Thursday 28 February 2019

আব্দুল মাতিন ওয়াসিমঃ কিশানগঞ্জের পথে

Image may contain: one or more people, people standing, outdoor and text
 মাদ্‌রাসার সেই দিনগুলি...! 
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম


কিশানগঞ্জের পথে
নব্বইয়ের দশক সমাপ্তির দোরগোড়ায়; তখন আমি কদমডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র। স্কুলের পাশাপাশি রোজ সকালে পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে গিয়ে হাজির হতাম গ্রামের মকতবে। সেখানে আমাদের পড়ানো হতো আরবি। সেই সাথে শেখানো হতো সামাজিক রীতিনীতি, শিষ্টাচার, ইসলামী আদব-কায়দা, নামায-কালাম ইত্যাদি। কিছুদিনের মধ্যে আমূল পরিবর্তন দেখা দিল, ডানপিটে, দুরন্ত, গেছো ছেলেটি কেমন শান্ত স্বভাবের হয়ে গেল! এই দেখে অসিমুদ্দিন ও মহুবা খাতুন বুকে পাথর বেঁধে তাঁদের ছোট ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন বাড়ি থেকে বহু দূরে কিশানগঞ্জে, জামিয়াতুল ইমাম আল-বুখারি’তে।   

ইমাম বুখারি (১৯৪ – ২৫৬ হি)। মুসলিম সমাজে একটি সুপরিচিত নাম। স্মৃতির প্রখরতা, জ্ঞানের গভীরতা, চিন্তার বিশালতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা, অটুট সততা এবং অপরাজেয় হিম্মতের এক মূর্ত প্রতীক। আক্ষরিক অর্থেই একটি বিপ্লব একটি আদর্শ। অনুপ্রেরণার একটি মাইল ফলক। হাদিস শাস্ত্রের এক বিজয়ী সম্রাট। তাঁর সংকলিত মহামূল্যবান হাদিসগ্রন্থ ‘সাহীহুল্‌ বুখারী’ বিশুদ্ধতার নিরিখে দ্বিতীয়; আল্‌-কুরআনের পরেই যার স্থান। তাঁরই কর্ম-পদ্ধতিকে আদর্শ ক’রে গড়ে উঠেছে একটি প্রতিষ্ঠান বাংলা ও বিহারের মিলন-স্থানে। কিশানগঞ্জের খাগড়ায় একটি পিছিয়ে পড়া মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকায় জ্বলে উঠেছে জ্ঞানের এক প্রদীপ, আলোর এক মশাল ‘জামেয়াতুল্‌ ইমাম আল্‌-বুখারি’ নামে  

১৯৮৮ সালের মাঝামাঝিতে বাঁশের বেড়া ও খড়ের ছাউনি দিয়ে তৈরি চার কামরার একটি আঙ্গিনায় অঙ্কুরিত হয়েছিল একটি কিশলয়। চারা গাছটি রোপণ করেছিলেন আব্দুল মাতিন; আমি না, তিনি আব্দুল মাতিন সালাফি। মদিনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তরে প্রথম বিভাগে প্রথম হয়ে নিজ সমাজকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার ব্রত নিয়ে শুরু করেন এই যাত্রা। রোপিত ঐ চারাটিকে দিবারাত্রি জল সিঞ্চন করে একটি প্রকাণ্ড মহীরুহে রূপায়িত করেন তিনি ও তাঁর সহকর্মী-সহযাত্রী মুযাম্মিল-ইউসুফ-মুনিরুদ্দিনরা। তাঁর তিরোধানের পর, বর্তমানে সেই মহীরুহের শীতল ছায়া ও সুমিষ্ট ফল মানচিত্রের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দিতে সদা তৎপর তাঁর উত্তরসূরি মতিউর রহমান মাদানি ও তাঁর সহযাত্রীরা।

ক্লাস থ্রি পাশ করে সবে ফোরে উঠেছি। রমযানের ছুটিতে জাহাঙ্গীর বাড়ি ফিরেছে। জাহাঙ্গীর ঐ মাদ্‌রাসায় আমাদের গ্রামের প্রথম ছাত্র। বর্তমানে ও সৌদি আরবে জনকল্যাণ ও সচেতনতামূলক কোন এক সংস্থায় অনুবাদকের কাজ করে। আসার পথে বাবার কথা মতো সাথে নিয়ে এসেছে এডমিশন ফর্ম। এক রাতে ইসমাইল দা আমাদের বাড়ি আসল। আমাদের গ্রামে তখন সে-ই একমাত্র ইংলিশে এম এ। বাবার অনুরোধে ইসমাইল দা বাড়ি এসে ফর্ম ফিল-আপ করে দিয়ে গেলপরের দিন সকালে মেজদা গিয়ে পোস্ট করে দিল সেই চিঠি।

সেবার রমযানে প্রায় সতেরটা রোযা রেখেছিলামইসলামে ছোট থেকেই আদব-কায়দা, শিষ্টাচার, রীতিনীতি শেখানোর বিধান রয়েছে। যাতে বড় হয়ে সেসব অনুশাসন মেনে চলতে অসুবিধা না হয়। আমাদের গ্রামের জাহের কাকু ছোট বেলায় রোযা রাখেননি। হয়তো তাই বড় হয়ে, এমনকি বুড়ো বয়সেও তিনি রোযা রাখতে পারতেন না। তাঁর প্রসঙ্গ টেনে বাবা আমাকে রোযা রাখতে উৎসাহ দিতেন, যখন আমার বয়স আট তখন থেকেই। সেবার ঈদে নতুন জামাকাপড় তেমন কেউই নেয়নি। বাবা, মা, দুই দাদা কেউ না। সেই টাকা দিয়ে আমার জন্য নতুন পাঞ্জাবি-পায়জামা, লুঙ্গি-গেঞ্জি, জামাকাপড় ও হস্টেলের অন্যান্য জরুরি আসবাবপত্র কেনা হয়েছিল।

ঈদের সাত দিন পর, মেজদা সাইকেলে করে আমাকে কুশমুণ্ডি পৌঁছে দিলসাথে জাহাঙ্গীর ও রফিকওশুক্রবারের দিন ছিল। কুশমুণ্ডির মসজিদে জুম্‌আর নামায পড়ে দেড়টা নাগাদ বালুরঘাট-ইসলামপুর স্টেট বাসে চেপে রওয়ানা হলাম। এই প্রথম এত দূরে। সাথে বাড়ির কেউ না। এক অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। মনের মাঝে পুলক ও উদ্বেগের মিশ্রণ শরীরের লোমকূপগুলোকে শিহরিত করে তুলছিল মুহুর্মুহু। মাঝে মাঝেই ভিজে যাচ্ছিল দু’ চোখের পাতা। সেদিনই সে-বাসে কিশানগঞ্জ যাচ্ছিল আমাদের এলাকার আরও কিছুজন। তাঁদের অনেকেই আমাকে স্নেহ করে ভালোবাসা ও অভয় দিল। সৌদ দা, সে এখন রায়গঞ্জের কোনো এক হাই মাদ্‌রাসায় শিক্ষকতা করে, আমার সাথে শিশুসুলভ মশকরা করছিল। আমি যখন জিজ্ঞেস করলাম, দাদা আপনি কোন ক্লাসে পড়েন। মজা করে উত্তর দিয়েছিল, ‘আমি ক্লাস ওয়ানে পড়ি’। এরকম আরও অনেক মজার আলাপচারিতা করেছিল সে।

তিন সাড়ে-তিন ঘণ্টার যাত্রা শেষে নামলাম খাগড়ায়। খাগড়া নামটার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল সেই ছোটবেলায়। মা’র কাছে গল্প শুনেছিলাম, আমার নানা বন্ধুবান্ধবের সাথে নিয়ে ঘোড়ায় চেপে খাগড়ার মেলায় যেতেন। পনেরো দিন-এক মাস থেকে গৃহস্থালির জিনিসপত্র কিনে বাড়ি ফিরতেন। ফেরার সময় আমার মা-মাসিদের জন্য হালওয়া ও শনপাপড়ি কিনতে কখনোই ভুলতেন না। আর আমার দুই মামার জন্য আনতেন খেলনা গাড়ি। মাঝে বাবা ও বড় আব্বুর কাছেও খাগড়া মেলার বহু গল্প শুনেছি। সে-সব শুনে মনের ক্যানভাসে খাগড়ার যে ছবি এঁকেছিলাম, নেমে দেখলাম, দুটোর মাঝে বিস্তর ফারাক!


হিফ্‌যখানায় কিছুদিন


 মাদ্‌রাসার সেই দিনগুলি...! 
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

হিফ্‌যখানায় কিছুদিন
পরের দিন সকাল সকাল জাহাঙ্গীর আমাকে নিয়ে গেল অফিসে। সাথে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস। ভর্তি হতে গিয়ে কিছু সমস্যা দেখা দিলদ্বিতীয় দিন যখন অফিসে গেলাম, কর্তৃপক্ষ জানালো, সব আসন পূর্ণ হয়ে গেছে। আর কোনো নতুন এডমিশন হবে না। তারপর এক সপ্তাহ লাগাতার অফিস যেতে থাকলাম। কিন্তু কোনো লাভ হল না। অবশেষে শলাপরামর্শ করে, ভর্তি হলাম হিফ্‌য বিভাগে। এই বিভাগে ছাত্রদের অল্প অল্প করে পুরো কুরআন হিফ্‌য (মুখস্থ) করানো হয়। ভর্তি প্রক্রিয়া শেষে ব্যাগপত্র নিয়ে গিয়ে উঠলাম ‘হিফ্‌যখানা’ বিল্ডিঙে। আদতে সেটা ছিল একটি মসজিদ।  ক্যাম্পাসে জামে মসজিদ নির্মাণের পর সেটাকে হিফ্‌যখানায় রূপান্তরিত করা হয়। এবং সেখানেই হিফ্‌য বিভাগের ছাত্রদের থাকা ও পঠনপাঠনের ব্যবস্থা করা হয়।

মসজিদের অমন ব্যবহার আমি আমাদের গ্রামে দেখিনি। কিন্তু বড় হয়ে, হাদিস শাস্ত্রের বইপত্র ঘেঁটে দেখলাম, ইসলামি ইতিহাসের সেই সোনালী দিনগুলিতে দিনরাত সর্বক্ষণ মসজিদের ফাটক খোলা থাকত। গরিব-দুঃখী-অনাথ-আশ্রয়হীনদের মাথা গুঁজবার ঠাই ছিল মসজিদ। মদিনায় নবি (সা)-এর মসজিদে একটি সুফ্‌ফা (চালা) লাগানো হয়েছিল। তার তলায় বসবাস করতেন আবু হুরায়রা (রা)-এর মতো দুঃখী অসহায় নিঃস্ব সাহাবি (নবির সহচর)-রা। তাই তাঁদেরকে ‘আস্‌হাবুস্‌ সুফ্‌ফা’ (চালার অধিবাসী) বলা হয়। সে-সময় মসজিদ চত্বরেই অনায়াসে চলত শিশুকিশোরদের ক্রীড়াকৌতুক। রাজনীতির মত গুরুগম্ভীর কাজকম্মের আসরও বসত মসজিদের ভেতর। বিদেশী দূতদের সাথে আলাপআলোচনাও হত। সমাজের বিচার, শালিসী সভা সব। পঠনপাঠন থেকে বিবাহ আরও কতকিছু যে সংঘটিত হত মসজিদের অন্দরে, ইতিহাসের পাতায় তা ধরা আছে। সময়ের সাথে সাথে সব কোথাও হারিয়ে গেছে। উবে গেছে সেসব রীতি-রেওয়াজ, উধাও হয়ে গেছে মসজিদ কেন্দ্রিক সমাজ ব্যবস্থা। আস্তে আস্তে এমন হয়ে গেছে যে, আজকাল দু’চারজনই দিনে-রাতে দু’চারবার মসজিদে যায়; অনেকে যায় সপ্তাহান্তে। কেউ কেউ তো তাও করে না। আর এভাবেই মসজিদ হারিয়ে ফেলেছে তার ব্যবহারিক গুরুত্ব, মানচিত্র জুড়ে প্রায় সব মুসলিম সমাজে!

সেখানে হিফ্‌যের বুনিয়াদী নিয়মকানুন দ্রুত শিখে নিয়ে তিন দিনের মাথায় কুরআন মুখস্থ করতে আরম্ভ করলাম। তখন আমার স্মৃতিশক্তি বেশ তীক্ষ্ণ ছিল মনে হয়; ঐ ক’দিনে এক জুয্‌ (পারা) মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। মোট তেরো দিন ছিলাম। শেষের আগের দিন সকালবেলা নির্ধারিত অংশটুকু বারবার ঝালিয়ে নিচ্ছিলাম যাতে ক্বারী (ঐ বিভাগে পারদর্শী ব্যক্তি) সাহেবকে শোনানোর সময় কোথাও আটকে না যাই, বা কোনো অংশ ভুলে না যাই। কিন্তু সেদিন এক অবাক কাণ্ড ঘটল, আমার আগের জন পড়া শোনাতে গিয়ে মাঝের কিছু অংশ ভুলে গেল। ক্বারী সাহেব রেগে গিয়ে তাকে মুরগা বানিয়ে দিয়ে আদেশ করলেন, ঐ অবস্থাতে ভুলে যাওয়া অংশটুকু বারবার ঝালিয়ে নিতে। এসব দেখে ভীষণ ভয় হল আমার। পেচ্ছাবের বাহানা করে ছুটে গেলাম বাথরুমে। কিছুক্ষণ পর যখন টিফিনের বেল বেজে উঠল, কোনোরকমে বইখাতা তুলে রেখে গেলাম প্রিন্সিপ্যালের অফিসে। পুরো ক্যাম্পাসে সবচেয়ে ছোট ছিলাম আমি। স্বভাবতই দু’ সপ্তাহে প্রায় সবাই চিনে গেছিল। অফিসে ঢুকেই হাউমাউ করে কাঁদতে আরম্ভ করলাম। মুযাম্মিল স্যার কাছে ডাকলেন। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে আমার সব কথা শুনলেন। যেমনভাবে জাহাঙ্গীর ও তাঁর সহপাঠীরা শিখিয়ে দিয়েছিল, ঠিক তেমন করেই গুছিয়ে বললাম সব কথা। শুনে তিনি আমায় ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করিয়ে নিলেন।

Monday 25 February 2019

আল-কুরআনের ভাবানুবাদঃ (৮০) সূরাতু ‘আবাসা (ভ্রূ কুঞ্চিত করলো)


৮০) সূরাতু ‘আবাসা (ভ্রূ কুঞ্চিত করলো)

মক্কায় অবতীর্ণ, আয়াত ৪২, রুকু’ ১   
 
بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمـَنِ الرَّحِيمِ

পরম করুণাময় ও অতি দয়ালু আল্লাহ্‌র নামে (শুরু করছি)

عَبَسَ وَتَوَلَّى

(নবী সাঃ বিরক্ত হয়ে) ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন এবং মুখ ফিরিয়ে নিলেন;

أَن جَاءهُ الْأَعْمَى

(তিনি তখন কয়েকজন সম্ভ্রান্ত কোরায়েশ নেতাদেরকে ইসলামের পথে আহ্বান জানাচ্ছিলেন, ঠিক সে-সময়) তাঁর কাছে অন্ধ লোকটি (আব্দুল্লাহ ইব্‌নু উম্মে মাক্‌তূম রাঃ) এসেছেন বলে।

وَمَا يُدْرِيكَ لَعَلَّهُ يَزَّكَّى

তুমি তো জানো না, সে হয়তো (নিজ ত্রুটিবিচ্যুতি হতে) পরিশুদ্ধ হতে পারে!  

أَوْ يَذَّكَّرُ فَتَنفَعَهُ الذِّكْرَى

অথবা উপদেশ গ্রহণ করতে পারে এবং সেই উপদেশে তার উপকারও হতে পারে!

أَمَّا مَنِ اسْتَغْنَى

পক্ষান্তরে, যে (নিজেকে যথেষ্ট ভাবে এবং কাউকেই) পরওয়া করে না,

فَأَنتَ لَهُ تَصَدَّى

তুমি তার চিন্তায় মশগুল হয়ে গেলে।

وَمَا عَلَيْكَ أَلَّا يَزَّكَّى

অথচ সে নিজে পরিশুদ্ধ না হলে তাতে তোমার কোনো দোষ নেই (কারণ তোমার দায়িত্ব তাদের নিকট পৌঁছে দেওয়া)।

وَأَمَّا مَن جَاءكَ يَسْعَى

তবে, যে তোমার কাছে ছুটে আসলো,

وَهُوَ يَخْشَى

মনে আল্লাহ্‌র ভয় নিয়ে,

فَأَنتَ عَنْهُ تَلَهَّى

তুমি তাকে অবজ্ঞা করে অন্যের প্রতি মনোযোগী হলে;

كَلَّا إِنَّهَا تَذْكِرَةٌ

(ভবিষ্যতে) কখনও এমনটা করো না, নিঃসন্দেহে এটা (অর্থাৎ আল্‌-কুর্‌আন) একটা উপদেশ বানী।

فَمَن شَاء ذَكَرَهُ

অতএব যার ইচ্ছা হবে, সে এই উপদেশ গ্রহণ করবে।

فِي صُحُفٍ مُّكَرَّمَةٍ

আর এই উপদেশ লিখিত আছে সম্মানিত গ্রন্থে (অর্থাৎ লাওহ মাহ্‌ফূজে),

مَّرْفُوعَةٍ مُّطَهَّرَةٍ

যা উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ও অত্যন্ত পবিত্র,

بِأَيْدِي سَفَرَةٍ

এবং এমন লিপিকারদের (অর্থাৎ ফেরেশতাদের) হাতে (সংরক্ষিত),

كِرَامٍ بَرَرَةٍ

যারা মহৎ ও পূতচরিত্রবান। 

قُتِلَ الْإِنسَانُ مَا أَكْفَرَهُ

ধ্বংস হোক (এই অবিশ্বাসী ও অবাধ্য) মানুষেরা, কত অকৃতজ্ঞ এরা!

مِنْ أَيِّ شَيْءٍ خَلَقَهُ

(এরা কি কখনও ভেবে দেখেছে,) তিনি কোন্‌ বস্তু হতে মানুষকে সৃষ্টি করেছেন?

مِن نُّطْفَةٍ خَلَقَهُ فَقَدَّرَهُ

শুক্র বিন্দু থেকে তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে সুপরিমিত গঠন ও আকৃতি প্রদান করেছেন।

ثُمَّ السَّبِيلَ يَسَّرَهُ

অতঃপর তার জন্য পথ সহজ করে দিয়েছেন।

ثُمَّ أَمَاتَهُ فَأَقْبَرَهُ

তারপর (এক সময়) তার মৃত্যু ঘটান এবং তাকে কবরস্থ করান। 

ثُمَّ إِذَا شَاء أَنشَرَهُ

তারপর যখন তাঁর ইচ্ছা হবে পুনরুজ্জীবিত করবেন।

كَلَّا لَمَّا يَقْضِ مَا أَمَرَهُ

কিন্তু না, আল্লাহ্‌ মানুষকে যে-আদেশ করেছিলেন, মানুষ এখনও তা পূর্ণ করেনি।

فَلْيَنظُرِ الْإِنسَانُ إِلَى طَعَامِهِ

(প্রত্যেক) মানুষের উচিৎ নিজ খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করা;

أَنَّا صَبَبْنَا الْمَاء صَبًّا

আমি (তার জন্য) আশ্চর্য উপায়ে প্রচুর পানি বর্ষণ করেছি,

ثُمَّ شَقَقْنَا الْأَرْضَ شَقًّا

অতঃপর ভূমিকে অদ্ভুদভাবে বিদীর্ণ করেছি,

فَأَنبَتْنَا فِيهَا حَبًّا

এবং তাতে আমি শস্য উৎপন্ন করেছি,

وَعِنَبًا وَقَضْبًا

এবং আঙ্গুর ও (পুষ্টিকর) শাক-সব্জি,

وَزَيْتُونًا وَنَخْلًا

জায়তুন ও খেজুর,

وَحَدَائِقَ غُلْبًا

বহু ঘন ও নিবিড় উদ্যান,

وَفَاكِهَةً وَأَبًّا

ফলমূল এবং ঘাসফুস

مَّتَاعًا لَّكُمْ وَلِأَنْعَامِكُمْ

(জীবিকা রূপে এবং নানা উপকারার্থে) তোমাদের জন্য ও তোমাদের চতুস্পদ জন্তুদের জন্য। 

فَإِذَا جَاءتِ الصَّاخَّةُ

অতঃপর যে-দিন কর্ণবিদারক নাদ (অর্থাৎ প্রলয় কালে শিঙার দ্বিতীয় ফুঁৎকারের তীব্র ধ্বনি) ভেসে আসবে,

يَوْمَ يَفِرُّ الْمَرْءُ مِنْ أَخِيهِ

সে-দিন মানুষ নিজ ভাইয়ের থেকে দূরে সরে যাবে,

وَأُمِّهِ وَأَبِيهِ

নিজ মা-বাবার থেকে (পৃথক হয়ে যাবে),

وَصَاحِبَتِهِ وَبَنِيهِ

নিজ স্ত্রী-সন্তানদের কাছ থেকে (পালিয়ে যাবে);

لِكُلِّ امْرِئٍ مِّنْهُمْ يَوْمَئِذٍ شَأْنٌ يُغْنِيهِ

সে-দিন প্রত্যেকেই নিজ নিজ চিন্তায় মগ্ন থাকবে এবং নিজেকে নিয়েই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়বে।

وُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ مُّسْفِرَةٌ

সে-দিন বহু মুখমণ্ডল (প্রকৃত মুসলিমদের মুখমণ্ডল) জ্বলজ্বল করবে,

ضَاحِكَةٌ مُّسْتَبْشِرَةٌ

আনন্দ-উল্লাস করবে এবং (জান্নাত লাভের) সুসংবাদকে উপভোগ করবে;

وَوُجُوهٌ يَوْمَئِذٍ عَلَيْهَا غَبَرَةٌ

তবে সে-দিন বহু মুখমণ্ডল আবার ধুলোয় ধূসরিত থাকবে,

تَرْهَقُهَا قَتَرَةٌ

কলুষ-কালিমা তাদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখবে।

أُوْلَئِكَ هُمُ الْكَفَرَةُ الْفَجَرَةُ

কারণ, তারা (ইহলোকে) কাফের ও পাপাচারী (ছিল)।

ভাবানুবাদ- আব্দুল মাতিন ওয়াসিম 

Wednesday 20 February 2019

আল-কুরআনের ভাবানুবাদঃ (৭৯) সূরাতু আন্‌-নাযি‘আত (উৎপাটনকারী)



৭৯) সূরাতু আন্‌-নাযি‘আত (উৎপাটনকারী)   
মক্কায় অবতীর্ণ, আয়াত ৪৬, রুকু’ ২  

 

بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمـَنِ الرَّحِيمِ

আল্লাহ্‌র নামে, যিনি পরম করুণাময় ও অতি দয়ালু (শুরু করছি)।

وَالنَّازِعَاتِ غَرْقًا

শপথ সেই ফেরেশতাদের যারা ডুব দিয়ে নির্মম ভাবে (অবিশ্বাসী ও অবাধ্যদের আত্মা) উৎপাটন করে

وَالنَّاشِطَاتِ نَشْطًا

শপথ সেই ফেরেশতাদের যারা মৃদু স্পর্শে (বিশ্বাসী ও সৎ লোকেদের আত্মা) বের করে নিয়ে যায়,  

وَالسَّابِحَاتِ سَبْحًا

শপথ সেই ফেরেশতাদের (বা জ্যোতিষ্কসমূহের) যারা (নিজ কক্ষপথে) দ্রুত গতিতে সন্তরণ করে,

فَالسَّابِقَاتِ سَبْقًا

অতঃপর শপথ সেই ফেরেশতাদের (বা নক্ষত্রসমূহের বা ঘোড়াগুলির) যারা দ্রুত গতিতে অগ্রসর হয় যেন কোনো প্রতিযোগিতায় নেমেছে,

فَالْمُدَبِّرَاتِ أَمْرًا

এবং সেই ফেরেশতাদের যারা (নিজ পালনকর্তার) সকল আদেশ ও কর্ম নির্বাহ করে, (অবশ্যই প্রলয় সংঘটিত হবে এবং সকলের কর্মের হিসেব নেওয়া হবে);

يَوْمَ تَرْجُفُ الرَّاجِفَةُ

সেদিন (যখন শিঙায় প্রথম ফুঁৎকার দেওয়া হবে) পৃথিবী ও পর্বতমালা তীব্র ভাবে প্রকম্পিত হবে (এবং সকল প্রাণীই মৃত্যু বরণ করবে)।

تَتْبَعُهَا الرَّادِفَةُ

তারপরে (যখন শিঙায় দ্বিতীয় ফুঁৎকার দেওয়া হবে) পৃথিবী আবারও তীব্র ভাবে প্রকম্পিত হবে (এবং সকল প্রাণী পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠবে)।

قُلُوبٌ يَوْمَئِذٍ وَاجِفَةٌ

সেদিন বহু হৃদয় ভীত ও বিহ্বল হবে।

أَبْصَارُهَا خَاشِعَةٌ

তাদের দৃষ্টি নত হয়ে থাকবে।

يَقُولُونَ أَئِنَّا لَمَرْدُودُونَ فِي الْحَافِرَةِ

কিন্তু (যখনই তাদেরকে পুনরুজ্জীবিত হওয়ার বিষয়ে বলা হয়) তারা বলে— আমরা কি সতিই (আমাদের জীবনের) পূর্বাবস্থায় প্রত্যাবর্তিত হবো?

أَئِذَا كُنَّا عِظَامًا نَّخِرَةً

গলিত অস্থিতে পরিণত হওয়ার পরেও?

قَالُوا تِلْكَ إِذًا كَرَّةٌ خَاسِرَةٌ

তারা আরও বলে— তা-ই যদি হয়, তবে তো এই প্রত্যাবর্তন বড়ই সর্বনাশা হবে!

فَإِنَّمَا هِيَ زَجْرَةٌ وَاحِدَةٌ

কিন্তু, এটা তো কেবল একটা তীব্র নিনাদ (দ্বিতীয় ফুঁৎকারের)।            

فَإِذَا هُم بِالسَّاهِرَةِ

অতঃপর (সেদিন) যখন তারা চোখ তুলে তাকাবে, নিজেদেরকে (ভূপৃষ্ঠের এক) প্রশস্ত ময়দানে আবির্ভূত ও পুনরুজ্জীবিত অবস্থায় পাবে।

هَلْ أتَاكَ حَدِيثُ مُوسَى

(হে মুহাম্মদ সাঃ!) তোমার কাছে কি মূসা (আঃ)-এর বৃত্তান্ত পৌঁছেছে?

إِذْ نَادَاهُ رَبُّهُ بِالْوَادِ الْمُقَدَّسِ طُوًى

যখন তার পালনকর্তা তাকে পবিত্র ত়ুয়া উপত্যকায় আহ্বান করেছিলেন,

اذْهَبْ إِلَى فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى

(ডেকে তাকে আদেশ করেছিলেন, হে মুসা আঃ!) তুমি ফেরাউনের কাছে যাও, নিশ্চয় সে (অবাধ্যতা, পাপাচারিতা, পৌত্তলিকতা ও অবিশ্বাস সবক্ষেত্রেই) সীমালংঘন করেছে।

فَقُلْ هَل لَّكَ إِلَى أَن تَزَكَّى

এবং (তাকে) বলো, তুমি (অবাধ্যতা ও অবিশ্বাসের পাপ থেকে) নিজেকে মুক্ত ও পবিত্র করবে কি?

وَأَهْدِيَكَ إِلَى رَبِّكَ فَتَخْشَى

(যদি করতে চাও,) তাহলে আমি তোমাকে তোমার পালনকর্তার দিকে পথ দেখাবো; এবং (তোমার প্রথম কাজ হবে) তুমি তাঁকে ভয় করো।

فَأَرَاهُ الْآيَةَ الْكُبْرَى

অতঃপর মূসা (আঃ) তাকে মহা নিদর্শন (স্বরূপ কিছু অলৌকিক জিনিস) দেখালেন।  

فَكَذَّبَ وَعَصَى

কিন্তু ফারাও মিথ্যারোপ করল এবং অমান্য করল।

ثُمَّ أَدْبَرَ يَسْعَى

অতঃপর পিছনে ফিরে পূর্বের কর্মে (অর্থাৎ অবিশ্বাস ও অবাধ্যতার পথে) নিয়োজিত থাকলো।

فَحَشَرَ فَنَادَى

এবং সকলকে সমবেত করে সজোরে ঘোষণা করলো,

فَقَالَ أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَى

বলল— আমিই তোমাদের সর্বোচ্চ পালনকর্তা।

فَأَخَذَهُ اللَّهُ نَكَالَ الْآخِرَةِ وَالْأُولَى

অতঃপর (তার এই চরম সীমালঙ্ঘনের কারণে) আল্লাহ তাকে পরকালের ও ইহকালের কঠিন শাস্তিতে আবদ্ধ করলেন।

إِنَّ فِي ذَلِكَ لَعِبْرَةً لِّمَن يَخْشَى

নিঃসন্দেহে এতে বহু শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে তাদের জন্য যারা (আল্লাহ্‌কে) ভয় করে।

أَأَنتُمْ أَشَدُّ خَلْقًا أَمِ السَّمَاء بَنَاهَا

(তোমরা যারা অস্বীকার করছো তোমরাই বলো,) তোমাদের সৃষ্টি অধিক কঠিন না এই যে আকাশ তিনি নির্মাণ করেছেন তার সৃষ্টি?

رَفَعَ سَمْكَهَا فَسَوَّاهَا

তিনিই এই আকাশকে উঁচু ও সুবিন্যস্ত করেছেন।

وَأَغْطَشَ لَيْلَهَا وَأَخْرَجَ ضُحَاهَا

এবং এর রাতকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করেছেন আর এর পূর্বাহ্ণকে প্রকাশ করেছেন সূর্যালোকে।

وَالْأَرْضَ بَعْدَ ذَلِكَ دَحَاهَا

তারপরে পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছেন।

أَخْرَجَ مِنْهَا مَاءهَا وَمَرْعَاهَا

অতঃপর ভূগর্ভ থেকে জল ও নানা ধরণের উদ্ভিদ নির্গত করেছেন, 

وَالْجِبَالَ أَرْسَاهَا

এবং পর্বতমালাকে দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন,

مَتَاعًا لَّكُمْ وَلِأَنْعَامِكُمْ

তোমাদের ও তোমাদের চতুস্পদ জন্তুদের জন্য জীবনোপকরণ রূপে।

فَإِذَا جَاءتِ الطَّامَّةُ الْكُبْرَى

অতঃপর যখন মহা সংকট (অর্থাৎ কেয়ামত) এসে যাবে;

يَوْمَ يَتَذَكَّرُ الْإِنسَانُ مَا سَعَى

যে দিন মানুষ নিজ কৃতকর্ম স্মরণ করবে,

وَبُرِّزَتِ الْجَحِيمُ لِمَن يَرَى

এবং সকল দৃশ্যমান (বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসী) ব্যক্তির জন্য জাহান্নামকে সম্পূর্ণ রূপে প্রকাশ করা হবে,

فَأَمَّا مَن طَغَى

সেদিন, যে ব্যক্তি (অবিশ্বাস, অত্যাচার, অসৎ কর্ম ও অবাধ্যতায়) সীমা লংঘন করেছে,

وَآثَرَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا

এবং পার্থিব জীবনকে অগ্রাধিকার দিয়েছে,

فَإِنَّ الْجَحِيمَ هِيَ الْمَأْوَى

তার ঠিকানা হবে জাহান্নাম।

وَأَمَّا مَنْ خَافَ مَقَامَ رَبِّهِ وَنَهَى النَّفْسَ عَنِ الْهَوَى

পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি নিজ পালনকর্তার সামনে দাঁড়ানোকে ভয় করেছে এবং খেয়ালখুশী মতো আচরণ করা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রেখেছে,

فَإِنَّ الْجَنَّةَ هِيَ الْمَأْوَى

তার ঠিকানা হবে জান্নাত।

يَسْأَلُونَكَ عَنِ السَّاعَةِ أَيَّانَ مُرْسَاهَا

(হে মুহাম্মদ সাঃ) তারা তোমাকে কেয়ামত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, কবে তা সংঘটিত হবে?

فِيمَ أَنتَ مِن ذِكْرَاهَا

(কেয়ামত কবে হবে?) এ বিষয়ে তোমার তো কোনো ধারণা নেই (তাই এ বিষয়ে কিছুই বলার দরকার নেই),

إِلَى رَبِّكَ مُنتَهَاهَا

এ বিষয়ে চরম ও পূর্ণ জ্ঞান শুধু তোমার পালনকর্তার কাছে রয়েছে।

إِنَّمَا أَنتَ مُنذِرُ مَن يَخْشَاهَا

তোমার কাজ কেবল তাদেরকে সতর্ক করা যারা কেয়ামতকে ভয় করে।

كَأَنَّهُمْ يَوْمَ يَرَوْنَهَا لَمْ يَلْبَثُوا إِلَّا عَشِيَّةً أَوْ ضُحَاهَا

যেদিন তারা এই মহা প্রলয় (ও তারা বিভীষিকা স্বচক্ষে) দেখবে, সেদিন তাদের মনে হবে, তারা যেন পৃথিবীতে কেবলমাত্র একটা সন্ধ্যা অথবা একটা সকাল যাপন করেছে।

ভাবানুবাদ- আব্দুল মাতিন ওয়াসিম