম্ভ্রান্ত রাজবংশে জন্ম গ্রহণ করেন।

 

তাঁর বাল্যকাল সম্পর্কে বেশী কিছু জানা যায় না। খুবই সীমিত কিছু কথা জানা যায়। যেমন তিনি ছিলেন পিতার কনিষ্ঠ সন্তান। শৈশবে তিনি অত্যন্ত আদর-যত্নে প্রতিপালিত হন। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলা, দুঃসাহসীকতাপূর্ণ কার্যকলাপের প্রতি তাঁর গভীর আকর্ষণ ছিল। কৈশোরেই কাব্যচর্চার প্রতি আগ্রহী হয়ে পড়েন। কবিতা, গান এবং মদ নিয়ে তাঁর সূর্য উদয়-অস্ত যেতো। খেলাধুলা ও আমোদ-প্রমোদে ডুবে থাকতেন। কাব্যচর্চা, খামখেয়ালীপনা এবং আন্‌ডিসিপ্লিন্‌ড জীবন যাত্রার জন্য তাঁর প্রতি বিরক্ত হয়ে পিতা তাঁকে গৃহ ত্যাগের নির্দেশ দেন। তবে, কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন, জ্‌রা গোত্রের ফাতেমা নামের এক নারীর প্রতি তিনি মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়েন এবং তাঁকে নিয়ে একটি প্রেম-গীতি রচনা মোড়ে ফেলেন। যারপরনায় পিতা তাঁকে বাড়ি থেকে বহিষ্কার করেন। পিতার আশ্রয় হতে বিতাড়িত হয়ে নানা গোত্রের কিছু উচ্ছৃংখল যুবকদের নিয়ে গড়া একটি দলে যোগ দেন। এবং তাঁদের সাথে মিলেমিশে ভবঘুরে জীবন যাপন আরম্ভ করেন। নানা স্থানের ঝর্ণাধারে, গোত্র হতে গোত্রান্তরে, বাগিচার মধ্যে শিকার, খেলাধুলা, সঙ্গীত ও কবিতা রচনা ইত্যাদিতে দিন অতিবাহিত হতে থাকে তাঁর। এজন্যেই তাঁকে ল্‌-মালিকুদ় দ়িল্লী (ভবঘুরে রাজকুমার) বলা হয়।

 

কবি যখন একদিন ইয়ামেনের দাম্মুন নামক জায়গায় আমোদ-প্রমোদে ডুবে ছিলেন, এমন সময় বানু আসাদ কর্তৃক তাঁর পিতার নিহত হওয়ার সংবাদ তাঁর কাছে পৌঁছল। ক্ষোভে দুঃখে ফেটে পড়লেন। আমুদে কণ্ঠেই চিৎকার করে উঠলেন, “পিতা আমার শৈশবকে নষ্ট করে দিয়েছেন। এখন তাঁর রক্তঋণ আমার যৌবনকে ভারাক্রান্ত করে তুলেছে। আজ আর জেগে থাকা নয় এবং কাল মদ পান নয়। আজ আকণ্ঠ মদ পান করা আর আগামী কাল থেকে শুধু কাজ।[1] সপ্তাহকাল প্রমোদে মত্ত থাকার পর শপথ করলেন যে, পিতার হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে বনূ আসাদ গোত্রের একশত জনকে হত্যা ও সমসংখ্যকের কপালের চুল কর্তন না করা পর্যন্ত মদ ও মাংশ খাবেন না এবং প্রসাধনী, তৈল ও নারী স্পর্শ করবেন না। 

 

ইয়ামেন হতে ফেরার পথে তাবলা উপত্যকায় এক আদেশ-নিষেধ জ্ঞাপক মূর্তির নিকট পৌঁছে ই মূর্তির পার্শ্বে রাখা আদেশ, নিষেধ ও বিলম্ব সূচক তীর তিনটির মাধ্যমে প্রথা অনুযায়ী নিজ সিদ্ধান্তের ভবিষ্যৎ জানতে চাইল। ঘটনাচক্রে প্রতিবারই নিষেধ সূচক তীর উঠল। ফলে  ক্ষিপ্ত হয়ে মূর্তির মুখের উপর তীর নিক্ষেপ করলেন

 

মাতুল গোত্র বানু বাক্‌র ও তাগ্‌লিব গোত্রের সহায়তায় বানু আসাদ গোত্রের উপর চড়াও হলেন। তাতে বানু আসাদের অনেক লোক নিহত হল। তিনি পিতার হারানো ক্ষমতাকে পূনরুদ্ধারের প্রাণপণ চেষ্টা করলেন। কিন্তু পূর্ব-শত্রু হীরা প্রদেশের বাদশাহ তনয় মুন্‌যির পারস্য রাজ্যের সহায়তায় কবির বিরুদ্ধে সৈন্য পাঠাল। তাঁর ভয়ে কবির সমর্থকেরা একে একে সকলে কবিকে ত্যাগ করলো। ফলে কবি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে লাগলেন। কিন্তু কেউই তাঁকে সাহায্য করলো না।

 

অবশেষে আবলাক দুর্গের মালিক বিখ্যাত কবি সামওয়াল বিন আদিয়ার নিকট শরনাপন্ন হলেন। তাঁর কাছে উত্তাধিকারী সুত্রে পাওয়া লৌহবর্মটি গচ্ছিত রেখে একটা পত্র নিয়ে কন্সটান্টিনোপলের উদ্দেশ্যে যাত্রা রওয়ানা দিলেনসামওয়ালের পত্রের সুবাদে ৫৩০ খ্রিস্টাব্দে সিরিয়ার গাস্‌সানী শাসক হারি িন আবি-সিমরের সহায়তায় কবি কন্সটান্টিনোপলের শাসনকর্তা জাষ্টিনিয়ানের নিকট পৌঁছতে সক্ষম হলেনকন্সটান্টিনোপলের সম্রাট তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে ফিলিস্তিনের ফাইলাক অশ্বারোহী সৈন্যের সেনাপতি পদ প্রদান করলেনকবি নিজ বাহিনী নিয়ে যাত্রা করে আঙ্কারায় পৌঁছলে গুটি বসন্ত জাতীয় রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।

 

কিছু বর্ণনায় রয়েছে, কবির এক শত্রু ত়িম্মাহ়্ আল্‌-আসাদী সম্রাটের নিকট কবির বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যে, কবি সম্রাটের তনয়ার সাথে অবৈধ প্রনয়ে লিপ্ত ফলে সম্রাট কবিকে হত্যার জন্য বিষ মিশ্রিত বিশেষ ধরনের পোশাক উপহার দেন। এ পোশাক পরিধানের পর বিষ ক্রিয়ায় কবি সম্পুর্ণ শরীর ঘায়ে ভরে যায়। এর ফলে কবির মৃত্যু ঘটে। সম্ভব ৫৪০ খ্রিস্টাব্দে মারা যান এবং আঙ্কারার নিকট ‘আসীব পর্বতেরর পাদদেশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তখন তাঁর বয়স ছিল ৮০ বছর। আর এজন্যই তাঁকে জ়ুল্‌-ক়ুরূহ় (ক্ষতবিক্ষত) বলা হয়। 

 

ম্‌ল্‌ ক়ায়ে জাহেলী (প্রাক্‌-ইসলামি) যুগের সর্বাধিক প্রসিদ্ধ কবি। মুআল্লাকা রচনা ছাড়াও তিনি বহু কবিতা রচনা করেছিলেন। কিন্তু  তাঁর সমস্থ কাব্যকীর্তি কালের করাল গ্রাস হতে রক্ষা পায়নি। তা সত্বেও নানা সংকলন গ্রন্থ হতে উৎকলিত তাঁর যে সমস্ত কবিতা একত্রে স্থান দেওয়া হয়েছে তাওয়ানু ম্‌ল্‌ ক়ায়ে নামে পরিচিত১৯৩০ সালে কায়রো হতে মুদ্রিত ওই ওয়ানে তাঁর সুপ্রসিদ্ধ মুআল্লাকা সহ সর্বমোট ৮৪ টি ক্ষুদ্র বৃহৎ কবিতা স্থান পেয়েছে।

 

তিনি ছিলেন প্রধানত ভাব প্রধান কবি। তাঁর কবিতা সাধারনতঃ দুভাগে বিভক্ত। জীবনের প্রথম ভাগে সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও আরামে পূর্ন থাকায় সেই সময়কার কবিতা রোমান্টিকতার সুর, ঝংকার, মূর্ছনায় ভরপুর। পিতৃহত্যার পরবর্তী কবিতাগুলোতে গভীর দুঃখ বেদনা ও যন্ত্রনার ভাবধারা লক্ষনীয়। তবে সব ধরণের কবিতা রচনা করায় কাব্যিক জগতে তার বিশেষত্ব রয়েছে।

 

ম্‌ল্‌ ক়ায়ে মুআল্লাকার কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কবি। বাহরে ত্বা ছন্দে রচিত ৮১টি পঙক্তি সম্বলিত প্রসিদ্ধ মুআল্লাকাটি তাকে সর্বযুগের শ্রেষ্ঠ কবিদের কাতারে শামিল করেছে এবং প্রাক্‌-ইসলামি যুগের শ্রেষ্ঠ কবির মর্যাদা দান করেছে। তিনি মুআল্লাকায় যেসব রীতি প্রবর্তন করেছেন সেগুলো অভিনব। তিনিই সর্ব প্রথম আরবী কবি যিনি চঞ্চল হরিনী ও বন্য গাভীর সাথে নারীর তুলনা করেছেন। তাঁর মুআল্লাকা স্বীয় জীবনের ঘটনা প্রবাহ এবং অভিসারের কাহিনীতে ভরা। আরবের অমার্জিত আবেগ-উচ্ছাসের চিত্র তাঁর কাব্যে ফুটে উঠেছে। তিনিই সর্বপ্রথম কবি যিনি বন্ধুদের সাথে প্রিয়ার পরিত্যাক্ত ভূমিতে দাড়িয়ে ক্রন্দন করার রীতি প্রবর্তন করেছেন।

 

অনুপম কল্পনা, সুনিপুণ উপমা, অপরিচিত শব্দের অধিক ব্যবহার, সংক্ষিপ্ত শব্দে অধিক ভাব প্রকাশের ক্ষেত্রে সিদ্ধহস্ত ছিলেনতাঁর কবিতা তাঁর স্বভাব ও চরিত্রের স্বচ্ছ দর্পণ। অনুপম আঙ্গিকে বিভিন্ন ভাব ও ভাবনার অসাধারণ উপস্থাপন তাঁর অধিক ভ্রমন ও প্রশস্ত জ্ঞানের ফল। আর এসব ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একেবারেই স্বাভাবিক ও অকৃত্রিম। নিজ মুআল্লাকার সূচনা তিনি প্রেয়সীর বাস্তুভিটার স্মরণ ও প্রেয়সীর স্মৃতিচারণা দিয়ে আরম্ভ করে একটা প্রথার প্রবর্তন করেন যা পরবর্তী কবিগণ মধ্যযুগ পর্যন্ত অনুসরণ করে চলেছেন

দাঁড়াও! (বন্ধুদ্বয়) আমি কেঁদে নিই, প্রেয়সী ও দাখুল-হাওমাল-র মাঝে ধূলো-মলিন বালুর আঁকাবাঁকা টিলার শেষ প্রান্তে (অবস্থিত) তার আবাসভূমির স্মরণে [2]

 

তাঁর অসাধারণ বর্ণনা ভঙ্গী, বিশেষতঃ অশ্ব ও উষ্ট্রীর বর্ণনা যেমন তিনি বলেছেন

ঘোড়াটি (সুচতুর!) একই সাথে (পলকে) আক্রমন ওপলায়ন, অগ্রে ওপশ্চাতে গমন করতে পারে; এমন প্রস্তরখণ্ডের ন্যায়, যাকে অধিক বর্ষণ উপর থেকে নিক্ষেপ করেছে [3]

 

তিনি উপমা প্রদানে অসাধারণ পটু ছিলেন নিজ মুআল্লাকায় তিনি এক জায়গায় বলেছেন

বিচ্ছেদের সকালে তাঁরা যখন যাত্রা করলো, আমি গ্রামের বাবলা গাছের তলে বসে যেন হানযাল ফল চূর্ণ করছিলাম (অর্থাৎ, অঝোরে কাঁদছিলাম)[4]

 

অতি কোমলভাবে ভাব প্রকাশে সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি প্রেয়সীর অশ্রুবাণের উল্লেখ করে বলেছনে

তির-সদৃশ্য তোমার নয়নদুটি অশ্রু ঝরিয়ে (এই) আহত হৃদয়ের ধ্বংসাবশেষকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে [5]

 

তিনিই সর্বপ্রথম হরিণ ও হরিণশাবকের সঙ্গে নারীর তুলনা করেন তিনি মুআল্লাকায় লিখেছেন

(অভিমানে করে) সে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে প্রশস্ত গণ্ডদেশ প্রদর্শন করলোআর ওয়াজরা বনের অন্তঃসত্ত্বা হরিণী অথবা বন্য গাভীর মত চোখ-অন্তরাল বানালো

 

(সে প্রদর্শন করছিল) শ্বেত হরিণের গ্রীবার ন্যায় গ্রীবা; তবে যখন সে উত্তোলন করেছিল তাঁর গ্রীবা  (হরিণের মতো) অলংকারহীন ও ভূষণহীন ছিল না ![6]

    



[1]

ضيّعنى أبى صغيرا- وحمّلنى دمه كبيرا- لا صحو اليوم ولا سكر غدا- اليوم خمر وغدا أمر

[2]

قفا نبك من ذكرى حبيب ومنزل     بسقط اللوى بين الدخول فحومل

[3]

مكر مفر مقبل مدبر معا    كجلمود صخر حطه السيل من عل

[4]

كأني غداة البين لما تحملوا     لدى سمرات الحي ناقف حنظل

[5]

وما ذرفت عيناك إلا لتضربي     بسهميك في أعشار قلب مقتّل

[6]

تَـصُدُّ وتُبْدِي عَنْ أسِيْلٍ وَتَتَّقــِي     بِـنَاظِرَةٍ مِنْ وَحْشِ وَجْرَةَ مُطْفِـلِ

وجِـيْدٍ كَجِيْدِ الرِّئْمِ لَيْسَ بِفَاحِـشٍ      إِذَا هِـيَ نَصَّتْـهُ وَلاَ بِمُعَطَّــلِ

No comments:

Post a Comment