Tuesday 14 August 2018

তুর্কি যুগে আরবী সাহিত্যচর্চা


তুর্কি যুগে আরবী সাহিত্যচর্চা
কাজী মহঃ মাকীন

তুর্কি যুগের আরবী সাহিত্য সম্পর্কে জানার আগে আরবী সাহিত্যের যুগ বিভাজনের মধ্যে তুর্কি যুগের অবস্থানটা জেনে নেওয়া দরকার। মূল প্রসঙ্গে আসার আগে, মতানৈক্যের সম্ভাবনা সহ নীচে এক পলকে যুগ বিভাজনটা তুলে ধরা হল
 ইসলামপূর্ব যুগঃ আনুমানিক ৫০০- ৬২২ খ্রীঃ
 ইসলামী যুগঃ ৬২২- ৬৬১ খ্রীঃ
 উমাইয়া যুগঃ ৬৬১- ৭৫০ খ্রীঃ
 আব্বাসী যুগঃ ৭৫০- ১২৫৮ খ্রীঃ
 স্পেনীয় যুগঃ ৭৫০- ১৪৯২ খ্রীঃ
 মামলুক যুগঃ ১২৫৮- ১৫১৭ খ্রীঃ
 তুর্কি যুগঃ ১৫১৭- ১৭৯৮ খ্রীঃ
 আধুনিক যুগঃ ১৭৯৮- চলমান

উল্লেখ্য যে, প্রথম চারটি যুগে সাহিত্য চর্চা আরব উপদ্বীপ কেন্দ্রিক ছিল। পঞ্চমটি ছিল ইউরোপের স্পেনে গড়ে ওঠা আব্বাসী যুগের সমান্তরালে বয়ে চলা। শেষ তিনটি ক্ষেত্রে এর অভিমুখ আফ্রিকার মিশর কেন্দ্রিক হয়ে যায়। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে মামলুক ও তুর্কি যুগকে একত্রে অনেক ইতিহাসবিদ সাহিত্যের পতনের যুগ বলে অভিহিত করেছেন।       
যে আরবী সাহিত্য ও আরবীয় জ্ঞানচর্চা আব্বাসী খিলাফতে সমৃদ্ধির চরম শিখরে গিয়েছিল তার সঙ্গে কী এমন ঘটেছিল যে মামলুক ও তুর্কি যুগে তার খ্যাতির তথা চর্চার শিখা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল? খুব সংক্ষেপে আমরা ইবনে কাসীরের আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ গ্রন্থের ভূমিকার নির্যাস লক্ষ্য করলে তার কারণ আংশিক অবহিত হব।
৬০০ বছর ধরে গড়ে ওঠা সাম্রাজ্যের সর্বস্তরে সমৃদ্ধ শহর বাগদাদ ১২৫৮ খ্রীষ্টাব্দে এসে মাত্র ছদিনে মোঙ্গল নেতা হালাকু খানের হাতে কেবল পরাজিত নয়, ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। তাদের নির্বিচার লুটপাট, গণহত্যা বাগদাদকে বধ্যভূমিতে রূপান্তরিত করে। বায়তুল হিকমাহ এর মত জ্ঞানচর্চার বিশ্বখ্যাত কেন্দ্র ধ্বংস করে দেয়। পুড়িয়ে দেওয়া হয় অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য, দুর্মূল্য সাহিত্য সম্ভার। ২০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করে বিধ্বংসী হালাকু খান। মোঙ্গল-তাতার জাতি বিভীষিকায় পরিণত হয়েছিল সেই সময়।
এইরকম পরিস্থিতিতেই বহু সাহিত্যিক, জ্ঞানপিপাসু প্রানভয়ে বাগদাদ ত্যাগ করে। যাদের একটা বৃহৎ অংশ ক্রমশ মিশর অভিমুখে পা বাড়ায়। আরবী সাহিত্য চর্চা মিশর অভিমুখী হওয়ার সেটাই ছিল সূচনা। চোখের সামনে নিদারুণ ধ্বংসযজ্ঞ, প্রাণ বাঁচানোর তাগিদ, ভয়, অনিশ্চয়তা সব মিলিয়ে সাহিত্যচর্চার বাতাবরণ সুদূরপরাহত ছিল। একটা দীর্ঘ সময় সাহিত্য চর্চা ছিল ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটিসম। মিশরের মামলুক সাম্রাজ্যকে আরব দুনিয়ার শেষ রাজবংশ বলা যায়। সূচনা হয় মূলত ১২৪৯ খ্রীষ্টাব্দে। ১২৬০ সালে তাদের হাতেই আইন জালুতেরযুদ্ধে প্রতিহত ও পরাজিত হয় মিশর দখলে লোলুপ ১২৫৮ সালে বাগদাদ ধ্বংসকারী হালাকু খান। ক্রমশ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।
এইরূপ পরিস্থিতিতে সাহিত্যচর্চা কিছু সময়ের জন্য স্তিমিত থাকলেও এই যুগেই এমন কিছু ধর্মতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ জন্ম নেন- যাদের নাম ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে। ইবনে খাল্লিকান, ইবনে খালদুন, ইবনে হিশাম, জালালুদ্দীন সুয়ূতী, ইবনু হাজার আসকালানী, আত-তাফতাযানী, আব্দুল কাহির জুরজানী, আয-যাহাবী, ইবনু তিকতাকা, ফিরোযাবাদী, আবুল ফিদা, ইবনে মানযুর, ইবন বতুতা, বূসীরী, সফীউদ্দীন হিল্লী প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য। সাহিত্যের পাশাপাশি ধর্মতত্ত্ব চর্চাও কিছুটা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল মামলুক যুগে।
এবার চলে আসি তুর্কি যুগে।
অনারব তুর্কি সুলতান প্রথম সেলীম ১৫১৭ খ্রীষ্টাব্দে  মিশরীয় মামলুকদের পরাজিত করে তুর্কি শাসনের সূচনা করে। অভাবিত ভাবে মিশরবাসী এক চরম নির্যাতনের সাক্ষী হয়। শাওক্বী দ্বায়েফের তারীখুল আদাবিল আরাবীথেকে জানতে পারি, মিশর জয়ের পর আটমাস সেখানে অবস্থানপূর্বক তাদের ধনরত্ন; প্রাসাদ, গ্রন্থাগার, মসজিদে রক্ষিত গ্রন্থসমূহ; শিল্পসামগ্রী প্রভৃতি লুট করা হয়। লেখ, সাহিত্যিক, ধর্মতত্ত্ববিদদের চরম হেনস্থা করা হয়। অনেকের মতে, বহু জ্ঞানীগুণী ও পুস্তকরাজির সলিলসমাধি ঘটিয়েছিল তারা। এভাবে অনারব তুর্কিরা আরবী ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উপর আঘাত হানে। যা আগামী তুর্কি শাসনকাল জুড়ে বিরাজ করে। কারণ তার প্রশাসনিক ভাষা রূপে তুর্কি ভাষার আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। তাই স্বাভাবিকভাবেই আরবী সাহিত্য চর্চায় ভাটা পড়ে। আরবী ভাষআকে দাবিয়ে রাখা, আরবী ভাষীর উপর অত্যাচারএই রকম মানসিক অবস্থায় সৃষ্টিশীল রচনার উৎপাদন নিতান্তই কষ্টকল্পনা ছিল।
তবে যে জাতির ধর্মীয় ভাষা, দৈনন্দিন উপাসনার ভাষা আরবী, যে জাতির সাহিত্যচর্চা সহজাত ও স্বতঃস্ফূর্ততারা বাধার বিন্ধ্যাচল অতিক্রম যে করবেই এ আর আশ্চর্য কী! আন-নাবলুসী, যায়নুদ্দীন হামিদি, ইবনে মাতূক, আশ-শায়বানী, আল-মাক্কারী, হাজী খলীফা, ইবনে কাসীর, আল-খাফাজী প্রমুখ একাধারে হাদীস, তফসীর, ফেকাহ, সাহিত্য, ইতিহাস, ভ্রমণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন।
অতএব, সামগ্রিকভাবে দেখলে এই পাঁচ শতাধিক বৎসরকাল একেবারে যে সাহিত্য বা জ্ঞানচর্চাহীনতায় নিমজ্জিত ছিল তা আদৌ নয়। বরং প্রতিভা যে চাপা থাকে না তারই যেন আদর্শ উদাহরণ বয়ে চলে এই যুগ। তাই একে পতনের যুগ না বলে বলা ভাল স্থবিরতার যুগ।

[লেখকের আবেদনঃ উপরোক্ত ব্যক্তিদের সম্পর্কে আমরা একজন করে একটা সংক্ষিপ্ত জীবন পরিচিতি লিখলে সকলে উপকৃত হব।]

গ্রন্থপঞ্জীঃ
১) তারীখুল আদাবিল আরাবী- আ. হা. যাইয়াত
২) তারীখুল আদাবিল আরাবী- শাওকি দ্বায়েফ
৩) আল বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ- ইবনে কাসীর
৪) আরবী সাহিত্যের ইতিবৃত্ত- ড. মু. শহীদুল্লাহ

কে বলে আমার সন্তান মানুষ হয় নি; এরাও তো আমার ছেলে...



কে বলে আমার সন্তান মানুষ হয় নি; এরাও তো আমার ছেলে...


আন্তর্জাতিক সেমিনার শেষে দেশে ফিরছিলাম। প্লেনে উঠে সুন্দরী এয়ার হোস্টেসের দেখিয়ে দেওয়া সিটে আরাম করে বসলাম। প্রায় পনেরো ঘণ্টার একঘেয়ে ননস্টপ জার্নি। আটলান্টিকের উপর দিয়ে বারমুডা ট্র্যাঙ্গেল কে একপাশে রেখে উড়ে যাবো প্রথমে দুবাই। সেখান থেকে আবার কলকাতায় নিজের দেশে। যদিও এই বিদেশী এয়ারওয়েসের ব্যবস্থা খুব ভাল তবুও এত লম্বা জার্নি করতে ভাল লাগে না আর।
একটা গল্পের বই এর পাতায় চোখ রেখেছিলাম। তখনো টেক-অফ করতে একটু দেরি ছিল। হঠাৎ কানে ভেসে এলো বঙ্গভাষা। যথারীতি একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে বুঝে নিলাম কথার উৎস স্থল আমার সামনের রো ছেড়ে তার পরের রো। এখান থেকে যেটুকু চোখে পরল এক জোড়া বৃদ্ধ বৃদ্ধা ; একজনের চকচকে টাকের চারপাশে সাদা পাকা চুলের সমারোহ, অন্য আরেক জনের সাদা চুলের খোপার মাঝে কয়েকটা কালো চুল কিছুটা যেন বলছে স্মৃতি টুকু থাক। খুব নিচু স্বরে উত্তপ্ত কিছু আলোচনা হচ্ছিল বুঝতে পারছিলাম। এভাবে উঁকিঝুঁকি মারাটা অশোভন, তাই নিজেকে সংযত করে গল্পের বইয়ের পাতায় মন দিতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু টুকরো টুকরো কয়েকটা শব্দ ভেসে এসে আমার কানে ঢুকছিল, তার মধ্যে আমার জন্মস্থানের নামটা দুবার কানে আসায় কৌতূহল বেড়েই চলল। টয়লেট ঘুরে ফেরার সময় ভাল করে লক্ষ্য করলাম।
বহু বছর পর আমার স্কুলের হেড স‍্যার শ্রী শুভময় চ‍্যাটার্জীকে দেখে চিনতে কয়েক সেকেন্ড সময় লেগেছিল। ততক্ষণে প্লেন মাঝ আকাশে। ওনাদের পাশের সিটটা খালি দেখে এয়ার হোস্টেস কে বলে ওখানেই বসলাম। আমি বসায় ওনারা চুপ করে গেছিলেন। আমি হাত জোর করে নমস্কার করে বললাম -"স‍্যার, আমি নীলাদ্রী ঘোষাল। ৯২ র মাধ্যমিকের ব্যাচ স‍্যার, মনে পরছে?"
হাই পাওয়ার লেন্সের ভেতর থেকে দুটো ঘোলাটে চোখ আমার দিকে ফিরে তাকাল। আস্তে আস্তে চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল হয়ে উঠে সারা মুখে সেই সুন্দর হাসি ছড়িয়ে পরল। বললেন -" নীল..... ঘোষাল বাবুর ছেলে !! শুনেছিলাম বড় বিজ্ঞানী হয়েছিস, খুব নাম হয়েছে তোর..."
শেষ কথাটায় কেমন একটা শ্লেষের সুর বেজে উঠলো। মাসিমাকে নমস্কার করে বললাম-" সুজয়দার কাছে এসেছিলেন ?"
সুজয়দা হেড স‍্যারের একমাত্র ছেলে, আমার থেকে দু বছরের সিনিয়র ছিল। বড় ইঞ্জিনিয়ার, পিটসবার্গে থাকে জানতাম।
মাসিমা মাথা নেড়ে মুখ ঘুরিয়ে জানালার দিকে চেয়ে মেঘ দেখতে লাগলেন। স‍্যার ও গম্ভীর হয়ে গেছিলেন। বললাম, -" কতদিন ছিলেন এখানে ? কোথায় কোথায় ঘুরলেন স‍্যার ?"
-"ছিলাম প্রায় দুমাস। ছেলে আর বৌ খুব ব্যস্ত, তাও ঘুরিয়েছে টুকটাক।" স‍্যার বললেন।
একবার মনে হল নিজের সিটে ফিরে যাই, ওনারা বোধহয় কথা বলতে চাইছেন না। কিন্তু যেতে গিয়েও পারলাম না। হেডস্যারের কাছে দীর্ঘদিন পড়েছিলাম, খুব কাছ থেকে ওনাকে দেখেছিলাম। উনি ছিলেন মানুষ গড়ার কারিগর। এতো সুন্দর করে সব কিছু বোঝাতেন, পড়ানো ছাড়াও অনেক কিছুই ওনার থেকে শিখেছিলাম। পয়সা নিয়ে প্রাইভেটে উনি কোনোদিন পড়ান নি। তবে আমাদের পাশের চা বাগানের বস্তি গুলোতে গিয়ে সন্ধ্যাবেলায় বিনা-পয়সায় অনেককে পড়াতেন। এছাড়া বই পত্র দিয়ে গরীব ছাত্রদের যথেষ্ট সাহায্য করতেন। কত গরীব ছাত্রর পরীক্ষার ফি দিয়ে দিতেন প্রতিবছর।
মাধ্যমিকের আগে বাবার ভীষণ শরীর খারাপ হয়েছিল। বহুদিন বাবা বিছানায় ছিল। জমানো টাকা কড়ি সব শেষের দিকে। আমাদের একটুকরো জমি মা বিক্রি করবে ভেবেছিল সে সময়। কিন্তু স‍্যার কোথা থেকে খবর পেয়ে একদিন এসে মাকে বলেছিলেন জমি বিক্রি করতে না।আমার দায়িত্ব উনি নিয়েছিলেন। কয়েক মাস ওনার বাড়ি খাওয়া দাওয়া করে পড়াশোনা করেছিলাম। মাসিমা নিজেদের গরুর দুধ, গাছের ফল , পুকুরের মাছ, লাউ , কুমড়ো শীতের সবজি সব আমার হাত দিয়ে মা কে পাঠাতেন। আমাদের গাছের নারকেল সুপুরি স‍্যার নিজে দাঁড়িয়ে বিক্রির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেই টাকায় বাবার চিকিৎসা হয়েছিল।
কোনোদিনও কোনো ছাত্রকে বকতে বা শাস্তি দিতে দেখি নি ওনাকে। একবার আমার বন্ধু তরুণ কারো টিফিন চুরি করে খেতে গিয়ে ধরা পরেছিল। তরুণের মা পাঁচ বাড়ি কাজ করে ওকে পড়াতো।ও টিফিন কখনোই আনত না। স‍্যার সব জানতে পেরে ওকে নিজের বাড়ি নিয়ে গিয়ে খাইয়ে ছিলেন। তারপর থেকে প্রায় প্রতিদিন দুপুরেই স‍্যারের বাড়ি ওকে খেতে ডাকতেন মাসিমা।
মাসিমার ছিল দয়ার শরীর, সব ছাত্রদের মাতৃস্নেহে ভালবাসতেন। আমরা কখনো কোনো কাজে গেলে মাসিমার হাতের নাড়ু , তক্তি খেয়ে আসতাম। সুজয়দা পড়াশোনায় মেধাবী ছিল। অনেক কষ্টে স‍্যার ওকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়ে ছিলেন। স‍্যারের ইচ্ছা ছিল না ও বিদেশে যাক। স‍্যার পড়ানোর সময় সর্বদা বলতেন দেশের সব স্কলার ছেলেরা বাইরে চলে গেলে দেশের উন্নতি হবে কি করে ? আজ নিজের খুব লজ্জা লাগছিল এই কথাটা মনে পরায়। আমিও বহু বছর বাড়ির বাইরে, যদিও দেশের মাটিতে বসেই আমি গবেষণা করছি।
আমিও স‍্যারের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ডাক্তারি পাস করে প্রথম কিছুদিন এক গ্রামীণ হাসপাতালে ছিলাম। রাজনৈতিক পার্টির দাপটে আর রুগীদের আত্মীয় দের অত্যাচারে সব নীতি বিসর্জন দিয়ে কয়েক মাসেই পালিয়ে এসেছিলাম। তারপর পড়তে বাইরে এসে গবেষণায় ঢুকে গেছিলাম।বিদেশে কাটিয়েছি বহু বছর । বাবা মা বহুবার ফিরতে বললেও ফিরতে পারি নি। অবশেষে বাবা মারা যেতে ফিরে এসেছিলাম।তারপর গবেষণার জন্য ব‍্যঙ্গালোরে চলে যাই। গত পাঁচ বছর ব‍্যঙ্গালোরেই আছি।
একটা এয়ার বাম্পে পরে প্লেনটা লাফিয়ে ওঠায় সম্বিত ফিরল। দেখলাম স‍্যার একটা বই পড়ছেন। এয়ার হোষ্টেস সবাইকে খাবার দিচ্ছিলেন। ওনারা নিরামিষ খাবার নিলেন। স‍্যার আমায় জিজ্ঞেস করলেন -" তোর ফ‍্যামেলি কোথায় ? একা যাচ্ছিস !!"
আবার একটা ধাক্কা, ঝনক আমাকে ছেড়ে চলে গেছির দশ বছর আগেই। আসলে বিদেশে এসে আমার কাজের চাপ এতো বেশি ছিল ওকে সময় দিতে পারতাম না। ওর কোনো বন্ধু ছিল না। একা কোথাও যেতে পারতো না। অবসাদে ভুগে ভুগে শেষ হয়ে যাচ্ছিল ও। দশ বছর আগে ফিরে গেছিল একাই। যদিও ডিভোর্স হয় নি কিন্তু যোগাযোগ ছিল না বহু বছর। ও ওর বাবা মা এর কাছেই থাকত। দেশে ফিরে ফোনে কয়েকবার কথা হয়েছিল। একবার দেখা করেছিলাম। স‍্যারকে অর্ধসত্য বললাম যে ও দেশেই আছে।
মাসিমা বললেন -" বাঃ, ভাল, তোমার মা অন্তত বৌ নাতি নাতনি নিয়ে আনন্দে আছেন তাহলে।" লজ্জায় তাকাতে পারছিলাম না।
মাসিমা বলে চলেছিলেন -" আমার ছেলেটা কি করে এতো বদলে গেল জানি না । আমাদের বোধহয় কোথাও কোনো ফাঁক ছিল।" ওনার চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পরল।
-"আঃ, কি হচ্ছে!! নিজেকে সামলাও । " স‍্যার একটা চাপা ধমক দিলেন যেটা ওনার চরিত্রের সাথে বেমানান।
-" কেন চুপ করবো ? এভাবে ফিরে যাচ্ছি..... ওখানে গিয়ে সবাইকে কি বলবো বল তো ? জমি বাড়িটাও বিক্রি করে দিয়ে এলে তুমি ...."
-" সে কিছু একটা ব্যবস্থা হবেই। আগে তো পৌঁছাই।" স‍্যার উত্তর দিলেন।
বুঝতে পারছিলাম কোথাও তাল কেটে গেছে। বললাম -" স‍্যার, আমি আপনার ছেলের মতো। আমাকে খুলে বলবেন কি হয়েছে? যদি আমি কিছু করতে পারি ........"
-" সবে চার ঘণ্টা কেটেছে। এখনো ১১ ঘণ্টার পথ বাকি। তুই দেশে ফেরার আগেই সব জেনে যাবি। " স‍্যার একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন।
-" সুজয় আর ওর বৌ বহু বছর এদিকে। বহু বছর পর এ বছর সুজয়ের ছেলে হয়েছিল, বহুদিন ওরা ওদিকে যায় না। সুজয় আমাদের পাকাপাকি এদিকে চলে আসতে বলেছিল অনেক দিন ধরেই। ওরা এদেশের গ্রীনকার্ড পেয়ে গেছিল। এতদিন আসি নি। কিন্তু নাতির ফটো দেখে তোর মাসিমাকে আর রাখতে পারলাম না। সুজয় চাইছিল আমরা পাকাপাকি ভাবে চলে যাই। ও নিজে এসে সব ব্যবস্থা করে জমি বাড়ি সব বিক্রি করে আমাদের নিয়ে গেছির দু মাস আগে। আমার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু এই বেকার বৃদ্ধর কথায় কেউ কান দেয় নি। এখানে এসেই বুঝলাম ওদের আসলে বাচ্চা দেখার জন্য আয়ার দরকার ছিল। ক্রেস গুলো ছমাসের আগে বাচ্চা নেবে না। বৌমা বাধ্য হয়ে আমাদের আনিয়েছিল। বাচ্চার ছমাস হতেই ওকে ক্রেসে দিয়ে আমাদের ফেরার টিকিট ধরিয়ে দিল ছেলে। বলল শীত আসছে, আমাদের কষ্ট হবে ঠাণ্ডায়।কোনো বৃদ্ধাশ্রমে থাকার ব্যবস্থাও করে দিয়েছে নেট ঘেঁটে। " স‍্যার এটুকু বলেই চোখ বুঝলেন।
-"বাচ্চাটা এই দুমাসেই আমাদের ন্যাওটা হয়ে গেছিল। খুব মুখ চিনত। দেখলেই দু হাত বাড়িয়ে কোলে উঠতে চাইত।" মাসিমা কান্না ভেজা গলায় বললেন।
-"জমি বাড়িটাও বিক্রি করে দিয়েছি। টাকা পয়সা সব নাতির নামে করে দিয়েছিলাম। আমাদের আর কি প্রয়োজন!! কিন্তু এখন ভাবছি কি করবো!!" স‍্যার বললেন।
সুজয়দাকে যতটুকু দেখেছিলাম পড়াশোনা ছাড়া কিছুই জানত না। আজ নিজের বাবা মা কে এভাবে অবহেলা করেছে শুনে খুব রাগ হল। আমাদের পাশের বাড়ির নগেন জেঠুর ছেলে কলকাতায় ভাল চাকরী করতো। বাবা মা কে সেভাবে দেখত না। বহু পুরানো জরাজীর্ণ বাড়ি ভেঙ্গে পরছিল। মেরামতের দরকার ছিল। ওনাদের ও চিকিৎসার দরকার ছিল। স‍্যার স্কুলের সব ছাত্রদের নিয়ে নিজেই ওনাদের বাড়ি মেরামত করে দিয়েছিলেন। চিকিৎসাও করিয়েছিলেন। এমনি টুকরো টুকরো বহু কথা মনে পরছিল।
আলম বলে একটা মুসলিম ছেলে পড়তো আমাদের সাথে। ওর বাবা ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা পরে গুলি লেগে মারা গেছিল। সবাই ওকে একঘরে করেছিল ডাকাতের ছেলে বলে। একমাত্র স‍্যার আমাদের বুঝিয়ে বলেছিলেন কেউ শখ করে ডাকাত হয় না। আর ওতে আলমের কোনো দোষ নেই তাও বলেছিলেন। সস্নেহে আলমের চোখের জল মুছিয়ে ওকে বুকে টেনে নিয়েছিলেন। সেই আলম আজ একটা এনজিও চালায়। বন্ধ চা বাগানের পরিবার গুলোকে সাহায্য করে নানা ভাবে। সেদিন স‍্যার ওর পাশে না দাঁড়ালে ভেসে যেতো ও। হয়তো বাবার থেকেও বড় ডাকাত তৈরি হত একদিন।
আমাদের উত্তরবঙ্গে বর্ষা কালে পাহাড়ি নদীতে খুব হড়কা বান আসতো। সেবার নাগরাকাটা টাউনটা রাতারাতি ভেসে গেছিল ডায়না নদীর জলে। কত লোক যে গৃহহারা হয়েছিল হিসাব নেই। গরমের ছুটি চলছিল স্কুলে। হেডস্যার একাই নেমে পরেছিলেন সাহায্য করতে। স্কুলে ঠাঁই দেওয়া হয়েছিল গৃহহারা পরিবার গুলোকে। আমদের কয়েকজনকে নিয়ে স‍্যার একাই ঐ বৃষ্টিতে ঘুরে ঘুরে সাহায্য তুলে ওদের কয়েকদিন খাওয়া দাওয়া শুকনো জামা কাপড়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। সরকারী সাহায্য এসেছিল বেশ কিছুদিন পরে। সে বছর রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিলেন স‍্যার। আজ ওনার ছেলের কৃপায় ওনার ঠিকানা হতে চলেছে বৃদ্ধাশ্রম। মনটা খচখচ করছিল।
দুবাইতে নেমে স‍্যার আর মাসিমাকে বসিয়ে
চটপট কয়েকটা দরকারি কাজ করে নিলাম। মেল পাঠানোর ছিল কয়েকটা। এতো বড় জার্নি তে মাসিমার শরীরটা একটু খারাপ করেছিল। তিনঘণ্টা পর কলকাতার ফ্লাইটে উঠে আমার সিটটা বদলে ওনাদের কাছেই বসেছিলাম। স‍্যার বললেন -" একটা উপকার করবি নীল, ততকালে আমাদের উত্তরবঙ্গে যাওয়ার টিকিট করে দিতে পারবি ? ওখানেই সারা জীবন কাটিয়েছি। ওখানেই শেষ দিন পর্যন্ত থাকতে চাই। তোর মাসিমারও তাই ইচ্ছা।ঐ বৃদ্ধাশ্রম কে না বলে দেবো।যে কটা টাকা পেনসিয়ান পাই তা দিয়ে আমাদের চলে যাবে। একটা এক-কামরার বাড়ি ভাড়া নিয়ে নেবো।"
এবার আমার চোখের কোন ভিজে উঠেছিল। বললাম -" আপাতত আমার উপর সব ছেড়ে দিন। ব্যবস্থা করছি।"
দমদম এয়ার পোর্টে লাগেজের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম ওনাদের নিয়ে। নেট ওয়ার্ক আসতেই কয়েকটা দরকারি ফোন করে নিলাম। বাইরে আসতেই চোখে পরল স‍্যারেদের নাম লেখা একটা বোর্ড হাতে বৃদ্ধাশ্রমের লোক দাঁড়িয়ে। কত আধুনিক ব্যবস্থা করেছে সুজয়দা!!
ওনাদের নিয়ে বাইরে এসে দেখলাম কাজল, অনীশ, রাহুল , তরুণ, প্রতিকদা সবাই ওয়েট করছে। সবাই ছুটে এসে স‍্যারের ট্রলিটা টেনে নিলো। আমি পরিচয় করালাম স‍্যারের সাথে ওনার সব প্রাক্তন ছাত্রদের, আজ সবাই নিজের নিজের জায়গায় সুপ্রতিষ্ঠিত। আমার মেল পেয়ে সবাই আজ ছুটে এসেছে স‍্যারের জন্য। আলম ও কলকাতায় এসেছিল কোনো কাজে। কিছুক্ষণের মধ্যে ও এসে গেলো। রাহুলের ফ্ল্যাট বাগুইহাটিতে, ওখানে সবাই মিলে স‍্যার আর মাসিমাকে নিয়ে গেলাম। আলম জানালো সে স‍্যারদের নিয়ে যেতে চায়। ওদের এনজিও একটা অনাথ আশ্রম খুলেছে ওখানেই। স‍্যার কে ওখানেই রাখতে চায় ও। এভাবেই শ্রদ্ধাঞ্জলী দিতে চায় আমাদের হেড স‍্যার কে।বিভিন্ন বয়সের বাচ্চাদের মাঝে স‍্যার খুব ভাল থাকবেন ওর ধারনা। যে কাজ সারা জীবন করেছেন তাই নিয়েই থাকবেন।স‍্যার আর মাসিমা রাজি হলেন অবশেষে।
স‍্যার মাসিমাকে বললেন -" কে বলে আমার সন্তান মানুষ হয় নি। এরাও তো আমার ছেলে।আজ কেমন সবাই আমাদের আপন করে নিলো ..... " স‍্যারের চোখে আনন্দের অশ্রু।
সংগৃহীত 

Thursday 9 August 2018

কে প্রকৃত মানুষ?



কে প্রকৃত মানুষ?
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

যখন খুব ছোট ছিলাম, এ-পাড়া ও-পাড়ায় লড়াই হতো, স্কুলে-খেলার মাঠে-খেতে ছাগল চরাতে গিয়ে; মনের মধ্যে কেমন একটা পাড়া-প্রীতি কাজ করতো। কে ঠিক, কে ভুল- এসবের কোন পরওয়াই করতাম না আমরা। আমার পাড়ার ছেলের পক্ষ আমাকে নিতেই হবে।
আজ বড় হয়ে দেখি লড়াইটা একই রয়েছে, শুধু আমার গ্রামে নয়; আমার এই পৃথিবীতে। দ্বন্দ্বের এ-ইতিহাস, এ-প্রথা সর্বদা  সর্বত্রে স্বমহিমায় বিরাজমান; সেটা ক্রমশ পাড়ার সেন্টিমেন্ট থেকে ভাষা, সমাজ, ধর্ম, লিঙ্গ, জাতি ও রাজনীতিতে স্থান করে নিয়েছে। 
এসবের উর্ধে যে উঠেছে সে-ই মানুষ; বাকিরা কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ বাঙালী, কেউ ভারতীয়, কেউ শ্বেতাঙ্গ, কেউ মুসলিম, কেউ কমিউনিস্ট, আবার কেউ পুরুষ।
কেউ আবার সবই; কিন্তু মানুষ নয়...!

আমার বিশ্বাস-
(প্রকৃত) মানুষ সে, যার কথা বা কাজে অন্য কেউ আঘাত পায় না।

[একবার নবি মুহাম্মদ সা-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, মুসলিম কে? উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “যার কথা ও কাজে অন্য মানুষেরা আঘাত পায় না সে-ই মুস্‌লিম।” (মুস্‌নাদ আহ্‌মাদ- ৭০৮৬, ৮৯১৮, সুনান নিসায়ি- ৪৯৯৫, শেখ আল্‌বানি ও শেখ আর্‌নাউত হাদিসগুলিকে সাহিহ অর্থাৎ বর্ণনাসূত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশুদ্ধ ও প্রামাণ্য বলে মন্তব্য করেছেন।)]  

Wednesday 8 August 2018

رابندرانات طاغور: وشرّفْني بأن لا أبتعد


وشرّفْني بأنْ لّا أبتعد
رابندرانات طاغور
ترجمة: عبد المتين وسيم

إنني باق هنا
لأحمدك بالأغنيات
فهب لي في ردهتك ذا
مكانا في إحدى الزوايا.
و إنني في عالمك هذا
سيدي، حييت بدون عمل
و لو حياتي العقيمة ذا
لا تتفجر إلا بالنغمات.  

فعندما تحين في حلكة الليل
آوان تسبيحك في المعبد الصامت
مرني، مولاي، لأقوم
فأسبحك بالأغنيات.
و شرّفني بأن لا أبتعد
عندما تناغم القيثارة خلال السماء
بالألحان الذهبية في الصباح
                  مع هبوب النسيمات.    




“না রই দূরে”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
আমি হেথায় থাকি শুধু
  গাইতে তোমার গান,
দিয়ো তোমার জগত্সভায়
  এইটুকু মোর স্থান |
         আমি তোমার ভুবন-মাঝে
         লাগি নি নাথকোনো কাজে,
         শুধু কেবল সুরে বাজে
              অকাজের এই প্রাণ |

নিশায় নীরব দেবালয়ে
  তোমার আরাধন,
তখন মোরে আদেশ কোরো
  গাইতে হে রাজন |
         ভোরে যখন আকাশ জুড়ে
         বাজবে বীণা সোনার সুরে
         আমি যেন না রই দূরে
             এই দিয়ো মোর মান |
[রবীন্দ্র রচনাবলী (পশ্চিমবঙ্গ সরকার শতবার্ষিকী সং) খণ্ড ২পৃ ২৩৪ থেকে সংগৃহীতগীতবিতানে যতিচিহ্ণ ("লাগি নিনাথ,", "না রই দূরে,") এবং পঙ্‌ক্তিবিন্যাস সামান্য আলাদা।]