Sunday 29 December 2019

জিবরান খালিল জিবরানঃ বান গ্রামের মারতা



বান গ্রামের মার্‌তা
মূল - জিব্‌রান খালিল জিব্‌রান
অনুবাদ- আব্দুল মাতিন ওয়াসিম  

[জিবরান খলিল জিবরান। লেবাননী-আমেরিকান কবি, চিত্রশিল্পী, লেখক, দার্শনিক এবং লেবাননের জাতীয় কবি। তিনি একজন প্রথাবিরোধী লেখক ছিলেন। জন্ম লেবাননের উত্তরে বাশারি শহরে, ৬ জানুয়ারি ১৮৮৩ সালে। অল্প বয়সে পরিবারের সাথে যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে শিল্পকলা নিয়ে পড়াশুনা আরম্ভ করেন এবং সেখানেই তাঁর সাহিত্য জীবনের শুরু। ইংরেজি ও আরবি দু’ ভাষাতেই লিখেছেন। আরবি সাহিত্যের রেনেসাঁয় তার রোমান্টিক ধারা ধ্রুপদি ধারা থেকে আলাদাভাবে জায়গা করে নিয়েছে, বিশেষত তাঁর গদ্য কবিতা। ১৯২৩ সালে রচিত 'দ্য প্রফেট' (আন্‌-নাবী) তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা। পরবর্তীতে এটি চল্লিশটি বিদেশী ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এবং এটি বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক বিক্রিত বইগুলির একটি। ১০ এপ্রিল ১৯৩১ সালে নিউইয়র্কে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

()
পিতা মারা গে তখন মার্‌তা মায়ের কোলে। বয়স যখন নয়, মায়ের আশ্রয়টুকুও হারিয়ে গেল তার জীবন থেকে। বড্ড একা হয়ে গেল সে। অনাথ রূপে তার ঠাই হল এক অভাবী প্রতিবেশীর বাড়িতে। ঐ প্রতিবেশী নিজ স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে জীবন যাপন করতো সেখানে; লেবাননের সুন্দর উপত্যকাগুলির মাঝে নির্জন শস্যখেতেসম্পদ বলতে তার ছিল অল্প একটু শস্যক্ষেত এবং কিছু ফলমূলের গাছ।   

পিতা যখন মারা গেল, উত্তরাধিকার সূত্রে পিতার কাছ থেকে মার্‌তা কিছুই পেল না। শুধু পেল পিতার পদবিটা। আর একটা জীর্ণ কুটির, যেটি ছিল তাল-তমাল গাছগাছালির মাঝে। আর তার মা যখন মারা গেল, তার জন্য রেখে গেল শুধুমাত্র বেদনার অশ্রু আর অনাথের লাঞ্ছনা। ফলে, নিজ ভিটেমাটিতেই সে হয়ে গেল প্রবাসিনী। একাকী বাস করতে লাগলো উঁচু উঁচু পাথরের ঢিবি ও ঘন গাছগাছালির মাঝে।
প্রতিদিন সকালে খালি পায়ে, ছেঁড়া জামাকাপড় পরে দুগ্ধবতী গাভীর পেছন পেছন হেঁটে যেতো উপত্যকার শেষ প্রান্তে। যেখানে সবুজ ঘাসে মোড়া একটা মাঠ ছিল। সেখানে চারণভূমিতে গাভীটাকে ছেড়ে দিয়ে গাছের ছায়ায় বসে পাখীদের সাথে গান গাইত। নদীর সুরে সুর মিলিয়ে কাঁদতো। তার খুব হিংসা হতো গাভীর অফুরন্ত খাবার দেখে। কখনো ফুলের দ্রুত-বৃদ্ধি ও প্রজাপতির ডানা-মেলা নিয়ে ভাবতে ভাবতে হারিয়ে যেতো চিন্তার জগতে। অবশেষে সারা দিনের ক্লান্তি ও ক্ষুধায় কাতর হয়ে সূর্যের সাথে সেও বাড়ি ফিরতো। ঐ জীর্ণ কুটিরে ফিরে নিজ অভিভাবকের মেয়ের সাথে বসে গোগ্রাসে গিলত ভুট্টার রুটি। সাথে অল্প একটু শুকনো ফল। কখনো তেল ও সির্‌কায় ডোবানো তরকারী। তারপর শুকনো খড়কুটোর বিছানায় নিজের হাত দুটোকে বালিশ করে শুয়ে পড়তো। শুয়ে শুয়ে ভাবত, যদি জীবনটা পুরোটাই স্বপ্নচ্ছেদ ছাড়াই অন্তহীন এক গভীর ঘুমের মতো হতো! এভাবে মুহূর্তেই পাড়ি দিত ঘুমের দেশে। ভোর-সকালে অভিভাবক তাকে ধমক দিত প্রাতঃক্রিয়া সারার জন্য। তার ধমক শুনে, ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে শয্যা ত্যাগ করতো।
এভাবে বেশ ক’ বছর কেটে গেল। অসহায় মার্‌তা ঐ দূরবর্তী টিলা-উপত্যকার মাঝে গাছের ডালের মতো লিকলিকিয়ে বাড়তে থাকলো। তার অজান্তেই মনের গহীনে জন্ম নিতে লাগলো নানা আবেগ-অনুভূতি। যেমন করে ফুলের গভীরে জন্মায় সৌরভ। পরস্পর পালা করে তার চোখের সামনে ভিড় করতে লাগলো স্বপ্ন ও দুশ্চিন্তা। যেমন ভাবে পালা করে জলের ঘাটে পৌঁছোয় ভেড়ার পাল। এবার সে এক চিন্তামগ্ন কিশোরীতে পরিণত হল। অব্যবহৃত, উর্বর মাটির মতো যাতে জ্ঞান তখনো বীজ বপন করেনি এবং পরীক্ষা দ্বারা পদপিষ্টও হয়নি। আর তার মনটা উদার এবং পবিত্র। যদিও ভাগ্যের নির্মম বিধি তাকে নির্বাসিত করেছিল ঐ ক্ষেত-খামারের মাঝে। যেখানে জীবন পরিবর্তিত হয় বছরের সকল ঋতুর সাথে পাল্লা দিয়ে। যেন সে পৃথিবী ও সূর্যের মাঝে উপবিষ্ট এক অজানা বস্তুর প্রতিচ্ছবি।
আমরা যারা জীবনের অধিকাংশ সময় কোনো জনবহুল শহরে অতিবাহিত করেছি, আমরা প্রায় কিছুই জানি না তাদের সম্পর্কে এবং তাদের জীবনশৈলী সম্পর্কে যারা লেবাননের প্রান্তিক গ্রামাঞ্চলে থাকে। আমরা আধুনিক সভ্যতার প্রবাহে ভেসে চলেছি। আমরা ভুলে গেছি, অনেক সময় ভুলে যাওয়ার ভান করেছি, সস্বচ্ছতা ও পবিত্রতায় পূর্ণ সাধারণ ও সুন্দর ঐ জীবন-দর্শনকে। ঐ গ্রাম্য জীবন এমনই যে, যখনই আমরা সে-বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করি, আমরা দেখি গ্রাম্য জীবন বসন্তকালে হাস্যময়, গ্রীষ্মকালে ভারাক্রান্ত, শরৎ কালে কর্মব্যস্ত এবং শীতকালে আরামপ্রিয়। বস্তুত তা মূল প্রকৃতির সাথে সম্পূর্ণরূপে সাদৃশ্যপূর্ণ। যদিও আমরা গ্রামীণ লোকেদের তুলনায় অধিক ধনবান; তবে ওরা মনের দিক থেকে আমাদের চেয়ে ঢের উদার এবং মহৎ। আমরা চাষ করি তবে ঘরে ফসল তুলি না। কিন্তু ওরা যা কিছু চাষ করে সবই ঘরে তুলে নেয়। আমরা তো লালসার দাস। কিন্তু ওরা তুষ্টির সন্তান; অল্পতে সন্তুষ্ট হয়। আমরা জীবন-পেয়ালাকে পান করি তাতে নৈরাশ্য, আশংকা ও ক্লান্তি মিশিয়ে। কিন্তু ওরা তা পান করে খাঁটি ও নির্ভেজাল রূপে।  

মার্‌তার বয়স যখন ষোল হল, তখন তার মনটা পোলিশকৃত আয়নার মতো হয়ে গেল। তাতে ভেসে উঠত লাগলো সবুজ মাঠের প্রতিচ্ছবি। আর তার হৃদয়গহ্বর হয়ে গেল শূন্য উপত্যকার ন্যায়; ফিরিয়ে দিত লাগলো সকল শব্দের প্রতিধ্বনি।
শরতের কোনো এক বিকেলে চারিদিক তখন প্রকৃতির আর্তনাদে ভরে উঠেছে, মার্‌তা একটি ঝর্নার পাশে বসে গভীর ভাবে ভাবছে। ঝর্ণাটি ভূগর্ভ থেকে উৎসারিত হচ্ছে যেমন করে কবির কল্পনা থেকে নানা ভাবনার উৎসারণ ঘটে। সে ভাবছে গাছের হলুদ পাতাগুলোর অস্থিরতা নিয়ে, ঐ পাকা পাতাগুলোর সাথে বাতাসের ক্রীড়াকৌতুক নিয়ে; যেন মৃত্যু মানব-আত্মা নিয়ে খেলা করছে। তারপর, সে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল ফুলের উপর। দেখতে পেল, ফুলগুলো ধীরে ধীরে নির্জীব হয়ে যাচ্ছে, শুকিয়ে যাচ্ছে, এক সময় ফেটে গিয়ে তার বীজগুলো ঝরে পড়ছে মাটিতে। আর ঐ মাটি বীজগুলোকে নিজ গর্ভে গুছিয়ে রাখছে যেমন করে মেয়েরা নিজেদের গয়নাগাটি, সোনারূপা লুকিয়ে-গুছিয়ে রাখে যুদ্ধ-বিগ্রহের দিনগুলিতে।      
গাছপালা ও ফলমূলের দিকে তাকিয়ে সে ভাবছে নানা কথা। আর গ্রীষ্মের বিচ্ছেদ-জ্বালায় পুড়ছে তার অনুভূতি, দগ্ধ হচ্ছে মনন। এমন সময় শুনতে পেল উপত্যকার কাঁকুরে মাটির উপর খুরের শব্দ। ফিরে তাকাতেই দেখতে পেল, এক অশ্বারোহী ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসছে। তার হাবভাব ও পোশাকআশাক দেখে মনে হচ্ছে যুবক বেশ অভিজাত ও চতুর। ঝর্ণার কাছে পৌঁছে ঘোড়ার পীঠ থেকে নেমে এলো। দু’ পা এগিয়ে গিয়ে মিষ্টি ও কোমল স্বরে মার্‌তাকে সম্বোধন করলো। অমন করে তাকে কেউ কোনোদিন সম্বোধন করেনি। তারপর তাকে জিজ্ঞেস করলো— “আমি সমুদ্র-তীরে যাওয়ার পথ হারিয়ে ফেলেছি। তুমি কি আমাকে একটু পথ বলে দেবে?” মার্‌তা ঝর্ণার ধারে সোজা হয়ে দাঁড়াল। উত্তর দিল— “জি, আমি জানি না। আমার অভিভাবক জানেন। আমি বাড়ি গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করবো।” তার কথায় লজ্জার ভাব স্পষ্ট রূপে ফুটে উঠছিল। লজ্জাশীলতায় তার কোমলতা ও সৌন্দর্য দ্বিগুণ বেড়ে গেছিল। ফলে যখন সে যাওয়ার উপক্রম করল, অশ্বারোহী তাকে দাঁড় করালো। তার শিরাউপশিরায় ততোক্ষণে যৌবনের উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়েছে। তার দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটেছে। বললো— “থাক তোমাকে যেতে হবে না।” তার ঐ কথা শুনে মার্‌তা থমকে দাঁড়াল। ওর মনে হল, ঐ অশ্বারোহীর কণ্ঠে এমন এক শক্তি আছে, যা ওকে নড়তে দিচ্ছে না। লজ্জায় সে আড়চোখে একবার ওর দিকে তাকালো। দেখল, লোকটা গভীর ভাবে কী যেন ভাবছে; তার মানে-মতলব-অর্থ কিছুই বুঝে আসলো না। এবং ঠোঁটে এক মায়াবী হাসি, যা দেখে কান্না পাচ্ছিল তার। আরও দেখল, ঐ লোকটা বেশ আগ্রহ সহকারে তাকিয়ে আছে তার খালি পা, নিটোল-সুন্দর হাত, চিকণ গ্রীবা ও ঘন-মোলায়েম চুলের দিকে। অন্যদিকে, অশ্বারোহী-যুবক তখন মুগ্ধ হয়ে ভাবছে, কীভাবে সূর্য এর ত্বককে এত উজ্জ্বল করেছে, এবং প্রকৃতি এর হাত দুটোকে এত মজবুত ও সুডোল করেছে! মার্‌তা তখনো মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার আর বাড়ি ফেরার ইচ্ছে হচ্ছে না; কোনো কথাও সে বলতে পারছে না। এবং কেন অমন মনে হচ্ছে তার কারণও বুঝতে পারছে না।    

সে-দিন সন্ধায় দুগ্ধবতী গাভীটা একাই খামারে ফিরে এলো। অভিভাবক ক্ষেত থেকে ফিরে দেখল, মার্‌তা নেই। দ্রুত ঐ উপত্যকায় গেল। বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করল। কিন্তু মার্‌তার কোনো হদিশ পেল না। মার্‌তা, মার্‌তা বলে চিৎকারও করল। উত্তরে শূন্য উপত্যকা ও বাতাসের আর্তনাদ তাকে তারই প্রতিধ্বনি ফিরিয়ে দিল। হতাশ হয়ে ফিরে এলো নিজ কুঁড়ে ঘরে। স্ত্রীকে খবর দিল। হতভাগিনী নীরবে সারা রাত কাঁদলো। আর মনে মনে বিড়বিড় করতে থাকলো, একবার আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম তাকে, হিংস্র-বন্য পশুদের দাঁত ও নখের মাঝে। তারা তার শরীর ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছিল আর সে একবার হাসছিল, একবার কাঁদছিল!  
ঐ সুন্দর ও সবুজ ক্ষেতখামারের মাঝে মার্‌তার জীবন সম্পর্কে আমি যা কিছু জানতে পেরেছিলাম, এটা ছিল তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ। আমি এই কথাগুলো জেনে ছিলাম এক গ্রামীণ বৃদ্ধের কাছে। ঐ বৃদ্ধ মার্‌তাকে চিনত যখন মার্‌তা শিশু ছিল। তারপর কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পৌঁছল। এবং একদিন ঐ এলাকা থেকে নিখোঁজ হয়ে গেল। পেছনে ফেলে গেল শুধু মাত্র ক’ফোটা অশ্রু তার পালিতা মায়ের চোখে। আর কিছু টুকরো স্মৃতি; যা পূবালী বাতাসের সাথে সকাল সকাল ঐ উপত্যকায় ভেসে বেড়ায়। তারপর আস্তে আস্তে বিলুপ্ত হয়ে যায়; যেমন করে জানালার কাঁচে কোনো শিশুর হাতের ছাপ বিলুপ্ত হয়।

(খ)
১৯০০- শরৎকাল। উত্তর লেবাননে এক সপ্তাহ ছুটি কাটিয়ে বৈরুতে ফিরলাম। বিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়ার পূর্বে আরও এক সপ্তাহ কাটালাম বন্ধুবান্ধবদের সাথে, শহরের অলিগলিতে ঘুরে বেড়িয়ে। স্বাধীনতার স্বাদ আস্বাদন করলাম; যার প্রতি লালায়িত থাকে যৌবনকাল। বিদ্যালয়ের চার-দেওয়ালের মাঝে এবং বাড়িতে যে স্বাধীনতা পাওয়া যায় না। ঐ ক’টা দিন আমরা ছিলাম পাখীর মতো। সামনে খাঁচার দরজা খোলা। মুক্ত বিহঙ্গে মন মতো উড়ে বেড়িয়ে, গান গেয়ে নিজেদের মনোবাসনা পূর্ণ ও তৃপ্ত করলাম। বস্তুত, যৌবন এক সুন্দর স্বপ্ন। বইয়ের অনুশীলন, লেখাপড়া ও ক্যারিয়ারের চক্রব্যূহ তার মোহভঙ্গ করে। তার সৌন্দর্যকে কেড়ে নিয়ে একটা রুঢ় ও স্বাদহীন সময়ে রূপান্তরিত করে। এমন কোনো সময় কখনো আসবে কি জানি না, যখন পণ্ডিতগণ জ্ঞানের স্বাদ ও যৌবনের স্বপ্নকে একাত্ম করতে পারবেন; যেমন ভাবে পরস্পরে ঘৃণাকারী হৃদয়গুলোকে ভর্ৎসনা ও তিরস্কার মিলিত করে? যখন প্রকৃতি হবে আদম-সন্তানের শিক্ষক, মানবতা হবে বই, আর জীবন হবে বিদ্যালয়? অমন সময় কখনো কি আসবে? আমার জানা নেই। তবে আমার ধারণা, আমরা ধীর গতিতে এগিয়ে চলেছি আত্মিক উন্নতির পথে। আর তা হল নিখিল বিশ্বের সৌন্দর্যকে উপলব্ধি করা অনুভূতি ও ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে। এবং সেই সৌন্দর্যকে ভালোবেসে কল্যাণ ও প্রাচুর্যের প্রার্থনা করা।    
একদিন সন্ধ্যায় আমি বসে ছিলাম বাড়ির বারান্দায়। চিন্তা করছিলাম শহরের অলিগলিতে অব্যাহত জীবন-সংগ্রাম নিয়ে। শুনতে পাচ্ছিলাম হোকারদের চিৎকার-চেঁচামেচি। তারা প্রত্যেকে হাঁক ছাড়ছিল, তার কাছে যে খাবার ও সামগ্রী আছে তা সবচেয়ে ভালো। এমন সময়, একটি পাঁচ বছরের শিশু আমার কাছে আসলো। গায়ে ছেঁড়াফাটা কাপড়। কাঁধে একটা থালা। তাতে ক’টা ফুলের তোড়া। দুর্বল স্বরে – উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া লাঞ্ছনা ও বেদনা-ভরা অবজ্ঞা তার স্বরকে আরও ক্ষীণ করে দিয়েছিল – বলল— স্যার, একটা ফুল নেবেন?  
আমি ওর ছোট্ট ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকালাম। দেখতে পেলাম, ওর চোখ দুটোয় দুঃখ ও দারিদ্র্যের ছাপ স্পষ্ট। মুখটা অল্প একটু ফাঁকা হয়ে আছে; যেন কোনো ব্যথিত বুকে একটা গভীর ক্ষত। হাত দুটো দুর্বল, নগ্ন ও কৃশকায়। ছোট্ট ও শীর্ণকায় দেহটা ন্যুব্জে আছে ফুলের থালাটার ভারে। যেন সে সজীব ঘাসের মাঝে শুষ্ক ও হলদে গোলাপের একটা ছোট্ট ডাল। এসব কিছুই আমি এক লহমায় লক্ষ্য করলাম; ঠোঁটে এক চিলতে হাসির মাধ্যমে তাকে একটু স্নেহ করে। বাস্তবে ঐ এক চিলতে হাসি অশ্রু অপেক্ষা অধিক তিক্ত ছিল। ঐ এক চিলতে হাসি বেরিয়ে আসে আমাদের হৃদয়-গহীন থেকে। ফুটে ওঠে আমাদের ঠোঁটে। যদি আমরা সেই হাসিকে তার মতো করে ছেড়ে দিই তাহলে তা আরও উপরে উঠে চোখ দিয়ে ঝরে পড়বে। তারপর আমি তার কাছ থেকে একটা ফুল কিনলাম। আমার উদ্দেশ্য ছিল তার সাথে একটু কথা বলা। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, ওর ঐ দুঃখে ভারাক্রান্ত চোখ দুটোর আড়ালে একটা ছোট্ট কচি হৃদয় ভাঁজ হয়ে আছে দীর্ঘ ও স্থায়ী অভাবের করুণ অধ্যায়ের উপর। যুগের মঞ্চে যা অভিনীত হচ্ছে। খুব কমজনই অমন করুণ দৃশ্যকে গুরুত্বসহ অবলোকন করে। তবে আমি যখন তাকে স্নেহ-মাখানো শব্দে ডাকলাম, ও খানিকটা আশ্বস্ত হল। খানিকটা সহজ হল। অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। কারণ তার মতো পথশিশুরা তো অমন স্নেহ-জড়ানো কণ্ঠে অভ্যস্ত নয়। অধিকাংশ লোকজন তো তাদেরকে সমাজের জঞ্জাল মনে করে। সময়ের বিষাক্ত তীরে ওরা আহত ও ক্ষতবিক্ষত সে-কথা বিশ্বাসই করে না। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম— তোমার নাম কী?   
মাথা নীচু করে উত্তর দিল— আমার নাম ফুয়াদ।
— তুমি কার ছেলে? কোথায় থাকো?
— মার্‌তা আল্‌-বানিয়াহ্‌র ছেলে।
— তোমার বাবা কোথায়?
“বাবা” শব্দটা শুনে ছোট্ট মাথাটা নাড়ালো। বুঝিয়ে দিল যে বাবা কী জিনিস সে জানে না। অতঃপর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম— ফুয়াদ, তোমার মা’ কোথায়?
— বাড়িতে, অসুস্থ।   
ওর মুখ থেকে ঐ ক’টা শব্দ শোনা মাত্রই আমার অনুভূতির আকাশে ফুটে উঠতে লাগলো এক দুঃখী, অভাগিনীর করুণ ছবি। মুহূর্তেই বুঝে গেলাম, হতভাগিনী মার্‌তা যার গল্প আমি ঐ গ্রামীণ বৃদ্ধের কাছে শুনেছিলাম ও এখন বৈরুতে অসুস্থ হয়ে পড়ে আছে। ঐ কিশোরী যে গতকাল উপত্যকার গাছপালার মাঝে নিরাপদে জীবন যাপন করছিল এখন শহরে অভাব-অনটনের যাতনা-যন্ত্রনায় বিদ্ধ। সেই অনাথ কিশোরী যে নিজ কৈশোরকে প্রকৃতির কোলে কাটিয়েছে সুন্দর সবুজ মাঠে গাভী চরিয়ে এখন শহরের নোংরা নদী-ভাঙ্গনের সাথে ভেসে যাচ্ছে। এবং দুঃখ-দুর্দশার জালে আটকা পড়েছে। 
আমি এসব কথা ভাবছিলাম। আর আমার কল্পনায় ভেসে উঠছিল সে-সবের ছবি। অন্যদিকে, ছেলেটা অপলক তাকিয়ে ছিল আমার দিকে। যেন সে তার শিশু মনের চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছিল আমার হৃদয়ের চূর্ণবিচূর্ণ হওয়াকে। যখন সে মুখ ঘুরিয়ে যেতে লাগলো খোপ করে তার হাতটা ধরে বললাম— আমাকে তোমার মায়ের কাছে নিয়ে চলো। আমি তাকে দেখতে চাই। অবাক হয়ে, নিঃশব্দে সে আমার আগে আগে হাঁটতে লাগলো। মাঝে মাঝে সে পেছন ফিরে দেখছিল, আমি তার পেছন পেছন হাঁটছি  কি না?      
সেই সংকীর্ণ নোংরা গলিতে, যেখানে বাতাসে মিশে থাকে মৃত্যুর নিঃশ্বাস, ঐ ভাঙাচোরা বাড়িগুলোর মাঝে, যেখানে মন্দ লোকেরা অন্ধকারের আড়ালে পাপকর্ম করে, কালো সাপের মতো ঐ সর্পিল রাস্তার বাঁকে বাঁকে আমি হাঁটছিলাম বুকে ভয় ও আশংকা নিয়ে ঐ ছোট্ট শিশুর পেছন পেছন। যার তারুণ্য ও হৃদয়ের স্বচ্ছতা হতে ঠিকরে ঠিকরে পড়ছিল এক অদ্ভুত সাহসিকতা। প্রাচ্যবাসীদের নজরে সিরিয়ার কনে ও রাজা-বাদশাদের মুকুটের মণি এই বৈরুত শহরের রুঢ় ও নির্দয় লোকেদের প্রতারণা সম্বন্ধে যারা ওয়াকিবহাল তারাও ওর ঐ সাহসিকতা কখনো অনুভব করতে পারবে না। অবশেষে আমরা পৌঁছলাম বসতির শেষপ্রান্তে। ছেলেটি একটা পোড়ো বাড়িতে ঢুকল; কালের ছোবলে যার চারিদিকই ছিল ভগ্নপ্রায়। তার পেছনে আমিও ঢুকলাম। যত কাছে যাচ্ছিলাম আমার হৃদয়ের স্পন্দন তীব্র হচ্ছিল। শেষে গিয়ে দাঁড়ালাম একটা স্যাঁতস্যাঁতে ঘরের মাঝখানে। ঐ ঘরে কোনো আসবাবপত্র কিছুই ছিল না। শুধু ছিল একখানা প্রদীপ, যার ক্ষীণ আলো হলদে রঙের তীর দিয়ে অন্ধকারকে বশে আনার ব্যর্থ চেষ্টা করছিল। আর ছিল একটা মামুলী চৌকী। ওসব দেখে তাদের দারিদ্র্য ও দুর্দশা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। ঐ চৌকীর উপর দরাজ হয়ে পড়েছিল এক মহিলা; খানিকটা ঘুমের ঘোরে। তার মুখটা ছিল দেওয়ালের দিকে। যেন সে সমাজের নিপীড়ন থেকে বাঁচতে দেওয়ালের কাছে আশ্রয় চাইছে। অথবা ওর মনে হয়েছে মানুষের হৃদয়ের তুলনায় দেওয়ালের হৃদয় অধিক কোমল ও দয়ালু। ছোট্ট শিশুটি যখন কাছে গিয়ে তাকে ডাকল— মা! ঐ মহিলা ঘুরে তাকাল। দেখল, ছেলে আমার দিকে ইশারা করছে। ছেঁড়াফাটা লেপটা একটু নড়ে উঠলো। একের পর এক ওঠা শ্বাসে অবরুদ্ধ এবং তীব্র যন্ত্রণায় কাতর কণ্ঠে সে বলল—         
বাবু সা’ব, আপনি কী চান? আপনি কি আমার শেষ জীবনটুকু কিনে আপনার প্রবৃত্তির কদর্যতায় কালিমালিপ্ত করতে এসেছেন? এখান থেকে চলে যান। এই বসতিটা এমন মেয়েতে ভর্তি, যারা আপনার কাছে অল্প মূল্যে তাদের শরীর ও মন বিক্রি করতে প্রস্তুত। আপনি তাদের কাছে যান। আমার কাছে বেচবার মতো কিছুই নেই। অবশিষ্ট নিঃশ্বাসটুকু অতি শীঘ্রই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। কিছুক্ষণ পরেই মৃত্যু এসে কবরের বিশ্রামের বিনিময়ে এই নিঃশ্বাসটুকুও কিনে নেবে!
ঐ কথাগুলো ছিল তার দুঃখী জীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ। সে-সব শুনে আমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল। আমি তার কাছে গেলাম এবং আমার আবেগ ও অনুভূতি আমার কথার মধ্যে নিশ্চিত ফুটে উঠবে এই আশা নিয়ে বললাম—
মার্‌তা, আমাকে ভয় পেয়ো না। আমি তোমার কাছে কোনো ক্ষুধার্ত পশু রূপে আসিনি। একজন সমব্যথী মানুষ রূপে হাজির হয়েছি। আমিও লেবাননের অধিবাসী। বহু দিন কাটিয়েছি সেই উপত্যকায় এবং ধান ক্ষেতের পাশে ঐ গ্রামগুলিতে। আমাকে ভয় পেয়ো না তুমি, মার্‌তা!
সে আমার কথাগুলো শুনলো। তার মনে হল, ঐ কথাগুলো তার ব্যথায় ব্যথিত মনের ভেতোর থেকে উৎসারিত হচ্ছে। বিছানার উপরেই একটু নড়ে উঠল। যেমন করে পাতাবিহীন কচি ডাল শীতের বাতাসের ছোঁয়ায় নড়ে উঠে। তারপর দু’ হাত দিয়ে মুখ ঢেকে নিল; যেন সে নিজেকে আড়াল করতে চাইছে সেই স্মৃতি থেকে, যা তার মিষ্টতার কারণে ভয়ঙ্কর ও সৌন্দর্যের কারণে তিক্ত হয়ে গেছে। আর্তনাদ-মেশানো দীর্ঘ ও গম্ভীর নীরবতার পর তার মুখটা বেরিয়ে এলো কম্পমান দু’ হাতের আড়াল থেকে। লক্ষ্য করলাম, তার ভারাক্রান্ত চোখ দুটো নিবদ্ধ হয়ে আছে কামরার শূন্যে ভাসমান এক অদৃশ্য বস্তুর প্রতি। শুষ্ক ঠোঁট দুটো হতাশার তীব্রতায় নড়ছে। আর গলায় ইতস্তত করছে মৃত্যুর গোঙানি। তাতে মিশে আছে চাপা কান্নার স্বর। অতি শীঘ্রই যাতে ছেদ পড়বে। অতঃপর সে বলল, আর তার কণ্ঠ অনুরোধ ও দয়াভিক্ষার কারণে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছিল এবং দুর্বলতা ও যন্ত্রণায় বুজে আসছিল। সে বলল—
আপনি দয়ালু ও স্নেহপ্রবণ রূপে এসেছেন। আকাশের মালিক যেন আমার পক্ষ থেকে আপনাকে এর উত্তম প্রতিদান দেন; যদি পাপিষ্ঠার প্রতি দয়া করাটা পুণ্যের কাজ হয় এবং পতিতা ও নীচ লোকেদের প্রতি স্নেহ প্রবণতা সঠিক হয়! তবে আমি আপনাকে অনুরোধ করছি, আপনি যেখান থেকে এসেছেন সেখানেই ফিরে যান। এই জায়গায় আপনার অবস্থান আপনার জন্য লজ্জা ও লাঞ্ছনা বয়ে আনবে। আমার প্রতি করুণা ও স্নেহের বিনিময়ে আপনার কপালে জুটবে অপমান ও বদনাম। শূকরের ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি এই কামরায় আপনাকে কেউ দেখে ফেলুক তার আগেই আপনি ফিরে যান। আর যাবার বেলা দ্রুত হাঁটবেন। এবং কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে রাখবেন। যাতে পথচারীরা আপনাকে চিনতে না পারে। আমার প্রতি আপনার মনে যে দয়া ও স্নেহ তাতে কি আমার পবিত্রতা ফিরে আসবে? বলুন! আমার কলঙ্ক কি মুছে যাবে? আর না মৃত্যুর নির্দয় আঘাত থেকে রেহাই পাবো! আমার দুর্ভাগ্য ও পাপের দরুন আমি এই অন্ধকার গর্তে পড়েছি। তবে আপনার দয়ালু মনের কারণে আপনি যেন কলঙ্কিত না হন! তাই আপনি এখান থেকে চলে যান। আমি কবরস্থানে বসবাসকারী কুষ্ঠরোগীর ন্যায়। আপনি আমার কাছে আসবেন না। না হলে সমাজ আপনাকেও নোংরা ভাববে। এবং আপনাকেও বহিষ্কার করবে। আপনি এখুনি ফিরে যান। ঐ পবিত্র উপত্যকায় আমার নাম আর উল্লেখ করবেন না। কারণ রাখাল তার মেষপালের কথা ভেবে পাঁচড়ায় আক্রান্ত মেষকে তাড়িয়ে দেয়। যদি কখনো কোনো প্রসঙ্গে আমার নাম আসে, অন্য কিছু বলার দরকার নেই; শুধু বলবেন, মার্‌তা মারা গেছে। তারপর সে তার ছেলের কচি হাত দুটো ধরল এবং পরিতাপের সাথে চুমু খেয়ে দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল—          
লোকজন আমার ছেলেকে ঘৃণা ও অবজ্ঞার চোখে দেখবে। বলবে, এটা পাপের ফসল। পতিতা মার্‌তার সন্তান। লজ্জার সন্তান। এটা অঘটনের সন্তান। অনাকাঙ্ক্ষিত। তারা আরও অনেক কিছু বলবে। কারণ তারা অন্ধ; সত্যটা দেখতে পায় না। তারা নির্বোধ; তারা জানে না যে, ওর মা নানা যাতনা-যন্ত্রণা সহ্য করেও ওর শৈশবকে নির্মল ও পবিত্র করে রেখেছে। চরম দুঃখ-দুর্দশা সত্ত্বেও ওর জীবন থেকে ঐ নোংরা ছায়াকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। কিছুক্ষণ পরেই আমার মৃত্যু হবে। আর সে পথশিশুদের মাঝে এই কঠিন জীবন পথে একাকী অনাথ রূপে পড়ে থাকবে। আমি তার জন্য রেখে যাব এক ভয়ঙ্কর স্মৃতি। যদি সে ভীরু ও কাপুরুষ হয় তাহলে ঐ সব স্মৃতি মনে করে লজ্জা পাবে। কিন্তু যদি বীরপুরুষ এবং ন্যায়পরায়ণ হয় তাহলে সে-সব কথা মনে করে তার রক্ত টগবগ করে ফুটবে। যদি আকাশ তাকে রক্ষা করে এবং সে শক্তিশালী যুবক হয় তাহলে তার ও তার মা’র প্রতি যারা অত্যাচার করেছে তাদের থেকে প্রতিশোধ নিতে আকাশ তাকে সাহায্য করবে। কিন্তু যদি তার মৃত্যু হয় এবং কালের করাল গ্রাস থেকে সে মুক্তি পায় তাহলে আলো ও সুখের ঠিকানায় আমার সাথে তার দেখা হবে; আমি সেখানেই তার অপেক্ষায় থাকবো।  
আমি মন থেকে বললাম— মার্‌তা, তুমি কবরস্থানে থাকতে পারো, তবে তুমি কুষ্ঠরোগী নও। সময় তোমাকে নোংরা লোকেদের মাঝে নিক্ষেপ করেছে, তবে তুমি নোংরা নও। শরীরের নোংরা পবিত্র মনকে কখনো কলুষিত করতে পারে না। স্তূপীকৃত বরফ কখনো জীবন্ত বীজকে ধ্বংস করতে পারে না। এই জীবনটা তো দুঃখের খামারবাড়ি। এখানে ফসল দেওয়ার পূর্বে হৃদয়গহীনকে পিষ্ট করা হয়। তবে দুর্ভাগ্য সে-সব শিষ ও মঞ্জরির যেগুলি খামারের বাইরে চলে যায়। কারণ সেগুলোকে হয় পিঁপড়ে তুলে নিয়ে যায় মাটির ভেতোরে, নয়তো পাখির ঝাঁক আকাশে। কৃষকের গোলায় তার জায়গা হয় না।
মার্‌তা, তুমি অত্যাচারিত, পীড়িত। তোমার উপর অত্যাচার করেছে প্রাসাদের সন্তানরা; যারা বিত্তবান কিন্তু মনের দিক থেকে ছোটলোক। তুমি পীড়িত, ঘৃণিত এবং অবহেলিত। আর মানুষের জন্য অত্যাচারীর থেকে অত্যাচারিত, নিপীড়ক থেকে নিপীড়িত হওয়াই শ্রেয়। উপযুক্ত এটাই যে, সে মৃত্তিকার ন্যায় সহনশীল ও নমনীয় হবে। তার জন্য এমন বলশালী ও কঠোর হওয়া উচিৎ নয় যে, নিজ সামর্থ্যের বলে জীবন পুষ্পকে চূর্ণ করে দেবে। নিজ প্রবৃত্তির জন্য সুন্দর অনুভূতিগুলোকে বিকৃত করে দেবে।
মার্‌তা, আত্মা হল একটা সোনার বৃত্ত; ঐশ্বরিক ধারা হতে  নির্গত। জ্বলন্ত আগুন ঐ বৃত্তকে জ্বালিয়ে তার আকৃতি পরিবর্তন করতে পারে। তার বৃত্তাকারের সৌন্দর্য নষ্ট করতে পারে। তবে ওর সোনাটাকে অন্য কোনো ধাতুতে রূপান্তরিত করতে পারে না। বরং ওর উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি করে। কিন্তু দুর্ভোগ শুকনো খড়কুটো ও গাছপালার। যখন আগুন তাকে স্পর্শ করে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। তারপর বাতাসের সাথে ভেসে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায় মরুভূমির বুকে।
মার্‌তা, তুমি হলে এক পদপিষ্ট পুষ্প। তোমাকে মানুষ আকৃতির পশুরা পা দিয়ে মাড়িয়ে দিয়েছে। তোমাকে পদদলিত করেছে তাদের জুতো দিয়ে কঠোরভাবে। কিন্তু তোমার সুবাসকে গোপন করতে পারেনি। বরং তোমার সুবাস বিধবাদের বিলাপ, অনাথদের আর্তনাদ ও অভাবগ্রস্থদের দীর্ঘশ্বাসের সাথে দয়া ও ন্যায়ের উৎস আকাশে পৌঁছে গেছে। মার্‌তা, তুমি ভাগ্যবতী যে তুমি পদপিষ্ট পুষ্প; পদদলনকারী পা নও। অতএব তোমার উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। তুমি নিজেকে শান্ত করো। মনকে প্রবোধ দাও।        
আমি বলছিলাম। আর সে মন দিয়ে শুনছিল। আমার ঐ ক’টা সান্ত্বনা-বাক্য শুনে সে একটু আশ্বস্ত হল। তার হলদে-বিবর্ণ মুখটা একটু উজ্জ্বল হল। যেমন ভাবে গোধূলির স্নিগ্ধ ও মনোরম আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে মেঘপুঞ্জ। সে আমাকে ইশারা করলো। আমি কাছে গিয়ে তার বিছানার এক পাশে বসলাম। অবলোকন করতে লাগলাম, তার হাবভাব তার দুঃখী মনের গোপন কথাগুলো বলে দিচ্ছিল। আমি অবলোকন করছিলাম তার হাবভাব যে  জানে কিছুক্ষণ পরেই তার মৃত্যু হবে, তার হাবভাব জীবনের বসন্তে কিশোরী অবস্থায় যে শুনতে পেয়েছে মৃত্যুর পদধ্বনি নিজ জীর্ণ বিছানার চারপাশে, ঐ পরিত্যাক্ত যুবতীর হাবভাব যে গতকাল লেবাননের সুন্দর উপত্যকার মাঝে জীবনশক্তিতে ভরপুর ছিল আর এখন জরাজীর্ণ, জীবনের বন্ধন থেকে মুক্তি পাবার অপেক্ষায়; তার হাবভাব অনেক কথাই বলছিল। দীর্ঘ নীরবতার পর অবশিষ্ট শক্তি একত্রিত করে সে বলতে লাগলো; আর কথার সাথে তাল মিলিয়ে দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরতে লাগলো এবং নিঃশ্বাসের সাথে প্রাণপাখীও ওঠানামা করতে লাগলো—     
হ্যাঁ, আমি পীড়িতা। এক মানুষরূপী পশু কর্তৃক নিহত হয়েছি। আমি পদপিষ্ট পুষ্পসম। সে-দিন আমি বসে ছিলাম ঝর্ণার ধারে। ঐ যুবক ঘোড়ায় চেপে আমার পাশ দিয়ে অতিক্রম করলো। কোমল ও কমনীয় কণ্ঠে আমায় সম্বোধন করলো। বলল, আমি সুন্দরী, দেখতে অপূর্ব। সে আমাকে ভালোবেসে ফেলেছে। আমাকে ছেড়ে কখনো কোথাও যাবে না। পুরো পৃথিবী হিংস্র জন্তুজানোয়ারে ভরা। উপত্যকায় পাখী ও শেয়ালের আবাস। আরও অনেক কথা...। তারপর আমার কাছে এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরল। চুমু খেলো। আমি অনাথ ও পরিত্যাক্ত, জীবনে সেদিনই প্রথম চুমুর স্বাদ পেলাম। আমাকে সে ঘোড়ার পীঠে তার পেছনে বসালো। আমাকে নিয়ে গেল এক নির্জন, সুন্দর-সাজানো বাড়িতে। বাজার থেকে রেশমের জামাকাপড়, মনোরম সুগন্ধি, সুস্বাদু খাবার ও চমৎকার পানীয় নিয়ে এলো। হাসিমুখে সবকিছু করলো। নিজ পাশবিক চাহিদা ও অসৎ উদ্দেশ্যকে নম্র আলাপচারিতা ও প্রেমমূলক ইশারা-ইঙ্গিতের আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিলো। অতএব আমার শরীরকে ভোগ করার পর আমাকে লাঞ্ছনায় ভারাক্রান্ত করে পালিয়ে গেল। আমার গর্ভে রেখে গেল এক জীবন্ত জ্বলন্ত অঙ্গার। যা আমার কলিজা থেকে আহার গ্রহণ করছিল। দ্রুত বড় হচ্ছিল। কিছু দিন পর এই অন্ধকার জগতে ধূম্র-বেদনা ও বিষাদ-ক্রন্দনের মাঝে তার আবির্ভাব হল। এভাবেই আমার জীবন দুটো ভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। একটা দুর্বল ও বেদনায় কাতর। অপরটা অত্যন্ত ছোট, চিৎকার করতে লাগলো নীরব রাতে ফিরতে চেয়ে প্রশস্ত প্রাঙ্গনে। ঐ প্রতারক আমাকে এবং আমার দুগ্ধপোষ্য শিশুকে সেই নির্জন বাড়িতে ফেলে গেল। আমরা যুঝতে থাকলাম তীব্র ক্ষুধা, প্রচণ্ড শীত ও একাকীত্বের যন্ত্রণার সাথে। কান্না ও বিলাপ ছাড়া কেউ আমাদের সাহায্যকারী ছিল না। সেখানে আশংকা ও দুশ্চিন্তা ছাড়া আমাদের কোন নৈশসঙ্গী ছিল না।       
তার বন্ধুরাও আমার ঠিকানা জানতে পারল। আরও জানতে পারল আমার অভাব ও দুর্বলতার কথা। তারা একে একে আমার কাছে হাজির হল। সকলে অর্থের বিনিময়ে আমার সম্ভ্রম কিনতে চেয়েছিল। দু’মুঠো খাবারের বদলে আমার শরীর ভোগ করতে চেয়েছিল। আহ্‌ কতবার আমি নিজেকে শেষ করতে চেয়েছি। নিজ হাতে টুঁটি চেপে আত্মহত্যা করতে চেয়েছি। কিন্তু পারিনি। কারণ তখন জীবনটা শুধু আমার একার ছিল না। আমার জীবনে আমার অংশীদার ছিল আমার সন্তান। যাকে আকাশ নিজের থেকে দূরে সরিয়ে এখানে পাঠিয়েছে। আর আমাকে সমাজ-জীবন থেকে দূরে এই হাবিয়া নরকে নিক্ষেপ করেছে। এখন সেই প্রতীক্ষিত সময় হাজির হয়েছে। দীর্ঘ-প্রত্যাখ্যানের পর আমাকে বরণ করতে মৃত্যু এসে উপস্থিত হয়েছে আমার দ্বারে। যাতে আমাকে পৌঁছে দিতে পারে তার নরম-মোলায়েম ফুলের বিছানায়।    
উড়ন্ত আত্মাসমূহের স্পর্শের ন্যায় এক গম্ভীর নীরবতার পর, মৃত্যুছায়ায় আচ্ছন্ন চোখ দুটো উপরে তুলে এক অদ্ভুত শান্ত কণ্ঠে সে বললো—
“হে ন্যায়পরায়ণ আত্মা, আপনার চেহারা-ছবি ভয়ানক হলেও তার আড়ালে লুকিয়ে আছে এক ন্যায়নিষ্ঠ মন, আপনিই একমাত্র শুনতে পাচ্ছেন আমার বিদায়বেলার কান্না, আমার ক্লান্ত মনের আর্তনাদ। শুধু আপনার কাছেই একটু ভিক্ষা চাইছি, করজোড়ে অনুরোধ করছি, আমার উপর একটু দয়া করবেন। এক হাতে আমার ছেলেটাকে একটু দেখবেন। আর অন্য হাতে আমার লাশটাকে মাটিতে সঁপে দেবেন।  
ধীরে ধীরে তার স্নায়ু নিস্তেজ হয়ে গেল। শ্বাসপ্রশ্বাস দুর্বল ও ক্ষীণ হতে থাকলো। দুঃখ ও মমতা মেশানো চোখে এক পলক ছেলের দিকে তাকালো। তারপর আস্তে আস্তে চোখ দুটো নোয়ালো। এবং অত্যন্ত ক্ষীণ স্বর – এত ক্ষীণ যে শোনাই যাচ্ছিল না – বলল— “হে আমাদের পিতা, হে আকাশে সমাসীন সত্ত্বা, মহিমান্বিত হোক তোমার নাম..., নেমে আসুক তোমার ফেরেশতারা..., আকাশে যেমন ঠিক তেমনি পৃথিবীর বুকেও তোমার বিচরণ অবাধ হোক..., আমাদের ক্ষমা করো, আমাদের পাপ মোচন করো!”  
তার আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেল। ঠোঁট দুটো কিছুক্ষণ নড়তে থাকলো। ঠোঁট দুটোর নড়া বন্ধ হতেই সারা শরীরের নড়াচড়া স্তব্ধ হয়ে গেল। তারপর একটু যেন কেঁপে উঠল। একবার উহ্‌-আহ্‌ করলো। পর-মুহূর্তেই মুখটা ফ্যাকাশে ও বিবর্ণ হয়ে গেল। পিঞ্জরমুক্ত হল প্রাণপাখী। আর চোখ দুটো এক অদৃশ্য বস্তুর প্রতি নিবদ্ধ হয়ে রয়ে গেল। 
***
সকাল বেলা মার্‌তার লাশটা একটা কাঠের বাক্সে রাখা হল। তারপর দু’জন অসহায় প্রাণী ঐ কফিনটাকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে গেল। মার্‌তাকে সমাধিস্ত করা হল শহর থেকে বহু দূরে একটা পরিত্যক্ত জমিতে। শহরের ফাদার তার জন্য শেষ প্রার্থনা করতে অস্বীকার করলেন। জনগণ তাদের কবরস্থানে তাকে সমাধিস্ত করতে দিল না; যেখানে ক্রুশ পাহারা দেয় কবরগুলোকে। ঐ দূরবর্তী জমিতে তাকে শেষ বারের মতো বিদায় জানাতে কেউ এল না। শুধু দুটো প্রাণী, তার ছোট্ট ছেলে এবং এক যুবক; এই জীবনের নানা বিপদআপদ-বালা-মসিবত যার হৃদয়ে মায়ামমতা ও করুণা জাগিয়ে তুলেছিল।

[‘আরায়িসুল্‌ মুরূজ ৫৭ – ৭৯]

Saturday 21 December 2019

এ লড়াই ভালোবাসার জন্য, ঘৃণার বিরুদ্ধে !


এ লড়াই ভালোবাসার জন্য, ঘৃণার বিরুদ্ধে !
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম 
আজ আমার যা বয়স, বাবার বয়স তখন এরকমই হবে! আজ থেকে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে, ৭১-এর আগুনে ঝলসে যাচ্ছে মানুষ। নিপীড়নের যাঁতাকলে পিষছে আমার মায়ের ভাষা। বাঙালি ঘটিবাটি হাতে নিয়ে রাতের অন্ধকার গায়ে দিয়ে দলে দলে চলে আসছে এপারে; বিভাজন রেখা পেরিয়ে ভারতে।
আমার বাড়ি সীমান্তবর্তী এলাকায়। আমার আবেগের শহর, যার নাম এখনো আমাদের সাথে জুড়ে রয়েছে, দিনাজপুর; আমার বাড়ি থেকে আধ ঘণ্টার দুরুত্বে, ওই বিভাজন রেখার ওপারে; তাই আমাদের আলাপ হয় বইয়ের পাতায়। খান-বাহিনীর অত্যাচার থেকে নিস্তার পেতে সেই রেখা পেরিয়ে এপারে আসছে মানুষ। শ’য়ে শ’য়ে, হাজারে হাজারে। পুরুষদের পরনে লুঙ্গি-গেঞ্জি আর মেয়েদের শাড়ি। তাদের সবার পরিচয়, তারা বাঙালি। ওই লুঙ্গিতে কেউ হিন্দু তো কেউ মুসলিম। না, তাদেরকে পোশাক দেখে সেদিন আলাদা করা যায়নি। কারণ, ভারতে তখনো এ বিষবাষ্প ছড়ায়নি।
এপারে তাদের জন্য সরকার ও সাধারণ মানুষ আশ্রয় ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। তাদের যন্ত্রণায় একটু ভালোবাসার প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। সে-সময় আমার বাবা-(কাকারা)ও নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী ওদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। মা রান্না করে বাবার হাতে দিতেন। আর বাবা সেই খাবার ওই লোকেদের কাছে পৌঁছে দিতেন। পুরাতন জামাকাপড়, কাঁথা-কম্বল এবং চিড়ে-মুড়ি-গুড় সংগ্রহ করে তাদেরকে দিতেন। তবে তা ছিল ভালোবাসার একটা চারা মাত্র।
যুদ্ধ শেষে পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হল। অনেকে ফিরে গেল। কেউ কেউ এপারেই থেকে গেল। তাদের কিছুজন সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেল সম্পর্কের অজানা জগতে; জীবিকার জন্য ওই মফঃস্বল থেকে শহরতলী বা শহরে; হয়তো বা কোলকাতায় যাদবপুরে।
বাবা, মাঝে মাঝে সন্ধ্যা বেলা আমাকে সেই গল্পগুলো শোনাতেন। এক হিন্দু বৃদ্ধা কীভাবে বাবার মাথায় হাত বোলাতেন, কান্না জোড়ানো কণ্ঠে বাবাকে আশীর্বাদ করতেন। একটি ছোট্ট ফুটফুটে শিশু ছিল তাদের সাথে। বাবা আদর করে কোলে তুলে নিতেন। তার নাক টিপতেন। কাতুকুতু দিতেন আর শিশুটি খিলখিল করে হাসত। সে যে শিশু, আর শিশুরা তো বুঝতে পারে না, শিবির কী, আর ডিটেনশন ক্যাম্প কী?
বাবা মারা গেছেন আট বছর হল। সেসব গল্প আমাকে এখন আর কেউ শোনায় না। তবে বহু বছর পর, আজ তাদের দেখা পেলাম। ওই বৃদ্ধা (দাদী মা)-র নাতিনাতনিদের, ওই ফুটফুটে শিশুটির, এখন সে প্রৌঢ়, মুখে কাঁচাপাকা দাড়ি, মাথায় গলফ-ক্যাপ। তাদের দেখা পেলাম আজকের ‘নো-এনআরসি’র মিছিলে, হাজার হাজার মানুষের মুখে, মনে, অভিব্যক্তিতে। বাবার লাগানো ভালোবাসার ওই চারাটি এখন বিশাল মহীরুহ, তারই ফলফুল হাতে নিয়ে তারা এসেছেন। একে অপরকে ভালোবাসার জন্য। পরপস্পরের হাত ধরে। কেউ প্রেমিকাকে সাথে নিয়ে। কেউ বন্ধুর সাথে। কেউ সহপাঠীর হাত ধরে। কেউ সহকর্মীর কাঁধে হাত রেখে।
তাদের লড়াই, তাদের আন্দোলন, তাদের মিছিল ভালোবাসার জন্য; ঘৃণার বিরুদ্ধে!
তাই আমার বিশ্বাস, ভালোবাসা জিতবে!

১৯-১২-২০১৯ 
কোলকাতা-৩৯

আপনি কি এই সময়ের গডসে...!

বড্ড অসহায় লাগছে। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে বুকের ভেতোর। কান্নার তীব্রতা বেড়ে চলেছে প্রতিনিয়তআর চেপে রাখতে পারছি না।
আমার অপরাধটা কীআমি মুসলিমতিরঙ্গাকে কপালে বেঁধেছিএটা আমার অপরাধ! গঙ্গার জলে অযু করেছিএটা আমার অপরাধ! ‘সারে জাহাঁ সে আচ্ছা’ মাটিতে দিনে পাঁচ টাইম সাজদাহ্‌ করি (মাথা ঠেকাই)এটা আমার অপরাধ! সংবিধানকে বুকে আঁকড়ে বাঁচতে চেয়েছিএটা আমার অপরাধ! গান্ধী-আম্বেদকরের ছবি হাতেতাঁদেরই দেখানো পথে আন্দোলনে নেমেছিএটা আমার অপরাধ! আমি জামিয়াআলীগড়জেএনইউজেইউ-তে পড়ছিএটা আমার অপরাধ!
আমার অপরাধটা কীএকবার স্পষ্ট করে বলবেন!
আমার আন্দোলন দেখে আপনার মনে হতে পারেএটা কাটার বাচ্চাদের আন্দোলন। কিন্তু আমার আন্দোলনআমার অস্তিত্বের সংগ্রাম। সংবিধান রক্ষার লড়াই। ভারতের শ্রেষ্ঠত্ববহুত্ববাদ-কে বাঁচানোর মরিয়া চেষ্টা। ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোকে মযবুত করার প্রাণপণ প্রয়াস।
আমার লড়াইটা মোদিয়া (মিডিয়া)-র অপপ্রচারের বিরুদ্ধে। আঞ্জনা-অর্ণব-সুধির-রুবিকা নামক আইটি সেলের মিথ্যাচারিতার বিরুদ্ধে। আমার আন্দোলন স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে। স্বৈরাচার ও একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। পুলিশি পোশাকে গুণ্ডারাজের বিরুদ্ধে।
গতকাল জামিয়া ও আলীগড় ক্যাম্পাসে ঢোকা পুলিশদের উপর গডসের আত্মা ভর করায় তারা যে তাণ্ডব করেছেএসব দেখার পরেও আপনি যদি মনে করেনঠিক হয়েছে কাটার বাচ্চাদের সাথে। তাহলে আপনি আধুনিক যুগের গডসে। আপনিই প্রকৃত গান্ধী (-র বিচারধারা)-র হত্যাকারী। ঘেন্না হয় আমারআপনাকে শতসহস্র সভ্যতার লালনভূমি এই মাটির উত্তরাধিকারী ভাবতে!

১৬-১২-২০১৯
পার্কসার্কাস, কোলকাতা



তিনি যে-পথে বিপ্লব এনেছিলেন, হোক কলরব সে-পথে

যে মহামানবটির ভালোবাসা বুকে লালন করে আছিতাঁকে তায়েফের লোকেরা মেরে রক্তাক্ত করে দিলজবাবে তিনি তাদের জন্য করুণার প্রার্থনা করলেন।

যাতায়াতের সময় পথে কাঁটা বিছিয়ে রাখতোমাথার উপর ময়লা-আবর্জনা ছুঁড়ে দিত এক মহিলাএকদিন মাথায় ময়লা পড়ল নাপথে কাঁটা নেইছুটে গেলেন তার বাড়িখোঁজ নিতে।

যে লোকটা পিছু নিয়েছিলঅস্ত্র তুলেছিল মারার জন্য কিছুক্ষণ আগেতাকে নিঃশর্ত ক্ষমা করে দিলেন।

তাঁর এই আন্দোলনএই বিপ্লব ছিল অত্যন্ত যৌক্তিক পদ্ধতিতে।

চলুনআমরাও আন্দোলন করিশান্তিপূর্ণ ভাবে। কোনো সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তিকে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না করে। সতর্ক ভাবেযাতে কোনো সাধারণ মানুষের গায়ে আঁচড় অবধি না লাগে। রোগী ও সেবাযানের প্রতি যত্নশীল ও সহানুভূতিশীল হয়ে।

একবার ভেবে দেখুনযাদবপুরের ওই হাঙ্গামার দিনযেদিন কেউ একজন টেনেছিল বাবুল-জীর বাল (চুল) যার কারণে ছুটে গেছিলেন রাজ্যপালসেদিন কত কিছু ভাঙচুর করা হয়েছিলগেটের বাইরের ওই কাকুর দোকানটা অবধি তছনছ করে দিয়েছিল ওরাযদি আপনিও আন্দোলন করতে গিয়ে লণ্ডভণ্ড করে দেন পথঘাটতাহলে আপনার ও ওদের মধ্যে কী পার্থক্য...!

হোক কলরব, হোক আন্দোলন, তাঁর (সা) দেখানো পথে!

১৪-১২-২০১৯
কোলকাতা-৩৯



শুধু আবৃতি নয়, চেতনায় লালন করুন!

মনে পড়ছে কবিতাটানিশ্চয় মনে পড়ছেপ্রতিটা লাইন এখনো গড়গড় করে বলতে পারেন। ছোটবেলা স্কুলে কতবার আবৃতি করেছেনতাই না! আবৃতি প্রতিযোগিতায়বার্ষিক অনুষ্ঠানেউৎসবে। পুরষ্কারও পেয়েছেন। শ্রোতাদের বাহবা কুড়িয়েছেন। প্রশংসা পেয়েছেন। আবৃতির ভিডিও ইদানীং ইউটিউবে আপলোড করে লক্ষ লক্ষ ভিউলাইকশেয়ার ও কমেন্টস পাচ্ছেন।

তবে শুধু আবৃতিই করেছেন। কবিতার কথাগুলোকেকবির চেতনা ও ভাবনাকে নিজের মনের গহ্বরে লালন করতে পারেননিনিশ্চয়ই পারেননি। কণ্ঠের সুর দীর্ঘ করেকখনো স্বর চওড়া ও আওয়াজ দরাজ করে পাঠ করেছেন। কিন্তু কবির মনের গহীন থেকে ঠিকরে ঠিকরে বেরিয়ে আসা আর্তনাদ আপনার মনকে ছুঁতে পারেনি।

যদি এই কবিতা আপনার হৃদয়কে নাড়িয়ে দিতকবির আহ্বানে আপনার মন বিচলিত হতোতাহলে দেশের এই দুর্দিনে আপনি অমন নির্বাক থাকতে পারতেন না। সংবিধানের মৌলিকতা ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে দেখেও কফি মগে চুমুক দিতে দিতে বলতেন না, ‘শালা কাটার বাচ্চারা! শান্তির ছেলেরা! ঠিক হয়েছে শালাদের...!’

আপনি অহরহ বলেন, ‘ওরা গান্ধীজীকে হত্যা করেছেবাপুকে মেরেছে’। আজ আপনার নীরবতা গান্ধীজীর আদর্শকে হত্যা করছে। ভারতের বহুত্ববাদকে ধ্বংস করছে। মৌলানা আজাদের বিশ্বাসকে তছনছ করছে। এপিজে'র চেতনাকে নস্যাৎ করে দিচ্ছেএকবারও ভেবে দেখেছেন কি?

এতকিছুর পরেও আপনি নীরব। কারণ আপনি কবিতাটা মুখস্থ করেছেনস্রেফ মুখস্থ করেছেনউপলব্ধি করতে পারেননি।
... 
হ্যাঁঠিকই ধরেছেনআপনাকেই বলছি!

১৫-১২-২০১৯
কোলকাতা-৩৯



উনি দ্বেষের বিকাশ করেছেন...!

উনি বলেছিলেন ‘দেশের বিকাশ করবেন’। উনি কথা রেখেছেন। উনি ‘দ্বেষের’ বিকাশ করেছেন। আর তার ‘সুফল’ ছড়িয়ে পড়েছে গ্রামে-গঞ্জে।

যে বন্ধুটি একদা আমার সাথে বিস্কুট শেয়ার করেছিল। হাত ধরাধরি গ্রামের মাঠেপুকুর ধারেনদীর পাড়ে হেঁটেছিলমেঠো আলপথে সাইকেল চালিয়েছিলএখন অপেক্ষায় আছেসময়-সুযোগ পেলেই আমাকে আমার সাইকেল (নাগরিকত্ব) থেকে ফেলে দেবে।

যে মাস্টার মশাই আমাকে দেশপ্রেমের পাঠ পড়িয়েছিলেনমানবিকতা শিখিয়েছিলেনআমার প্রতি এই অমানবিক অত্যাচার ও বর্বর আক্রমণ দেখে মনে মনে পুলকিত হচ্ছেন।

যে শিক্ষিকা আমায় আদর করে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে শিখিয়েছিলেনরবীন্দ্র প্রেমে উদ্বুদ্ধ করেছিলেনআজ যখন আমি মানব-বন্ধনে (হিউম্যান চেইনে) দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে গাইতে আন্দোলন করছিউনি তা দেখে কপালে ভাঁজ ফেলেতির্যক চাহনি দিয়ে মুখ বাঁকিয়ে বলছেনম্লেচ্ছর মুখে রবীন্দ্রনাথ।

যে কাকিমাএকদা আমাকে তার সন্তানের পাশে বসিয়ে যত্ন করে পায়েস-ক্ষীর খাইয়েছিলেনআজ আমার দুর্দিনে পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে আমার বরবাদির খুশিতে পায়েস খাওয়াচ্ছেন।

যে মেয়েটি আমার ভালো ব্যবহারে মুগ্ধ হয়েবা পড়াশুনোয় আমার একাগ্রতা দেখে একদা আমার প্রতি ক্র্যাশ খেয়েছিলআজ তার মনে আমার জন্য একরাশ ঘৃণাএত বেশি ঘৃণা যেআমাকে জব্দ করতে সে এখন কুলদিপ সেঙ্গার (উন্নাও ধর্ষণ কাণ্ডের নায়ক)-কেও ভোট দিতে রাজি।

আর তাই এ কথা স্পষ্ট যেএই ক’বছরে বিকাশ হয়েছেদেশব্যাপী দ্বেষের বিকাশ হয়েছে।

বিঃ দ্রঃ জানিঅনেকে এমনও আছেনযারা এই দুঃসময়ে পাশে দাঁড়িয়েছেনসংবিধানের মৌলিকতা রক্ষা করতেবহুত্ববাদকে বাঁচাতেস্বৈরতন্ত্রকে রুখতে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাচ্ছেনএমন সকলকেই কুর্নিশ করছিশ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাচ্ছি। তবে এমন মানবিক লোকেদের সংখ্যা খুবই কম। বহু সংখ্যক লোক এখনো তীরে দাঁড়িয়ে (সংবিধানধর্মনিরপেক্ষত ও গণতন্ত্র-এর) তরী ডুবার দৃশ্য দেখতে উৎসুক।

১৬-১২-২০১৯
কোলকাতা-২৩