Monday 17 September 2018

আব্দুল মাতিন ওয়াসিমঃ আমি এখন স্বপ্নবিহীন...!


আমি এখন স্বপ্নবিহীন...!
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

এই কদিন কোনকিছুই লিখতে পারছিনা। লিখতে বসলে শব্দগুলো কেমন জড়িয়ে যাচ্ছে। ভাবনাগুলো থেমে থেমে আসছে। রাজনৈতিক চাপানউতোরের মাঝে আর্থসামাজিক ইস্যুগুলো কেমন কিলবিল করছে মাথার মধ্যে। স্মৃতি হাতড়ে পূর্বের কোনো দিন বা মুহূর্ত ঘুরে আসলে সেই স্মৃতিই বারবার জারণ করছে মনকে; অজান্তেই কখনো এক চিলতে হাঁসি ভেসে উঠছে ঠোঁটের কোণে, তো কখনো চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে এক-আধ ফোঁটা অশ্রু। 
আমি চাষির ছেলে। আর্থিক সংকটকে গল্প-কাহিনী-সিনেমা-সিরিয়াল দিয়ে নয়; বাস্তব জীবন থেকে অনুভব করেছি। তাই আমার শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য-যৌবনের উচ্ছলতা-উচ্ছ্বাস-আবেগ-উল্লাস সব তিল তিল করে জমানো ছিল বুকে; বেশ গভীর ভাবে। স্বপ্ন ছিল, ভালোভাবে পড়াশুনা করে আগে একটা চাকরি পেতে হবে। তারপর সেই স্বপ্নের জগতে পাড়ি জমাবো। এক এক করে জয় করবো পরিকল্পনার কেল্লা-প্রাসাদকে...। 
কিন্তু, আজকাল আমি কেমন যেন গুটিয়ে গেছি। আগে বন্ধুদের মাঝে সারাক্ষণ বকবক করতাম। এখন বন্ধুদের থেকে আড়ালে থাকি; তাঁদের ফোন ধরিনা। এড়িয়ে যাই। ডাকলেও যাই না। তাই, কেউ কেউ ভাবে, আমি চাকরি পেয়ে বদলে গেছি। জানি না, তাঁরা ঠিক না ভুল। তবে, হ্যাঁ বদলে গেছি আমি; চাকরি পেয়ে নয়। আসলে আমার ভাবনাগুলো বদলে গেছে। ভেঙে গেছে আমার স্বপ্নে গড়া সেই জগত। একটা একটা করে খসে পড়ছে ইচ্ছার সব তারারা। একটু একটু করে ধসে যাচ্ছে আত্মবিশ্বাসের সেই গগনচুম্বী প্রাচীর। তবে আমি আজও থেমে নেই; হেঁটে চলেছি দিগদিগন্তে; উদ্ভ্রান্তের মতো; অজানার পাণে...। 
হয়তো, আজ আমি অসহায়; বালক ইউসুফের মতো; যাকে কুয়োতে নিক্ষেপ করেছিল তাঁর সহোদরেরা...। 
আজ আমি স্বপ্নবিহীন। মনের গহীনে লালিত স্বপ্নেরা পালিয়েছে আমায় ফেলে এই ঘন অন্ধকারের চাদরে-মোড়া সমাজ-কুয়োতে। যেভাবে ঠিকাদার ফেলে যায় রাস্তার ধারে তাঁর বিকল রোড-রোলার!

Sunday 16 September 2018

কারবালা-র কারবালা

কারবালা-র কারবালা
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

আশুরা অর্থাৎ ১০ই মুহার্‌রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন একটা দিন এ দিনেই মুসা (আ) ও তাঁর অনুসারীরা ফেরাউনের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন আর এ জন্যই মদিনার ইহুদিরা এ দিন রোযা রাখত। তা দেখে নবি (সা)-ও ৯-১০ বা ১০-১১ সিয়াম পালনের অসিয়ত করেন (বুখারি ৩২১৬, আহ্‌মাদ ২১৫৫)। কিন্তু উপমহাদেশে এ দিনটি স্মরণীয় হয়ে আছে কারবালা-কে কেন্দ্র করে; বহু ইতিহাস-গ্রন্থে যেই মর্মন্তুদ ঘটনার বাস্তব আখ্যানকে ঘিরে রেখেছে পাথর উল্টালে রক্ত বের হত-সূর্যগ্রহণ লেগেছিল-আকাশের দিগন্ত লাল হয়েগেছিল-আকাশ থেকে পাথর পড়ছিল-র মত গল্পের আগাছারা।     
৬০ হিজ্‌রিতে ইয়াযিদ পিতা কর্তৃক খলিফা নিযুক্ত হতেই শুরু হয় বিতর্ক। হুসাইন (রা)-ও তাঁকে মেনে নেননি। চলে আসেন মক্কায় (আল্‌-বিদায়াহ্‌ ওয়ান্‌-নিহায়াহ্‌ ১১/৪৭৭)। এখানে কুফা-বাসীদের বারো হাজার চিঠি, ইয়াযিদের প্রতি অসন্তোষের খবর নিয়ে তাঁর নিকট পৌঁছলে পিতৃব্য-তনয় মুস্‌লিম বিন আক্বিল-কে কুফার মনোভাব যাচাই করতে পাঠান। হুসাইন (রা)-এর খেলাফতের প্রতি লোকেদের আবেগ-উৎসাহ দেখে মুসলিম তা চিঠি মারফৎ জানালেন। আঠারো হাজার অত্যুৎসাহী লোক হানি বিন উর্‌ওয়া-র ঘরে হুসাইনের পক্ষে মুসলিমের হাতে বায়াতও করে ফেলেন (তারীখুত্‌ ত্বাবারী ৬/২২৪)। অন্যদিকে, ইয়াযিদ এ খবর পেয়ে উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদ-কে কুফার গভর্নর নিযুক্ত করেন। উবাইদুল্লাহর চক্রান্তের শিকার হয়ে চার হাজার সমর্থক নিয়ে মুসলিম তাঁর প্রাসাদ ঘেরাও করেন কিন্তু তাঁর ভাষণ শুনে ও সেনাবাহিনীর ভয়ে একে একে সকলে মুসলিমের সঙ্গ ত্যাগ করে (আল্‌-কামিল, ইব্‌নুল আসীর ৩/১৪২)। সূর্যাস্তের পর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। মৃত্যুর পূর্বে তিনি হুসাইন-কে চিঠি লেখেন- হুসাইন! পরিবার-পরিজন নিয়ে ফিরে যাও। কুফাবাসীদের আদিখ্যেতায় প্রতারিত হবে না। এরা তোমাকে মিথ্যা বলেছে। আমাকেও মিথ্যা বলেছে (মুখ্‌তাসারু সীরাতিল খুলাফা আর্‌-রাশিদীন, নাসির আস্‌-সাইফ ২৫)         
ওদিকে, প্রথম চিঠির উপর ভিত্তি করে ৮২ জন সহযাত্রী নিয়ে যিল্‌হাজ্জ মাসের ৮ তারিখে হুসাইন (রা) ইবনে আব্বাস, ইবনে উমর, ইবনে যুবাইরইবনে আম্‌র-(রা)দের বাধা-নিষেধ উপেক্ষা করে (আল্‌-বিদায়াহ্‌ ওয়ান্‌-নিহায়াহ্‌ ৮/১৬১-১৬৩) কুফার উদ্দেশ্যে রওনা দেন (ত্বাবাক্বাতু ইব্‌নে সাদ ১/৪৫১) মাঝপথে দ্বিতীয় চিঠিটি তাঁর হস্তগত হয়। চিঠি পড়ে তিনি কুফার পথ পরিহার করে ইয়াযিদের কাছে যাওয়ার জন্য সিরিয়া অভিমুখে অগ্রসর হতে থাকেন। পথিমধ্যে ইবনে যিয়াদের সেনাবাহিনী আম্‌র বিন সাদশিম্‌র বিন যিল-জাওশান ও হুসাইন বিন তামিমের নেতৃত্বে কারবালার প্রান্তরে হুসাইনের (রা) পথ আটকায় ইমাম হুসাইন (রা) তাদেরকে প্রস্তাব দেন– ১) আমাকে মদিনা ফিরে যেতে দাও। ২) অথবা আমাকে বায়াতের জন্য ইয়াযিদের কাছে যেতে দাও ৩) অথবা কোন সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যেতে দাও, সেখানে আমি  জিহাদ করবো ও সীমানা পাহারা দেব (সিয়ারু আ’লামিন্‌ নুবালা ৩/৩১১) কিন্তু তারা রাজি হয়নি। আর তাই তাদের এক সেনাপতি হুর বিন ইয়াযিদ ক্ষুব্ধ হয়ে হুসাইন রা-র পক্ষে চলে যান। ইমাম হুসাইন পরিবার-পরিজন ও মুষ্টিমেয় সহযোদ্ধাদের নিয়ে বীরত্বের সাথে লড়তে লড়তে শিম্‌রের বর্শা-বিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়েন (আল্‌-কামিল, ইবনুল আসীর ৩/১৮৩) নিহত হওয়ার পূর্বে ইরাকবাসীদের বলেন, “তোমরা কি চিঠির মাধ্যমে আমাকে এখানে আসতে আহবান   করোনিআমাকে সাহায্য করার ওয়াদা করোনিঅকল্যাণ হোক তোমাদের...!” (তারীখুত্‌ ত্বাবারী ৪/৪০১-৪০২)            
এবার প্রশ্ন- তাঁর হত্যার জন্য দায়ী কে? ইব্‌নে তাইমিয়া ও অন্যান্য ঐতিহাসিক-মুহাদ্দিসদের মতে ইয়াযিদ হত্যার আদেশ দেয়নি। সে উবাইদুল্লাহকে পাঠিয়ে ছিল হুসাইন রা-কে বায়াত গ্রহণ থেকে বিরত রাখার নিমিত্তে এই মর্মান্তিক খবর পেয়ে সে আফসোস করেছিল এবং পরিবারের জীবিত সদস্যদেরকে সসম্মানে মদিনা পাঠানোর ব্যবস্থাও করেছিল। সেই সাথে উবাইদুল্লাহকে অভিশাপও দিয়েছিল (মিন্‌হাজুস্‌ সুন্নাহ্‌ ৪/৪৭২। তবে ইবনে কাসীর, ইব্‌নুল আসীর, ইবনে খাল্‌দূন ও ইমাম যাহাবী (রাহ)-র মতে খলিফা ও শাসক হওয়ার দরুন হুসাইন (রা)-র হত্যার দায় খানিকটা হলেও তার উপর বর্তাবে।   
আমার ধারণা, ইয়াযিদের বিষয়ে নীরব থাকাই শ্রেয়। না তাকে তিরস্কার করা উচিৎ আর না তার সাফাই গাওয়া। কারণ সে এখন মৃত। নিজ কৃতকর্ম অনুযায়ী ফল পেয়ে গেছে। তাছাড়া, ৪৯ হিজ্‌রিতে কন্‌স্ট্যান্টিনোপলের যুদ্ধে তার নেতৃত্বে ইমাম হুসাইন, ইবনে আব্বাস, ইবনে উমার, ইবনে যুবাইর, আবু আইয়ুব-(রা) প্রমুখ সাহাবি শামিল হয়েছিলেন (তারীখুত্‌ ত্বাবারী ৫/২৩২)। আর এই যুদ্ধে সকল অংশগ্রহণকারীদের জন্য ক্ষমার সুসংবাদ স্বয়ং নবি (সা) প্রদান করে গেছেন (বুখারি ২৭৬৬)   
শেষে বলব, কোনো মৃত বা শহীদের জন্য পরিবার-আত্মীয়-অনুগামীদের মন খারাপ হবে, কান্না পাবে এটাই স্বাভাবিক; স্বয়ং নবি (সা)-রও এমনটাই হয়েছিল (মুস্‌লিম ৯৭৬)। তবে নাওহা-বিলাপ ইসলামে অবৈধ (বুখারি ১২৩২)। আর বিলাপকারীদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তির বিধানও (মুস্‌লিম ১৬১৩) বরং, সুন্নাহ্‌ অনুযায়ী মুহার্‌রামের ৯-১০ বা ১০-১১ সিয়াম পালন করাই বাঞ্ছনীয়।
[দৈনিক পূবের কলম, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮-তে 'হৃদয়বিদারক কারবালা' শিরোনামে প্রকাশিত]