Sunday 18 July 2021

সামী বা সেমেটিক ভাষাগোষ্ঠী

 

সামী
বা সেমেটিক ভাষাগোষ্ঠী
বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত ভাষাসমূহের সংখ্যা প্রায় ২৭৯৬। এই ভাষাসমূহ মূলত তিনটি ভাষাগোষ্ঠি হতে নির্গত। (ক) আর্য-ইন্দো ইওরোপীয়, ল্যাটিন, ফরাসী, ইংরেজী, ফারসী প্রভৃতি। (খ) তুরানী-মঙ্গোলীয়, জাপানী, তাতারী, তুর্কী, চীনা প্রভৃতি। (গ) সামী- আশুরী, হিব্রু, সাবায়া, আরামী, ফিনিসী, ইথিওপী ও আরবী।
 
আস্‌-সামিয়া শব্দটির উৎপত্তিঃ
নূহ (আঃ)-এর তিন পুত্র সাম (سام), হাম (حام), ও ইয়াফিস (يافث) বিশ্বব্যাপী মহাপ্লাবনের পর জীবিত ছিলেন। সম্ভবত নূহ-তনয় সাম হতে  السامية  বা Semitic শব্দটির উৎপত্তি বলে একাধিক পণ্ডিতদের মত। এ প্রসঙ্গে মিশরীয় পণ্ডিত জুরজি জায়দান বলেছেন--
"والتي كانت تتفاهم بالفينيقية والآشورية والآرامية "شعوبا سامية" نسبة إلى سام بن نوح لأن هذه الأمة جاء في التوراة أنها من نسله وسموا لغاتهم اللغات السامية."

বিশ্ববিখ্যাত পণ্ডিত
অধ্যাপক নিকলসন এ সম্পর্কে বলেছেন-- 
The Arabs belong to the great family of nations which on account of their supposed descent from Shem, the son of Noah, are commonly known as the “Semitic”.

বাবেলী, আশুরী, আরামী, সিরীয়, তালমুদী, ফিনীশী, ইথিওপী, আরবী ইত্যাদি ভাষা জন্য সর্বপ্রথম السامية  বা “Semitic” শব্দটির ব্যবহার করেছিলেন সুবইয়ানী ভাষাবিশারদ ইয়াকুব আর্‌-রাহাভী (يعقوب الرهوي)
 
সেমেটিক জাতি ও ভাষা প্রসঙ্গে  Encyclopedia of Britannica- তে বলা হয়েছেঃ
“The name “Semetic languages” is used to designate a group of Asiatic and African language some living and some dead, namely, Hebrew and Phoenician, Aramaic, Assyrian, Arabic, Ethiopic the which was introduced by Eichorn is drived from the fact the most nation which speak or spoke from Shem, son of Nooh”.
 
সামী জাতির আদি নিবাসঃ
সামী জাতির আদি নিবাস কোথায় ছিল এটা একটা জটিল প্রশ্ন। অনেক ভাষাবিদের মতে, বাবেল বা মেসোপোটেমিয়া ছিল সামী জাতির আদি নিবাস, আবার অনেকের মতে আফ্রিকা বা আর্মেনিয়া। তবে অধিকাংশ পণ্ডিতদের মতে আরবদেশ ছিল সামীদের আদি বাসস্থান। এবং এটিই সঠিকতম অভিমত বলে ধারণা পোষণ করেছেন একাধিক আরব ভাষাবিদ
 
ইতিহাসেও উল্লেখ্য আছে যে, সামী গোত্রের লোকজন এশিয়ার দক্ষিন-পশ্চিম অঞ্চলে বাস করতেন। তাদের বসবাসের এলাকা ছিল; উত্তরে তরুস পরবত ও আর্মেনিয়া পর্বতমালা, দক্ষিণে ভারত সাগর এবং পশ্চিমে লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগর।
 
ডক্টর শাওকী জ়ায়েফ (شوقي ضيف) সামীদের আদি বাসস্থান ছিল আরবদেশ, এ বিষয়ের প্রতি সকল গবেষকদের ঐক্যমতকে প্রকাশ করতে গিয়ে বলেছেন যে

 "الباحثون يتفقون على أن موطنهم في العصور التاريخية هو الجزيرة العربية."
   
সামীভাষার বৈশিষ্টসমূহঃ   
সামী বা সেমেটিক একটি অন্যতম ভাষাগোষ্ঠী। ভাষাগোষ্ঠির অধীনে একাধিক ভাষা রয়েছে। এবং প্রত্যেকটি ভাষার নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট রয়েছে। তবে এই ভাষাগোষ্ঠীর প্রধান প্রধান বৈশিষ্টগুলি নিম্নে উল্লেখ প্রদত্ত হল—
 
(ক) স্বরবরনের ওপর ব্যঞ্জনবরণের প্রাধান্য। এ ভাষায় কোন বস্তুর প্রাথমিক রূপরেখা ব্যঞ্জনবরণের সাহায্যে প্রকাশিত হয়; স্বরবর্ণ ব্যবহৃত হয় কেবল সেই শব্দকে বিভিন্ন ধাতু রূপে প্রদানের ক্ষেত্রে এবং অর্থ পরিবর্তন সাধনের ক্ষেত্রে। স্বরবর্ণ মাত্র তিনটিঃ আলীফ, ওয়াও, ইয়া (ا - و - ي) যা স্বরধ্বনি আ, ই, উ (ـَـ ، ـُـ ، ــِـ)-এর দ্যোতক ও প্রকাশক
 
(খ) স্বরচিহ্নের পরিবর্তন দ্বারা শব্দের অর্থের পরিবর্তন সাধন করা, যেমন; ইল্‌মুন্‌ (عِلْمٌ)-জ্ঞান, আলেমুন (عالِمٌ)-জ্ঞানী, আলামু (أعْلمُ)-আমি জানি, নালামু (نَعْلمُ)-আমরা জানি।
 
(গ) এ ভাষার বর্নমালায় এমন কিছু বর্ণ আছে, যেগুলি সামীভাষাবিদ ব্যতীত অন্যদের পক্ষে উচ্চারন করা কঠিন।
 
(ঙ) দ্বিবচন এই ভাষার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট। একবচন, দ্বিবচন ও বহুবচন খুব কম ভাষাতেই ব্যবহৃত হয়। লিঙ্গের ক্ষেত্রে এ ভাষা স্বতন্ত্র। ভাষায় পুং লিঙ্গ ও স্ত্রী লিঙ্গ ব্যতীত ক্লীব লিঙ্গের ব্যবহার নেই।
 
(চ) ক্রিয়ার মধ্যে বচন ও লিঙ্গের আবির্ভাব এই ভাষাগোষ্ঠির একটি বিশেষ ঐতিহ্য।
 
(ছ) এই ভাষায় বিভিন্ন অর্থ ও ভাব প্রকাশের জন্য একটা মূল ধাতুর সঙ্গে এক বা একাধিক হরফ যোগ করা হয় যেমন
 فعل-- أفعل, فعّل, فاعل, انفعل, افتعل, استفعل, تفعّل ইত্যাদি।
 
(জ) সামী ভাষার প্রত্যেকটি শব্দ পুং লিঙ্গ (مذكر ) বা স্ত্রী লিঙ্গ (مؤنث) হয়, যেমন قمر-مذكر, شمس-مؤنث  
 
(ঝ) বিশেষ্যর তিনটি রূপ মার্‌ফু'’(مرفوع), মান্‌সূব (منصوب) এবং মাজ্‌রূর (مجرور) যেমন
قام زيد (مرفوع), رأيت زيدا (منصوب), مررت بزيد (مجرور)
 
(ঞ) এ ভাষাগোষ্ঠির সকল ভাষা আশুরী ও হাবাশী ব্যতীত ডানা দিক থেকে লিখতে হয়।
 
(ট) এই ভাষায় ক্রিয়াপদের পরে সেই ক্রিয়ার ধাতুজাত শব্দ ব্যবহার করে ক্রিয়ার কখনো আধিক্য, কখনো ক্রিয়ার ধরণ, আবার কখনো ক্রিয়ার প্রকৃতি আরোপ বা প্রকাশ করা হয়। যেমন
ضربت ضربا
 
(ঠ) এ ভাষার অধিকাংশ সর্বনামের রূপে লিঙ্গ ভেদ লক্ষ্য করা যায়। যেমন
هو-هي/ هم-هن/ أنتَ-أنتِ/ أنتم-أنتن   
 
(ড) সংখ্যাবাচক শব্দের ব্যবহারে এ ভাষায় বিশেষ নিয়ম দেখা যায়। কখন, কোন লিঙ্গে কী ব্যবহার হবে তা ব্যাকরণের কঠোর নিয়মে আবদ্ধ। যেমন
ثلاثة إخوان, ثلاث أخوات 
 
সামিভাষা গোষ্ঠি হতে একাধিক গুরুত্ত্বপূর্ণ ভাষা নির্গত হয়েছে। তার মধ্যে বেশ কিছু ভাষার বিলুপ্তি ঘটলেও, বহু ভাষা অদ্যকাল পর্যন্ত ব্যাপক ভাবে প্রচলিত ও ব্যবহৃত। এই ভাষাগোষ্ঠির সর্বাধিক উল্যেখযোগ্য ভাষা হল আরবি। আরবি একমাত্র ভাষা, যা সামীভাষার সমস্ত বৈশিষ্ট বহন করে। এ ভাষাগোষ্ঠির প্রচলিত সকল ভাষা বিশেষত আরবি সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে ব্যাপক সমৃদ্ধ।

সামী ভাষাসমূহের বিভক্তিকরণঃ
নূহ (আঃ) তনয় সামের বংশধর অর্থাৎ সামী জাতি এবং তাদের গোষ্ঠির বহির্ভূত ওই সকল স্থানে বসবাসকারী সকল মানুষ যে ভাষায় কথা বলতো তা সামী বা সেমেটিক ভাষা (اللغات السامية) নামে পরিচিত। ঐতিহাসিকরা সামীগোষ্ঠির ভাষাসমূহকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করেছেন যথা
ক) اللغات السامية الشمالية الغربية (পশ্চিম-উত্তরীয় সামীভাষা)
(খ) اللغات السامية الشرقية (পূর্বাঞ্চলীয় সামীভাষা)
(গ) اللغات السامية الجنوبية الغربية أو الجنوبية (পশ্চিম-দক্ষিনীয় বা দক্ষিনীয় সামীভাষা); এই শাখার অন্তর্ভুক্ত কয়েকটি ভাষা হল— (১) দক্ষিনীয় আরবি (২) উত্তরীয় আরবি (৩) ইথিওপিও।

-আব্দুল মাতিন ওয়াসিম


Friday 16 July 2021

আব্দুল মাতিন ওয়াসিমঃ শব ও সিয়াসত


শব ও সিয়াসত্‌   

আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
 

পঞ্চাশোর্ধ এক জোড়া চোখ

পাশে একটা শূন্য কোল ও নির্বিকার মুখ

সামনে একটি শববাহী গাড়ি একটু দূরে

তাতে বছর ছাব্বিশের এক যুবকের লাশ

করোনা-রোগীদের চিকিৎসা করতে গিয়ে

বিনা-সরঞ্জামে মৃত্যু হয়েছে তার

আজ তার দেহটা আপাদমস্তক প্লাস্টিকে মোড়া;

তার চারপাশে, কাছে-দূরে কোথাও কেউ নেই

না গান-স্যালুট, না কোনো পতাকা;

সে তো কোনো রাষ্ট্রের জন্য প্রাণ দেয়নি

দিয়েছে মানুষের জন্য, হয়তো তাই!

 

৩০-০৩-২০২০

বাঁশকুড়ি- ৭৩৩১২১

Wednesday 14 July 2021

নাজিক আল-মালায়িকাহঃ নববর্ষের প্রতি



নববর্ষের প্রতি  
নাজ়িক আল্‌-মালায়িকাহ্‌, ইরাক  
 
হে নববর্ষ, তুমি এসো না আমাদের ঘরে  
ভূতের জগৎ থেকে উঠে আসা প্রতিধ্বনি আমরা
আমাদের পরিত্যাগ করেছে মানুষ
কেটে গেছে আমাদের রাত, টুটে গেছে অতীত
আমাদের ভুলে গেছে তকদির
এখন আমাদের জীবন কাটছে ভূতেদের মতো
আমরা আশা-আকাঙ্ক্ষায় চিরবঞ্চিত
আমাদের না আছে কোনো স্মৃতি, না আছে কোনো স্বপ্ন
আমাদের চোখের দিগন্ত ছাইয়ে ভরা
আমাদের শান্ত মুখগুলো যেন এক একটা স্থির হ্রদ
আর আমাদের কপাল নীরব ও নিশ্চুপ
তাতে না আছে রং, না আছে জৌলুস
আমাদের ঠোঁটগুলোও বিবর্ণ 
আমরা ভুলে গেছি অনুশোচনা
আমরা ফিরে গেছি সময় থেকে শূন্যে 
তবুও কখনও পুড়িনি অনুতাপে
বরং অতিবাহিত করে চলেছি নিজেদের জীবন
এক মোলায়েম হাবেলিতে
অনুভূতিহীন ও স্মৃতিবিহীন সেই জীবন
আমরা বেঁচে আছি, কিন্তু জানি না—
জীবন কী, অভিযোগ কী, ক্রন্দন কী
আমরা জানি না মৃত্যু কী, জন্ম কী
আর না আমরা জানি আকাশের অর্থ।
 
নববর্ষ, এগিয়ে যাও তুমি
ওই পথ ধরে, নিজ পদচিহ্নকে মুড়ে  
আমাদের জাগাবার চেষ্টা করো না খামোখা
আমাদের শিরা এখন পাটকাঠির মতো
আবেগ ও অনুভূতিহীন
দুঃখ কী, আমরা জানি না 
আমাদের রন্ধ্রে আর ক্রোধ বয় না
বিদ্রোহ করতে পারে আমাদের আত্মা
কে বলেছে তোমায় এ কথা?
এর চেয়ে ঢের ভালো হতো যদি আমরা মারা যেতাম
আর কবর প্রত্যাখ্যান করতো আমাদের শবগুলোকে
যদি আমরা ফিরে পেতাম সময়কে অন্যদের মতো করে  
যদি মাপতে পারতাম বছরের বাটখারা দিয়ে যুগকে
যদি বুঝতে পারতাম নিজের একটা ঘর থাকার মানে
যদি গগনচুম্বী প্রাসাদের দরজাগুলো
উদ্বেলিত করতো আমাদের মনকে
বয়ে আনতো আমাদের জন্য জীবনের রসদ 
যদি ছুটতে পারতাম জীবনের সাথে পাল্লা দিয়ে
দেখে-শুনে-জেগে-ঘুমিয়ে  
যদি তীব্র তুষারপাত গ্রাস করতো আমাদেরকে  
যদি ঘোর অন্ধকারে ঢেকে যেতো আমাদের গা
যদি অনুভব করতে পারতাম আমরা  
যেভাবে আর পাঁচজন অনুভব করে
যদি বিচলিত হতো আমাদের অন্তর  
উন্মাদনায়, দুঃখে বা অসুস্থতায়
যদি রুদ্ধ হয়ে যেতো আমাদের নির্বুদ্ধিতার পথ
স্মৃতিচারণা, আকাঙ্ক্ষা অথবা অনুশোচনায়
যদি নীরবতা বিঘ্ন ঘটাতো আমাদের একাকীত্বে
এবং আমরা ভয় পেতাম উন্মাদনায়
যদি আমাদের বিশ্রাম বিঘ্নিত হতো যাত্রায়
আঘাতে অথবা অসম্ভব প্রেম-যাতনায়;  
ভালো হতো যদি আমরা আর পাঁচজনের মতো করে
আলিঙ্গন করতে পারতাম মৃত্যুকে!



إلى العام الجديد

نازك الملائكة – العراق


يا عام لا تقرب مساكننا فنحن هنا طيوف

من عالم الأشباح، يُنكرُنا البشر

ويفر منّا الليل والماضي ويجهلنا القدر

ونعيش أشباحًا تطوفْ

نحن الذين نسير لا ذكرى لنا

لا حلم, لا أشواقُ تُشرق، لا مُنى

آفاق أعيننا رمادْ

تلك البحيرات الرواكدُ في الوجوه الصامتهْ

ولنا الجباه الساكتهْ

لا نبضَ فيها لا اتّقادْ

نحن العراة من الشعور، ذوو الشفاه الباهتهْ

الهاربون من الزمان إلى العدمْ

الجاهلون أسى الندمْ

نحن الذين نعيش في ترف القصورْ

ونَظَلُّ ينقصنا الشعور.

لا ذكرياتْ،

نحيا ولا تدري الحياةْ،

نحيا ولا نشكو، ونجهلُ ما البكاءْ

ما الموت, ما الميلاد, ما معنى السماء

**

يا عامُ سرْ، هو ذا الطريقْ

يلوي خطاكَ، سدًى نؤمل أن تُفيقْ

نحن الذين لهم عروق من قصبْ

بيضاءُ أو خضراء نحن بلا شعورْ.

الحزن نجهله ونجهل ما الغضب

ما قولُهم إنّ الضمائر قد تثور

ونود لو متنا فترفضنا القبور

ونود لو عرف الزمانْ

يومًا إلينا دربه كالآخرين

لو أننا كنا نؤرخ بالسنين,

لو أننا كنا نقيَّد بالمكانْ

لو أن أبواب القصور الشاهقات

كانت تجيءُ قلوبَنا بسوى الهواء،

لو أننا كنا نسير مع الحياةْ

نمشي، نحس، نرى، ننام

وينالنا ثلج الشتاءْ

ويلفُّ جبْهَتَنا الظلام

أواه لو كنا نحسّ كما يحس الآخرونْ

وتنالنا الأسقام أحيانًا وينهشنا الألم

لو أنَّ ذكرَى أو رجاء أو ندم

يومًا تسدُّ على بلادتنا السبيلْ

لو أننا نخشى الجنونْ

ويثيرُ وحشَتنا السكون

لو أن راحتنا يعكّرها رحيل

أو صدمة أو حزن حب مستحيل.

أواه لو كنا نموت كما يموت الآخرونْ

 

ديوان "قرارة الموجة"، 1957