Sunday 17 March 2019

আব্দুল মাতিন ওয়াসিমঃ জল ও জীবন এবং আমি...!


Image result for লাঙ্গলের পেছনে ছোট ছেলে
জল ও জীবন এবং আমি...! 
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম



আমি তখন খুব ছোট। পড়ি কদমডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সকালে উঠে, কিছুক্ষণ বইখাতা নিয়ে বসতাম। তারপরে খেয়েদেয়ে বাবার সাথে যেতাম মাঠে। বাবা হাল বাইতেন আর আমি বাবার পেছন পেছন থাকতাম। বর্ষাকালে সঙ্গে থাকতো একটি থলে। তখনকার দিনে হাল-চাষের সময় জলের সাথে ভেসে আসত ছোট ছোট মাছ। সেগুলি ধরে থলের মধ্যে রাখতাম। দুপুর বেলা বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে তুলে দিতাম সেই মাছগুলি। আবার আলু তোলার পর আলুর খেতে হাল বাইলে, খুঁজে না-পাওয়া আলুগুলো বেরোতো; আর আমরা সেগুলো কুড়িয়ে থলেতে, কখনো হাফপ্যান্টের পকেটে, কখনো লুঙির কোছায় রাখতাম। প্রায়ই মাঠের আলে বসে কাঁচা পেঁয়াজ আর কাঁচা লংকা দিয়ে বাবার সাথে পান্তাভাত খেতাম পরমানন্দে। 

তখন আমাদের গ্রামে জলের ব্যবস্থা খুব ভালো ছিল না; টিউব-ওয়েলের পাশাপাশি লোকে কুয়োর জলও খেত। আমাদের অত বড় গ্রামে মাত্র তিনটে টিউবওয়েল ছিল; পূব পাড়ে একটা, পশ্চিম পাড়ে একটা, আর একটা আমাদের বড়-বাড়িয়াতে। তবে কুয়ো ছিল বেশ ক'টা। খোদ আমাদের বাড়িতেই ছিল একটা। কুয়োর জলে বাসন মাজা, কাপড় কাঁচা, চান করা সবই করতাম। এমনকি পানও করতাম। 

সেদিনগুলিতে জল পান নিয়ে তেমন মাথা ব্যাথা ছিল না কারোর। এর জন্য অবশ্য কলেরা-ডাইরিয়ার মতো মহামারী এবং অত্যন্ত ভয়ানক পরিস্থিতির সম্মুখীনও হতে হয়েছে প্রান্তিক মানুষদের। সেসময় স্কুলে গিয়ে আমরা তুলাই নদীর জল পান করেছি। উত্তরের মাঠে গেলে বাটুয়াদীঘির জল, পূবের মাঠে গেলে ফকিরকুড়ির জল, এছাড়াও পুকুরের জল, গাঙের জল, চৌকার জল আমাদের তেষ্টা মিটিয়েছে। 


তারপর এক দীর্ঘ যাত্রা, প্রায় কুড়ি বছরের...। 
এখন আমি থাকি কোলকাতায়। ভালো মাইনের সরকারী চাকরি করি। কলেজে গেলে অ্যাকুয়াগার্ডের জল আর ফ্ল্যাটে মিনারেল ওয়াটার; এর বাইরের জলের সাথে আমার জিভের আর তেমন সাক্ষাৎ হয় না বললেই চলে। এখনো যখন মাঝেমধ্যে ছুটিতে গ্রামের বাড়ি যাই, দেখি অসংখ্য মানুষ, পুরুষ-মহিলা সকলে চৈত্রের জ্বলন্ত দুপুরে খাঁ খাঁ মাঠে কাজ করছে; মাথায় একটা ছেঁড়া লুঙি বা এক ফালি কাপড়। গায়ে বহু পুরনো জীর্ণ একখানা গেঞ্জি। কারুর অবস্থা আরও করুণ...। 

তবে তাঁরা এখন আর গাঙের জল খায় না। বাড়ি থেকে প্লাস্টিকের বোতলে করে জল আনে। সেই বোতল পুকুরের জলে বা গাঙের পানিতে বা খেতের কাদাজলে ডুবিয়ে রাখে; যাতে জল গরম না হয়। এসব দৃশ্য দেখে আমার অজান্তেই হাতদুটো প্রসারিত হয়। স্মৃতি আর বাস্তবের সংগমে দাঁড়িয়ে হাতড়াই বাবার সেই হাতদুটো। খুঁজি, আর খুঁজে চলি; কিন্তু খুঁজে আর পাই না...। 

ক'দিন ছুটি কাটিয়ে ফিরে আসি আবার এই তিলোত্তমার বুকে। যেখানে এখন শুধুই স্বার্থের গন্ধ। কংক্রিটের বিশাল জঙ্গল, আরও কতকিছু। তবে এখানেও সবাই অ্যাকুয়ার জল পায় না। মিনারেলও না। টাইম-কলের পাশে লম্বা লাইনে দাঁড়ায় বালতি-বোতল-গামলারা। মারামারি-হাতাহাতি-ঝগড়াও করে মালিকেরা। 

সুদীর্ঘ সংগ্রামের পরে স্বাধীনতা পেয়েছি আমরা। হয়তো তার চেয়েও দীর্ঘ সংগ্রামের প্রয়োজন এক ফোটা স্বাদু ও পেয়ো জল সবার মুখে তুল দিতে। তাই প্রস্তুত হতে হবে এখনই। আরো একটা লড়াই লড়তে হবে। তবে এবারের লড়াইটা হবে জীবনের জন্য; জলের জন্য...।   

১৭-০৩-২০১৮
পার্কসার্কাস, কোলকাতা

আব্দুল মাতিন ওয়াসিমঃ সেদিনের কালবৈশাখীতে

সেদিনের কালবৈশাখীতে

আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

সেদিন বিকেলে, সূর্য তখন সারা দিনের ক্লান্তি ঝেড়ে গিয়ে বসেছে হাঁড়িয়া কোণের তালগাছটার মাথায়। একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। আমি বাবার কেনি আঙুল ধরে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চলেছি শাটিমারি হাটের পথে। আমার শৈশবজুড়ে শাটিমারি একটি রোমাঞ্চকর নাম; সেখানে গিয়ে বাবার কিনে দেওয়া এক টাকায় দুটো শিঙাড়া খাওয়ার কী যে মজা তা বয়ান করবার মতো শব্দ আমার অভিধানে নেই।

ছোটবেলায় আমাদের আর একটা ক্র্যায ছিল মেঘু। মেঘু কাকু পাশের গ্রাম আঁচরইলে থাকতো। রোজ বিকেলে তার ছোট্ট ডালিটা কাঁখে নিয়ে এসে হাজির হতো আমাদের পাড়ায়। তার বাঁধাধরা ক'টা খদ্দের ছিল আমাদের গ্রামে-- আমি, আমিরুল, নাসি, বিমল ও দেলোয়ার। মেঘু কাকু আমাদের বাড়ির কাছে এসে জোরে হাঁক ছাড়ত-- "পাঁ--পড় নিবেন নাকি বো পাঁপড়; গরম গরম পাঁপড়..."। ওর কণ্ঠ শুনে আমরা যেখানেই থাকি না কেন মুহূর্তের মধ্যে হাজির। সাথে চাল, কেউ বাটিতে করে, তো কেউ প্যান্টের পকেটে, কেউ আবার জামা বা গামছার এক প্রান্তে গুটিয়ে। আসলে মা' তো রোজ চাল আনতে দিত না। ব্যাপারটা এমন ছিল যে, বিকেল হলে আমরা অনেকেই বায়না ধরতাম-- "মা বো মুই আইজকা মেঘুক খাম" (মা, আমি আজকে মেঘুকে খাবো)।

সেদিন হাটে পৌঁছে, যথারীতি আগে শিঙাড়ার দোকানে গেলাম। সেখানে বসিয়ে আমার হাতে দু'টো শিঙাড়া ধরিয়ে দিয়ে বাবা চলে গেলেন বাজার করতে। আর আমি বসে বসে শিঙাড়া খেতে লাগলাম মনের সুখে। ওদিকে ততক্ষণে মেঘের কাছে পরাজয় বরণ করেছে সূর্য। আর মেঘাচ্ছন্ন আকাশের আলোআঁধারিতে সূর্য কোথায় যে লুকিয়ে পড়েছে তার কোন আতাপাতা নেই। সাথে মেঘবালিকারা একে অপরকে ডাকাডাকি, তর্জনগর্জন শুরু করেছে ভীষণভাবে। মাঝেমধ্যে বিদ্যুতের ঝলকানি যেন তাদেরকে পথ দেখিয়ে দিচ্ছে। এসব দেখে বাতাসও আর বসে থাকল না। পিছিয়ে থাকল না বৃষ্টিও। মুহূর্তের মধ্যে সারা হাটজুড়ে একটাই শব্দ উচ্চারিত হতে লাগল, কালবৈশাখী!

বাবা কোথা থেকে সুপারম্যানের মতো উড়ে এসে এক হাতে আমাকে আর অপর হাতে হাটের ঝোলাটা নিয়ে ছুটতে লাগলেন। কোনোরকমে গিয়ে মাথা গুঁজলাম হাটের পশ্চিম-উত্তর কোণে মন্দিরের চালায়।

নিমেষেই ভরে গেল চালা। মাটির ঘরটাও ভর্তি হয়ে গেল। বাইরে তখন প্রবল বেগে বাতাস বইছে। তার সাথে তাল মিলিয়ে শিলাবৃষ্টি নৃত্য করছে। মাঝেমধ্যেই বিদ্যুতের ঝলকানি আলোকসজ্জার কাজ করছে। আর হঠাৎহঠাৎ দমকা হাওয়া এসে ধাক্কা মারছে আমাদের মনে। স্বভাবতই মুখ থেকে বেরোচ্ছে কী হবে এখন!

আর পাঁচটা বাচ্চার মতো আমিও ভয়ে থরথর করে কাঁপছি। বাঁচার জন্য যে যার মতো করে প্রার্থনা করছে। গুটিসুটি হয়ে খাপটি মেরে জাপটে ধরে আছি বাবার হাতটা। ঝড়ের তীব্রতা কোনোমতেই কমছে না। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ গোপেশ জ্যাঠুর। তবুও নাগাড়ে আওড়ে চলেছে মন্ত্র। মাথা নত করে আমাদের সবার জন্য প্রার্থনা করছে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়েছে দেবীর সম্মুখে। অন্যদিকে তখন বালা যাতে টলে যায়, সবাই যাতে মসিবতের হাত থেকে রেহাই পাই তার জন্য বিড়বিড় করে দুআ করছে সুভান বড়-আব্বা। কিন্তু ঝড়ের হম্বিতম্বি বেড়েই চলেছে। কালবৈশাখীর তাণ্ডবলীলা থামার কোন নামই নিচ্ছে না। সুভান বড়-আব্বা দিশা-দুয়ার, কূল-কিনারা না-পেয়ে ঐ চালাতেই জোরে জোরে আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার বলে আজান দিতে লাগলেন (মুসলিম সমাজে বিপদের সময় রক্ষা পেতে আজান দেওয়ার একটা রীতি প্রচলিত আছে। বিষয়টি তত্ত্ব ও তথ্যের নিরিখে কেমন তা আমার জানা নেই।)। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর ঝড় থামল। আর আমরা যে যার বাড়ি ফেরত গেলাম।

সেদিনের ঐ ঘটনা সেখানে উপস্থিত কারোরই দৃষ্টিকটু মনে হয়নি। এমনকি এলাকায় কেউ কিছুই ভাবেনি। কিন্তু অমন ঘটনা যদি আজ কোথাও, কোনো মন্দিরে বা মসজিদে বা গির্জায় ঘটে; তাহলে কী হবে একবার ভেবে দেখুন। কত নিরপরাধ প্রাণের বলি চড়বে। দেশের কত সম্পদ নষ্ট হবে। বিঘ্নিত হবে শান্তি, সম্প্রীতি, সৌহার্দ। ভেঙে যাবে বিমল ও কামালের বন্ধুত্ব। সাদিয়া-সুস্মিতার মাঝে তৈরি হবে ঘৃণার এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর। শুধু লাভ হবে রাজনীতির কারবারিদের...!

১৭-০৩-২০১৯
তপ্সিয়া, কোলকাতা

আব্দুল মাতিন ওয়াসিমঃ খোলা-তালাক

Image result for বিচ্ছেদ

 খোলা-তালাক 

আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

দু' মাস হতে চলল সারাহ্‌ বাপের বাড়িতেই আছে। প্রথম প্রথম তেমন কেউই বিষয়টাকে আমল দেয়নি। কিন্তু, একমাস হয়ে গেল শ্বশুর বাড়ি যাচ্ছে না দেখে, পাড়াপড়শির কৌতূহল বাড়তে লাগল। আস্তে আস্তে বিষয়টি নিয়ে কানাকানি শুরু হল। কোনোভাবে পাশের বাড়ির মল্লিকা বৌদি একদিন জানতে পারলো, সারাহ্‌ নিজে খোলা-তালাক দিয়ে এসেছে স্বামীকে। ব্যাস, মুহূর্তের মধ্যে আলোর গতিতে ছড়িয়ে পড়ল ব্র্যাকিং নিউজটা। আর শুরু হয়ে গেল আলাপ-আলোচনার পালা। কি কল-তলা, কি পুকুর-ঘাট, কি ফিদ্দুর চায়ের দোকান- সব জায়গাতেই হট্‌-পট্যাটো সারাহ্‌। পাড়াপড়শি-আত্মীয়স্বজন প্রায় সবাই একসুরে খোদ সারাহ্‌কেই দায়ী করতে লাগল। নজরূল মিঞা তো চায়ে চুমুক দিতে দিতে বলেই বসলেন-- "কত বড় স্পর্ধা দেখো, মেয়ে হয়ে ডিভোর্স দিয়ে এসেছে স্বামীকে...!" 

সারাহ্‌ বহু রাত বিনিদ্র যাপন করেছে শ্বশুর বাড়িতে। পণের টাকা পরিশোধ করতে পারেনি তাঁর বাবা, তা নিয়ে উঠতে-বসতে শাশুড়ি-ননদের কাছে খোঁটা শুনতে হয়েছে তাঁকে। রয়্যাল-এনফিল্ড পায়নি বলে স্বামী বহুবার তাঁর গায়ে হাত তুলেছে। সেসব কথা কিন্তু পাড়ার কেউ জানে না। আর তারা জানতেও চায়নি কোনোদিন। তারা শুধু একটাই কথা জেনেছে আর তা নিয়েই দিনরাত কানাঘুষো করছে সবাই-- সারাহ্‌ তালাক দিয়েছে নিজের স্বামীকে; খোলা-তালাক।

১৪-০৩-২০১৮
মোমিনপুর, কোলকাতা 

Friday 8 March 2019

আব্দুল মাতিন ওয়াসিমঃ ভ্রূণ



 ভ্রূণ 
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

বাব্‌লি আবারও মা হতে চলেছে। পরীক্ষা নিরীক্ষা করে কোনোভাবে জানতে পারল, এবারও গর্ভে এসেছে এক কন্যা সন্তান। কী করবে বুঝতে পারছে না বিমল। বসে আছে মাথা নীচু করে, চুপচাপ, ঘরের এক কোণে। কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়ালো সে। ঘর থেকে বেরিয়ে উভয়ে দ্রুত পৌঁছালো ডাক্তার শিরিনের ক্লিনিকে...।

সব শুনে ডাক্তার শিরিন বললেন, "এবরশন মহাপাপ এবং আইনতঃ দণ্ডনীয় অপরাধ"। বাবলি ও বিমল উভয়ে সমস্বরে, ঝাঁঝালো কন্ঠে, একরাশ হতাশা ও বিরক্তি মিশিয়ে বলে উঠল, "টাকা দিচ্ছি। কাজটা করে দিন। এত কথা শুনতে চাইনা"। 

শিরিনের চোখ ছলছল করে উঠল। দীর্ঘ দশ বছর ধরে তাঁর গর্ভ যে হাহাকার করছে একটি ভ্রূণের জন্য। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, "অন্য কোথাও যান"।

Tuesday 5 March 2019

আব্দুল মাতিন ওয়াসিমঃ ক্লাস ওয়ান থেকে টু’য়ে



ক্লাস ওয়ান থেকে টু’য়ে

তারপরের দিন সকালে যথারীতি গিয়ে ক্লাসে বসলাম।  গ্রামের প্রাইমারী স্কুল থেকে ক্লাস থ্রি পাশ করে যাওয়ার সুবাদে বাংলা, অংক এবং ইংরেজিতে তেমন অসুবিধা হওয়ার কথা ছিল না। গ্রামের মক্‌তবে উর্দু ও আরবি শিখেছিলাম। তাই উর্দু পড়ার পাশাপাশি একটু আধটু বলতে ও লিখতেও পারতাম। বুঝতামও খানিকটা। কিন্তু আরবি পড়তে পারলেও তেমন লিখতে পারতাম না। বুঝতে তো পারতামই না। কারণ, আমাদের দেশের প্রায় সব জায়গারই একই অবস্থা, আরবি অনেকেই পড়তে শেখে কিন্তু লিখতে, বুঝতে এবং বলতে শেখে না। এমনকি যারা আরবিতে গ্রাজুয়েশন ও মাস্টার্স করেছে বা করে তাঁদেরও অনেকে সঠিকভাবে আরবি লিখতে ও বলতে অক্ষম।

যাইহোক প্রথমদিন, অচেনা পরিসর, এক অদ্ভুত রকমের আড়ষ্টতা নিয়ে ক্লাস ওয়ানের শ্রেণীকক্ষে ঢুকলাম। এবং টিফিনের আগের প্রায় সবকটা পিরিয়ডই মোটামুটি ভাবে উতরে গেলাম। টিফিন বিরতিতে বইখাতা ক্লাসে রেখেই ফিরে গেলাম রুমে। হস্টেলের মাত্‌বাখ (রান্নাঘর) থেকে পাওয়া এক চামুচ সেদ্ধ ছোলা আর বাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া এক বাটির মতো মুড়ি সর্ষে তেলে মেখে টিফিন করলাম। তারপর গেলাম ক্লাসে। টিফিনের পর প্রথম পিরিয়ডটা ছিল আরবির। পড়তে পারলেও মানে বুঝতাম না। তাই কী করবো, কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ঐ দিকে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক ক্লাসে ঢুকেই এক এক করে সবাইকে নির্ধারিত অংশের অর্থ জিজ্ঞেস করছিলেন। না পারলে, ছড়ি দিয়ে হাতের তালুতে আঘাত করছিলেন। আমি বসেছিলাম দ্বিতীয় লাইনে। ভয়ে, শুনে শুনে ঐ অংশটুকুর অর্থ মুখস্থ করে ফেললাম। যখন শিক্ষক আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, না-দেখে পুরোটাই মুখস্থ শুনিয়ে দিলাম। কিন্তু তিনি যাতে বুঝতে না পারেন, তার জন্য  বইয়ের উপর খামোখা আঙ্গুল ফেরাচ্ছিলাম। 

ক্লাস শেষে ফিরে গেলাম হস্টেল বিল্ডিঙে। যোহরের সালাতের (মধ্যাহ্ন প্রহরের নামায) আধ ঘণ্টা আগে ছুটি হয়েছিল। দ্রুত স্নান সেরে মসজিদে গেলাম। নামায শেষে ঘরে ফিরে থালাটা নিয়ে ছুটলাম মাত্‌বাখের দিকে। ছোটদের আলাদা লাইনে দাঁড় করানো হতো। কখনো কখনো একই লাইনে সবাইকে দাঁড় করানো হতো, সেক্ষেত্রে বড় দাদারা ছোট ভাইদের লাইনের প্রথমে পাঠিয়ে দিতেন। তাই গিয়ে দাঁড়ালাম লাইনের প্রথমে। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে দিল জামিল (বাবুর্চি) কাকু। তিনটে বড় বড় গামলায় ভাত, তরকারী ও ডাল। ভাত ও তরকারীর গামলার দায়িত্বে দুজন শিক্ষক আর ডালের দায়িত্বে এক সিনিয়র দাদা। এবং এই পুরো সিস্টেমটাই রুটিন মাফিক ভাগ করা ছিল শিক্ষক ও কিছু সিনিয়র দাদাদের মাঝে। সেদিনের দায়িত্বে ছিলেন মাস্টার আব্দুর রশিদ ও ইউসুফ। তবে ডালের দায়িত্বে থাকা ঐ দাদার কথা মনে করতে পারছি না এখন। যাইহোক ভাত-ডাল-তরকারী নিয়ে কামরায় ফিরলাম। হস্টেলের খাবার কেমন হয় তা অনেকের জানা। বিশেষ করে হস্টেলের ডাল; সমুদ্রে মুক্তো খুঁজতে ডুবুরী যেমন পরিশ্রম করে ঠিক তেমনই মুশুরের দানা খুঁজতে হস্টেলের আবাসিকরা। স্বভাবতই অতি কষ্টে গলাধঃকরণ করলাম। 

উপমহাদেশের বেশির ভাগ মাদ্‌রাসায় মধ্যাহ্ন ভোজনের পর, আসরের সালাত (বিকেলের নামায) পর্যন্ত ছেলেরা যে যার কামরায় (রুমে), কেউ হাতের লেখা লেখে, কেউ হোমওয়ার্ক করে, কেউ বসে বসে বই পড়ে, আবার কেউ বেঘোরে ঘুমোয় তো কেউ ক্বায়লুলাহ্‌ (মধ্যাহ্ন ভোজনের পর শুয়ে, তবে জেগে একটু আরাম করা। এবং নবি (সা) প্রায়শই এভাবে দুপুরের খাবারের পর বিশ্রাম নিতেন। তাই এটি একটি সুন্নত রূপে সমাদৃত) করে। তখন আমি জাহাঙ্গীর কাকুর রুমে থাকতাম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে সেদিন ক্লাসে কী কী হয়েছে সব কাকুকে খুলে বললাম। শেষে বললাম, “কাকু আমি না সব পারছি। শুধু আরবি আর হিন্দিতে একটু অসুবিধাআমার মনে হয় ক্লাস টু’তে ভর্তি হলে ভালো হবে!”

জাহাঙ্গীর কাকু ও তার রুমমেটরা সবাই মিলে আমাকে একদিনেই হিন্দি পড়তে এবং একটু আধটু লিখতে শিখিয়ে দিল। আমি উর্দু ভাষা টুকিটাকি জানতাম, ফলে হিন্দি বুঝতে আমার তেমন অসুবিধা হচ্ছিল না। কেন না ঐ দু’টো  ভাষা তো সহোদরা। একটা যদি মা হয়, তো আরেকটা হল মাসি। সন্ধ্যাবেলা, মাগ্‌রিবের সালাত (সূর্যাস্তের নামায) আদায়ের পর ওদের শেখানো কৌশল অনুযায়ী সালাম দিয়ে ঢুকলাম প্রিন্সিপ্যাল স্যারের অফিসে। কাঁদো কাঁদো স্বরে আমার সব কথা বললাম। হিন্দি বইটা সামনে ধরে ‘লাল মুর্‌গি কুক্‌ কুক্‌ কুক্‌’ গল্পের প্রথম পাতাটা এক শ্বাসে পড়ে ফেললাম। স্যার হাসতে হাসতে বললেন, “যাও কাল থেকে ক্লাস টু’র ঘরে বসবে”
-আব্দুল মাতিন ওয়াসিম 

Friday 1 March 2019

বদিউর রহমানঃ বৃথা আক্ষেপ

Image may contain: one or more people, glasses and text

 বৃথা আক্ষেপ   
বদিউর রহমান


যৌবন যবে গত চিরতরে,
মৃত্যু আসিবে হঠাৎ একেবারে।
সে দুইয়ের মাঝে বার্ধক্য আসি’
ন্যুব্জ আমাকে নতজানু করে।

বলিল না সে তো বিদায়ের ক্ষণে ,
আবার হইবে দেখা তোমা’ সনে।
নিয়তি লিখন এমনই তো হবে,
ফিরিবে না কভু গত যৌবনে।

দেখিতাম যারে আঁখিদ্বয় ভরি’
ধূসরতা আসি দৃষ্টিকে হরি’,
পারি না বুঝিতে বেদনার ভারে
চেনাকে অচেনা বলে ভুল করি।

হাতটা ধরিয়া সোহাগের সুরে,
বলিতাম যারে, বসিও না দূরে,
কী বা ভয় তব, আমি তো আছিই।
তাহা বিনে দুখ দেহমন জুড়ে।

আজ মোর ক্ষীণ দৃষ্টি শকতি,
আরও দুর্বল চালিকা শকতি,
মহাকালে আজ উধাও হয়েছে
ক্ষীণ হতে ক্ষীণ চিন্তা শকতি।


৩০-০৪-২০১৭