Saturday 18 April 2020

কাজী মোহাঃ মাকীনঃ আরবী ভাষার প্রতি...


আরবী ভাষার প্রতি...
কাজী মোহাঃ মাকীন

বাংলা আমার প্রথম অনুভব, ইংরাজি সহচর;
আরবী তোমাকে আপন করেছি হৃদয়ের গৃহ ‘পর।
তোমাতে রয়েছে ইতিহাস কত, সভ্যতা বিজয়ের।
তোমাতে সুপ্ত জাতির অহং, তুমি অবিনশ্বর।

তোমাতে রয়েছে জ্ঞানের আকর, ঝিনুকে লুকোনো মোতি।
ডুবুরী তোমাকে চয়ন করেছে, বিশ্বে দিয়েছো জ্যোতি।
সুতোয় গেঁথেছে চপলা রমণী, হয়েছ কণ্ঠহার।
কবির কাব্যে তুমি আভরণ, প্রেমিকের দেবারতি।

খোদার প্রেমের শরাব তো তুমি, নবীপ্রেমিকের সাক্বী;
শরাব পিয়েছে ইবনে ফারিয খোদাতে বিভোর থাকি’।
ক্বায়েস তাহার প্রেমিকাকে যেথা ভাষাতে দিয়েছে রূপ।
শাব্বী তোমাতে অঞ্জলী দেয় প্রেমিকারে দেবী ডাকি’।

তোমা’ প্রাঙ্গনে শাওক্বী রচেছে পিরামিড ইতিহাস।
তোমার প্রতিটি ছত্রে মিশেছে সুখদুঃখের শ্বাস।
তোমার শব্দ সাথে নিয়ে কভু আছড়ায় বিপ্লব।
তোমার কথায় সুরের লহরী দিয়েছে বাঁচার আশ।

তোমার বুকেতে মরূদ্যানের না-ছোঁয়া জলের ছবি।
তোমার ছন্দে জলধির বুকে রক্তিম নব রবি।
তোমার ছত্রে পুষ্পবাগের ঝরণার পদতলে
প্রেমিকা হারায় প্রেমিকার সনে নির্বাক পল্লবী।

এভাবে কবির কল্পনা যত করিয়াছ বাঙ্ময়।
গল্পনায়ক ছুটিয়েছে ঘোড়া তোমার জগতময়।
নাটকের নট-নায়িকারা যেথা গায় জীবনের গান,
আরবী আমার সেই পৃথিবীর বিশ্বাস-বরাভয়।

১৩/০৩/২০২০

Friday 17 April 2020

বদিউর রহমানঃ উত্তম ও অধম



উত্তম অধম
বদিউর রহমান

মৃত্যু সততই দুঃখের শত্রু-মিত্র, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিতযারই মৃত্যু হোক না কেন, তা বেদনার, ব্যাথার মৃত্যু তার করাল ছায়া বিস্তার করে চলেছে আদি-অনন্তকাল ধরে তার ডাক আলোকে আলোকে, নক্ষত্রে নক্ষত্রে রাজা-উজির, নাথ-অনাথ সকলের সঙ্গে তার সমান ব্যবহারজন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা রবেযেমন শাশ্বত সত্য, সেরকমই আরেকটা সত্য কথা হলডেথ দ্য লেভেলার

প্রিয়জনদের মৃত্যু বেদনাবিধুর, সন্দেহ নেই সেই ব্যথা ধীরে ধীরে কাটিয়ে মানুষ আবার মূল জীবনস্রোতে অজান্তেই ফিরে আসে বুকের খচখচানিটা নিয়ে আবার পথ চলতে থাকে ক্রমশঃ অন্তরের ব্যথাটা কখন কমে যায় অনেকে উপলব্ধিই করতে পারে না কথাগুলো সাধারণগ্রাহ্য হলেও ব্যতিক্রমী মানুষজনও আছেন সেরকম তিনজনের কথা বলব তিনজন কিন্তু সামাজিক দিক দিয়ে তিনটে শ্রেণীভূক্ত প্রথমজন হতদরিদ্র, দ্বিতীয়জন মধ্যবিত্ত আর তৃতীয়জন স্বচ্ছল পরিবারের এক মান্যবর ব্যক্তি আলোচ্য তিনশ্রেণীর মানুষদের মধ্যে একটা বিষয় কমনতাঁরা ভালবাসতেন ভালবাসার মানুষের মৃত্যুর অভিঘাত তারা সহ্য করতে পারেননি

প্রথমে হতদরিদ্র বিশ্বনাথের কথায় আসা যাকগোপাল নামে এক গরীবের তিনছেলেমেজ আর ছোট দু’জন বেশ ছটফটে আর চালাকচতুর হাতের কাজকাম শিখছেবড়ছেলে বিশ্বনাথ (বিশু) একটু বোকা-হাবা গোছের সবটাতেই অচল বিশুর মা একদিন চোদ্দ-পনের বছরের বিশুকে নিয়ে আমার মায়ের কাছে আসেপ্রায় হাতেপায়ে ধরে বিশুকে কাজে নিতে বলেবাড়িতে কাজের লোক কয়েকজন ছিল বলে মা প্রথমে বিশুকে নিতে ইতস্ততঃ করে বলেন গরুর গোয়ালের লোকটার সঙ্গে কাজ করুক বিশুর মা রাজি হয় একটা শর্তেআজীবন তাকে দেখতে হবেবিশুর মা তারপর আমার মায়ের হাত ধরে বলে, “বিশুকে তোমার হাতে সঁপে দিয়ে নিশ্চিন্ত হলামসে জন্যই হয়ত মা বিশুর প্রতি একটু বেশি দরাজ ছিলেনপুকুরের মাছ, জমি থেকে তোলা সরষের তেল, আলু, লাউ, কুমড়ো ইত্যাদি সবার অলক্ষ্যে দিয়ে সাহায্য করতেন

সেই বিশু কয়েক বৎসর পর যথানিয়মে বিয়ে করলবিশুর বৌয়ের রংটা চাপা, আর বেশ বুদ্ধিমতীছিপছিপে শরীরে ছাপা শাড়ীতে, বিশেষ করে টকটকে লাল লম্বা সিঁদুরে সুশ্রীই দেখাত প্রতিদিন এককেজি চাল পাওনা হিসেবে সপ্তাহান্তে তা নিতে আমাদের বাড়িতে আসত বিশুর বৌ বস্তা থেকে ডালায় চাল বের রে নিজে হাতেই নিত পাওনা চালমা সেদিকে ফিরেও তাকাতেন নাআর মাস গেলে আব্বার হাত থেকে মাসমাহিনাটাও সে- নিত গুনেবিশু হিসেব নিকেশ বোঝে না সংসারের সব দায়দায়িত্ব ছিল বিশুর বৌয়ের

কয়েক মাস পরে স্বাভাবিক নিয়মেই সেই বৌ অন্তঃসত্ত্বা হয়ে প্রসব করলো কন্যা সন্তান তারপর আবার দু’টো কন্যা কেন জানিনা বিশুর মত মানুষও যেন একটু চিন্তিত, বিরক্ত তারপরেরটা কোল আলো করে জন্মালো পুত্রসন্তান সেদিনকার বিশুর আনন্দোজ্জ্বল মুখটা এখনো মনে পড়ে বিশ্বনাথ যেন বিশ্ব জয় করেছে

ছেলেপুলের সংসারে শুধু বিশুর উপর ভরসা না করে তার স্ত্রী অনতিদূরের এক চিঁড়েকলে কাজ করে দুপয়সা উপার্জন করতে শুরু করে বিশু আমাদের গরু-বাছুর নিয়েই থাকে যতদিন যায় বিশুর শরীরটা শুকাতে থাকে, যেন দিনে দিনে খর্বকায় হয়ে যাচ্ছেখোল-ভুসি খাওয়া আমাদের তাগড়া জার্সি গরুগুলোকে বিশু অনেক সময় সামলাতে পারত না তারা বিশুর কথামতো চলাফেরা করত না বিশু তাদের বকাবকি এমনকি গালাগালি দিত খুঁটিতে বাঁধা অবস্থায় গরুগুলোকে আদর করতো তার পিঠ চেটে এমনকি তার মুখ চুম্বন করে এভাবেই চলেছে দীর্ঘ তিরিশ-পঁয়তিরিশ বছর যতদিন আব্বা বেঁচে ছিলেন বিশুর নিজের অথবা তার পরিবারের সমস্ত ওষুধপালা আব্বাই দাতব্য করতেন

আব্বা মারা যাওয়ার পর ডাক্তার খন্দকার দুলাভাইকে একবার তার অসুখ দেখায় ডঃ খন্দকার প্রেসক্রিপশন লেখার সময় জিজ্ঞাসা করেন, “তোমার বয়স কতো?” উত্তরে বিশু বলে, “দাঁড়ান, আমার বৌ এসে আপনাদের রান্নাশালে বসে আছে, ওকে জিজ্ঞেস করিগরু আর গোয়াল সামলাতে গিয়ে তার শরীরটার মত বুদ্ধিটাও কমে গিয়েছিল ছাপোষা মানুষটার সংসারটা ধরে রেখেছিল তার স্ত্রী আব্বা মারা যাওয়ার কয়েক বছরের মধ্যে গরু পোষার হরেক ঝামেলা আমরা বহন করতে পারিনি ঘরের দুধ-ঘি-এর মায়া ত্যাগ করে বাজার থেকে কিনে খাওয়া আরম্ভ করি মনে হয়েছিল সেটা সহজলভ্য ও নির্ঝঞ্ঝাট

দীর্ঘদিন আমাদের কাজে নিয়োজিত থেকে তার চলে যাওয়ার সময় যেটুকু দানস্বরূপ তাকে দেওয়া হয়েছিল  তা জীবনধারণের জন্য  খুবই অপ্রতুল ভাগ্যিস কয়েক দিনেরমধ্যে একটা স্কুল ঝাড়ু দেওয়ার  কাজ পেয়ে দিনান্তে পাপক্ষয় করতে থাকে দু- এক বৎসর পর এক শীতে হঠাৎ মৃত্যু হয় বিশুর যেটুকু সম্ভব পাশে দাঁড়িয়েছি। তার স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিয়ে ছেলেমেয়েদের মুখে চেয়ে শক্ত হতে উপদেশ দিয়েছি কথাগুলো সে শুনছিল কিনা জানিনা দেখে মনে হচ্ছিল শোকে স্থবির, বিহ্বল এক সপ্তাহ পার হয়নি খবর পেলাম বিশুর স্ত্রী গত হয়েছে বিশু ভাগ্যবান তার মত মানুষকেও তার স্ত্রী কত গভীরভাবে ভালবেসেছিল যে সংসারমুখী কর্তব্যপরায়ন মানুষটা তার শোকের অভিঘাত সহ্য করতে পারেনি

দ্বিতীয়জন আমাদের পাড়ার আজিজ একেবারে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান পাড়ার বহু প্রাচীন মসজিদটার পাশে পৈত্রিক বাড়ি তার ছোট দু ভাই মজিদ ও হামিদ সকলেই আমার খেলার সাথি চার আনা আটানা চাঁদা তুলে সাড়ে তিন টাকার চামড়ার বল কিনে পাড়ার জলসাপড়ার মাঠে বল খেলতাম ওদের মধ্যে আজিজ বড় স্কুলে সিক্স-সেভেন পর্যন্ত পড়ে দর্জির কাজ শেখে ওই বয়সে কাজে লাগার জন্য খুব বেশিদিন আমাদের সঙ্গে খেলেনি একটু-আধটু কাজ শিখল আজিজের বিয়ে হল কয়েক বৎসর পর মজিদেরও বিয়ে পৈত্রিক ভিটেয় ঘরের সংকুলান হয় না অনতিদূরে তাদের অন্য ভিটেয় বাড়ি করল আজিজ ইতিমধ্যে তার এক ছেলে এক মেয়ে ছেলে- মেয়ে স্কুলে যায় মেয়েরা বোধহয় তরতরিয়ে বাড়ে আজিজ পাত্র খুঁজে মেয়েকে পাত্রস্থ করে সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারটা বেশ স্বচ্ছন্দে দিন কাটাচ্ছিল বছর ঘোরেনি মেয়েটি সন্তান প্রসব করতে গিয়ে মারা গেল একধাক্কায় আজিজের সংসারটা থমকে গেল এক মাস অতিক্রম করেনি আজিজের স্ত্রী বুকের যন্ত্রনায় হাসপাতালে শয্যাশায়ী কয়েকদিনের মধ্যে ফিরে এলো লাশ হয়ে আজিজ প্রায় মূক ও বধির দশটা দিনও পার হলো না আজিজের দেহটাও নিথর হয়ে গেল এত কম দিনের ব্যবধানে একই পরিবারের পরপর মৃত্যু খিজির খাঁ কবরস্থানের ইতিহাসে আছে কিনা আমার জানা নেই তবে আজিজের স্ত্রীর মৃত্যুটা তার মেয়ের শোকে অনুমান করতে পারি কিন্তু আজিজের মৃত্যুটা কার শোকের অভিঘাত আমার জানা নেই মেয়ের শোক না স্ত্রীর শোক নাকি উভয়ের শোক-- তা আমার অনুমানের উর্দ্ধে তবে স্বীকার করি এরা ভালোবাসতে জানতো  হয়তো পরিনাম না জেনে

তৃতীয়জন হলেন অভিজাত শ্রেণীর উচ্চবিত্তের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি কলকাতার ট্যাংরা এলাকায় নিজেদের বাগান বাড়ি সংলগ্ন পৈত্রিক বাড়িতে বসবাস কলকাতার কোন এক কলেজ থেকে কমার্স নিয়ে বিকম পাস এম কমে ভর্তি হয়ে তদানীন্তন সিটি কলেজের অধ্যক্ষ স্বনামধন্য শীতলাচরণ সেনগুপ্ত মহাশয়-এর কাছে প্রাইভেট পড়তেন। অল্প ক’দিনেই আমাদের আলোচ্য ব্যক্তি তাঁর স্নেহধন্য হয়ে ওঠেন সেই সূত্রে তাঁর চার্টার্ড ফার্মে শিক্ষানবিশি সঙ্গে চলছিল কলকাতায় জমি বাড়ি কেনাকাটা ও অন্যান্য ব্যবসা। খুব অল্প সময়ে দ্রুত উন্নতি করে চলেছিলেন স্বাধীনতার সময় ছেচল্লিশের দাঙ্গায় কলকাতা ছেড়ে তিনি পূর্বপুরুষের ভিটে পান্ডুয়া সংলগ্ন সরাইয়ে চলে যান তারপর সেখান থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্য করতেন ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন স্বল্পবাক, ধর্মভীরু নিষ্ঠার সঙ্গে ধর্মাচার করেই ক্ষান্ত  ছিলেন না, আধ্যাত্মিকতার আরও উচ্চমার্গের অন্বেষণে রাত্রে এক ঘুমের পর শেষ রাতে উঠে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর উদ্দেশ্যে তাহাজ্জুদের নামাজ চিরকাল তাঁর বাড়ির পাশের মসজিদে আদায় করতেন সততা ও নানা কারণে ব্যবসায় তাঁর সুখ্যাতি অর্জন করতে দেরি হয়নি স্বভাবতই সমগোত্রীয় ও সমমর্যাদা সম্পন্ন পরিবারে তাঁর বিবাহ তাঁর স্ত্রী রূপের দিক থেকে যেমন ছিলেন অপরূপা সেরকমই ছিলেন বুদ্ধিদীপ্তা কথাবার্তায়, ব্যবহারে তাঁর ব্যক্তিত্বের ছাপ অনুভূত হতো সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরপুর সংসারে একটাই অভাব ছিল তাঁরা ছিলেন নিঃসন্তান তাতে কী? ভাইয়ের ছেলে মেয়েরাই হয়ে ওঠে তাঁদের সন্তান সকলের উপর তাঁদের সজাগ দৃষ্টি অন্যদিকে সন্তানগুলোও তাঁদের অনুগত বাইরের জগতটা সামলান তিনি আর সংসারের অন্যান্য দায়দায়িত্ব পালন করেন তাঁর বুদ্ধিমতী স্ত্রী জীবনযাত্রার দিনগুলো বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও ছিল সচল ও সুখের মহাকালের অমোঘ নিয়মে সেই ব্যক্তির প্রিয়তমা স্ত্রীর জীবন প্রদীপ নিভে যায় একটু আচমকাই তবে এই ধী-সম্পন্ন ব্যক্তিটিকে আপাতদৃষ্টিতে ধৈর্য ধারণ করে থাকতে দেখে প্রায় সকলে ধাতস্থ হয়ে ছিলেন। কিন্তু দশ দিনও পার হয়নি তিনিও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন

এই মৃত্যুগুলো কি কাকতালীয়? নাকি শোক ও গভীর বেদনার অভিঘাত সহ্য করতে না পারার কার্যকারণ? আমার ধারণা কাছের মানুষের বিয়োগে মনের উপর যে ক্রিয়া-বিক্রিয়া ঘটে তার মাত্রা জনে-জনে ফারাক হয়। তাই তার সরলীকরণ ঠিক নয় ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি যে, প্রিয়জনকে হারানোর শোকে মুহ্যমান হয়ে আকস্মিকভাবে যারা মৃত্যুবরণ করেন তাঁরা স্মরণীয়। তাঁরা মহান। তাঁরা উত্তম। কিন্তু এই অকিঞ্চন আজও জীবিত, এখনো বহাল তবিয়তে। হয়তো সে অধম তা-ই!