Thursday 28 October 2021

মুহাম্মদ (সাঃ)-এর সামাজিক সংস্কারঃ কিছু কথা

 
মুহ়াম্মদ (স়াঃ)-এর সামাজিক সংস্কারঃ কিছু কথা
 
পৃথিবীতে যে কয়জন সমাজ সংস্কারকের আবির্ভাব ঘটেছে, মহানবী (সাঃ) ছিলেন তাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। তাঁর পরিচালিত সমাজের ভিত্তি ছিল সাম্য ও ভ্রাতৃত্ববোধ। সেখানে ছিল না কোন শ্রেণি ভেদাভেদ। মানবতার আদর্শে গঠিত সেই সমাজ ব্যবস্থায় ছিল পৃথিবীর যে কোন জাতির জন্য আদর্শ স্বরূপ। তিনি সকল মানুষের মধ্যকার ভেদাভেদ ও বংশ-আভিজাত্যের গৌরব দূর করেন। এক মুসলমানকে অপর মুসলমানের ভাই হিসেবে স্বীকৃতি দেন। সেই সমাজকাঠামোর মূল ভিত্তি ছিল ন্যায়বিচার। তিনি সকল প্রকার অসামাজিক কর্মকাণ্ড দূর করেন। মদ্যপান, জুয়া খেলা, হত্যা, লুটতরাজ, কন্যা শিশু হত্যা, সুদ প্রথা ও নারীর প্রতি অমর্যাদা ইত্যাদি অন্যায় কাজ দূর করেন।
 
() দাস প্রথার বিলোপ
ইসলামপূর্ব আরব সমাজে দাস প্রথার ব্যাপক প্রচলন ছিল। মহানবী (সাঃ) পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম দাসপ্রথার বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা পালনকারী। দাসদের জীবনের কোন মূল্য ছিল না। তারা ছিল তাদের প্রভূর সম্পত্তি। দাসদের উপর অমানুষিক অত্যাচার করা হত। তাদের সাথে পশুর ন্যায় আচরণ করা হত। তাদের কোন অধিকার ছিল না। ছিল না কোন সামাজিক মর্যাদা। পণ্য দ্রব্যের ন্যায় তাদের বাজারে ক্রয় বিক্রয় করা হত। মহানবী (সাঃ) সমাজে দাসদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। তিনি তাদের সাথে ভালো ব্যবহারের নির্দেশ দেন। তিনি তাদের মুক্তির প্রতি আহ্বান জানান। তিনি নিজে অসংখ্য দাসকে মুক্তি দিয়েছেন। মুসলিম সামরিক বাহিনীর অন্যতম একজন সেনাপতি ছিলেন ক্রীতদাস যায়িদ। তাঁর দেখানো পথ অনুসরণ করে তাঁর সাহাবীগণও অসংখ্য দাসদের আযাদ করে দেন। হাবসী ক্রীতদাস বিলাল (রাঃ) কে হযরত আবু বকর (রা) মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত করেন। পরবর্তীতে তিনি ইসলামের প্রথম মুয়ায্‌যিন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।
 
() ইসলামের নারীর মর্যাদা
মহানাবী (সাঃ) কর্তৃক অন্যতম সামাজিক সংস্কার ছিল সমাজে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠা। আরবের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা নিগৃহীত হতো। কন্যা সন্তানের পিতৃত্বকে আরবরা অভিশাপ হিসেব মনে করত। নারীরা ছিল ভোগ-বিলাসে উপকরণ। তাদেরকে পণ্য-দ্রব্যের মত বেচা-কেনা করা হত। তাদেরকে পৈত্রিক সম্পত্তি ও স্বামীর সম্পত্তি হতে বঞ্চিত করা হতো। সমাজে তাদের কোন মর্যাদা ছিল না। এমতাবস্থায় মহানবী (সাঃ) ঘোষণা করলেন মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহস্ততিনি নারীকে পুরুষের সঙ্গিনী ও সহযাত্রী রুপে ঘোষণা করেন। তিনি নারীদের পৈতৃক ও স্বামীর সম্পত্তির অংশীদার হিসেবে ঘোষণা করেন। মূলত মহানবী (সাঃ) এর একক প্রচেষ্টায় সমাজে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হল। নারীরা সম্মান ও মর্যাদা অধিকারী হিসেবে সমাজে আত্মপ্রকাশ করলেন।
 
() সাম্যের ভিত্তিতে সমাজ প্রতিষ্ঠা
পৃথিবীর ইতিহাসে মহানবী (সাঃ) সর্বপ্রথম সাম্যের ভিত্তিতে সমাজ গঠন করেন। যেখানে ছিল না বংশগত, জন্মগত কিংবা ভাষাগত পার্থক্যের ভিত্তিতে মানুষের ভেদাভেদ। তিনিই ঘোষণা করেন যে, প্রত্যেক মুসলমান ভাই ভাই। মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নেই। এই আদর্শের ভিত্তিতে তিনি সমাজে মানুষের মধ্যকার বৈষম্য ও শ্রেণি ভেদাভেদ দূর করতে সক্ষম হন।
 
() তাওহীদের আদর্শে সমাজ প্রতিষ্ঠা
সমাজে প্রচলিত নানা অনাচার, ধর্মীয় গোঁড়ামি, পৌত্তলিকতা, কুসংস্কারকে তিনি সমাজ হতে মূলোৎপাটন করেন। তিনি আল্লাহর একত্ববাদের ভিত্তিতে সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। সকল ক্ষমতার উৎস একমাত্র মহান আল্লহা তায়ালা- এই আদর্শকে কেন্দ্র করে তিনি সকল সামাজিক কর্মকাণ্ড ও সমাজ ব্যবস্থা পরিচালিত করেন।
 
() ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সৃষ্টি
মহানবী (সাঃ) সমাজে সাম্যের বাণী প্রতিষ্ঠা করেন। সকল মানষকে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করেন। মানবতাই ছিল তাঁর সমাজ ব্যবস্থার মূল ভিত্তি, যা পৃথিবীর ইতিহাসে এক নজীরবিহীন দৃষ্টান্ত। মিথ্যা অহমিকা, বংশীয় আভিজাত্য ও কুল মর্যাদা সমাজ হতে তিরোহিত করেন। মানবতার মহান আদর্শে সমাজ প্রতিষ্ঠিত করেন।
 
() শান্তিময় সমাজ
প্রাক-ইসলামী যুগের আরব সমাজে সর্বদা গোত্রে গোত্রে দ্বন্দ্ব-সংঘাত লেগেই থাকত। অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কারণে ভয়াবহ যুদ্ধ লেগে যেত যা বেশ কয়েক বছর ধরে নিরন্তর চলতে থাকত, রক্তপাত ছিল অতি সাধারণ ঘটনা। মহানবী (সাঃ) মানব জাতিকে সংঘাত ও রক্তপাতহীন একটি সমাজ উপহার দেন। তিনি হিলফুল ফুযুলবা শান্তিসংঘ নামে একটি সংস্থা গড়ে তোলেন। হিজরতের পরে তিনি সকল জাতি-ধর্মের সমন্বয়ের মদীনা সনদ তৈরি করেন।
 
() ভিক্ষাবৃত্তি ও অশ্লীলতা উচ্ছেদ
মহানবী (সাঃ) সমাজ হতে ভিক্ষাবৃত্তি দূর করে। কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহে উৎসাহিত করেন। অনাচার, ব্যভিচার, মদ, জুয়া, পাপাচার ও চরিত্রকে কলুষিত করে এমন সব কর্মকাণ্ডকে সমাজ হতে উচ্ছেদ করেন।
 
(জ) নিস্কলুষ সমাজ গঠন
মহানবী (সাঃ) মসাজ হতে আর্থ-সামাজিক অন্যায়, প্রতারণা, দুর্নীতি, মিথ্যাচার, অসাধুতা ইত্যাদি দূরীভূত করেন। মানবকল্যাণকামী সুন্দর একটি সমাজ কাঠামো বিনির্মাণ করেন।
 
(ঝ) জ্ঞানার্জনে উৎসাহ
মহানবী (সাঃ) ঘোষণা করলেন যে, “জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক নর-নারীর জন্য ফরয।তিনি সমাজে শিক্ষা ও জ্ঞান বিস্তারে বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। তিনি শিক্ষা ও জ্ঞানের গুরুত্বকে সকলের সামনে তুলে ধরেন। তিনি বলেন যে, যারা জানে ও যারা জানে না, উভয়ে সমান নয়।
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ধর্মীয় সংস্কারঃ সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা


মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ধর্মীয় সংস্কারঃ সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
 
মহানবী (সাঃ) ছিলেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট ধর্ম সংস্কারক। তাঁর আবির্ভাবের সময় আরব ও বহির্বিশ্বে প্রকৃত ধর্ম বলতে কিছুই ছিল না। সর্বত্র দেব-দেবী, জড় ও প্রকৃতির পূজা হতো। ধর্মের নামে অধর্মের চর্চাই হতো বেশি। এমন এক ধর্মহীন সমাজে মহান আল্লাহর রহমত হিসেবে মুহাম্মদ (সাঃ) আবির্ভূত হন ইসলামের শান্তির বাণী নিয়ে।
 
(ক) তাওহীদের বাণী প্রতিষ্ঠাঃ
মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লহর প্রতিনিধি হিসেবে আগমন করেন। তিনি এক আল্লাহর বাণী প্রচার করেন তিনি আল্লাহর একত্ববাদের প্রতি আহ্বান জানান, তিনি ঘোষণা করেন, “আল্লাহর ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই, মুহাম্মদ (সাঃ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল
 
(খ) পৌত্তলিকতার অবসানঃ
ইসলাম আগমনের পূর্বে আরববাসী ছিল পৌত্তলিকতায় আকন্ঠ নিমজ্জিত। তারা পবিত্র কাবাগৃহে ৩৬০ টি মূর্তি স্থাপন করেছিল। তারা বিভিন্ন জড় পদার্থ ও প্রাকৃতিক শক্তিকে উপাসনা করত। মুহাম্মদ (সাঃ) অন্ধকারে নিমজ্জিত সমাজে আল্লাহর একত্ববাদের কথা শোনান। তাদের মাঝে তাওহীদের (একেশ্বরবাদ) বীজ বপন করেন। ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেন।
 
(গ) আল্লাহর সার্বভৌমত্বঃ
আল্লাহ সকল ক্ষমতার অধিকারী- তিনি সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, রক্ষাকর্তা, রিযিকদাতা, আইনদাতা এই সার্বভৌমত্বের বিশ্বাস মহানবী (সাঃ) প্রচার করেন। তিনি ঘোষণা করেন, “সার্বভৌমত্বের অধিকার একমাত্র আল্লাহর।তিনি আরো বলেন, “আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কোন শরীক নেই।
 
(ঘ) পরকালের ধারণাঃ
ইসলাম পূর্ব যুগের আরবগণের মৃত্যুর পরবর্তী জীবন, পুনরুত্থান দিবস, আখিরাত, জান্নাত, জাহান্নাম সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না। মহানবী (সাঃ) তাদের মধ্যে আল্লাহর বাণী প্রচার করলেন। তিনি বললেন, ‘এই দুনিয়ার জীবনই শেষ নয়। এই পৃথিবী একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে। মৃত্যুর পর সকলের কৃতকর্মের হিসাব নেওয়া হবে
 
(ঙ) পূর্ববর্তী নবী-রাসূলের উপর ঈমানঃ
মহানবী (সাঃ) পূর্ববর্তী নবী-রাসূলদের উপর ঈমান আনার আহবান জানান। তারা সকলেই এক আল্লাহর বাণী প্রচার করে গেছেন। তাই আল্লাহর উপর ঈমান আনতে হলে পূর্ববর্তী নবী-রাসূলের প্রতি ঈমান আনা আবশ্যক।
 
(চ) আল্লাহর ইবাদতে নিযুক্তঃ
মহানবী (সাঃ) মানব জাতিকে এক আল্লাহর ইবাদতে নিযুক্ত হতে আহবান জানালেন। তিনি প্রচার করলেন যে, মহান আল্লাহ একমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্যই মানব জাতিকে সৃষ্টি করেছেন। জড় উপাসনা, পৌত্তলিকতা ও মিথ্যা ধর্ম বিশ্বাস সমাজ হতে তিরোহিত করে তিনি এক আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহ্বান জানান।
 
(ছ) শরীয়তের মূলনীতির শিক্ষাঃ
মহানবী (সাঃ) ইসলামী শরীয়তের ৫ টি প্রধান স্তম্ভ- ঈমান, সালাত, সাওম, জজ্জ্ব ও যাকাত সম্পর্কে শিক্ষা দেন। শরীয়তের মূলনীতিকে তিনি বিশ্ববাসীর মধ্যে ছড়িয়ে দেন। যা বিশ্ববাসীকে আলোর পথে চলতে সাহায্য করে।
 
(জ) সালাত, সাওম, হজ্জ ও যাকাতঃ
মহানবী (সাঃ) আল্লাহর নির্দেশ অনুসারে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের প্রতি আহ্বান জানান। রমযানের ৩০ দিন রোযা রাখা, অবস্থা-সম্পন্নদের সঞ্চিত সম্পদকে পবিত্র করার জন্য যাকাত প্রদান ও সুস্থ সামর্থ্যবানকে হজ্জ্ব করার প্রতি আহ্বান জানান। সালাত আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করে। সাওম বা রোযা জাহান্নামের আগুন হতে রক্ষা করে, যাকাত সম্পদের পবিত্রতা বিধান করে এবং সমাজে ধনী দরিদ্রএর পার্থক্য ঘোচাতে সাহায্য করে এবং হজ্জ্ব মানুষের সকল পাপ হতে পবিত্র করে তোলে। মহানবনী (সাঃ) মানব জাতির মাঝে শরীয়তের এই মৌলিক আদর্শকে তুলে ধরেছেন।
 
(ঝ) কুরআন-হাদীসঃ
মহানবী (সাঃ) মনাবজাতির সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য কুরআন ও হাদীসকে রেখে গেছেন। কুরআন আল্লাহর বাণী। ওপর দিকে মহানবী (সাঃ) এর কথা, দৃষ্টান্ত ও মৌন সম্মতি নিয়ে হাদীস রচিত হয়েছে। এ দুটি গ্রন্থ মাওনবজাতির ইহকালীন জীবনের পথ নির্দেশক ও পরলৌকিক মুক্তির পাথেয়। যা মানব জাতিকে যুগে যুগে সঠিক পথে পরিচালিত করে চলেছে।
 
(ঞ) ইসলাম মানবজাতির জীবনদর্শনঃ
মহানবী (সাঃ) ইসলামকে মানব জাতির পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। এটিই হচ্ছে মানবজাতির একমাত্র মুক্তির সনদ। ব্যক্তি জীবন, সামাজিক জীবন, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবন, অর্থনৈতিক, নৈতিক ও দর্শন সব কিছুর পথ নির্দেশের এক চূড়ান্ত দলিল হচ্ছে ইসলাম। যা মহানবী (সাঃ) এর মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করেছে। 
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

Wednesday 27 October 2021

প্রাক-ইসলামি যুগে আরবদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা


 
প্রাক্‌-ইসলামি যুগে আরবদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থা   
 
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরব ভূখণ্ডে সামাজিক ও ধর্মীয় জীবন চরম অধঃপাতে ছিল। মক্কা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে পৌত্তলিক আরবরা ছাড়াও ইহুদী, খ্রিস্টান ও হানীফ (অর্থাৎ এক ঈশ্বরে বিশ্বাসী) সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করতো। তাদের অধিকাংশই সবসময় মদ, ব্যভিচার, জুয়া, নারী ইত্যাদি নিয়ে মত্ত থাকতো। অসংখ্য দেবদেবীর পূজা করতো। পবিত্র কাবা ঘরে তিন শষাটের অধিক মূর্তি রাখা ছিল। সহজ করে বলতে গেলে তারা আদ্যোপান্ত নানা রকমের পাপাচারিতায় ডুবে ছিল। আর তাই সেখানে এরকম নৈতিকতার অবক্ষয় রোধের জন্য একজন যোগ্য সংস্কারকের আবির্ভাব অত্যাবশক হয়ে পড়েছিল।
 
সামাজিক অবস্থাঃ
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবদের মধ্যে কোনো গুনাগুণ ছিল না, এ কথা সম্পূর্ণ রূপে সত্য ও স্বীকার্য নয়। তারা সাহসিকতা, আতিথেয়তা, কাব্যমোদী, সারল্য প্রভৃতি গুণে গুণান্বিত ছিল। কিন্তু তাদের চরিত্রে নীতিহীনতা ছিল প্রবল। আর তাতেই তাদের সমস্ত গুণাবলী ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। যা মানব সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারাকে প্রতিহত করেছিল। নিম্নে তাদের সামাজিক অবস্থা সংক্ষেপে তুলে ধরা হল— 
 
() নীতিবোধের অভাবঃ পাপাচার, কুসংস্কার, অন্যায়-অবিচার, মদ, জুয়া, নারী, যুদ্ধ-বিগ্রহের কালোমেঘে প্রাক-ইসলামী যুগে আরবের আকাশ আছন্ন হয়ে গিয়েছিল। নর্তকী ছাড়া তাদের উৎসব কল্পনা করা যেতনা। আদিম প্রকৃতির ধর্মীয় রীতি-নীতি অনুসরণের ফলে তাদের মধ্যে নীতি-বোধ জাগ্রতা হতে পারেনি।
 
() নারীর অবস্থাঃ ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে আরবে নারীর কোনো মর্যাদা ছিল না। তারা আস্থাবর ও ভোগবিলাসের সামগ্রী রূপে গণ্য হতো। যে-কোনো পুরুষ একাধিক স্ত্রী গ্রহণ ও বর্জন করতে পারতো। সৎ মা ও খালাকে পত্মীরূপে বরণ করতে তাদের দ্বিধাবোধ ছিলনা। আল্লাহ্‌ পাক পবিত্র কোরআনে বলেনঃ
"ولا تنكحوا ما نكح أباؤكم من النساء إلا ما قد سلف. إنه كان فاحشة و مقتا. و سأء سبيلا.               
 
() কন্যা সন্তানদের জীবন্ত সমাধীঃ ইসলাম আবির্ভাবের পূর্বে আরবে কন্যা-সন্তানের জন্মকে লজ্জা অভিশপ্ত ও দূর্ভোগের কারণ বলে মনে  করা হতো। কন্য-সন্তান জন্ম গ্রহণ করেছে শুনলে পিতার মুখ দুঃখে, ক্ষোভে বিবর্ণ হয়ে যেত। যেমন মহান আল্লাহ তার চিত্র অঙ্কন করে বলেছেন- 
 و إذا بشر أحدهم بالأنثى ظل وجهه مسودا و هو كظيم 

কখনো কখনো কন্যার হৃদয় বিদারক চিৎকার উপেক্ষা করে পিতা তাঁকে জীবন্ত কবর দিতে কুণ্ঠাবোধ করতো না। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ্‌ বলেনঃ
  و إذا المؤودة سئلت بأي ذنب قتلت
             
() ব্যাভিচার ও অনাচারঃ সে যুগে ব্যাভিচা-অনাচার ও নৈতিক অবনতি আরব সমাজকে কলুষিত করে তুলেছিল। লম্পট আরবরা পিতার মৃত্যু হলে বিমাতাকে স্ত্রী রূপে গ্রহণ করতো। বিবাহিতা রমণীরা সন্তান লাভের জন্য স্বামীর নিকট পর পুরুষের সাথে ব্যাভিচারের অনুমতি পেত। একাধিক স্ত্রী থাকা সত্বেও অনেকে বহু প্রনয়িনীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারতো।
 
() দাস-দাসীদের অবস্থাঃ আরবদের মধ্যে ক্রীতদাস প্রথার প্রচলন ছিল। পন্যদ্রব্যের ন্যায় হাটে বাজারে দাস-দাসী ক্রয়বিক্রয় হতো। তাদের সামাজিক অধিকার ও ব্যাক্তি স্বাধীনতা ছিল না। দাস-দাসীদের জীবন ও মৃত্যু অনেকটা প্রভুর মর্জির উপর নির্ভরশীল ছিল। দাস-দাসীর সন্তানরাও মনিবের কতৃত্বাধীন থাকত।
 
ধর্মীয় অবস্থাঃ
ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবের ধর্মীয় অবস্থা ছিল তমসাচ্ছন্ন। তারা বহু দেব-দেবীর পূজা-উপাসনা করতো। সৌর-জগতের পূজা করতো। ভবিষ্যত ও ভাগ্য গণনা করতো। সেখানে অনেক সম্প্রদায়ের লোক বাস করতো। তাদের ধর্ম বিশ্বাস ছিল আদীম প্রকৃতির। তারা ছিল জড়বাদী। তাদের ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
 
() ইহুদী ও খৃষ্টান সম্প্রদায়ঃ ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বে আরবে পৌত্তলিক আরবরা ছাড়া ইহুদী ও খৃষ্টান সম্প্রদায়ের লোক বাস করতো। ইহুদীরা হযরত মূসা (আঃ)-এর উম্মত হওয়া সত্বেও তারা নবীর দেওয়া শিক্ষা ভুলে ধর্মীয় ব্যাপার নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছিল। অজ্ঞতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন ইহুদীরা জহোবা-কে পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা ও নিয়ন্ত্রনকর্তা হিসেবে গণ্য করতো। খৃষ্টানরা ত্রিতত্ত্ব ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিল এবং মূর্তী পূজা করতো। 
 
() পৌত্তলিকাঃ সে যুগে আরবীয়রা বিভিন্ন দেব-দেবীতে বিশ্বাসী ছিল। লাত, মানাহ্‌, উজ্জাহ্‌-কে আরবরা আল্লাহ্‌র তিনজন কন্যা বলে মনে করতো। আল-উজ্জাহ্‌ মক্কা বাসীদের নিকট সর্বাধিক সমাদৃত ছিল। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক উইলিয়াম মূর বলেনঃ অনন্তকাল হতে মক্কা এবং সমগ্র উপদ্বীপ আধ্যাত্মিক অসভ্যত্যায় নিমজ্জিত ছিল।
 
() কাবাগৃহঃ দেব-দেবীর পূজার্চনার জন্য আরব দেশে অসংখ্য মন্দির ছিল। পবিত্র কাবাগৃহে ৩৬০ টি দেব-দেবীর মূর্তি রাখা হয়েছিল। অধিকাংশ আরব ঐতিহাসিকদের মতে এ মূর্তি গুলির মধ্যে হযরত ঈসা (আঃ) ও মার্‌ইয়াম (আঃ)-এর  মূর্তিও ছিল”। আরবরা এই কাবাগৃহকে তাদের পবিত্র উপাসনালয়/ মন্দির বলে মনে করতো। এখানে রক্ষিত দেব-দেবীর মূর্তি গুলির মধ্যে সর্ব প্রধান ছিল হুবল’। ভবিষ্যৎ গণনা করার জন্য এ মূর্তির আশেপাশে তির রাখা হতো।
 
() সৌরজগতের পূজাঃ মূর্তি পূজা ছাড়াও তারা চন্দ্র, সূর্য, তারকা ও বায়ুর পূজা করতো। তারা প্রস্তুর খণ্ড, বৃক্ষ ও বালুর পূজা করতো। আল্লহ এক অদ্বিতীয় তাঁর জন্ম মৃত্যু নেই, শেষ বিচারের দিন সকলকেই জবাবদিহি করতে হবে- এ সকল কথায় তাদের কোনো বিশ্বাস ছিলনা।
 
() হানীফ সম্প্রদায়ঃ ধর্মীয় কু-সংস্কার ও অধঃপতনের যুগেও আরবে এক শ্রেণীর লোক একেশ্বরবাদে বিশ্বাসী ছিল। এরা হল হানীফ সম্প্রদায়। তারা পৌত্তলিকতার বিরোধিতা করে এবং মানুষকে সঠিক পথের নির্দেশ দেয়। ওয়ারাকা বিন নাওফাল, আবু-আনাস, যায়েদ-বিন আসর প্রমুখ ছিলেন এ সম্প্রদায়ের বিশেষ লোক। এরা সংখ্যায় কম থাকার জন্য আরবের উপর তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি।
 
আরবদের রাজনৈতিক অবস্থাঃ
প্রাক্‌ ইসলামি যুগে আরবদের রাজনৈতিক অবস্থাও ছিল চরম অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলায় ভরা। না ছিল কোনো কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থা, আর না কোনো সংবিধান। মনগড়া মতবাদের ছায়ায় আদিম যুগের ধাঁচে গোত্রীয় শাসন ব্যবস্থা জারি ছিল।
 
() সাম্রাজ্যবাদের শিকারঃ কোনো কেন্দ্রীয় শাসকের নিয়ন্ত্রণে না থাকায় তৎকালীন আরব দুটি সাম্রাজ্যবাদী মহাশক্তি রোমান ও পারস্যের লোলুপ দৃষ্টির শিকার ছিল। উত্তর আরব রোমানদের এবং দক্ষিণ আরব পারসিকদের কর্তৃত্ব বলয়ে ছিল। আবিসিনীয় আগ্রাসনভীতিও আরবকে সর্বদা শঙ্কিত রাখতো। ইয়েমেন জবরদখলকারী আবিসিনিয়ার খ্রিস্টান শাসক আবরাহার ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে বিশাল হস্তিবাহিনী নিয়ে কাবা ঘর আক্রমণ তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তবে উত্তর ও দক্ষিণ আরব ব্যতীত সমগ্র আরবদেশই স্বাধীন ভূমি হিসেবে পরিচিত ছিল।
 
() গোত্রতান্ত্রিক ব্যবস্থাঃ প্রাক্‌ ইসলামি এবং মহানবী (সাঃ)-এর যুগে আরবের রাজনৈতিক অঙ্গনে কেন্দ্রীয় সরকারের অভাবে গোত্রতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু ছিল। আরবরা ছিল বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত। আরবিতে গোত্রকে কাবিলাবলা হয়। প্রতিটি গোত্র বংশ হিসেবে ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত ছিল। গোত্রের বিভক্ত অংশগুলোকে একত্রে কাওমবা জাতি বলা হতো। কখনো কখনো কতিপয় গোত্র মিলে সহাবস্থানের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ চুক্তি সম্পাদন করতো। এসব চুক্তিকে আল্‌-আহ্‌লাফবা মৈত্রী চুক্তি বলা হতো। আরবদের সমাজ জীবনে গোত্রই ছিল একমাত্র নিরাপত্তার চাবিকাঠি। এজন্য গোত্রভুক্ত হয়ে বসবাস করা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। স্বগোত্রীয় সদস্যদের প্রতি তারা যেমন সহানুভূতিশীল ও বন্ধুভাবাপন্ন ছিল, তেমনই শত্রু গোত্রের প্রতি তারা চরম শত্রুতা পোষণ করতো।
 
নেতা নির্বাচন পদ্ধতিঃ আরবের গোত্রভিত্তিক শাসনব্যবস্থায় নেতা ছিলেন গোত্রীয় প্রধান। প্রত্যেক গৈত্রে শায়েখনামে একজন দলপতি ছিলেন। বয়স, বিচার, বুদ্ধি, সাহস, আর্থিক অবস্থা, অভিজ্ঞতা যাচাই-বাছাই করে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে শায়েখনির্বাচিত হতেন। আবার নির্বাচনের মাধ্যমেই শায়েখ পরিবর্তন করা হতো। এজন্য তার মেয়াদকাল সম্পূর্ণরূপে নির্বাচকমণ্ডলীর সন্তুষ্টির ওপর নির্ভরশীল ছিল। আরবদের শায়েখের প্রতি আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত ও সর্বজনস্বীকৃত বিষয়। শায়েখের যে কোনো নির্দেশ পালনে তারা প্রাণপণ চেষ্টা করতো।
 
() গোত্রীয় কলহ ও যুদ্ধঃ সে যুগে ছোটখাটো বিষয় নিয়ে গোত্রীয় কলহের সূত্রপাত হতো। আর সেই কলহের ধারাবাহিকতা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধবিগ্রহের মধ্য দিয়ে বংশানুক্রমে চলতো। যেমন বানু বাক্‌রের সাথে বানু তাগ্‌লিবের দাহিস ওয়াল্‌ গাব্‌রাযুদ্ধ চল্লিশ বছর স্থায়ী হয়েছিল। মদিনার আওস ও খায্‌রাজের মধ্যে বুয়াসযুদ্ধ এবং কুরায়েশ ও হাওয়াযিনের মধ্যে ফিজারযুদ্ধ দীর্ঘকাল ধরে চলেছিল। আর এসব যুদ্ধ সামান্য কারণে, যেমন জলের নহরের ব্যবহার, জীবজন্তুর তৃণলতা ভক্ষণ, গবাদি পশু পালন প্রভৃতি বিষয়কে কেন্দ্র করে এক গোত্র ওপর গোত্রের সাথে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হতো।
 
() রাজনৈতিক ঐক্য ও স্থিতিশীলতার অভাবঃ  সে যুগে আরবদের মাঝে রাজনৈতিক ঐক্য বলতে কিছুই ছিল না। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা ছিল তাদের নিত্য সঙ্গী। তাদের রাজনৈতিক জীবন আদিম যুগের মতোই ছিল। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতাবোধ মোটেই ছিল না। আর স্থিতিশীলতার অভাবে তাদের প্রশাসন পদ্ধতি সহজেই পরিবর্তন হয়ে যেতো। এবং সাড়া বছর ধরে সবাইকে মানসিক অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতার মধ্যে থাকতে হতো।
 
() মন্ত্রণা পরিষদঃ তবে তৎকালীন মক্কায় আল্‌-মালানামে একটি মন্ত্রণা পরিষদ গড়ে উঠেছিল। এই পরিষদ মক্কা ও শহরতলীর শাসনব্যবস্থা তদারক করতো। বেদুইনদের মতো মৈত্রী জোট গঠন, বৈদেশিক বাণিজ্যিক ও সামরিক চুক্তি সম্পাদনেও এই মন্ত্রণা পরিষদ সক্রিয় ভূমিকা রাখতো।
 
() সংবিধানের অভাবঃ সংবিধান যে কোনো রাষ্ট্র বা সংস্থা ও সংগঠনের মূল চালিকাশক্তি। নিয়মতান্ত্রিক কোনো দেশ বা সংগঠন গঠনতন্ত্র বা সংবিধান ছাড়া চলতে পারে না। জাহেলি যুগের আরবদের নিকট দেশ পরিচালনার উপযোগী কোনো সংবিধান ছিল না বলে তারা সুষ্ঠু কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করতে পারতো না।
 
() ‘জোর যার মুলুক তারনীতিঃ কোনো সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা গড়ে না ওঠার ফলে জাহেলি যুগে আরব সমাজের মূল নীতি হয়ে উঠেছিল জোর যার মুলুক তার’। আর তার ফলে সন্ত্রাসবাদ, অসহিষ্ণুতা অ গোত্রীয় যুদ্ধ ইত্যাদি পন্থায় আরবরা একে অপরের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতো।
 
() গোত্রীয় জোটঃ পবিত্র নগরী মক্কায় অবস্থিত কাবা শরীফের কারণে মক্কা ও মক্কাবাসীদের সমগ্র আরবে অপরিসীম গুরুত্ব ছিল। এ কারণেই কোরায়েশ গোত্রের বিভিন্ন শাখা প্রশাখা এবং পার্শ্ববর্তী আরও কতিপয় গোত্রের মধ্যে একটি মৈত্রীজোট বা গোত্র-সংঘ রূপ লাভ করেছিল। এই জোটের নেতাদের পরামর্শ অনুযায়ী একটি আন্তঃগোত্রীয় শাসনব্যবস্থাও গড়ে উঠেছিল।
 
() মক্কার নগর-রাষ্ট্রের মর্যাদাঃ আরবে কোনো কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা কিংবা সংগঠিত কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠন না থাকলেও ধর্মীয় এবং বাণিজ্যিক গুরুত্বের কারণে মক্কায় অগ্রসর রাজনীতি ও নগর রাষ্ট্রের উন্মেষ হয়েছিল। মক্কা নগর-রাষ্ট্রের পরিচালনার মূলে ছিল কোরায়েশ গোত্রপতিদের সমন্বয়ে গঠিত মন্ত্রণা পরিষদ। এই পরিষদ মক্কা নগররাষ্ট্রের প্রশাসন ব্যবস্থার তদারক করতো। এছাড়াও বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বেদুইনদের সাথে মৈত্রীজোট গঠন করা এই পরিষদের কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
 
() মক্কার প্রশাসনিক ব্যবস্থাঃ কোরায়েশদের একজন পূর্বপুরুষ কুসাই৪৮০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর প্রাক্কালে স্বীয় পুত্র আব্দুদ্‌ দারকে মক্কার ওয়ালী বা গভর্নর নিযুক্ত করেন। তিনি তৎকালীন মক্কার শাসনব্যবস্থা পাঁচ ভাগে বিভক্ত করেন। যথা— () হিজাবাঃ কাবা ঘর আবৃতকরণ () সিকায়াঃ যম্‌যম্‌ কূপ থেকে হাজীদের জন্য জল বণ্টন () রিফাদাঃ হজ্জ পালনকারীদের পবিত্র মক্কা নগরীতে সাদর সম্ভাষণ () নাদ্‌ওয়াঃ কার্যকরী কমিটির সদস্যপদ () লিওয়াঃ পতাকা উত্তোলন করা।
 
() দারুন্‌ নাদ্‌ওয়াহ্ঃ কুসাই কাবা ঘর সংস্কার ও মন্ত্রণা পরিষদ বিভক্তকরণের পাশাপাশি কাবা ঘরের পাশে আরেকটি প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন, যার নামকরণ করা হয় দারুন্‌ নাদ্‌ওয়াহ্‌বা মন্ত্রণা পরিষদ। দারুন্‌ নাদ্‌ওয়ায় বসে নগরের অভিজাতবর্গ যে কোনো সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন। কিন্তু নগর ও কাবা ঘর বিষয়ক কার্যক্রম, যেগুলোর সাথে সর্বসাধারণের সংশ্লিষ্টতা ছিল, সেগুলোর জন্য সকল নাগরিক কাবা প্রাঙ্গণে সাধারণ সভা করে সিদ্ধান্ত নিতেন।
 
অর্থনৈতিক অবস্থাঃ
আরবের ভৌগোলিক অবস্থা ছিল অত্যন্ত প্রতিকূল। আরব উপদ্বীপের জমি মরুময় ও অনুর্বর হওয়ায় তা কৃষিকাজের সম্পূর্ণ অনুপযোগী ছিল। সামান্য যে খাদ্যদ্রব্য উৎপন্ন হতো প্রয়োজন তুলনায় তা খুবই নগণ্য ছিল। তাই আরববাসীদের সর্বদা জীবন সংগ্রামে নিয়োজিত থাকতে হতো। মরুবাসী বেদুইনরা ব্যবসাবাণিজ্য, শিল্প কারুকার্য কিংবা ভূমিকর্ষণ তাদের মর্যাদা হানিকর বলে মনে করতো। এজন্য তারা পশুপালন, শিকার ও দস্যুবৃত্তিকে জীবিকা নির্বাহের পন্থা হিসেবে বেছে নেয়। আরবের কয়েকটি অর্থনৈতিক শ্রেণী হলো
 
(ক) গরিব যাযাবরঃ গরিব যাযাবর আরববাসীর আর্থিক অবস্থা ছিল সবচেয়ে বেশি শোচনীয়। পশুচারণ ও লুণ্ঠন করে তারা জীবিকা নির্বাহ করতো। যাযাবররা এতই হত দরিদ্র ছিল যে, দিন এনে দিন খেত। ১০০০-এর বেশি সংখ্যাজ্ঞান তাদের ছিল না।
 
(খ) কুসীদজীবী ইহুদিঃ তৎকালে আরবে ধনী বণিকশ্রেণি ইহুদিরা সুদের ব্যবসা করতো। তারা কখনো কখনো শতকরা একশ, দেড় শ বা দুশ গুণ পর্যন্ত সুদ নিত। সুদী করাবারের নিয়মাবলি এতই জঘন্যতম ছিল যে, ঋণগ্রহীতা অনেক সময় সর্বস্বান্ত হয়ে যেত। চক্রবৃদ্ধি হাতের সুদের প্রচলন থাকায় গ্রহীতার পক্ষে কোনো দিনই ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হতো না। মহাজন সুদের টাকার বিনিময় স্বরূপ ঋণগ্রহীতার ঘরবাড়ি, স্ত্রী এমনকি স্বয়ং খাতককেই তার দাস হিসেবে করায়ত্ত করতো।
 
(গ) কারিগর শ্রেণিঃ পৌত্তলিক আরবে কারিগর হিসেবে পরিচিত একশ্রেণির পেশাজীবী মানুষ ছিল। তারা হচ্ছে মূর্তি নির্মাতা শ্রেণি। আরবদের পূজ্য সকল মূর্তি এরাই নির্মাণ করতো। সমাজে এদের বেশ সম্মান ছিল। পৌত্তলিকদের ছাড়া ইহুদি, খ্রিষ্টানরাও মূর্তি তৈরি করতো। কাজেই তারা আর্থিকভাবে সচ্ছল এবং সামাজিক মর্যাদার অধিকারী ছিল।
 
(ঘ) শহরকেন্দ্রিক ব্যবসায়ীঃ শহরবাসী আরবগণ ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতো। প্রাক ইসলামী যুগে মক্কা বহির্বাণিজ্যের প্রধান কেন্দ্র ছিল। এ কেন্দ্র উত্তর ও দক্ষিণ আরবের পথে বিদেশের সাথে বাণিজ্যিক লেনদেনে বিপুল অর্থ উপার্জন করতো। মক্কা ও মদিনার সম্পদ সমৃদ্ধিতে বৈদেশিক বাণিজ্যের অবদানই সর্বাধিক। রাসুলে করীম (সাঃ)-এর প্রথমা স্ত্রী বিবি খাদিজাতুল কুবরা (রাঃ) এ সময়কার মর্যাদাসম্পন্ন ব্যবসায়ী ছিলেন।
 
(ঙ) মক্কাকেন্দ্রিক ব্যবসাঃ প্রাকইসলাম যুগে হিজাযের প্রধান তিনটি নগরী- মক্কা, মদিনা ও ত্বায়িফ খুবই সমৃদ্ধিশালী ছিল। দক্ষিণ হিজাযের নিম্নভুমিতে লোহিত সাগর থেকে প্রায় ৪৮ মাইল দূরে অবস্থিত মক্কা নগরী ইসলামের আবির্ভাবের পূর্বেই অন্যতম প্রধান ধর্মীয় ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল। কাবা শরীফের ধর্মীয় গুরুত্ব, উকায মেলা ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের জন্য মক্কা নগরী যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিল। মক্কার প্রায় ২০০ মাইল উত্তরে মদিনা শহর অবস্থিত। মদিনার সাথে ইয়েমেন ও সিরিয়ার বাণিজ্যপথ সংযুক্ত ছিল।
 
(চ) তায়েফ কেন্দ্রিক অর্থব্যবস্থাঃ সে সময় ত্বায়িফ ব্যবসায় বাণিজ্যে যথেষ্ট উন্নতি লাভ করেন। অনুকূল প্রাকৃতিক পরিবেশের কারণে ত্বায়িফে উৎপাদিত কৃষিজাত পণ্য বিশ্বের বাজারে প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি হতো। মক্কার প্রায় ২০০ মাইল উত্তরে অবস্থিত মদিনা ইয়েমেন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত প্রসারিত বাণিজ্যপতের সাথে সংযুক্ত ছিল। ভূমির উর্বরতার জন্য মদিনায় প্রচুর ফসল উৎপন্ন হতো। সে সময় এখানকার খেজুর একটি উল্লেখযোগ্য অর্থকারী ফসল হিসেব সুপরিচিত ছিল।
           
সাংস্কৃতিক অবস্থা
প্রাক্‌ ইসলাম যুগে আরবে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাপদ্ধতি অথবা সুরুচিপূর্ণ মার্জিত জীবনধারা গড়ে ওঠেনি। মক্কা, মদিনা ও অন্যান্য কয়েকটি বর্ধিষ্ণু শহরের অধিবাসীরা ব্যতীত আরবের অধিকাংশ লোকই মূর্খ ও নিরক্ষর ছিল। এতদসত্ত্বেও অসাধারণ স্মৃতিশক্তিবলে তারা ইসলামপূর্ব যুগের প্রচুর লোকগাথা, প্রবাদ, লোকশ্রুতি সংরক্ষণে সক্ষম হয়। তাদের সাধারণত তিনভাগে ভাগ করা যায়। খতিব (বক্তা), শায়ির (কবি) এবং নাস্‌সাব (বিভিন্ন গোত্রের বংশ পরিচয় বা কুলজী বিশারদ।)
 
(ক) প্রবাদ বাক্যঃ প্রবাদ বাক্য ছিল আরব সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান দিক। বিভিন্ন বিষয়ের ওপর অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের বাস্তব জ্ঞানের পরিস্ফুটন ঘটেছিল এ সকল প্রবাদ বাক্যের মাধ্যমে। প্রবাদ ও গদ্য রচনা গীতিকাব্যের তুলনায় যদিও অপ্রতুল ছিল, তা সত্ত্বেও বিখ্যাত পণ্ডিত আল হাকিমের (লোকমান) রচনায় আরবি প্রবাদ বাক্য সংগৃহীত ও সংরক্ষিত হয়েছিল। সে সময় বহু বিদিত আরবি প্রবাদ ছিল- সৌন্দর্য তার জিহবার বাচনশীলতার মধ্যে নিহিত। বুদ্ধিমত্তা তিনটি বস্তুর  ওপর আপতিত হয়েছে- ফরাসিদের মগজে, চীনাদের হস্তে ও আরবদের জিহবায়।
 
(খ) গীতিকাব্য ও বিষয়বস্তুঃ আরব সংস্কৃতির ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন আরবি গীতিকাব্য বা কাস্বিদা সমসাময়িক সাহিত্যের ইতিহাসে অতুলনীয় সম্পদ। বংশ গৌরব, বীরত্বপূর্ণ কাহিনী, যুগের ঘটনা, উটের বিস্ময়কর গুণাবলি, প্রতিপক্ষের লোকদের বদনামসূচক তীরবিদ্ধ কথামালা ছাড়াও নারী, নারীর সৌন্দর্য, প্রেম, যৌনজীবন সম্পর্কিত নগ্ন কথামালা, নারী-দেহের সৌন্দর্যের বর্ণনা, যুদ্ধের বিবরণ, রণসংগীত, ব্যঙ্গোক্তি, বংশগৌরব সম্পর্কিত গীতিকাব্য রচনা কর হতো। আরবরা যে নির্ভীক বীর, অতিথিপরায়ণ, ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল এবং কাপুরুষের মতো মৃত্যুভয়ে ভীত ছিল না, সে সম্বন্ধে আমরা তাদের কবিতা থেকেই অবগত হতে পারি।
 
(গ) কবি ও তাদের মর্যাদাঃ আরব কবি ও পণ্ডিতদের মধ্যে ইমরুল ক্বায়েস, ত্বারফা বিন আবদ্‌, আনতারা বিন শাদ্দাদ, আমর বিন কুলসুম, হারেস, লাবিদ বিন রাবিয়া, কাব বিন যুহায়ের প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া প্রত্যেক গোত্রেরই আলাদা কবি থাকতেন। এ গোত্রীয় কবি ছিলেন গোত্রের মর্যাদার প্রতীক। সকলে তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখত। সমাজে কবিদের অতিমানবের মর্যাদা দেওয়া হতো। তাদের কবিতায় উচ্চমানের সাহিত্য অলঙ্কার নিহিত ছিল।
 
(ঘ) বিনোদনঃ জাহিলী যুগে আরবরা বিভিন্ন প্রতিযোগিতা ও অনুষ্ঠানাদির মাধ্যমে বিনোদনমূলক কর্মে অংশগ্রহণ করতো। উট ও ঘোড়াদৌড় প্রতিযোগিতা আরবদের নিকট খুবই প্রিয় ছিল।
 
(ঙ) গদ্য সাহিত্য রচনাঃ লিখন পদ্ধতির বিকাশের অভাবে জাহিলী যুগের আরবে গদ্যসাহিত্য রচনায় সমৃদ্ধি লাভ করেনি। তবে বংশ বৃত্তান্ত, গোত্রীয় কলহ ও যুদ্ধবিগরহের ইতিহাস সংবলিত কিছু গদ্য সাহিত্য রচিত হয়েছিল। কাব্যগাথার মাধ্যমে প্রাচীনকাল থেকে আরবরা নিজেদের ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতো। ইতিহাস চেতনা তাদের মধ্যে এতই তীব্র ছিল যে, পরবর্তীতে ইসলামের ইতিহাস কিংবা বিশ্ব ইতিহাস রচনা তাদের প্রত্যক্ষ প্রভাবেই সূচিত হয়েছিল।
 
(চ) উকায মেলাঃ জাহিলিয়া যুগে প্রতিবছর নির্ধারিত সময়ে মক্কার অদূরে উকায নামক স্থানে একটি বাৎসরিক মেলা বসত। এখানে খ্যাতনামা আরব কবিদের মধ্যে কবিতা পাঠের আসর বসত। এখানে বিভিন্ন বিষয় যেমন- কাব্যগাথা, বীরত্ব ও বাগ্মিতার প্রতিযোগিতা হতো এবং শ্রেষ্ঠদের পুরস্কৃত করা হতো। এখানে গান বাজনা, নৃত্য প্রভৃতিও অনুষ্ঠিত হতো।
 
(ছ) সাব্‌আ মুআল্লাকাঃ আরবের উকায মেলায় সাহিত্য প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সেরা কবিতা নির্বাচন করা হতো। প্রতি বছরের নির্বাচিত সেরা কবিতাটি কাব-গৃহের দেওয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো। মুয়াল্লাকাএর অর্থ- ঝুলন্ত। এ ঝুলানোর কারণে এ কবিতাগুলোর নাম মু‘আল্লাকা হয়েছে। এরকম সাতটি কবিতা বা সাব্‌’আ মু‘আল্লাকা সাহিত্যজগতে এক অমূল্য রত্ন হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এছাড়াও দিওয়ানে হামাসা, কিতাবুল আগানী ও আল-মুফায্যালিয়াত বিশেষ উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।
 
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম