Tuesday 22 May 2018

رابندرانات طاغور: خذني بعد القطف


خذني بعد القطف
رابندرانات طاغور
ترجمة: عبد المتين وسيم
 
خذني بعد القطف
            بدون أي تأخر  
أخشى أن أسقط
            فأوذي في الغبار.   
أ تجد هذه الزهرة مكانا
بين زهور عقدك، لا أعلم؛  
وإلا، فشرّفها بلمستك المؤلمة.   
            أبتِ، فاقطفها واجْنِ
                بدون أي تأخر.
 
متى تمضي الأيام،
        فيلجها الظلام،  
ومتى تنقضي ساعات عبادتك
        بدون شعور مني بها.
وخذ ما لها من لون،
وما لها من رائحة،
فاستخدمه في عبادتك
                قبل الفناء.  
        أبتِ، فاقطفها واجْنِ
                بدون أي تأخر.   


ছিন্ন করে লও হে মোরে
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
ছিন্ন করে লও হে মোরে
              আর বিলম্ব নয়
       ধুলায় পাছে ঝরে পড়ি
              এই জাগে মোর ভয়।
       এ ফুল তোমার মালার মাঝে
       ঠাঁই পাবে কি, জানি না যে,
       তবু তোমার আঘাতটি তার
              ভাগ্যে যেন রয়।
       ছিন্ন করো ছিন্ন করো
              আর বিলম্ব নয়।
 
কখন যে দিন ফুরিয়ে যাবে,
   আসবে আঁধার করে,
কখন তোমার পূজার বেলা
       কাটবে অগোচরে।
যেটুকু এর রঙ ধরেছে,
গন্ধে সুধায় বুক ভরেছে,
তোমার সেবায় লও সেটুকু
       থাকতে সুসময়।
ছিন্ন করো ছিন্ন করো
         আর বিলম্ব নয়।

Saturday 19 May 2018

رابندرانات طاغور: دع عنك هذا الإنشاد والغناء


دع عنك هذا الإنشاد والغناء
رابندرانات طاغور
ترجمة: عبد المتين وسيم
 
دع عنك هذا الإنشاد والغناء
والتسبيح والعبادة والثناء
لمه عاكف أنت هنا
في زاوية المعبد المعتمة
خلف الأبواب المغلقة.
ومن الذي تعبده سرّا
في قلبك بالظلام مرتديا
افتح عينيك لترى
أن الإله ليس هنا في البيت.
 
وحيث قدم هو يحرث الفلاح هنا
فيذلل الأرض الصلبة
وحيث يمهّد الطريق فيكسر الحجارة
يُمضي فيه العام كله؛
ويرافقهم هو تحت الشموس والأمطار
فتتعفّر يداه هنا بالغبار
فاخلع رداءك المقدس مثله
واهبط إلى عفر التراب.
 
الخلاص! يا ترى، أين تجد الخلاص؟
وأين ذا موجود؟
ربّي، أنت فوق روابط الخلق
وملتصق بجميعهم للأبد.
دعِ التأملات وضعِ الأزهار
ولو تمزّقت ثيابك وتلوثت بالعفار
الزمه ورافق بعرق جبينك
في الجهد والمحراث. 



ভজন পূজন সাধন আরাধনা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
ভজন পূজন সাধন আরাধনা
সমস্ত থাক পড়ে।
রুদ্ধদ্বারে দেবালয়ের কোণে
কেন আছিস ওরে।
অন্ধকারে লুকিয়ে আপন-মনে
কাহারে তুই পূজিস সংগোপনে,
নয়ন মেলে দেখ দেখি তুই চেয়ে-
দেবতা নাই ঘরে।

তিনি গেছেন যেথায় মাটি ভেঙে
করছে চাষা চাষ-
পাথর ভেঙে কাটছে যেথায় পথ,
খাটছে বার মাস।
রৌদ্রে জলে আছেন সবার সাথে,
ধুলা তাঁহার লেগেছে দুই হাতে-
তাঁরই মতন শুচি বসন ছাড়ি
আয় রে ধুলার পরে।


মুক্তি? ওরে, মুক্তি কোথায় পাবি,
মুক্তি কোথায় আছে।
আপনি প্রভূ সৃষ্টিবাঁধন প'রে
বাঁধা সবার কাছে।
রাখো রে ধ্যান, থাক রে, ফুলের ডালি,
ছিঁড়ুক বস্ত্র, লাগুক ধুলাবালি-
কর্মযোগে তাঁর সাথে এক হয়ে
ঘর্ম পড়ুক ঝরে।

Friday 18 May 2018

رابندرانات طاغور: كدتُ أتلف نفسي في جمّ رغباتي


كدتُ أتلف نفسي في جمّ رغباتي
رابندرانات طاغور
ترجمة: عبد المتين وسيم
 
كدتُ أتلف نفسي في جمّ رغباتي
لكنك رفضت فحميتني منها
وهذه الرحمة القاسية
حيكت لي طوال حياتي كلها.
ومنحتني السماء والنور والجسد والحياة والعقل
منحتني هذه العطايا كلها بدون سؤال  
وإنك تهيئني يوما إثر يوم
جديرا لتلك العطايا العظيمة؛
وتهيئني لها حاميا إياي  
من مخاطر جامح الرغبات.
 
وأنا أتخلف حينا، وحينا أسعى
خلف هدفي على صراطك
لكنك ربّي أنت تتوارى
بقسوة عن وجهي.
وإنك رفضتني لتجعلني جديرا لك
وإنني أعلم، سيدوم لي عطفك هذا.
وبعد أن تجعل حياتي كاملا
ستهيئني للقاءك صالحا
وستقبلني حاميا إياي
من مخاطر ضعيف الرغبات.



আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমি বহু বাসনায় প্রাণপণে চাই,
বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে।
এ কৃপা কঠোর সঞ্চিত মোর
জীবন ভ'রে।
না চাহিতে মোরে যা করেছ দান
আকাশ আলোক তনু মন প্রাণ,
দিনে দিনে তুমি নিতেছ আমায়
সে মহাদানেরই যোগ্য করে
অতি-ইচ্ছার সংকট হতে
বাঁচায়ে মোরে।

আমি কখনো বা ভুলি, কখনো বা চলি
তোমার পথের লক্ষ্য ধরে-
তুমি নিষ্ঠুর সম্মুখ হতে
যাও যে সরে।
এ যে তব দয়া জানি হায়,
নিতে চাও ব'লে ফিরাও আমায়,
পূর্ণ করিয়া লবে এ জীবন
তব মিলনেরই যোগ্য করে
আধা- ইচ্ছার সংকট হতে
বাঁচায়ে মোরে।

Saturday 12 May 2018

আব্দুল মাতিন ওয়াসিমঃ মা বলে ডাকে


মা বলে ডাকে
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

আম্মি, পান্দ্‌রা মিনাট মে ট্রেন কাটিহার পহুঁচেগি। আপ আওনা একবার, প্লীজ!
গ্রীষ্মের ছুটি কাটিয়ে খালিদ আজ হস্টেলে ফিরছে। সে ও তার এক সহপাঠী আনিস, দু’জনে মিলে আবাধ-আসাম এক্সপ্রেসে চেপে সকাল-সকাল রওয়ানা হয়েছে দিল্লীর পথে। আর পনের মিনিট পরেই ট্রেন কাটিহার জংশনে ঢুকবে, আলিঙ্গন করবে প্ল্যাটফর্মকে; এমন সময় খালিদ মাকে ফোন করল।

তার মা দু’দিন আগে নিজ অসুস্থ পিতাকে দেখতে বাপের বাড়ি কাটিহার এসেছে। তার বাপের বাড়ি থেকে কাটিহার স্টেশন হাঁটা-পথে ৮ থেকে ১০ মিনিটের রাস্তা। একটা গাড়ি ভাই নিয়ে বেরিয়েছে সাতসকালে। আরেকটা গ্যারেজে। ড্রাইভার কী কারণে কাজে আসেনি। হাতে সময়ও বেশি নেই; সাতপাঁচ না-ভেবে গায়ে বোরখাটা চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। গেট থেকে বেরিয়ে এদিক-ওদিক তাকালেন, কিন্তু কোনো অটো বা রিকশা কিছুই পেলেন না। তাই মাথা নিচু করে জোরে জোরে হাঁটতে লাগলেন। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে যে কাজের মেয়েটির চপ্পল দুটো পরে এসেছেন, তা টের পেলেন মাঝ রাস্তায় যখন তার একটির ফিতা ছিঁড়ে গেল। জুতো জোড়া রাস্তায় ফেলে রেখে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে চললেন স্টেশনের পথে। হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছেও গেলেন মাকে দেখে আপ্লূত খালিদ বেরিয়ে এল। মা’ও আদর করে কলিজার টুকরোকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন কপালে স্নেহের চুম্বন এঁকে দিয়ে বললেন— বেটা মান লাগাকার পাড়না ইস্‌ বার তুমহেঁ হার্‌ হাল মেঁ নীট ক্র্যাক কার্‌না হ্যায়  

ট্রেনটি নির্ধারিত সময় থেকে ৭ মিনিট দেরীতে স্টেশন ছাড়ল। মাও গুটিগুটি পায়ে বাড়ির পথে হাঁটা দিলেন। মাথা নিচু করে পথচারীদের নজর এড়িয়ে এগোচ্ছিলেন তিনি তাঁর পিতা এলাকার অন্যতম প্রসিদ্ধ ব্যক্তি দুবারের বিধায়ক স্বেচ্ছায় রাজনীতি ছেড়েছেন। ইদানীং সমাজসেবা ও ধর্মকর্ম নিয়ে ব্যস্ততাঁর স্বামীও এক বিখ্যাত শিক্ষাব্রতী ও সমাজসেবী। ওভাবে খালি পায়ে, একটা মলিন বোরখা পরে হাঁটছেন দেখে রাস্তার প্রতিটা চোখ কৌতূহল ভরে নিরীক্ষণ করছে তাঁকে। কিন্তু কেউই ঠাহর করতে পারছে না, এমন কী এমারজেন্সি ছিল যে ওভাবে বেরিয়ে এসেছেন? আসলে তারা তো জানে না বিষয়টা। জানলে হয়তো আন্দাজ করতে পারতো মমত্বের গভীরতাকে। সন্তানের প্রতি মাতৃত্বের আবেগকে। খালিদের প্রতি তাঁর মমতাকে। হোক না খালিদ অন্য গর্ভের সন্তান; তাঁকে সে তো মা বলে ডাকে।  

১৩-০৫-২০১৭
কোলকাতা-৩৯

Friday 11 May 2018

رابندرانات طاغور: حيث لا يخاف العقل


حيث لا يخاف العقل
رابندرانات طاغور
ترجمة: عبد المتين وسيم
 
حيث لا يخاف العقل ويعقد الرأس مرتفعا
حيث يكون العلم مستقلا
حيث لم تكسِّر الأسوار في رحابها
العالَمَ بالجديدين إلى أجزاء عديدة
حيث تفور الكلمات من قلب الحقيقة
حيث يبسط السعي سلاحه
نحو الكمال فائضا متواصلا؛
 
حيث رمال صحراء الخرافات
لم تسدّ تيار العقل
ولم تفتّ الإنسان إلى فتات
حيث تقوده إلى الفكر والعمل أبدا
 
أبت! في روضة الحرية تلك
أيقظ بلدي بنزغك عنيفا.
 
(الأقلام الحرة، 28 يوليو 2019)
 
 
চিত্ত যেথা ভয়শূন্য
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
 
চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খণ্ড ক্ষুদ্র করি,
যেথা বাক্য হৃদয়ের উত্‍‌সমুখ হতে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়
 
যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি
বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি,
পৌরুষেরে করে নি শতধা;নিত্য যেথা
তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা
 
নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ,
ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত
 
আষাঢ় ১৩০৮
নৈবেদ্য ৭২

Wednesday 9 May 2018

বদিউর রহমানঃ ভূস্বর্গে কয়েক দিন

ভূস্বর্গে কয়েক দিন
বদিউর রহমান
[শব্দের মিছিল, মে ০৯, ২০১৮-র আত্মকথা বিভাগে প্রকাশিত। এখানে আরবি-ফার্সি শব্দের ও কবিতার অনুবাদ সহ নানা বিষয়ে টিকা প্রদত্ত হয়েছে।]

তিনদিন ব্যাপী ফার্সি আলোচনা চক্র সমাপ্তির পর কাশ্মীরের বিখ্যাত গায়ক ও সঙ্গীত আকাদেমি পুরস্কার-প্রাপ্ত ওস্তাদ গোলাম মোহাম্মদ শাযনাওয়াযের কণ্ঠে হাফিয শীরাযীর কবিতা সকলের উপর মায়াজাল বিস্তার করছিল। সন্তুর ঝংকারের সঙ্গে ‘দিল দউর গুফতা কিস্ত... আ কুজা মান আইম’[1] গযলের ‘বাম ও লই’[2] শরীর ও মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলছিল অনন্ত অসীম ঈশ্বরের মহিমা কীর্তনে প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে চলল সুরের মূর্ছনাতারপর তিনি বিখ্যাত সুফি-কবি জামি[3]র কবিতা ‘না দিদা জামাল তোরা...[4] খাস ইরানি ঘরানায় গাইতে লাগলেনজামির মর্মস্পর্শী কবিতা অচিরে সকলের হৃদয়ে গভীর প্রভাব বিস্তার করলভক্তিগীতির প্রভাবে কাশ্মীরের মতো ভূস্বর্গ যেন ম্লান হয়ে উঠছিল মহান ঈশ্বরের বিশ্বজোড়া গৌরব-ছটার সামনে
গযলের মাকতায়[5] ওস্তাদের কণ্ঠ খাদ থেকে খাদে নামলেও আচ্ছন্ন করা মোহজাল থেকে মুক্ত হতে একটু সময় লাগলো। পরক্ষনে আলোচনা চক্রের উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে ‘ফার্সির প্রভাবঃ কাশ্মীর তথা ভারতীয় কাব্য-কবিতায়’ আলোচনা সভার ইতি ঘোষণা করা হল। অবশ্য তারপর রাত আটটা পর্যন্ত চলেছিল মুশায়েরা[6] সে কথায় পরে আসা যাবে। শেষ থেকে শুরু করলাম; মাফ করবেন। এখন তাহলে শুরু থেকে শেষটা কেমন হল তার বয়ান দেওয়া যাক।
দু’হাজার চারের তেসরা অক্টোবর কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি বিভাগ তিনদিন ব্যাপী আলোচনা চক্রের ব্যবস্থা করে। জম্মু কাশ্মীর টুরিস্ট ডেভেলপমেন্টের প্রাসাদোপম বিশ্রামাগারে ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সত্তর-আশিজন ফার্সিবিদদের নিয়ে তিন’টে বাস কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ে সকাল সাড়ে ন’টায় পৌঁছায়। জমিন থেকে ছাদ পর্যন্ত চার দেওয়ালে অসংখ্য ফার্সি ও ঐ বিষয়ের ওপর নানা ভাষায় লিখিত বইয়ে সমৃদ্ধ বিভাগীয় লাইব্রেরি আমাদের অভিভূত করেফার্সি কবিতার উদ্ধৃতাংশ বিভিন্ন রকমের তুঘরা ও খুশখাতে[7] কাশ্মীরী নক্সায় ফ্রেমিং করে লাইব্রেরির চারিদিক নয়নাভিরাম করে তোলার প্রয়াস লক্ষণীয়। তার সঙ্গে বইয়ের করিডরে হাফিজ, রুমি, সা’দি, জামি, আমীর খুসরু প্রমুখ কবি মনীষীদের হাতে আঁকা পোর্ট্রেট সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এক উমার খাইয়ামের বিভিন্ন রুবাঈকে[8] কেন্দ্র করে যে পোর্ট্রেটগুলো টাঙানো সেগুলো শুধু দৃষ্টিনন্দন নয় বরং তাঁর কবিতার বিভিন্ন প্রেক্ষাপট বুঝে নিতে বিশেষ সহায়ক। আর ইতিউতি কবি মির্জা গালিবের ফার্সি কবিতার নয়নাভিরাম ক্যালিগ্রাফির কথা নাই বা বললামযেহেতু ফার্সির বিভাগীয় লাইব্রেরি তাই সেখানে গালিবের উর্দু কবিতা যথাযথভাবে সমাদৃত হয়নি। যদিও গালিব আমাদের কাছে উর্দু কবিতার জন্য সমধিক পরিচিত
আধ ঘণ্টার মধ্যে সেখান থেকে যাত্রা শুরু হল ফুল-বাগিচায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য প্রান্তে- ‘গান্ধিভবনে’সিকিউরিটি চেকিং করে কার্পেট মোড়া বিশাল অডিটোরিয়ামে বসার কিছুক্ষণ পর উদ্যোক্তাদের তরফ থেকে মাফ চেয়ে গুযারিশ[9] করা হল পুনরায় বাসে চড়তে। দার হকিকত[10], মুখ্যমন্ত্রী মুফতি সাঈদ বিশেষ কারণে সভা উদ্বোধন করতে লাচার। এক দিক থেকে বাঁচা গেল! রাজনীতিবিদদের আখরোট চেবানো কথাবার্তা কাঁহাতক ভালো লাগে! আমাদের নিয়ে যাওয়া হল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনতিদূরে ডাল লেকে। বিস্তৃত ডাল লেকে ছড়ানোছিটানো শিকারা বারবার হাতছানি দিচ্ছিল জলবিহারের। উদ্যোক্তাদের নির্দেশে তা সম্ভব হল না। আবার ফিরতে হ’ল গান্ধিভবনে।
সারা ভারত ফার্সি গবেষক-সমিতির তিনদিন ব্যাপী আলোচনা সভার সূচনা করা হল কোরআন শরীফের অংশ বিশেষ পাঠ করে। তারপর পড়া হল মহানবী (সাঃ)-এর প্রশংসায় সুবিখ্যাত ফার্সি কবি জামির কবিতা। ‘নাসিমা জানিবে বাত্বহা গুযার কুন, যে আহওয়ালাম মুহাম্মাদ রা খবর কুন’[11] বিভাগীয় ছাত্রছাত্রীরা শুধুমাত্র  হারমোনিয়ামের সাহায্যে অপূর্ব সূরের মূর্ছনায় সকলকে মুগ্ধ করল। তারপর তাঁরা কবি ইকবালের বিখ্যাত উর্দু কবিতা ‘খুদি কা সিররে নিহাঁ’[12] অপূর্ব মিষ্টি সুরে পেশ করল। পরক্ষনেই নিয়ম মাফিক সকলকে ‘খুশ-আমদিদ’[13] করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক এ ডব্লু কুরেশী আলোচনা সভার উদ্বোধন করেন।
সারা ভারত ফার্সি গবেষক-সমিতির সভাপতি প্রোফেসর শরীফ হুসেন কাসেমী সংক্ষেপে ফার্সি ভাষা ও সাহিত্যে ইরান ও ভারতবর্ষের অবদানের প্রসঙ্গে বলেন যে, ঐ অভিযান মুখ্যত একাদশ শতাব্দী থেকে শুরু হয়। তখন থেকে বিংশ শতাব্দীর কবি ইকবালের সময় পর্যন্ত ফার্সি চর্চায় ভারতবর্ষের বিশেষ অবদান আজও স্বীকৃত। এমনকি পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে ভারতীয় ফার্সিবিদরা ফার্সি কাব্যকবিতায়, ইতিহাস ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেয়। ভারতের শাসন ব্যবস্থা ও বিচার ব্যবস্থা ফার্সির মাধ্যমে হতো বলে, বিভিন্ন সময়ে হরেক ফরমান, হুকুমনামা ইত্যাদি ঐ ভাষাতেই জারি হতো। মুঘল সম্রাটরা প্রায় সকলেই কাব্যকবিতা, নৃত্য ও সঙ্গীতে বিশেষ শওকীন ও রুচিবান ছিলেন। শুধু ‘হুমায়ূন নামা’, আবুল ফযলের ‘আইনে আকবরি’ কেন, দারাশুকোর উপনিষদের ফার্সি অনুবাদ, তাঁর ‘মাজমাউল বাহরাইন’, আলি হুজয়ুরির ‘কাশফুল মাহজুব’ এবং ‘লুবাবুল আলবাব’ ইত্যাদি ভারতীয়দের ফার্সি ভাষায় উল্লেখযোগ্য অবদান। ফার্সি-চর্চায় অনন্য অবদানের জন্য হযরত আলি হামদানি, হাজি মোহাম্মদ জামালুদ্দিন, সৈয়দ তাজুদ্দিন, মীর সৈয়দ আলি, হাজি মোহাম্মদ কারী, মোল্লা নাদিমী, মহসিন, সৈয়দ যায়নুল আবেদিন বাশার, খোয়াজা হাবিবুল্লাহ, মোহাম্মদ আযম, পণ্ডিত নন্দরাম বেখুদ সবিশেষ উল্লেখযোগ্য। মোল্লা আমন কাশ্মীরীর মহাভারতের ফার্সি অনুবাদ আমাদের বিস্মিত করে। ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের মতো কাশ্মীরের ভাষা, সাহিত্য কৃষ্টির উপর ফার্সির প্রভাব এত গভীর যে এই ভূস্বর্গকে ‘ইরানে স্বাগীর’[14] বলা হয়। কাশ্মীরী সূফী কবিদের মধ্যে সৈয়দ শারফুদ্দিন বুলবুলশাহ, শামস দানিশ প্রমুখের খ্যাতি ভারতবর্ষের সীমা অতিক্রম করে সুদূর ইরান, বোখারা, বালুচিস্তান ও আফগানিস্তানে সমান বিরাজমানভারতীয় কথা সরিৎ সাগর, পঞ্চতন্ত্র ইত্যাদি অনবদ্য ফার্সিতে অনূদিত হয়ে ইরান তথা আরবদের ভারতের সাহিত্য-সাধনা সম্পর্কে কৌতূহলী করে। ইবনুল মোকাফফার পঞ্চতন্ত্রের আরবি অনুবাদ ‘কালিলা ও দিমনা’ যার সাক্ষ্য বহন করে চলেছে। যুগে যুগান্তরে ভারতীয় ফার্সিবিদ যথা উরফি, নাযিরী, গনি কাশ্মীরী, বেদিল, মির্জা গালিব ইত্যাদির গৌরবোজ্জ্বল অবদান ইরান-তুরানকে এখনও বিস্মিত করে। তাঁরা যেমন আমাদের সাহিত্যকর্ম নিয়ে উৎসুক, আমাদের দেশের নানা ভাষাভাষী মানুষও তাঁদের ফার্সি কাব্যকে আপন করে নিতে দ্বিধা করেনি। যুগযুগান্তর ধরে নানা ভারতীয় মনীষীর ফার্সি কর্মকাণ্ড ভারতের ও পৃথিবীর বিভিন্ন লাইব্রেরি ও আর্কাইভে শোভা বর্ধন করছে তাই নয় বরং বহু গবেষক-পাঠক-পাঠিকা সেগুলি নিয়ে নিরলসভাবে গবেষণা করে চলেছেন। ভারতবর্ষে ফার্সি ভাষায় রচিত বিভিন্ন মূল্যবান গ্রন্থাদি পাটনার খোদা বখশ লাইব্রেরি, রামপুরের রেজা লাইব্রেরি, কোলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটি ও ন্যাশনাল লাইব্রেরির বোহার সেকশনে এবং আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় ও নাদওয়াতুল ওলামা লাখনউ, দারুল মুসান্নিফিন ও হায়দ্রাবাদের সালারজং লাইব্রেরী ও বিভিন্ন মহাফেজ খানায় সুরক্ষিত।
আরও কিছু মূল্যবান কথা বলে আলোচনা চক্রের সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তিনি দিল্লিতে অবস্থিত ইরান কালচারাল হাউসের অ্যাটাসি আগা তামলেকে আহবান করেন কিছু বলার জন্য। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আক্ষরিক অর্থে সেমিনারের উদ্বোধন করেন। তখন দুপুর দু’টো।
দুপুরের খাওয়ার দাওয়াত ছিল জম্মু কাশ্মীরের ট্যুরিজম মন্ত্রীর তরফ থেকে গুলমার্গ গলফ ক্লাবে যা শ্রীনগর থেকে ৫৬ কিমি দূরে। তাই মেযবানদের[15] তরফ থেকে হাল্কা নাশতা ও কাহওয়ার ব্যবস্থা ছিল। বহু দিন থেকে কাহওয়ার কথা শুনেছিলাম। স্বভাবত উৎসুক ছিলাম তার স্বাদ ও লাযযাত গ্রহণে। এক কথায় অপূর্ব ও দিলশাদ[16] যেমন স্বচ্ছ সোনার মতো রং তেমনি মনমোহিনী স্বাদ। জাফরান দিয়ে তৈরি রেসিপিটা জেনে নিয়েছি শাওক থাকলে খাৎ ও কেতাবাত[17] ক’রে জেনে নেবেন।
কাহওয়ার নতুন অভিজ্ঞতার কথা আলোচনা করতে করতে আমরা গুলমার্গের জন্য অপেক্ষমান বাসের সিটে বসার মুহূর্তে আহবায়কদের মধ্যে একজন কাশ্মীরী ছাত্রীর সুরেলা কণ্ঠে আহ্বান শুনতে পেলাম, ‘তশরিফ তশরিফ’মনে হল স্বর্গভূমির স্বর্গদ্বারে সুস্বাগতম করার জন্য এক পরী অপেক্ষারতা  
শ্রীনগর থেকে ৫৬ কিমি দূরত্বে ২৭৬০ মিটার উচ্চতায় গুলমার্গ নিজ রূপে গরিয়ান। কাপের আকৃতির মতো ফলে ফুলে আচ্ছাদিত ঐ উপত্যকা যার তিনদিক সুবিশাল পর্বত দ্বারা বেষ্টিত। তাংমার্গের রাস্তা দিয়ে গুলমার্গে পৌঁছানোর রাস্তাটা অতীব সরলাকৃতিসরল রেখার মত রাস্তাটার দুপাশে সারিবদ্ধ পাইন গাছের মনোরম দৃশ্য সফরের ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। দুপাশের খেতখামারে লক্ষ করলাম ধান কাটা হচ্ছে। ধানের খড় গুলো ছোট; জাত হচ্ছে বাসমতি। শুনে অবাক হলাম, কাশ্মীর ঠাণ্ডা উপত্যকা হওয়া সত্ত্বেও ওখানকার মানুষ রুটির পরিবর্তে ভাত বেশি পছন্দ করে। তাই গমের পরিবর্তে ধানের চাষ বেশি। আমাদের বাংলার শীতের সবজির প্রায় সবকিছুই মাঝেমধ্যে নজরে আসছিল। আর প্রায়শই দেখতে পাচ্ছিলাম আপেলের বাগানতখন অবশ্য আপেলের মরসুম চলে গিয়েছিল তাই অল্প কিছু গাছে দেখতে পেলাম আপেল। পথিমধ্যে ছোট ছোট গ্রামগঞ্জ নজরে এল; দারিদ্র্যের ছাপ প্রকাশ পেলেও মানুষজন বেশ প্রাণবন্ত বলে মনে হলমাঝে মাঝে বাসের গতি যাচ্ছিল কমে; রাস্তায় গরু, ছাগল ও ভেড়ার পালের জন্য। ঐ সমস্ত চতুষ্পদ প্রাণীগুলোর গায়ে বেশি বেশি লোম লক্ষণীয় যা দিয়ে মূল্যবান পশমিনা ও প্রাকৃতিক উল তৈরি হয়।
ঐ ভাবে নানা মনোরম দৃশ্য দেখতে দেখতে গুলমার্গের যত কাছাকাছি পৌঁছাই তত অসহিষ্ণু হয়ে উঠি বিখ্যাত গুলমার্গ দর্শনের জন্য। তার অনতি দূরে পৌঁছাতে এক দিকে নাভা পর্বত ও তার বিপরীতে শ্রীনগর শহরের ‘বার্ডস আই ভিউ’ বড় নয়নাভিরাম। কিছুক্ষণের মধ্যে গুলমার্গ উপত্যকায় আমাদের অবতরণ। ঘাসের সবুজ কার্পেটে মোড়া ব্রিটিশ আমলের বিখ্যাত গলফ কোর্টের পাশে ঐতিহাসিক ক্লাব হাউসে চারটের সময় শাহী খানাপিনার শেষে এমন সুস্বাদু ও হারদিল আযিয[18] হালুয়া পরিবেশন করা হল যার যায়েকা[19] আজীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে
ক্লাব হাউস থেকে বের হয়ে উল্টো দিকের পর্বতের তুষারাবৃত চূড়ায় সূর্যের কিরণ অদ্ভুত মনোরম দৃশ্য সৃষ্টি করছিল। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগে (গোধূলি লগ্নে) সূর্যের আভা সাদা বরফের উপর লাল আবির ছড়াতে থাকে। সেই ভুবনমোহিনী অপূর্ব দৃশ্য চাক্ষুষ না করলে হয়তো এ জীবন বৃথা হতোএত মনোরম সেই দৃশ্য যে চোখ জুড়িয়ে আসে, যা ভাষায় বর্ণনাতীত।
সেখান থেকে ফেরার আগে পাশের খিলান মার্গ যাওয়া হ’ল না, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার জন্য। সেখানে ঘোড়ায় চেপে গিয়ে ফিরে আসতে কমপক্ষে চার ঘণ্টা প্রয়োজন। তাই জম্মু কাশ্মীরের ট্যুরিজম ডিরেক্টর জনাব আসলাম বেগ আমাদের নিয়ে গেলেন গন্ডোলা লিফট স্টেশনে। আগে রোপওয়ের মাধ্যমে গুলমার্গের পাশাপাশি পাহাড়ের কিয়দাংশ দেখা যেত। এখন তার পরিবর্তে অত্যাধুনিক ফ্রেঞ্চ টেকনোলজি অনুসারে সুরক্ষিত অথচ আরও উচ্চতর স্থানে (প্রায় ২২১৩ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত) নিয়ে যায় গন্ডোলা। ঐ শব্দটা ইতালীয়, যার অর্থ ছাগ শিশু যা নরম তুলতুলে এবং সদা-চঞ্চল আর সে কারণেই সকলের প্রিয়। চতুর্দিকে কাঁচ দিয়ে ঘেরা গাড়ির মতো গন্ডোলায় চাপার সৌভাগ্য আমাদের হল না। ওটা চলাচলের সময় বিকেল চারটের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। গন্ডোলার ইঞ্জিন-রুম ও ওঠা নামার স্টেশন দেখে এবং তার সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে আমাদের আশ মেটাতে হল।
গুলমার্গ থেকে ফেরার পথে ১১০ বৎসরের পুরানো বর্ণাঢ্য চার্চ বাস থেকে দেখলাম। ফেরার সময় নিচে সন্ধ্যায় আলোক সজ্জিত শ্রীনগর শহরটা স্বপ্নপুরীর মতো মনে হচ্ছিল। চলন্ত বাস থেকে নিষ্পলক চোখে তারিয়ে তারিয়ে ঐ সৌন্দর্যের রসাস্বাদন করছিলাম। তার দিলকাশ[20] সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে মনে হচ্ছিল অতি নিকট থেকে পুঞ্জীভূত নক্ষত্রমালাকে দেখছি। শ্রীনগর শহরের মাঝখানে পৌঁছে রাতের ডাল লেকের দৃশ্য দেখে সকলের দিওয়ানা হওয়ার উপক্রম। সুশোভিত আলোর বর্ণচ্ছটায় দীপ্তিমান রাতের ডাল লেকের বর্ণনা দেওয়ার জন্য বলিষ্ঠ লেখকের কলমও পরাস্ত হতে পারে। কাশ্মীর তুমি সত্যিই ভূস্বর্গ, দিবা নিশি তুমি জান্নাত- দিনের আলোয় ফিরদৌস[21] আর রাতের অন্ধকারে জান্নাতুন নাঈম[22]!
কাশ্মীরের কিঞ্চিৎ শোভা ও সৌন্দর্য-দর্শন ফার্সি আলোচনা চক্রে উপস্থিত ফার্সিবিদদের কয়েক ঘণ্টার জন্য মূক ও বধির করে দিয়েছিল যেন সকলে এক ভাবজগতে সমাচ্ছন্ন। গেস্ট হাউসে পৌঁছে ফ্রেশ হওয়ার পরে রাতের খাওয়ার জন্য গুযারিশ[23] করা হয়। সুস্বাদু খানাপিনা পেটে পড়ার পর পাইন কাঠে পরিবৃত চারি দেওয়ালের মাঝে ও ঝাড় লন্ঠনের আলোয় শোভিত এবং সুসজ্জিত গালিচায় মোড়া বাদশাহি ডাইনিং-এ চেহেল কদমী[24] করতে করতে কয়েকজন তাত্ত্বিক ধূমায়িত চায়ের কাপে ঝড় তুলতে চেষ্টা করেন। শুরু হল তর্ক। “আলোচনা চক্রে এসেছি, কাশ্মীর দেখতে নয়পেপার পড়ার কী হবে? আলোচনার কী হল?” কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি বিভাগের অধ্যাপকবৃন্দ ও আলোচনা চক্রের উদ্যোক্তারা সকলকে শান্ত করতে প্রয়াসী হলেন- সব হবে; সবর করুন বন্ধুগণ; সব হবে, লেকিন আহেস্তা আহেস্তা।
চার তারিখ সকাল ন’টায় গেস্ট হাউস থেকে যাত্রা শুরু হল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তার নিজস্ব বাসে। সাড়ে ন’টার পর থেকে আরম্ভ হল প্রবন্ধ পড়ার প্রথম অধিবেশন। একঘণ্টা পর দ্বিতীয় পর্যায়ের অধিবেশনে ছিল এ বান্দার লেখা ‘বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সভ্যতায় ফার্সির প্রভাব’ প্রথমে সুনীতি বাবুর ও. ডি. বি. এল, সুকুমার সেনের ‘বাঙালা ভাষার ইতিবৃত্ত’, থেকে ভাষা ও বাংলায় ব্যবহৃত ফার্সি শব্দাবলীর নমুনা পেশ করলাম। তারপর মধ্যযুগের কয়েকজনের বিশেষত ভারতচন্দ্র, মধুসূদন, রামমোহন, গিরিশভাই, রাজেন্দ্র লাল মিত্র ও পরবর্তীতে নজরুল ও তাঁর রুবাঈর অনুবাদ এবং এস বি সরকারের রুবাঈর অনুবাদ ইত্যাদির উল্লেখ করলাম। শেষে বিশ্বভারতীতে ফার্সি-চর্চার রবীন্দ্র উদ্যোগে বগদানভ ও তারাপুর ওয়ালার ফার্সি-চর্চার অবদানের কথা, মুজতবা আলির উদ্ধৃতি এবং আদালতে ব্যবহৃত ফার্সি শব্দাবলীর কথা বলে আমার বৈতরণী পার করলাম। আরও কয়েকজন ফার্সিবিদ তাঁদের জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ ঐ অধিবেশনে পেশ করলেন ফার্সি, উর্দু, ইংরাজি ইত্যাদি ভাষায়। মনে হচ্ছিল ফার্সি-চর্চার ফলশ্রুতি কাশ্মীরের সহস্র ফল্গুধারার মতো প্রবল বেগে ধাবিত। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য আলোচনা পত্র ছিল কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ড রাশিদ মাজরুহের ‘Persian Poetry and Kashmiri Poetry’ ; কোলকাতা মৌলানা আজাদ কলেজের ড মানসুর আলমের ‘Contribution of Iran society in Persian Studies’; কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরাজি বিভাগের অধ্যাপক ড হামিদ মীরের ‘Exoteric Theology and Esoteric Islam in Shah Hamadan’ ইত্যাদি।
তিনটের সময় প্রবন্ধ পাঠ ও আলোচনা চক্র বন্ধ করে দুপুরের খাওয়ার দাওয়াত এল কাশ্মীরী যাফরানের সুগন্ধের মতো। বিশ্ববিদ্যালয়ের দোতলা ক্যান্টিনের প্রশস্ত লনে বাহারি শামিয়ানা টাঙিয়ে আর ঘাসের উপর গালিচা বিছিয়ে ব্যবস্থা করা হয়েছিল মেহমানদের কাশ্মীরী খানাপিনা দিয়ে মেহমাননাওয়াযির[25] এক ঘণ্টার মধ্যে গুযারিশ করা হল বিখ্যাত নিশাৎ বাগ, শালিমার বাগ ইত্যাদি দর্শনের। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে চেপে ডাল লেকের অপর প্রান্তে নিশাৎ বাগ পৌঁছালে মুঘল সম্রাট ও তাঁদের আমীর ওমরাহদের রুচিবোধের তারিফ করতে বাধ্য হতে হয়। তাঁদের গুল-বাগিচা বানানোর নান্দনিক কৌশল প্রশংসনীয়। একটা বাগান একটা ধাপে স্বয়ং সম্পূর্ণ। ঐ রকম সাত আটটা ধাপে উচ্চ থেকে নিম্নে  বিভক্ত বাগানের সমষ্টি নিশাৎ বাগপ্রতিটা ধাপের বিস্তৃত ও প্রশস্ত বাগানের মধ্যস্থল দিয়ে ঝর্ণা প্রবাহিত, আবার প্রতি বাগানের মধ্য স্থলে ফোয়ারার স্ফুরিত বারির নানা ভঙ্গির ছলাকলা বড় মনোরম। প্রতিটা ধাপের বাগানের দুই পাশে প্রশস্ত ল’নে সবুজ ঘাসের কার্পেট ও তার কেন্দ্রস্থলে বাহারি ফুলের কেয়ারি
ফুল নির্বাচনে মুঘল সম্রাটদের ছিল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। পারস্য, বাসরা, মিশর ইত্যাদি বিভিন্ন দেশ থেকে যেমন দুর্লভ গোলাপের আমদানি করেছিলেন তেমনি বাগিচার সৌন্দর্য-বর্ধন করেছিলেন লালা ও বানাফসা ফুলের চর্চা করেনিশাত বাগের পিছনের দিকে যাবারওয়ান পর্বতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে মহীরুহ চিনার-গাছ-এর বাগান রচিত। চিনার গাছের নক্সাকাটা পাতা হেমন্তের পর সোনালি থেকে ধীরে ধীরে লাল বর্ণের হয়ে অপূর্ব দৃষ্টিনন্দন হয়ে ওঠে। সম্রাজ্ঞি নুর জাহানের  ভ্রাতা আসফখান কর্তৃক স্থাপিত নিশাত বাগের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত দেখে তাঁদের রুচির তারিফ করতে বাধ্য হই। সেখান থেকে আমাদের কাফেলা চলল শালিমার বাগে। সম্রাট জাহাঙ্গিরের কাশ্মীর-প্রীতি ছিল অপরিসীম। প্রতি গ্রীষ্মে তিনি সেখানে অবসর বিনোদন করতেন। বহু আশরাফি খরচ করে তদানীন্তন জগদ্বিখ্যাত বৃক্ষ-বিশারদ ও বাগান নির্মাণ-কৌশলীদের পরামর্শ অনুযায়ী রচনা করেন শালিমার বাগ। উত্তর ভারতের বিশেষ পাথর দ্বারা সাত-আটটা ধাপে এ বাগান বিস্তৃতপ্রতি ধাপের মধ্যিখান দিয়ে জলের ধারা বয়ে চলেছে বিভিন্ন রঙের পাথর দিয়ে নক্সা করা সিঁড়ি বেয়ে। সে এক ভুবনমোহিনী দৃশ্য। দূরে কাশ্মীরের জাতীয় বৃক্ষ চিনারের ছায়ায় ঘাসের সবুজ কার্পেটের উপর বসে চারিদিক নিরীক্ষণ করতে করতে ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্মতায় নিজ সত্তাকে বিলীন করার সব থেকে বেশি উদ্ধৃত কবিতা ‘মান তান শুদাম, তু জাঁ শুদি- মান তু শুদাম, তু মান শুদি- তা কাসে না গোয়াদ বাদ আযিঁ কে মান দীগারাম তু দীগরী’[26] এর মতো দেহের সঙ্গে মন, আত্মার সঙ্গে সত্তার এমন মাখামাখি হয়ে বিভোর হয়ে যাচ্ছিলাম যে, সে অনুভূতি বর্ণনা করা যায় না শুধু উপলব্ধি করা যায়। সম্বিত ফিরে পাই উদ্যোক্তাদের আহ্বানে যে এখনো অনেক বাকি। সম্বিৎ ফিরে পেতে সময় লাগে কেননা শালিমার বাগের অপূর্ব অদ্ভুত সৌন্দর্যে মন্ত্রমুগ্ধ হতে হতে নিজের অস্তিত্ব প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু কাফেলার বাঙ্গে দরা[27] ধ্বনিত হতে বাধ্য হয়ে শালিমার বাগকে আলবিদা করতে হয় 
এবার কাফেলার অভিমুখ ‘পরীমহল’  গোধূলি লগ্নের পড়ন্ত সূর্যের আলো আঁধারিতে অবিশ্বাস্য আঁকাবাঁকা খাড়া উঁচু পাহাড়ি পথ দিয়ে ধীরে অতি সন্তর্পণে আমাদের বাস এগিয়ে চললো দুপাশে লতাগুল্মের মাঝ দিয়েপারিপার্শ্বিক পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছিল পরীদের জগতে পৌঁছানো কি অতো সোজা! তাঁদের জগতকে নিশ্ছিদ্র আব্রুময় করতে দারাশুকো নিপুণ শিল্প-রসিকের পরিচয় রেখে গেছেন পাহাড়ের এক দুর্গম শিখরে।  সেখান থেকে শ্রীনগরের আলোক-খচিত শহরটাকে স্বপ্নপুরী বলে ভুল করাটা স্বাভাবিক। পরিমহলের উচ্চতম পোর্টিকো থেকে নীচের দুটো পোর্টিকো যাওয়ার সিঁড়িগুলো পাথরের তৈরি। যেতে হয় কয়েকটা সুড়ঙ্গ অতিক্রম করে। আঁধার ঘনিয়ে আসায় পরীদের সব কটা মহল দর্শন করার সৌভাগ্য হল না। পরিমহল তৈরি হয়েছিল মোঘল সম্রাজ্ঞী ও তনয়াদের জন্য সুরক্ষিত পর্বত শিখরে যেখান থেকে তাঁরা একদিকে শ্রীনগর ও অন্য প্রান্তের নিশাৎ বাগ ও শালিমার বাগের রূপাস্বাদন করবেন লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকেপরীমহলের আলো আঁধারিতে প্রতি পদক্ষেপে অনুভূতি হচ্ছিল কারা যেন এক মহল থেকে অন্য মহলে সরে যাচ্ছে বেগানা মানুষ থেকে তাঁদের রাজকীয় আব্রু রক্ষার্থে। তাঁদের পর্দা-নাশিনীর[28] কোন রকম বিঘ্ন না হয় ও তাঁদের যথাযোগ্য সেলাম জানিয়ে এবং সকল গুস্তাখির[29] ক্ষমা প্রার্থনা করে সেখান থেকে এক প্রকার  নিষ্কৃতি নিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি।
পর্বতের উপরে ফোর্টের মতো পরীমহল থেকে ফেরার পথে আর এক আশ্চর্য শিল্প নৈপুণ্য দেখা কিসমতে লেখা ছিল। একটা উপত্যকা-প্রায় জায়গায় প্রায় চল্লিশ পঁয়তাল্লিশটা সিঁড়ি ভেঙে হাল্কা আলোর মাঝ দিয়ে পৌঁছালাম চাশমাএ শাহীর (বাদশাহি ফোয়ারা) প্রথম প্রাঙ্গণে দু’ দিকে সবুজ ঘাসের কার্পেটে বিস্তৃত বাগান । নানা বর্ণের ফল ও ফুলের কেয়ারী। পাশ দিয়ে আরও পনের-বিশটা সিঁড়ি বেয়ে আবারও এক সুসজ্জিত বাগিচা অতিক্রম ক’রে চাশমাএ শাহীর দিদার নসিব[30] হল। বিভিন্ন পাহাড়ের ঝর্ণার জলকে নানা জায়গায় প্রাকৃতিকভাবে পরিশ্রুত করে প্রস্রবণের ধারাকে একত্রিত করে এক জোড়া মাছের মুখ দিয়ে তার পরিস্ফুটন। সেই জলের খ্যাতি ভ্রমণার্থীদের কাছে এত বেশি যে জলের উৎসমুখে পৌঁছানো হয়ে ওঠে কষ্টকর। টুরিস্ট ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর সাহেবের বদান্যতায় আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্নআমরা ছাড়া অন্য মানুষদের ভিড় ছিলনা। ঐ বাদশাহি ঝর্ণার জল আকণ্ঠ পান করে মাথায় মুখে দিতে সারাদিনের ক্লান্তি নিমেষের মধ্যে গায়েব হয়ে গেল। ওখানকার কেয়ারটেকার জানালেন যে পণ্ডিত জওয়াহার লাল নেহেরুর জন্য ঐ পরিস্রুত জল প্রতিদিন কাশ্মীর থেকে দিল্লি পাঠানো হতো। আর তিনি ঐ জল ছাড়া অন্য জল গ্রহণ করতেন না। কথাটা শোনামাত্র আমাদের সকলের ঐ জলের প্রতি আগ্রহ হঠাৎ এমন বৃদ্ধি পেল যা দেখে তাঁদের মজনু বললে অত্যুক্তি হবে না।
তারপর হল ভিন্ন স্বাদের এক অভিজ্ঞতা। তখন সকলে জমায়েত হয়েছে চাশমাএ শাহী বাগিচার এক প্রান্তে ঘাসের উপর বসে শুরু হল তাৎক্ষণিক মুশায়েরা[31]আমেদাবাদ মহিলা কলেজের অধ্যাপক আহমাদ হোসেন ওফা শুরু করলেন তাঁর স্বরচিত উর্দু গযল ‘হাঁসা কার রুলায়ে, রুলা কার হাঁসায়ে’ দিয়ে। ঐ গযলের বিশেষ শে’রগুলির উদ্ধৃতি দিলে আশা করি বেআদবি হবে না।
জাওয়ানি হ্যায় দো পাল
বুঢ়াপা মুসালসাল
ও জা কার না আয়ে
এ আকার না জায়ে
ওফা আহদো পায়মা
ক্বসম ক্বওলো ওয়াদে
কোঈ ইয়াদ রাখখে
কোঈ ভুল যায়ে
হাঁসা কার রুলায়ে
রুলাকার হাঁসায়ে
                        দু’আ কার রাহা হুঁ  
                        কে মানযিল না আয়ে।
                        হাঁসা কার রুলায়ে ...[32]
স্বভাবতই সকলের সমবেত আবেদনে তাঁকে একের পর এক গযল শোনাতে হল। তার মধ্যে অন্যতম গযলঃ
            পেশ আয়ি না, আয়ি না, আয়ি নাহি
            কোঈ দিল খোল কার মিলা হি নাহি
মাওসাম আয়া, রুকা, চালা ভি গায়া
হাম সে কুছ ভি কাহা, সুনা হি নাহি।
ঘার মে রাহ কার ভি এয়সা লাগতা হ্যায়
কে জেয়সে কাভি ঘার মে রাহা হি নাহি
হুস্ন কে পাস ইউ তো সাব কুছ হ্যায়
এক নায়াব শায় ওফা হি নাহি।।
মুশায়েরার নিয়ম অনুসারে সুর করে গযলগুলো যখন পাঠ করছিলেন সকলে ‘এরশাদ, এরশাদ’ ‘বাহবা, বাহবা’ ইত্যাদি বলে কবিকে উৎসাহিত করতে কার্পণ্য করেননি। কিছুক্ষণের মধ্যে আরও শ্রোতাদের আগমনে ও তাঁদের বাহবা ধ্বনিতে চারিদিক গুঞ্জরিত হচ্ছিল। অনেকদিন লাগবে সেই খোলা আকাশের নিচে মনোরম চাশমাএ শাহীর প্রশস্ত বাগিচার মুশায়েরা ভুলতে।
গযলের রসে আকণ্ঠ রসান্বিত হয়ে ফেরার পথে রাতের ডাল লেককে দূর থেকে ছবির মতো দেখাচ্ছিল আর কিছুক্ষণ পর তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হল- দোহাই তোমাদের, আজকের রাতটুকু আমাকে ছেড়ে দাও, সুসজ্জিত ভাসমান হাউসবোটে কাটাতে। রাতের অন্ধকারকে উপেক্ষা করে আলো-ঝলমল সারিবদ্ধ হাউস-বোটগুলো মনে হচ্ছিল ভাষার অতীত তীরে দোদুল্যমান দীপ্তিছটায় উদ্ভাসিত ভাসমান স্বপ্নপুরী, যেখানে সুললিত কণ্ঠের ও বসরায়ী গোলাপের মতো টুকটুকে-মসৃণ গণ্ডের এক চঞ্চলা মৃগনয়নী কাশ্মীরী অলংকারে বিভূষিত হয়ে আমার এন্তেজার[33] করছে ‘খুশ আমদিদ[34]’ বলার জন্য। মন চঞ্চল হয়ে বলতে ইচ্ছা করছিল দোহাই তোমাদের আজ রাতটুকু ছেড়ে দাও। হাউস বোটের মায়াজাল উপেক্ষা করতে আমি অক্ষম। কর্মকর্তাদের আবেদন করেছিলাম কিন্তু আবেদন গ্রাহ্য হয়নি।  
বাস থামল। আমাদের ইস্তেকবাল[35] করার জন্য জম্মু কাশ্মীরের টুরিস্ট ডিপার্টমেন্টের ডাইনিং হলের ছেলেগুলো হিম-শীতল ঠাণ্ডায় স্পিরিট বার্নারের আভেনের উপর সারিবদ্ধ গরম খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছিল। পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে খাবারের স্বাদ যে বৃদ্ধি পায় তার সাক্ষাৎ প্রমাণ পাচ্ছিলাম। সারাদিন জ্ঞানগম্ভীর কথাবার্তার পর হালকা আলাপ আলোচনা, হাসিঠাট্টা মেজাজটাকে শরীফ করে তুলছিল।
ডাইনিং হলে ছেলেগুলোর রসবোধ আছে। আমাদের আড্ডায় কোন রকম বিঘ্ন না ঘটিয়ে তারা সকলের অজান্তে একটা দু’টো করে বাতি নেভালে আলো-আঁধারির পরিবেশ তৈরি হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে অনেকের হাই উঠতে থাকে। একে অন্যকে শাব-বাখায়র[36] বলে যে যার নিজের রুমের দিকে চলে যায়। আমিও নরম বিছানায় কম্বলের নীচে শরীরটা এলিয়ে দিইপরের দিনের সমাপ্তি অনুষ্ঠানের কথা চিন্তা করতে করতে ঘুমে কখন আচ্ছন্ন হয়ে পড়ি বুঝতে পারি না।
কাকভোরে সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণের মধ্যে তৈরি হয়ে টুরিস্ট সেন্টারের বিস্তৃত ময়দানে পৌঁছে দেখি ইতিমধ্যে সেখানে অনেকে পায়চারি করছেন। গুরুগম্ভীর পাহাড়ের উপত্যকায় সকালের ভ্রমণ অন্য এক মাত্রা এনে দেয়প্রতিমুহূর্ত জীবন সুধা রসাস্বাদন করতে সাহায্য করে। ময়দানে কিছুক্ষণ চক্কর দিয়ে একটা ঝাউ গাছের কাছে অচেনা এক ফুল গাছের পাশের বেঞ্চিতে জিরিয়ে নিতে নিতে প্রতি লহমায় অনাবিল প্রশান্তি তারিয়ে তারিয়ে অনুভব করার সময় কাশ্মীরী নাশতার ম’ম গন্ধের আকর্ষণে এগিয়ে গেলাম ডাইনিং হলের দিকে। খুরমা-মাখনের সঙ্গে ধূমায়িত চায়ের পেয়ালার কাছে কোথায় লাগে উমার খাইয়ামের সূরা-সাক্বি ও জাম। খৈয়াম জেনে রেখো সাকির হাতের জাম না পেলেও ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা কখনো হয়ে উঠতে পারে অমুল্য, অপূর্ব ও অদ্ভুত। তার নেশায় কিছুক্ষণ বুঁদ হয়ে থাকতে দাও।
এমন মাস্ত করা অবস্থা থেকে সম্বিত ফিরিয়ে দেয় জিগরের দোস্ত, চশমে বদদূর[37] ড সাইয়েদ আখতার হুসাইন।দিল্লির জে এন ইউ-র রিডার ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন লেকচারার। আখতার সাহেব আধুনিক ফার্সি তথা ইংরাজিতে সমান দক্ষ। তাঁর তাৎক্ষণিক অনুবাদ শুনলে বিস্ময়ে হতবাক হতে হয়। কিছুক্ষণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির মাশোয়ারা করে উনি আমাদেরকে বাসের দিকে যাওয়ার ফরমান জারি করলেন। যথা সময়ে বাস এগিয়ে চলল বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে। পাঁচ তারিখে দুপুরের আগে পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য এক অডিটোরিয়ামে চলল পেপার পড়া ও আলোচনা চক্র। দুটোর সময় খাওয়ার বিরতি। তার এক ঘণ্টা পর শুরু হল সমাপ্তি অনুষ্ঠান।
মঞ্চে উপস্থিত হলেন উপাচার্য। কলা ও বিজ্ঞান বিভাগের ডিনদ্বয় ও ইরান কালচারাল হাউসের সচিব। সকলের বুদ্ধিদীপ্ত বক্তব্যের পর ফার্সি স্কলার সমিতির সচিব সইয়েদ আখতার হুসাইন কর্মকাণ্ডের সংক্ষিপ্ত অথচ বুদ্ধিদীপ্ত বক্তব্যের মাঝে জম্মু বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ফার্সি খোলার প্রস্তাব পেশ করলে সকলে মিলিত ভাবে ঐ প্রস্তাব সমর্থন করেন। সর্বশেষে সমিতির সভাপতি প্রোফেসর শরীফ হোসেন কাসেমি সাহেব সকলকে শুকরিয়া পেশ করে সেমিনারের ইতি ঘোষণা করলেন। পরক্ষনেই আর একটি ঘোষণার কথা ভেসে এলো কানে, যে নিয়ম মাফিক অনুষ্ঠান শেষ হলেও কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হবে শামে গযল। ওস্তাদ গোলাম মোহাম্মদের ফার্সি সঙ্গীতের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম এই ‘কাশ্মীর-নামা’ সেই ওস্তাদের সন্তুরের মূর্ছনা শেষ হওয়ার পর শুরু হল গযলের মেহফিল।
সন্ধ্যার ধূপছায়ায় কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের টুকটুকে ফরসা কাশ্মীরী অধ্যাপক শাদাব সাহেব বিসমিল্লাহ[38] করলেন অতীব মিষ্টি সুরে গযল পেশ করে। ঐ করিতকর্মা মানুষটিকে কাশ্মীর পৌঁছানোর পর থেকে আমাদের সকলের রক্ষণাবেক্ষণে নিরলসভাবে নিযুক্ত থাকার সময় ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি তাঁর সুপ্ত প্রতিভার কথা। প্রথম গযলের কথা গুলো-
ঠুকরাও কে আব পেয়ার কারো – মেঁ নাশে মে হুঁ
তুম আপনা কারোবার কারো – মেঁ নাশে মে হুঁ[39]
হৃদয়তন্ত্রে এমন প্রভাব বিস্তার করছিল যেন সজ্ঞানে সব হারাতে পারি মাহবুবার জন্য। যেমন ফার্সি কবির উক্তিতে ‘প্রেমিকার গালের একটা তিলের তরে সামারকান্দ ও বুখারা সব হারাতে পারি।’ একটা গযলের রেশ কাটতে না কাটতে শাদাব সাহেব বিখ্যাত ফার্সি কবি হাফিয শিরাযীর-
ঈঁ আয ফোরোগে রু এ      রওশন চিরাগ দিদে
মানিন্দ চাশ্মে আহু            চাশ্মে জাওয়াঁ দিদে
ঈঁ আয ফোরোগে রু এ ...[40]
সকলকে মাত করে দিল। শ্রোতাদের বারবার আবেদনে সাড়া দিয়ে উনি সুললিত কণ্ঠে গেয়ে চললেন একের পর এক ফার্সি আর উর্দু গযল। কয়েকটা ছত্রের উদ্ধৃতি আশা করি আপনার বিরক্তির উদ্রেক করবেনা। গুস্তাখি মাফ।
কোঈ দোস্ত হ্যায় না রাকিব হ্যায়                   (তিন বার)
তেরা শাহার কিত্না আজীব হ্যায়
মেঁ কিসে কাহুঁ মেরে সাথ চাল                                (তিন বার)
এহাঁ সাব কে সাব স্বালীব হ্যায়
তেরা শাহার কিত্না আজীব হ্যায়।
তুঝে দেখ কার মে হুঁ সোচতা                     (দু’ বার)
তু হাবীব হ্যায় ইয়া রাকিব হ্যায়।
 তেরা শাহার কিত্না আজীব হ্যায়                   (দু’ বার)
কোঈ দোস্ত হ্যায় না রাকিব হ্যায়[41]                (দু’ বার)
তারপরও শ্রোতাদের গুযারিশ উপেক্ষা করতে না পেরে শাদাব সাহেব আমীর খসরুর ফার্সি ও হিন্দাবি ভাষার গযলগুলো যখন গাইছিলেন শ্রোতারা রসাস্বাদন করছিলেন নিবিষ্ট চিত্তে। খসরুর ‘এ চেহারা এ যী বা এ তু...’ এবং হিন্দাবিতে যখন মুখড়ার ‘সাজনা তু সাগরে’ গুনগুনিয়ে নিয়ে সাঁওয়ারি সাঁওয়ারি ও’ বলে গযলটা ধরলেন শ্রোতাদের মধ্যে হুলুস্থুল পড়ে গেল। যখন অন্তরায় ‘সুন মেরি সাজনা রে’-র বোল তুললেন তখন এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা বিরাজ করছিল অত গুণীজনের মেহফিলে তিনি গভীর তন্ময়তার সঙ্গে গেয়ে চললেন ‘দেখো জো মুঝকো, না ভুল না, সুন মেরে সাজনা... !! 
সূরের মূর্ছনায় বিভোর হয়ে গেলেও মনে হচ্ছিল আমাদের কলকাতার কেউ কি নেই যে আমাদের মান রক্ষা করবে? যাক ড ইফতিখার মঞ্চে উঠেছেন। আমাদের মান ইজ্জতটা অন্তত এবার রক্ষা পাবে। তিনি আমীর খসরুর হিন্দাবিতে রচিত ‘যা হালে মিসকিন মাকুন তাগাফুল’, ‘চোরায়ে নায়না, বানায়ে বাতিয়া’ আরম্ভ করলে শ্রোতাদের করতালিতে বিশাল গান্ধিভবন কেঁপে উঠল। তাঁর গযল শেষ হতে না হতে কাশ্মীরী অধ্যাপক মাসুদি সাহেব বন্ধুবর ইফতিখারকে একরকম প্রায় ঠেলে স্টেজের নীচে পাঠিয়ে আর এক উদীয়মান কবি ও জে এন ইউ-র গবেষককে আহবান করলেনতাঁর সাম্প্রতিক রচিত গযল সমঝদার শ্রোতাদের মনোগ্রাহী হল না। শ্রোতাদের মধ্যে কলকাতার ইফতিখারের পুনরায় ‘গযলখানী’-র আবেদনে বাধ্য হয়ে মাসুদি সাহেব আবারও ড ইফতিখারকে আহ্বান জানালেন। শুরু হল স্বনামধন্য আধুনিক উর্দু কবি কালিম আজিযের বিখ্যাত গযল-
দিন এক সিতাম এক সিতাম রাত কারো হো
ও দোস্ত হো দুশ্মান কো ভি তুম মাত কারো হো
হাম খাক নাশীঁ তুম সুখান-ওয়ারে বাম কারো হো
পাস আ কার মিলো দূর সে কেয়া বাত কারো হো
হামকো জো মিলা হ্যায় ও তুমহি সে তো মিলা হ্যায়
হাম আওর ভুলা দেঁ তুমহেঁ কেয়া বাত কারো হো  
ইয়ুঁ তো মুঁহ ফের কার দেখো ভি নাহি হো
জাব ওয়াক্ত পাড়ে হ্যায় তো মাদারাত কারো হো
না দামান পে কোঈ ছিঁট না খাঞ্জার পে কোঈ দাগ
তুম কাতাল কারো হো কে কারামাত কারো হো  
সুদীর্ঘ কবিতাটার শেষ অংশটা উদ্ধৃত করলে নারাজ হবেন না-
বাকনে ভি দো আজিয কো জো বোলে হ্যায় বাকে হ্যায়
দীওয়ানা হ্যায় দীওয়ানে সে কেয়া বাত কারো হো ।।
তারপরও ইফতিখারের অবিরাম কবিতা পাঠ চলল দীর্ঘক্ষণ ধরে - নানা ভাষায় ও বিভিন্ন ছন্দে ও লয়ে। ওর পরে কাশ্মীর বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রছাত্রী পর পর গযল পেশ করল কিন্তু কোথায় যেন ছন্দ পতন হচ্ছিল। শুধু ফরিদ নামক ছাত্রের স্বরচিত গযলের একটা জায়গা দোলা দিল, বিশেষতঃ আজকের ফার্সি  আলোচনা সভা অন্তের পর বিচ্ছেদের মুহূর্তকে ধরে রাখার জন্য-
‘মুসাফির হ্যাঁয় হাম ভি, মুসাফির হো তুম ভি – মুলাক্বাত হোগী’ কথাগুলোর মধ্যে বিদায়ের ব্যথায় মন ভারাক্রান্ত করে দিচ্ছিল।
তিন দিন ব্যাপী কাশ্মীরের স্বর্গীয় পরিবেশে আমরা এক পরিবারভুক্ত হয়ে কীভাবে একাত্ম হয়ে কাটিয়ে আবার ব্যথাতুর হৃদয় নিয়ে যে যার জগতে ফিরে যাব। ঘটনাচক্রে হয়তো আবার কোন মেহফিলে ‘মুলাক্বাত হোগী’ 



[1]  মন বার বার প্রশ্ন করে যে আমার কোথা হতে আগমন !
[2]  আরোহণ ও অবরোহণ
[3]  নুরুদ্দিন আব্দুর রহমান জামি (১৪১৪ – ১৪৯২) আফগানিস্তানের একজন বিখ্যাত সূফী কবি। তাঁর উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম- হাফত আওরাং, লায়লা ও মাজনু, ফাতিহাত আশ-শাবাব। 
[4]  তোমার রূপের ছটা দেখি নাই ...
[5]  শেষ পঙক্তি
[6]  কবি সম্মেলন
[7]  ক্যালিগ্রাফিতে
[8]  দু’ পঙক্তি ও চার ছত্রের প্রেমমূলক কবিতা বিশেষ 
[9]  অনুরোধ
[10]  প্রকৃতপক্ষে
[11]  হে মৃদুমন্দ বাতাস মদিনা শরীফে ধাবিত হও ও আমার অবস্থার কথা প্রিয় নবী মহাম্মদের কাছে পৌঁছে দাও।
[12]  গোপন ব্যক্তিসত্ত্বা
[13]  স্বাগতম
[14]  ক্ষুদ্র ইরান
[15]  আয়োজক ও আপ্যায়ক
[16]  মনমাতানো
[17]  চিঠি লিখে
[18]  জনপ্রিয়
[19]  স্বাদ
[20] মনমোহিনী, যা মনকে আকৃষ্ট করে।   
[21] স্বর্গের নাম  
[22]  স্বর্গের নাম
[23]  অনুরোধ
[24]  খাওয়া পর চল্লিশ পা হাঁটা
[25]  আতিথেয়তা
[26]  আমি হব কায়া, তুমি হবে প্রাণ; আমি বিলীন হব তোমার সত্ত্বায়, আর তুমি বিলীন হবে আমাতে। পাছে কেউ বলতে না পারে- আমি আর তুমি ভিন্ন।
[27]  যাত্রাকালে বিশ্রামান্তের পর পুনরায় যাত্রা শুরু করার ডাক বা ঘণ্টাধ্বনি।
[28] পর্দায় অবস্থান
[29]  বেয়াদবি
[30]  দেখার সৌভাগ্য
[31]  কবিতাপাঠ
[32]  যৌবন দু’ লহমার, বার্ধক্য দীর্ঘমেয়াদী। ও গেলে ফেরে না, আর এ আসলে যায়না। ওয়াদা, কথা, কসম ও প্রতিশ্রুতি কেউ মনে রাখে আবার কেউ ভুলে যায়। কেউ হাসিয়ে পরে কাঁদায়, আবার কেউ কাঁদিয়ে পরে হাসায়। প্রার্থনা করি, যাতে যাত্রাপথের লক্ষ্যস্থলে এখনই না পৌঁছাই
[33]  অপেক্ষা
[34]  স্বাগতম
[35]  স্বাগতম
[36]  শুভরাত্রি
[37]  কুদৃষ্টি থেকে দূর
[38]  সূচনা
[39]  প্রত্যাখ্যান করো বা প্রেম করো, আমি যে উন্মাদ। তুমি নিজের কাজ করো, আমি তো উন্মাদ।
[40]  তোমার ঐ অবয়ব আলোক রশ্মির মতো।                তোমার ঐ নয়ন হরিণীর চঞ্চল আঁখি সম। 
[41]  নহে কেহ বন্ধু, নহে নহে কেহ শত্রু
তোমার শহর কত অদ্ভূত
কারে কহি, মোর সাথে চলো
(কেননা,) এখানে সকলেই বধ
তোমার শহর বড় অদ্ভূত
তোমায় দেখে ভেবে চলেছি
তুমি কী- বন্ধু না প্রতিদ্বন্দ্বী?
তোমার এই শহর বড়ই অদ্ভূত
নহে কেহ বন্ধু, নহে নহে কেহ শত্রু