Tuesday 17 January 2023

বদিউর রহমানঃ ‘সুনা হ্যায় বা’দ মরনে কে মাতাম বাড়া জ়োর হুয়া’



সুনা হ্যায় বারনে কে মাতাম বাড়া জ়ো হুয়া
বদিউর রহমান
 
বাড়িতে বিভিন্ন বিষয়ের বহু গৃহশিক্ষক আমার দিদি ও দাদাদের পড়াতে আসতেন। যতদূর মনে পড়ে সংস্কৃত অথবা বাংলার কোন এক স্যার পড়ানোর সময় ক্রমে ক্রমে সেই বার্তা রটে গেল গ্রামে শব্দবন্ধটির প্রেক্ষিত বলছিলেন। এই কথাটির সঙ্গে পুরোপুরি সাযুজ্য বা মিল না থাকলেও আমার জীবনের বর্তমান একটা ব্যাপারে কিছুটা অন্তত মিল পাচ্ছি। ব্যাপারটা ভুল কি জানি না তবে, কীভাবে রটে গেছে আমার শরীরটা নাকি ভীষণ খারাপ! হাতে হাতে মুঠোফোনের দৌলতে খবরটা সহজেই একটা মাত্রা পেয়েছে। প্রায়শই ফোন আসছে মুখ্যতঃ কুশল জানার জন্যে। শ্বাসকষ্টের জন্য বিভিন্ন রকমের ইনহেলার নেওয়ার কারণে গলার স্বরটাও খারাপ হচ্ছে ফোনের উত্তর দিতে গিয়ে অতি সাধারণ প্রশ্ন, “কেমন আছেন এর উত্তরে বলছি ভালো আছি এবং আপ্রাণ চেষ্টা করছি ভালো আছি কথাটা বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে তাও অনেকে বলছেন, ঠিক আছে! তোমার গলার আওয়াজ থেকেই বুঝতে পারছি তুমি কতটা ভালো আছো! তাই আর কথা বাড়াচ্ছি না ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধপালা করবে আর মনের জোর বাড়াবে। ভালো থেকো দু-চার জন ফলটল নিয়ে দেখতে চলে আসছেন মাঝখান থেকে আমি খুবই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ছি ওনাদের ব্যস্ত জীবনের কর্মযজ্ঞ থেকে এই অধমের জন্য সময় ব্যয় করতে হচ্ছে ভেবে ওনারা আমাকে দেখে কিছুটা চিন্তামুক্ত হয়ে ফিরছেন দিয়ে যাচ্ছেন নানা রকম পরামর্শ রেখে যাচ্ছেন নানা রকমের ফলমূল। আর আমার স্ত্রীকে বলে যাচ্ছেন প্রয়োজন হলে ফোন করতে
 
আমার ভাগ্য ভালো এখনো সেরকম ফোন করতে হয়নি। একেবারে যে কারো সাহায্য নিতে হয়নি তাও নয় আমার ছোট শ্যালিকা মলি ও দু-তিনজন বিশেষ ছাত্র আমাকে কয়েকজন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে আমাকে নিয়ে তারা যেখানে যেখানে গিয়েছে প্রত্যেক জায়গার ডাক্তাররাই আমাদের দু-তিন ঘণ্টা করে অপেক্ষা করিয়েছেন একটা ইনভেস্টিগেশনের জন্য সকাল সাড়ে সাতটায় টেকনিশিয়ানরা ডেকেছিল যথাসময়ে গিয়েছি বেলা আড়াইটার সময় বিভাগীয় অপারেটর জানালেন মেশিন খারাপ হয়ে গেছে চার-পাঁচ দিন পর খবর নিয়ে আসবেন। আবার সেখানে যাই শরীরটা আমার, দেখার দায় যেন সকলের বিশেষতঃ যারা আমাকে ভালবাসেন স্নেহ করেন তা না হলে যারা সাধারণত সল্টলেকে আমার বাসায় আসতে চান না তারা কেন অসুস্থ মানুষের জন্য ফলটল নিয়ে ইদানিং হাজির হচ্ছেন? অত দামী দামী ফল বহুদিন কিনে খাইনি এখন সেই ফলগুলো নিত্য খাচ্ছি একজন বন্ধু তো অন্যান্য ফলের সঙ্গে কয়েকটা কিউই এনেছেন রাগ করলাম কিছু আপ্তবাক্য শুনে সবকিছুই গ্রহণ করতে হলো এগুলো তো পাওনাগণ্ডাও বলতে পারেন কিন্তু যা হারাচ্ছি তার যৎসামান্য বিবরণ দিই পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়, গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়, জামশেদপুরের একটা কলেজের সিলেকশনে যেতে পারলাম না আর যেতে পারলাম না বেশ কয়েকটা বোর্ড অফ স্টাডিজ-এর মিটিংয়ে এবং সেমিনারে তার মধ্যে এক আধটার সেশনে চেয়ার করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম এমনকি গত ১৮ই ডিসেম্বরে বিশ্ব আরবি ভাষা দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যথাযথ অংশগ্রহণ করতে পারলাম না আমার অবস্থা যে দ্রুত এতটা করুণ হয়ে যাবে আমি নিজেও কখনো কল্পনা করিনি যে বার্তাটা এতদিন ছোট পরিসরে সীমাবদ্ধ ছিল সেটা এখন অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে শিক্ষা জগতের বিভিন্ন কাজকর্ম থেকে ধীরে ধীরে এবং নিঃশব্দে মুছে যেতে চলেছি এই দুঃখটার নিরসন কবে হবে জানি না শুভস্য শীঘ্রম বললে কি অত্যূক্তি হবে!
 
পুনশ্চঃ বিখ্যাত উর্দু কবি গালিব জীবনের অন্তিম লগ্নে অসুস্থ তাঁর এক ভক্ত চিঠি মারফত কবির কুশল জানতে চাইলে উত্তরে তিনি লেখেন, আর আমাকে কেন জিজ্ঞাসা করা! কয়েকদিনের মধ্যে আমার পাড়াপড়শিরাই জানাবে একটু অপেক্ষা করোআমৃত্যু রসিক কবি নিজের মৃত্যুর আগমনী সংকেতকে তাচ্ছিল্য করতে পারলেও তার একটা অপূর্ব উক্তির কথা উল্লেখ না করে পারছি না
মওত কা একদিন মুআইয়িন হ্যায়
নিন্দ কিঁউ রাতভর নেহি আতি
 
কবি গালিব জীবন-মৃত্যুকে এইভাবে দেখলেও নিঃসঙ্গ শেষ জীবনে অনেকের দীর্ঘশ্বাস পড়ে তখন নিজের ছাত্র-ছাত্রী, গুণমুগ্ধ ভক্তকুল, এমনকি নিজ সন্তান-সন্ততিদের অনুপস্থিতি বড় কষ্টদায়ক হয়ে যায় আধুনিক আরবি সাহিত্যের স্বনামধন্য লেখক ডঃ ত্বহা হুসেইনের শেষ জীবনের কথা উল্লেখ করেছেন তার ফরাসি স্ত্রী সুজান ব্রেসু অতীব ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ত্বহা বলেন, পৃথিবীর মানুষজন কত আত্মকেন্দ্রিক ও খারাপ! আমার কাছে আগের মত আর কেউ আসে না তার বাড়ি রামাতান সব সময় ছাত্র-ছাত্রী, কবি-সাহিত্যিক, দেশি-বিদেশি অধ্যাপক এবং বিশিষ্টজনদের সমাগমে গমগম করতো সে জায়গায় ত্বহার শেষ জীবনে শুধুমাত্র কামিল ও ত্বহার অন্যতম প্রিয় ছাত্রী সুহাইর কালমাভির রামাতান যাওয়াআসা ছিল সেই একাকিত্ব ত্বহা হুসেইনকে ব্যথিত করেছিল হয়ত খুব স্বাভাবিকভাবেই হয়ত অন্যদেরকেও ব্যথিত করেহয়তো সেটাই চিরাচরিত নিয়ম বার্ধক্যজর্জরিত, নখদন্তহীন বনের রাজাও নিঃসঙ্গতা ও শারীরিক ক্লেশের জন্য অশ্রু বিসর্জন করে জীবন পাত করে কেউই ভ্রুক্ষেপ করে না এটাই স্বাভাবিক এরকমটাই নিয়ম অবশ্য ত্বহা হুসেইন ১৯৭৩ সালে (অক্টোবরের ২৯শে রমজানের তৃতীয় দিন) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পরপর সেই বার্তা সারাদেশে রটে গেল দ্রুত টেলিভিশন, রেডিও, জনগণ, কবি-সাহিত্যিক ও অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী দলে দলে হাজির হয়ে ত্বহাকে কবরস্থ করেন তখন জমায়েত ছিল দেখার মত অথচ তাঁর জীবনের শেষ লগ্নে তাঁকে সাহায্য করার হাত ছিল অত্যল্প উর্দুতে একটা কথা আছে, সুনা হ্যায় বাদ মরনে কে মাতাম বড়া জ়ো হুয়া
 
সল্টলেক
০৩/০১/২০২৩