Friday 31 January 2020

তায়্যিব সালেহঃ এক মুঠো খেজুর


 এক মুঠো খেজুর 
                                                                                                                                      
মূল- তায়্যিব সালেহ, সুদান
অনুবাদ- আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

[আত্‌-তায়্যিব সালেহ গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। জন্ম উত্তর সুদানের কার্‌মাকূল গ্রামে, ১৯২৯ সালের ১২ই জুলাই। ‘মাওসামুল্‌ হিজ্‌রাহ্‌ ইলাশ্‌ শিমাল’ (মাইগ্রেশন টু দ্য নর্থ, ১৯৫২ সালে প্রকাশিত) তাঁর অমর কীর্তি ও সর্বাধিক আলোচিত উপন্যাস। ৩০টিরও অধিক ভাষায় অনূদিত। এই উপন্যাসের মাধ্যমেই তিনি খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছান। ‘আরব লিটারারি সোসাইটি’ ২০০১ সালে তাঁর এই উপন্যাসকে ‘বিংশ শতকের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস’ আখ্যায়িত করে। পরের বছর ২০০২ সালে ‘নরওয়েজিয়ান বুকস্ ক্লাব’ কর্তৃক প্রকাশিত ‘বিংশ শতকের ১০০টি সেরা উপন্যাস’-এর তালিকাতেও স্থান করে নেয় তাঁর এই উপন্যাসটি। তাঁর আর এক উপন্যাস ‘আর্‌সুয্‌ যাইন অবলম্বনে নির্মিত চলচিত্র ‘দ্য ওয়েডিং অব যেইন’ (কুয়েতি পরিচালক খালিদ আস্‌-সিদ্দিক কর্তৃক নির্দেশিত) ১৯৭৬ সালে ‘কান ফিল্ম ফেস্টিভাল অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করে। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি রচনা হলো দূমাতু উদ্দে হামিদ, যাউউল্‌ বাইত, নাখ্‌লাহ্‌ ‘আলাল্‌ জাদ্‌ওয়াল এবং মার্‌ইউদ। অনূদিত এই গল্পটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে। ২০০৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি, লন্ডনে তাঁর মৃত্যু হয়।]

আমি তখন খুব ছোট। বয়স কত ছিল ঠিক মনে নেই। তবে মনে আছে, অধিকাংশ সময় দাদুর সাথেই থাকতাম। লোকজন আমাকে কাছে পেলে আমার মাথায় হাত বোলাত, পিঠ চাপড়ে দিতো, কেউ বা থুতনী ধরে আদর করতো। তবে আমার কাছে মজার ব্যাপার ছিল- দাদুর সাথে কেউ অমনটা করতো না। আর আমি বাবার সাথে খুব একটা বাইরে বেরোতাম না। কারণ দাদু সব সময় আমাকে তাঁর সাথে রাখতেন। যেখানেই যেতেন আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। শুধুমাত্র ভোর বেলা দাদুকে ছাড়াই আমি কোরআন শিখতে মসজিদে যেতাম।

মসজিদ, নদী এবং ক্ষেতখামার এই তিনটেই ছিল আমার জীবনের গণ্ডি। আমার বয়সী ছেলেমেয়েরা মসজিদে যেতে চাইতো না। কোরআন মুখস্থ করতে ভয় পেতো। কিন্তু আমি ভালোবেসে মসজিদে যেতাম। আমি যে কোনো পড়া সহজেই মুখস্থ করতে পারতাম। এটাই ছিল মূল কারণ। মসজিদে কোনো অতিথি এলে মৌলানা সাহেব প্রতিবারই আমাকে দাঁড় করিয়ে সূরা আর্‌-রাহ়মান তেলাওয়াত করতে বলতেন। তেলাওয়াত শুনে অতিথিরা আমার মাথায় হাত বোলাতেন। আলতো করে গাল টিপে আদর করতেন। ঠিক যেমনটা দাদুর সাথে বাইরে বেরোলে লোকজন করতো।

মসজিদে আমার খুব ভালো লাগত নদীও ছিল আমার ভীষণ প্রিয়। পূর্বাহ্ণের সময় কোরআন পাঠের পর্ব শেষ হতেই স্লেটটা ফেলে রূপকথার জিনের মত চোখের পলকে গিয়ে হাজির হতাম মায়ের কাছে। তড়িৎ গতিতে গোগ্রাসে সকালের জলখাবারটা গিলেই ছুটতাম নদীর তীরে। নিমেষেই ঝাঁপ দিতাম জলে। সাঁতরাতে সাঁতরাতে যখন হাত-পা অবশ হয়ে আসতো জলের ধারে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতাম। পাড়ে বসে অপলক চেয়ে থাকতাম পূবে ছুটে চলা স্রোতস্বিনীর আঁকাবাঁকা পথের দিকে। চলতে চলতে নদীটা হারিয়ে যেত অ্যাকাশিয়ার গভীর অরণ্যে। আমিও ভালোবেসে ছেড়ে দিতাম আমার কল্পনার লাগাম। সেই অরণ্যের দেব-দানবদের নিয়ে ভাবতে আমার বেশ ভাল লাগতো- তাদের বিশালকায় দেহ, চোখা নাক আর মুখে লম্বা সাদা দাড়ি। অনেকটা আমার দাদুর মতই দেখতে।

আমার প্রায় সব প্রশ্নের জবাব দিতেন দাদু। তবে জবাব দেওয়ার আগে প্রতিবারই আঙুল দিয়ে তার চোখা নাকটা একটু ঘষে নিতেন। কখনো দাড়িতে হাত বোলাতেন। তার দাড়ি ছিল বেশ লম্বা, নরম তুলতুলে এবং ধবধবে সাদা; দেখতে তুলোর মতো। আমার জীবনে অমন ধবধবে সাদা এবং সুন্দর দাড়ি আর কারো কখনো দেখিনি। দাদু ছিলেন খুব লম্বা এবং দোহারা চেহারার। এত লম্বা যে, তার সাথে কথা বলার সময় ঘাড় বাঁকিয়ে, মাথা উঁচু করে উপর দিকে তাকাতে হয়নি আমাদের এলাকায় এমন একজনও ছিল না। এত লম্বা যে, কোনো ঘরে ঢোকার সময় দাদু তার ঘাড় আর পিঠ বাঁকা করেননি এমন দৃশ্য আমার চোখে কখনো পড়েনি। তার শরীর বাঁকিয়ে ঘরে ঢোকার দৃশ্য দেখলেই আমার ওই আঁকাবাঁকা নদীটার কথা মনে পড়ে যেতো। দাদুকে আমি খুব ভালোবাসতাম আর মনে মনে ভাবতাম, বড় হয়ে আমিও দাদুর মতন চিকন এবং লম্বা হবো। লম্বা লম্বা পায়ে এদিক ওদিক হেঁটে বেড়াবো।

আমার ধারণা, অন্যান্য নাতিনাতনিদের তুলনায় দাদু আমাকেই বেশি ভালোবাসতেন। প্রায় সব ক্ষেত্রেই আমাকে প্রাধান্য দিতেন। কারণ আমার চাচাতো (খুড়তুতো) ভাইয়েরা ছিল একদল আহাম্মক। আর তাদের নজরে আমি ছিলাম প্রচন্ড বুদ্ধিমান। আমি ভালোভাবেই জানতাম, দাদুর সামনে ঠিক কখন হাসতে হয় আর কখন চুপ থাকতে হয়। তাঁর নামাযের সময় সম্পর্কে আমার সঠিক ধারণা ছিল। তাই তিনি বলার আগেই আমি তাঁর জন্য জায়-নামায (নামাযপাটি) আর জগ ভর্তি অযুর পানি নিয়ে হাজির হতাম। দাদুর যখন কোনো কাজ থাকতো না আমি সু-ললিত কণ্ঠে তাকে কোরআন তেলাওয়াত করে শোনাতাম। আর তাঁর মুখ দেখে বুঝতে পারতাম তিনি তা উপভোগ করছেন এবং বেশ আনন্দ পাচ্ছেন।

আমাদের এক প্রতিবেশী ছিল। নাম মাসুদ। আমি মাসুদ চাচা বলে ডাকতাম। দাদু তাকে মোটেই পছন্দ করতেন না। একদিন দাদুকে সে কথাই জিজ্ঞেস করলাম— দাদু, আমার মনে হয় তুমি মাসুদ চাচাকে খুব একটা পছন্দ করো না; তাই না? নিজের চোখা নাকটা আঙুল দিয়ে একটু ঘষে নিয়ে উত্তর দিলেন— কারণ, ও একটা অপদার্থ অকর্মন্য। আমি এ ধরনের মানুষ মোটেই পছন্দ করিনা। জিজ্ঞেস করলাম— অকর্মন্য মানুষ আবার কেমন হয় দাদু?

কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে থাকলেন। তারপর সামনের বিস্তৃত মাঠের দিকে তাকিয়ে বললেন— মরুভূমির শেষ প্রান্ত থেকে নীল নদের তীর পর্যন্ত ওই যে বিশাল মাঠ দেখছো, একশ বিঘা। আর ওই যে খেজুর বাগান এবং সারি সারি অ্যাকাশিয়া, সেয়াল ও ভ্যাকেলিয়া নিলোটিকার গাছগুলো দেখছো, ওগুলো একসময় মাসুদের ছিল। উত্তরাধীকার সূত্রে বাবার কাছ থেকে পেয়েছিল।

এই বলে দাদু আবারো কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে গেলেন। তার এই নীরবতার সুযোগে আমি আমার দৃষ্টি তার সাদা দাড়ি থেকে সরিয়ে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠের দিকে নিক্ষেপ করলাম। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মনে মনে বলতে লাগলাম- এই খেজুর বাগান, এই সারিসারি গাছ এবং এই উঁচুনিচু, এবড়ো-খেবড়ো জমির মালিক যে-ই হোক না কেন, আমি তার তোয়াক্কা করিনা। এই জমি আমার খেলার মাঠ, আমার স্বপ্নের চারণভূমি।

কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙ্গে দাদু বললেন— দাদু ভাই, চল্লিশ বছর আগে এসব জমির মালিক ছিল মাসুদ। কিন্তু আজ এর বারো আনাই আমার। দাদুর এ কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। কারণ আমি জানতাম, পৃথিবী সৃষ্টির প্রথম দিন থেকেই এই সব জমির মালিক আমার দাদু; তাহলে...। দাদু আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন— দাদু ভাই, এই গাঁয়ে আমি যখন প্রথম আসি তখন আমার এক বিঘা জমিও ছিল না। এই সব সম্পদের মালিক ছিল মাসুদ। কিন্তু অবস্থা এখন বদলেছে। তার বেশীর ভাগ জমি আমি কিনে ফেলেছি আর আমার ধারণা, আল্লাহ আমাকে তাঁর কাছে নিয়ে যাওয়ার আগেই আমি মাসুদের বাকি চার আনাও কিনে ফেলবো।

জানি না কেন, দাদুর এই কথা শুনে আমার কেমন ভয় হল। আর মাসুদ চাচার প্রতি এক অদ্ভুত রকমের মায়া জন্মাল। মনে হল, দাদু যা বললেন, যা করতে চাইলেন তিনি যেন সে কাজ করার সুযোগ না পান! সেই সাথে আমার স্মৃতিপটে ভেসে উঠল সুরেলা কন্ঠে মাসুদ চাচার গান গাওয়ার দৃশ্য। তার চমৎকার কন্ঠ আর আকর্ষনীয় হাসি; যেন বয়ে চলা নদীর কলতান।

দাদু ছিলেন কঠিন প্রকৃতির। খুব একটা হাসতেন না। তাই যখন জানতে চাইলাম “মাসুদ চাচা কেন এতগুলো জমি বিক্রি করেছেন?” গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলেন— নারী।’

দাদুর মুখে নারী শব্দটা শুনে আমার মনে হল এ যেন ভয়ানক কোনো প্রাণী। তিনি আরও বললেনদাদু ভাই, মাসুদ জীবনে বহুবার বিয়ে করেছে। আর বিয়ের খরচ জোগাতে প্রতিবারই দু’-এক বিঘা ক’রে প্রায় সব জমিই ও আমার কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। দাদুর এ কথা শুনে চট করে একটা হিসেব কষে ফেললাম- এ কথা যদি সত্যি হয় তবে মাসুদ চাচার তো এতোদিনে নব্বইটা বিয়ে করার কথা! আমার তখন মনে পড়ে গেল তার তিন স্ত্রীর কথা। চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার মলিন চেহারা, হাতা-ছেঁড়া জুব্বা, তার খোঁড়া গাধা এবং গাধার পীঠে ভাঙা পালঙ্গের ছবি। কিন্তু আমার মনের দুয়ারে ভিড় করা এসব দৃশ্য চট করেই উবে গেল যখন দেখতে পেলাম মাসুদ চাচা আমাদের দিকে আসছেন। হঠাৎ তাকে আসতে দেখে আমি এবং দাদু একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। কাছে এসে মাসুদ চাচা দাদুকে বললেন আজকে আমার বাগানে খেজুর পাড়া হবে। আপনি থাকবেন তো?

তার কণ্ঠ শুনে আমার মনে হল, তিনি মন থেকে চাইছেন না যে দাদু খেজুর পাড়ার সময় বাগানে থাকুক। কিন্তু দাদু ধপ করে উঠে দাঁড়ালেন। আমি স্পষ্ট দেখতে পেলাম, তার চোখ দুটো মুহূর্তেই প্রচন্ড উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। দাঁড়িয়ে খপ করে আমার হাত ধরে টান দিলেন; আর আমরা মাসুদ চাচার খেজুর বাগানের দিকে হাঁটতে লাগলাম। বাগানে পৌঁছানোর পর কেউ একজন দাদুকে একটা চামড়া-মোড়া টুল এগিয়ে দিল। দাদু তাতে বসলেন আর আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম।

সেখানে বাগানের ভেতরে অনেকেই ছিল। তাদের প্রায় সবাইকেই আমি চিনতাম। কিন্তু কোনো এক কারণে সব কিছু বাদ দিয়ে মাসুদ চাচার দিকে আমার নজর গেল। ভিড় থেকে খানিকটা দূরে তিনি নিস্পৃহভাবে দাঁড়িয়ে আছেন; যেন তার কিছুই করার নেই। অথচ যে বাগানে খেজুর পাড়া হচ্ছে সেই বাগানের মালিক তিনি! কখনোসখনো খেজুরের বড় কোনো কাঁদি পড়ার শব্দ হলে তিনি সেদিকে দৃষ্টি ফেরাচ্ছেন। এক বাচ্চা ছেলে খেজুর গাছের মাথায় চেপে লম্বা ধারালো কাস্তে দিয়ে খেজুরের কাঁদিগুলো কাটছিল। তাকে লক্ষ্য করে বেশ উঁচু গলাতেই একবার বললেন— সাবধান! গাছের হৃদয়টা আবার কেটে ফেলো না যেন। কিন্তু তার কথায় কেউই কান দিল না। ছেলেটা ধারালো কাস্তে দিয়ে আগের মতই একের পর এক খেজুরের কাঁদি কাটতে থাকলো। ফলে গাছ থেকে অঝোরে খেজুর পড়তে থাকল আর আমার মনে হচ্ছিল যেন আকাশ থেকে পড়ছে।

যাই হোক, অন্যরা পাত্তা না দিলেও আমাকে কিন্তু মাসুদ চাচার ওই কথাটা “গাছের হৃদয়” ভাবিয়ে তুলেছিল। আমি কল্পনার দৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছিলাম এমন একটা খেজুর গাছ; যার অনুভূতি আছে হৃদয় আছে হৃদয়ে স্পন্দন আছে। হঠাৎ করে মাসুদ চাচার আরো একটা কথা আমার স্মৃতিতে কড়া নাড়লো। একদিন আমি খেজুর গাছের একটা ছোট ভাঙা ডাল নিয়ে খেলছিলাম। দেখতে পেয়ে তিনি আমাকে ডেকে বলেছিলেন— ‘শোনো বাবা! খেজুর গাছও মানুষের মত। আনন্দে হাসে, দুঃখে কাঁদে।’ যদিও সে দিন মাসুদ চাচার ওই কথা শুনে আমি বেশ বিব্রত হয়েছিলাম।

স্মৃতির জানালা থেকে নজর সরিয়ে আবারো সামনের খোলা মাঠের দিকে তাকালাম। দেখলাম, আমার খেলার সাথীরা পিঁপড়ের মত খেজুর গাছের নীচে ভিড় করছে। ছোটাছুটি করে খেজুর কুড়োচ্ছে আর খাচ্ছে। গাছ থেকে পেড়ে খেজুরগুলোকে এক জায়গায় টিলার মত স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। দেখলাম, বেশ কিছুজন টিনের কৌটা দিয়ে মেপে মেপে খেজুরগুলো বস্তায় ভরছে। মোট তিরিশ বস্তা খেজুর। খানিকক্ষণ বাদে একে একে প্রায় সবাই চলে গেল। শুধু থাকলো ব্যবসায়ী হুসেন এবং মুসা সাহেব; পূব দিকে আমাদের জমি ঘেষেই যার কিছু জমি আছে। আরও দু’জন; তবে এর আগে আমি তাদের কখনও দেখিনি।

হঠাৎই মৃদু শিস ধ্বনি কানে এলো। লক্ষ্য করলাম, দাদু বসে বসেই ঘুমোচ্ছেন। অন্যদিকে মাসুদ চাচা আগের মতোই খানিকটা দূরে একলা দাঁড়িয়ে। তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। শুধু একটা খেজুরের ডাল মুখে দিয়ে আনমনে চিবোচ্ছেন। মনে হচ্ছে যেন উদরপূর্তি করে খাবার পর মুখভর্তি ওই শেষ লুকমাটা কী করবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না।

কিছুক্ষণ পরেই দাদুর ঘুম ভেঙে গেল। উঠে দাঁড়াতেই খেজুরের বস্তাগুলোর দিকে হাঁটতে লাগলেন। তার পেছন পেছন ব্যবসায়ী হুসেন, পাশের জমির মালিক মুসা এবং সেই দুই আগন্তুক। দাদুর পেছনে আমিও হাঁটতে লাগলাম এবং মাসুদ চাচা কী করেন দেখতে তার দিকে মুখ ফেরালাম। দেখলাম, তিনি ধীরে ধীরে আমাদের দিকেই হাঁটছেন। দেখে মনে হলো, তিনি পিছু হটতে চাইছেন কিন্তু তার পা দুটো তাকে সামনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সবাই বস্তাগুলোর চারিদিকে গোল হয়ে দাঁড়াল। তাদের মধ্য থেকে কেউ কেউ দু’ একটা খেজুর হাতে নিয়ে দেখলো। কেউ আবার খেয়ে দেখল। দাদু একটা বস্তা থেকে এক মুঠো খেজুর তুলে আমাকে দিলেন। আমি সেগুলো চিবোতে লাগলাম। চিবোতে চিবোতে লক্ষ্য করলাম, মাসুদ চাচা তার দু’ হাত ভরে খেজুর তুলে নাকের কাছে নিয়ে গেলেন। দীর্ঘক্ষণ ধরে সেগুলোর ঘ্রাণ নিলেন। তারপর আবার বস্তায় রেখে দিলেন যেন তার এর চেয়ে বেশি কিছু করার অধিকার নেই।

বস্তাগুলো ভাগ করা হলো। হুসেন নিল দশটিদুই আগন্তুক নিল পাঁচটি করে। আর মুসা, যার জমি পূব মাঠে আমাদের জমির পাশে রয়েছে, সে নিল পাঁচটি বস্তা। আর বাকি পাঁচটি নিলেন দাদু। কিছু বুঝতে না পেরে আমি মাসুদ চাচার দিকে আবারও তাকালাম। লক্ষ্য করলাম, তার চোখ দু’টো ডানে-বামে নড়াচড়া করছে; যেন পথহারা দুটো ছোট্ট ইঁদুর এধারওধার করে নিজেদের গর্ত খুঁজছে। মাসুদ চাচাকে দাদু বললেন— ‘তোমার কাছে আরো পঞ্চাশ পাউন্ড খেজুর পাওনা রইলো। এ নিয়ে আমরা পরে কথা বলবো।’

হুসেন তার লোকজন ও ছেলেছোকরাদের ডাক দিল। তারা কতগুলো গাধা নিয়ে হাজির হলো। আর আগন্তুক দু’জন পাঁচটি উট নিয়ে এলো। তারা উট ও গাধার পিঠে নিজ নিজ বস্তাগুলো তুলে দিলো। একটা গাধার কর্কশ চিৎকার শুনে উটগুলো গরগর করে মুখে ফেনা তুললো; যেন তারা এর প্রতিবাদ করছে। লক্ষ্য করলাম, আমি নিজের অজান্তেই মাসুদ চাচার দিকে হাঁটছি। আর আমার হাত তার দিকে এগোচ্ছে, যেন তার জুব্বার হাতা স্পর্শ করতে চাচ্ছে। একটু এগোতেই তার গলায় ঘড়ঘড় শব্দ শুনতে পেলাম; ঠিক যেমনটা ভেড়া জবাই করলে হয়। ঠিক কী কারণে তা জানি না, বুকের ভেতরটা কেমন আনচান করে উঠল। দৌড়ে অনেকটা দূরে চলে গেলাম। পেছন থেকে দাদু ডাকলেন তবুও দাঁড়ালাম না। ওই মুহূর্তে মনে হল, আমি দাদুকে খুব ঘৃণা করি। আমি দৌড়োচ্ছিলাম; এত জোরে যেন কেউ একজন আমার পীঠে প্রচন্ড ভারি একটা বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে আর আমি তা থেকে মুক্তি চাইছি। দৌড়োতে দৌড়োতে এসে দাঁড়ালাম নদীর তীরে; যেখান থেকে বাঁক নিয়ে অ্যাকাশিয়ার গভীর অরণ্যে হারিয়ে গেছে নদীটা। সেখানে দাঁড়িয়ে গলায় আঙুল ঢুকিয়ে বমি করলাম দাদুর দেওয়া যে খেজুরগুলো খেয়েছিলাম তার সবটুকু বেরিয়ে গেল। কিন্তু কেন অমন করলাম? প্রশ্নটা উত্তরসহ স্রোতের সাথে ভাসতে ভাসতে হারিয়ে গেল অ্যাকাশিয়ার গভীর অরণ্যে।    

[দূমাতু উদ্দে হ়ামিদ ২০ – ২৬, দারুল্‌ জীল বৈরুত, ১৯৯৭]


حفنة تمر
الطيب صالح

لابدّ إنني كنت صغيراً جداً حينذاك. لست أذكر كم كان عمري تماماً، ولكنني أذكر أن الناس حين كانوا يرونني مع جدي كانوا يربتون على رأسي، ويقرصونني في خدي، ولم يكونوا يفعلون ذلك مع جدي. العجيب أنني لم أكن أخرج أبداً مع أبي، ولكن جدي كان يأخذني معه حيثما ذهب، إلا في الصباح حين كنت أذهب إلى المسجد، لحفظ القرآن. المسجد والنهر والحقل، هذه كانت معالم حياتنا. أغلب أندادي كانوا يتبرمون بالمسجد وحفظ القرآن ولكنني كنت أحب الذهاب إلى المسجد. لابد أن السبب أنني كنت سريع الحفظ، وكان الشيخ يطلب مني دائماً أن أقف وأقرأ سورة الرحمن، كلما جاءنا زائر. وكان الزوار يربتون على خدي ورأسي، تماماً كما كانوا يفعلون حين يرونني مع جدي. نعم كنت أحب المسجد. وكنت أيضاً أحب النهر. حالما نفرغ من قراءتنا وقت الضحى، كنت أرمي لوحي الخشبي، وأجري كالجن إلى أمي، والتهم إفطاري بسرعة شديدة واجري إلى النهر وأغمس نفسي فيه. وحين أكلُّ من السباحة، كنت أجلس على الحافة وأتأمل الشاطئ الذي ينحني في الشرق ويختبئ وراء غابة كثيفة من شجر الطلع. كنت أحب ذلك. كنت أسرح بخيالي وأتصور قبيلة من العمالقة يعيشون وراء تلك الغابة … قوم طوال فحال لهم لحى بيضاء وأنوف حادة مثل أنف جدي. أنف جدي كان كبيراً حاداً. قبل أن يجيب جدي على أسئلتي الكثيرة، كان دائماً يحك طرف أنفه بسبابته. ولحية جدي كانت غزيرة ناعمة بيضاء كالقطن. لم أرَ في حياتي بياضاً أنصع ولا أجمل من بياض لحية جدي. ولابد أن جدي كان فارع الطول، إذ أنني لم أرَ أحداً في سائر البلد يكلم جدي إلا وهو يتطلع إليه من أسفل، ولم أرَ جدي يدخل بيتاً إلا وكان ينحني انحناءة كبيرة تذكرني بانحناء النهر وراء غابة الطلح. كان جدي طويلاً ونحيلاً وكنت أحبه وأتخيل نفسي، حين استوي رجلاً أذرع الأرض مثله في خطوات واسعة. وأظن جدي كان يؤثرني دون بقية أحفاده. ولست ألومه، فأولاد أعمامي كانوا أغبياء وكنت أنا طفلاً ذكياً. هكذا قالوا لي. كنت أعرف متى يريدني جدي أن أضحك ومتى يريدني أن اسكت، وكنت أتذكر مواعيد صلاته، فاحضر له ((المصلاة)) وأملأ له الإبريق قبل أن يطلب ذلك مني. كان يلذ له في ساعات راحته أن يستمع إليّ أقرأ له من القرآن بصوت منغم، وكنت أعرف من وجه جدي أنه أيضاً كان يطرب له. سألته ذات يوم عن جارنا مسعود. قلت لجدي: (أظنك لا تحب جارنا مسعود؟) فأجاب بعد أن حك طرف أنفه بسبابته: (لأنه رجل خامل وأنا لا أحب الرجل الخامل). قلت له: (وما الرجل الخامل؟) فأطرق جدي برهة ثم قال لي: (انظر إلى هذا الحقل الواسع. ألا تراه يمتد من طرف الصحراء إلى حافة النيل مائة فدان؟ هذا النخل الكثير هل تراه؟ وهذا الشجر؟ سنط وطلح وسيال. كل هذا كان حلالاً بارداً لمسعود، ورثه عن أبيه). وانتهزت الصمت الذي نزل على جدي، فحولت نظري عن لحيته وأدرته في الأرض الواسعة التي حددها لي بكلماته. (لست أبالي مَن يملك هذا النخل ولا ذلك الشجر ولا هذه الأرض السوداء المشققة. كل ما أعرفه أنها مسرح أحلامي ومرتع ساعات فراغي). بدأ جدي يواصل الحديث: (نعم يا بنيّ. كانت كلها قبل أربعين عاماً ملكاً لمسعود. ثلثاها الآن لي أنا). كانت هذه حقيقة مثيرة بالنسبة لي، فقد كنت أحسب الأرض ملكاً لجدي منذ خلق الله الأرض. (ولم أكن أملك فداناً واحداً حين وطئت قدماي هذا البلد. وكان مسعود يملك كل هذا الخير. ولكن الحال انقلب الآن، وأظنني قبل أن يتوفاني الله سأشتري الثلث الباقي أيضاً). لست أدري لماذا أحسست بخوف من كلمات جدي. وشعرت بالعطف على جارنا مسعود. ليت جدي لا يفعل! وتذكرت غناء مسعود وصوته الجميل وضحكته القوية التي تشبه صوت الماء المدلوق. جدي لم يكن يضحك أبداً. وسألت جدي لماذا باع مسعود أرضه؟ (النساء). وشعرت من نطق جدي للكلمة أن (النساء) شيء فظيع. (مسعود يا بنيَّ رجل مزواج كل مرة تزوج امرأة باع لي فدناً أو فدانين). وبسرعة حسبت في ذهني أن مسعود لابد أن تزوج تسعين امرأة، وتذكرت زوجاته الثلاث وحاله المبهدل وحمارته العرجاء وسرجه المكسور وجلبابه الممزق الأيدي. وكدت أتخلص من الذكرى التي جاشت في خاطري، لولا أنني رأيت الرجل قادماً نحونا، فنظرت إلى جدي ونظر إليّ. وقال مسعود: ((سنحصد التمر اليوم، ألا تريد أن تحضر؟)) وأحسست أنه لا يريد جدي أن يحضر بالفعل. ولكن جدي هب واقفاً، ورأيت عينه تلمع برهة ببريق شديد، وشدني من يدي وذهبنا إلى حصاد تمر مسعود. وجاء أجد لجدي بمقعد عليه فروة ثور. جلس جدي وظللت أنا واقفاً. كانوا خلقاً كثيراً. كنت أعرفهم كلهم، ولكنني لسبب ما أخذت أراقب مسعوداً. كان واقفاً بعيداً عن ذلك الحشد كأن الأمر لا يعنيه، مع أن النخيل الذي يحصد كان نخله هو، وأحياناً يلفت نظره صوت سبيطة ضخمة من التمر وهي تهوي من علٍ. ومرة صاح بالصبي الذي استوى فوق قمة النخلة، وأخذ يقطع السبيط بمنجله الطويل الحاد: ((حاذر لا تقطع قلب النخلة)). ولم ينتبه أحد لما قال، واستمر الصبي الجالس فوق قمة النخلة يعمل منجله في العرجون بسرعة ونشاط، وأخذ السبط يهوي كشيء ينزل من السماء. ولكنني أنا أخذت أفكر في قول مسعود: ((قلب النخلة)) وتصورت النخلة شيئاً يحس له قلب ينبض. وتذكرت قول مسعود لي مرة حين رآني أعبث بجريد نخلة صغيرة: ((النخل يا بنيّ كالادميين يفرح ويتألم)). وشعرت بحياء داخلي لم أجد له سبباً. ولما نظرت مرة أخرى إلى الساحة الممتدة أمامي رأيت رفاقي الأطفال يموجون كالنمل تحت جذوع النخل يجمعون التمر ويأكلون أكثره. واجتمع التمر أكواماً عالية. ثم رأيت قوماً أقبلوا وأخذوا يكيلونه بمكاييل ويصبونه في أكياس. وعددت منها ثلاثين كيساً. وانفض الجمع عدا حسين التاجر وموسى صاحب الحقل المجاور لحقلنا من الشرق، ورجلين غريبين لم أرَهما من قبل. وسمعت صفيراً خافتاً، فالتفت فإذا جدي قد نام، ونظرت فإذا مسعود لم يغير وقفته ولكنه وضع عوداً من القصب في فمه وأخذ يمضغه مثل شخص شبع من الأكل وبقيت في فمه لقمة واحدة لا يدري ماذا يفعل بها. وفجأة استيقظ جدي وهب واقفاً ومشى نحو أكياس التمر وتبعه حسين التاجر وموسى صاحب الحقل المجاور لحقلنا والرجلان الغريبان. وسرت أنا وراء جدي ونظرت إلى مسعود فرأيته يدلف نحونا ببطء شديد كرجل يريد أن يرجع ولكن قدميه تزيد أن تسير إلى أمام. وتحلقوا كلهم حول أكياس التمر وأخذوا يفحصونه وبعضهم أخذ منه حبة أو حبتين فأكلها. وأعطاني جدي قبضة من التمر فأخذت أمضغه. ورأيت مسعوداً يملأ راحته من التمر ويقربه من أنفه ويشمه طويلاً ثم يعيده إلى مكانه. ورأيتهم يتقاسمونه. حسين التاجر أخذ عشرة أكياس، والرجلان الغريبان كل منهما أخذ خمسة أكياس. وموسى صاحب الحقل المجاور لحقلنا من ناحية الشرق أخذ خمسة أكياس، وجدي أخذ خمسة أكياس. ولم أفهم شيئاً. ونظرت إلى مسعود فرأيته زائغ العينين تجري عيناه شمالاً ويميناً كأنهما فأران صغيران تاها عن حجرهما. وقال جدي لمسعود: ما زلت مديناً لي بخمسين جنيها نتحدث عنها فيما بعد، ونادى حسين صبيانه فجاؤوا بالحمير، والرجلان الغريبان جاءا بخمسة جمال. ووضعت أكياس التمر على الحمير والجمال. ونهق أحد الحمير وأخذ الجمل يرغي ويصيح. وشعرت بنفسي أقترب من مسعود. وشعرت بيدي تمتد إليه كأني أردت أن ألمس طرف ثوبه. وسمعته يحدث صوتاً في حلقه مثل شخير الحمل حين يذبح. ولست أدري السبب، ولكنني أحسست بألم حاد في صدري. وعدوت مبتعداً. وشعرت أنني أكره جدي في تلك اللحظة. وأسرعت العدو كأنني أحمل في داخل صدري سراً أود أن أتخلص منه. ووصلت إلى حافة النهر قريباً من منحناه وراء غابة الطلح. ولست أعرف السبب، ولكنني أدخلت إصبعي في حلقي وتقيأت التمر الذي أكلت.
[শব্দের মিছিল, ৩১ জানুয়ারি, ২০২০-এর অনুবাদ বিভাগে প্রকাশিত]

Thursday 23 January 2020

সহাবস্থান ও ইসলামঃ কিছু কথা



 সহাবস্থান ও ইসলামঃ কিছু কথা 
আব্দুল মাতিন ওয়াসি
  
বহু কাল আগের কথা। পৃথিবীতে তখন কোনো ধর্মীয় বিভাজন ছিল না। সকলে বিশ্বাস করতো, সবার স্রষ্টা এক। তিনিই এই নিখিল বিশ্বের প্রতিপালক। পরবর্তীতে মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়ল নানা ধর্মে-বর্ণে-জাতিতে। আর মনুষ্য সমাজের এই বিভক্তি প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। অবশেষে এই বিভক্তিই ধরিত্রীর বুক খণ্ডক্ষুদ্র করে তৈরি করেছে একটি মানচিত্র; যেখানে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব ক্রমশ ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। চিন্তা-চেতনা-ধর্ম-বর্ণের এই বিভক্তি পৃথিবী থেকে দূর করা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে আমার ধারণা। তাই জীবনে সুষ্ঠুভাবে বাঁচতে সহাবস্থানের কোনো বিকল্প নেই।

সহাবস্থানের গুরুত্ব— ইসলাম একটি সার্বজনীন জীবন ব্যবস্থাসকল মানবজাতির জন্যই এর অবতারণাতাই সমগ্র মনুষ্য সমাজকে ইসলামে উম্মাতুন্ওয়াহিদাহ্(একটি সম্প্রদায়) হিসেবে গণ্য করা হয়েছেএবং পবিত্র আল্‌-কুরআনে মহান আল্লাহকে রাব্বুল আলামিন (বিশ্বজাহানের পালনকর্তা) হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছেঅর্থাৎ তিনি মুসলিম-অমুসলিম সবার স্রষ্টা, সবার রব প্রতিপালকএকইভাবে নবী মুহাম্মদ (সা)-কে রাহ্মাতুল্লিল্‘আলামিন(সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য করুণার মূর্তপ্রতীক) বলা হয়েছেএছাড়া মহাগ্রন্থ আল্‌-কুর্আনকে হুদাল্‌-লিন্‌-নাস(সকল মানবজাতির জন্য গাইডবুক পথপ্রদর্শক) আখ্যায়িত করা হয়েছেসুতরাং, মুসলিম-অমুসলিম সকলে একই মানব সমাজের অংশএকই সমাজে, একই প্রাকৃতিক গণ্ডি আবহে সবার বাসতাই সহাবস্থান বহুত্ববাদী জীবনব্যবস্থা ইসলামে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।  

সহাবস্থানের কাঠামো— সহাবস্থান, পারস্পরিক সহিষ্ণুতা, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সহানুভূতি সদ্ব্যবহার, মানবতাপূর্ণ উদারতা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলির অন্তর্গত। তাই নবী-জীবনে আদর্শের প্রজ্বল নমুনা উপস্থাপিত হয়েছে তিনি (সা) নিজ জীবনে অমুসলিমদের সাথে মেলামেশা-লেনদেন আচার-আচরণের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তাছাড়া ঐতিহাসিকমদিনার সনদইসলামের পরম উদারনীতি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ

আর তাই একজন মুসলিমের সহিষ্ণু হওয়া খুবই জরুরী। কেননা ইসলাম অমুসলিমদের সাথে সদাচরণ উত্তম ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছে। কুরআনের ঘোষণা— “যারা ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি এবং তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে বিতাড়ন করেনি, তাদের সাথে সদাচরণ নিষ্ঠাপূর্ণ ব্যবহার করতে আল্লাহ নিষেধ করেন নানিশ্চয় আল্লাহ নিষ্ঠাবানদের পছন্দ করেন।” [সূরা আল্‌-মুম্‌তাহ়িনা ৮] অন্য স্থানে বলা হয়েছে, “আহ্‌লে কিতাব (অন্যান্য ঐশী গ্রন্থের অনুসারী)-দের সাথে তোমরা উত্তমভাবে বাদানুবাদ করো।” [সূরা আল্‌-আনকাবুত ৪৬] অন্য ধর্মের মানুষদের কষ্ট দেওয়া তো দূরের কথা, তাঁদেরকে গালমন্দ করতেও ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে, বিশেষ করে তাদের উপাস্যদের ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপ করাকে, “তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উপাসনা করে, তোমরা তাদের উপাস্যদের সম্পর্কে অশ্রাব্য কথা বলো না।” [সূরা আল্‌-আন্‌‘আম ১০৮]

তাছাড়া, মুসলিম সমাজে বসবাসরত অমুসলিমরা যাতে নিজেদের সম্মানবোধ বজায় রেখে চলতে পারে, তাদের আর্থসামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়, তাদের প্রাণ, স্থাবর-অস্থাবর অর্থসম্পদ ও সম্ভ্রম সব কিছুই নিরাপদ থাকে ইসলাম তার ব্যবস্থা নিশ্চয়তা দিয়েছে। বলা হয়েছে— মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিমরা হচ্ছে যিম্মাহ্‌ অর্থাৎ আমানতস্বরূপ।” তাই রাসূল (সা) বলেছেন, “সাবধান! যদি কোনো মুসলিম কোনো অমুসলিম নাগরিকের উপর অত্যাচার করে, তার অধিকার খর্ব করে, তাকে কষ্ট দেয় এবং বলপ্রয়োগ করে তার কোনো কিছু দখল করে নেয়, তাহলে কেয়ামতের দিন আমি ওই মুসলিমের বিরুদ্ধে আল্লাহর নিকট অভিযোগ করব।” [সহিহ আবু দাউদ, আল্‌বানি ২৬২৬]
  
ধর্মীয় সহিষ্ণুতার দৃষ্টিকোণ— নবী (সা) যখন মক্কায় জনমানসকে ইসলামের পথে আহ্বান করলেন। তখন তাওহীদ (একত্ববাদ) ও শির্‌ক (পৌত্তলিকতা)-এর সংঘাত দেখা দিল। এবং নিপীড়িত ও নির্যাতিত লোকেরা ইসলামের সমানাধিকার নীতিকে গ্রহণ করতে লাগল। ফলে কোরায়েশের এক প্রতিনিধি দল রাসুল (সা)-কে প্রস্তাব দিল, “আমরা ছ’ মাস আপনার প্রভুর ইবাদত করবো, আর বাকি ছ’ মাস আপনারা আমাদের উপাস্যের উপাসনা করবেন”। ইসলামে যেহেতু বিশ্বাসের উপর কর্মকাণ্ড নির্ভরশীল, তাই তাদের প্রস্তাব নাকচ করে সমাধান দেওয়া হল, “তোমরা তোমাদের ধর্ম পালন করো, আমি আমার দ্বীন পালন করবো।” [সূরা আল্‌কাফিরূন ৬] পরবর্তীতে বিষয়টিকে আরও একধাপ এগিয়ে স্পষ্ট করা হল, “নিশ্চয় আলো-অন্ধকার ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরূপিত হয়েছে; ফলে ধর্মপালনে কোনো প্রকার বল প্রয়োগ বৈধ নয়।” [সূরা আল্‌-বাকারাহ্‌ ২৫৬]

তারপর হিজ্রত (মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় আগমন)-পরবর্তী সময়ে নবী (সা) মদিনায় একটি নতুন ইসলামি রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন এবং সেই রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন মদিনা সনদ-এর উপর ওই সনদের একটি ধারায় লেখা হয়েছিলমদিনায় সব ধর্মের লোকেরা স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবেকেউ কারোর ধর্মে কোনোরকম হস্তক্ষেপ করবে না...। [সিরাহ্‌, ইব্‌নু হিশাম ১/৫০৩-৫০৪] শুধু তাই নয়, মদিনার ইহুদিরা চরমভাবে ইসলামের বিরোধিতা করত; তা সত্ত্বেও রাসুল (সা) তাদেরকে ধর্ম-পালনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেননি বরং সহিষ্ণুতার নজির সৃষ্টি করেছেন, একবার মদিনার মসজিদে নবী (সা) নাজ্‌রানের এক খ্রিস্টান প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনা করছিলেনআলোচনা শেষে, তারা নিজ ধর্ম-অনুসারে (স়ালাত) প্রার্থনা করার অনুমতি চাইলে নবী (সা) তাদেরকে মসজিদ--নববি (মদিনার মসজিদ)-তে প্রার্থনা করার অনুমতি দিয়েছিলেন। [তাফসির, ইব্‌নু কাসির ২/৪২, যাদুল্‌ মা‘আদ ৩/৫৪৯]  

বিতর্ক ও সমালোচনার পদ্ধতি— সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের জন্য সহাবস্থানের প্রতি উৎসাহিত করার পাশাপাশি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা দিয়েছে ইসলাম। সেই সাথে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে স্বাধীনতা সীমারেখা এবং দায়িত্ব পালনে বিধিনিষেধ। কারণ, এই সমাজবদ্ধ জীবনযাপনে কথায়, কাজে, আচরণে ভুলত্রুটি ও পদস্খলন একটি অনিবার্য বিষয়। এবং তার সংশোধন উত্তরণের জন্য প্রয়োজন যথাযথ সমালোচনা। আর এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সমালোচনাকারীর হিতাকাঙ্ক্ষী হওয়া। কেননাকল্যাণ কামনাই ধর্ম।” [মুসলিম ২০৫] তাই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশদ তথ্য উপস্থাপন করে তার ভালো–মন্দ তুলে ধরে পক্ষে ও বিপক্ষে মতপ্রকাশ করা বা কখনো গভীর বিশ্লেষণ ও বিষয়ের নেতিবাচক দিক এবং তার নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট করা বাঞ্ছনীয়। এবং এই তর্কবিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনা হবে বুদ্ধিদীপ্ত, উপদেশমূলক ও উত্তম পন্থায় [সূরা আন্‌-নাহ়াল ১২৫]। কেননা ইসলামে পরনিন্দা, পরচর্চা, অহেতুক সমালোচনা ও অনর্থক তিরস্কার নিষিদ্ধ [সূরা আল্‌-হুজ্‌রাত ১২]

সহযোগিতাসহমর্মিতার পাঠ— আমরা প্রত্যেকে পরস্পরের পরিপূরকআমাদের সকলের যৌথ প্রয়াসই আমাদের সমাজ ব্যবস্থার কারিগর তাই আমাদের সকলকেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মানসিকতা মানবিক প্রেমবোধ দেওয়া হয়েছেযাতে আমরা সবার সঙ্গে মিলেমিশে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করতে পারি সত্য-সুন্দর জনকল্যাণকর কাজকে গ্রহণ করতে পারি। কাউকে ঘৃণা, অবহেলা অবজ্ঞা করা চলবে না সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সম্মান ভালোবাসা প্রদর্শন করতে হবে, সে যে পথের বা দলমতের হোক না কেনকারণ সব মানুষই পরস্পর ভাই ভাইআমাদেরকে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত ঘুচাতে বলা হয়েছে। স্রষ্টা আদেশ করেছেন, নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে না, তাহলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।” [সূরা আল্‌-আন্‌ফাল ৪৬]

বর্তমানে ভালোবাসা ও সহমর্মিতার মহাসংকটে ভুগছে পৃথিবী। মানবপ্রেম নেই মনুষ্যসমাজে। অথচ মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে মানবজাতির কল্যাণ সাধনের জন্য; “তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের উদ্ভব ঘটেছে।” [সূরা আলে ইমরান ১১০] অতএব তোমরা মানুষের পাশে দাঁড়াবে, আশ্রয়হীনদের আশ্রয় দেবে, অভুক্তদের ক্ষুধা মিটাবে, বিপদগ্রস্তদের উদ্ধার করবে। মনে রাখবে, “বিধবা ও অসহায়দের সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারীর সমতুল্য।” [বুখারি ৬০০৭, মুসলিম ৭৬৫৯] অন্য হাদিসে আদেশ করেছেন, অসুস্থ লোকের সেবা করো, ক্ষুধার্তকে অন্ন দাও এবং বন্দিকে মুক্ত করো।” [বুখারি ৫৬৪৯, মুস্‌নাদ আবু ইয়া’লা ৭৩২৫] কারণ, “আল্লাহ তখনই কোনো মানুষের সাহায্য করেন যখন সে নিজ ভাইয়ের সাহায্য করে’ [মুসলিম ৭০২৮, আবূ দাঊদ ৪৯৪৮, তিরমিযি ১৪২৫]

যেহেতু ইসলাম সবার জন্য শান্তি, সাম্য, উদারতা মানবিকতার কথা বলেতাই মুসলিম-অমুসলিম, সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামের নির্দেশ অত্যন্ত কঠোরসেজন্যই যে-কারোর প্রতি নিপীড়ন অত্যাচারকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, “হে আল্লাহ্ বান্দারা (হে মানবজাতি)! আমি তোমাদের সকলের জন্য যে-কোনোরকমের নিপীড়নকে নিষিদ্ধ করেছি।” [মুসলিম ৫৫]। সহাবস্থানের বিষয়টিকে স্পষ্ট করে অন্য এক হাদিসে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি “অমুসলিম নাগরিক”-কে হত্যা করে, সে জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না; যদিও জান্নাতের সুগন্ধি চল্লিশ বছরের দূরত্বে অবস্থান করেও অনুভব করা যাবে [বুখারি ৩১৬৬] অতএব প্রকৃত মুসলিম হতে হলে ভালো মানুষ হতে হবে, অন্যদের ভালোবাসতে হবে। নবীজি বলেছেন, “যতক্ষণ না অন্যদের ভালোবাসবে তুমি মুমিন হতে পারবে না।” [মুস্‌লিম ৫৪]

[পূবের কলম, ২৪ জানুয়ারি, ২০২০-এর দ্বীনদুনিয়া ক্রোড়পত্রে "সহাবস্থান ও ইসলামের নীতি" নামে প্রকাশিত]