Saturday 23 April 2022

বিন্দুতে সিন্ধুঃ অনুপ্রেরণা ও উৎসাহের স্ফুরণ - ক


শুরু যদি না-ই করি,
সব কাজ লাগে ভারী।


আজ যদি হেরে যাও, নও তুমি ব্যর্থ
সফলতা কাল পাবে, এই তার অর্থ


সে মেধাবী
সফলও
কিন্তু তার চরিত্র?!


আঁধার যতই হোক না কালো
                                  হোক না যতই ভয়ের রাত,
বিদায় তারে হবেই নিতে
                                 আসবে আলোর সুপ্রভাত।


আমার মনে হয় –
অভাব-অভিযোগ আর ব্যর্থতা একই আধুলির এপিঠ-ওপিঠ


‘আমি সবার চেয়ে ভালো মানুষ’ –
এটা প্রমাণ করতেই কেটে যায় আমাদের অর্ধেক জীবন।
কথায় না, সম্ভব হলে কাজে প্রমাণ করুন।


আগে আপনি নিজের মনকে জিজ্ঞেস করুন –
‘ভালো বা মন্দ হওয়ার জন্য আপনার কী করা উচিৎ, আর কী করা উচিৎ নয়?’
তারপরে ভাবুন –
আপনি কী করেছেন এবং কী করেননি, আর কী করছেন এবং কী করছেন না!


কোনো অবস্থাকে আগে তো গ্রহণ করবেন; তার পরে না হয় ভেবে স্থির করবেন যে –
সংশোধন করবেন,
না সংযোজন করবেন,
না বিয়োজন করবেন,
না সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তন করবেন। 


এই জীবন পথে সর্বোত্তম পাথেয় হল–
আত্মবিশ্বাস।


ইতিবাচক চিন্তাধারা সাহস যোগায় লড়াই করার –
সময়ের সঙ্গে ।
আর নেতিবাচক চিন্তাধারা দুর্বল করে দেয় আপনার মনোবল,
নষ্ট করে দেয় আপনার কর্মক্ষমতা।
এবার নিজেকে বদলান!


-আজ সারাদিনে আপনি কিছু পড়েছেন কি? কিছু শিখেছেন?
-না।
-আপনি আজ সারা দিনে কী কী করেছেন, তার সমীক্ষা কি করেছেন?
-না।
-তাহলে, আপনার জীবনের একটা দিন যে নষ্ট হয়ে গেল!


ছাত্র একটি প্রদীপ।
আর শিক্ষক তার ইন্ধন।
সম্পর্কটা অটুট রাখুন। তাহলেই ঔজ্জ্বল্য ছড়াবে।


-আপনি কি ধৈর্যহীন?
-হ্যাঁ। 
-তাহলে আপনি একটা ‘শয়তান’।


হীনমন্যতা – আপনাকে জীবন হতে দূরে, মৃত্যুর নিকটবর্তী করে দেবে।


কঠিন প্রচেষ্টার পরেও ভাগ্যে জোটে ব্যর্থতা-
ঘাবড়াবেন না, মনে রাখবেন- 'ধৈর্যই সাফল্যের চাবি-কাঠি'। 


নিজের সব জ্ঞান, সব ডিগ্রি পেছনে ফেলে চলুন-
‘তাঁর’ শিষ্যত্ব গ্রহণ করি।


মহান স্রষ্টা আপনার মধ্যেও কিছু বৈশিষ্ট অবশ্যই সৃষ্টি করেছেন।
খুঁজুন..., অবশ্যই খুঁজুন! 


সময়ের দোহাই দেওয়া-
মানে, হেরে পালিয়ে যাওয়া।


আপনি বেঁচে আছেন বটে।
কিন্তু, আপনি কি জীবিত?


-আপনি কি অল্পতে রেগে যান?
-হ্যাঁ।
-তার মানে, আপনার মনের মধ্যে শান্তি নেই; আর না আছে জীবনে শৃঙ্খলা।


‘অশিক্ষা’-র জগৎ একটি ভয়ানক ও পথহীন অরণ্য।
আর ‘শিক্ষা’-র আলোয় হদিশ মেলে –
পথের, কোনো পুষ্পশোভিত কাননের।


সফলতা যে উপাদানগুলি দিয়ে তৈরি, মেধা তার একটি; সব কটি বা সব কিছু নয়।


আপনার অবস্থান কী? জানতে চান!
প্রত্যাবর্তন করুন স্রষ্টার দিকে।


আপনি বহু কিছু পড়লেন,
শিখলেনও বহু কিছু,
অভিজ্ঞতার ঝুড়িও প্রায় পূর্ণ;
কিন্তু সে-অনুযায়ী কাজ করলেন না,
তাহলে আপনি ‘ব্যর্থ’!


আপনি কী চান?
জিততে চান; জিতবেন।
হেরে যেতে চান; হেরে যাবেন। 
ঠিক করুন, আপনি কোনটা চান!


অনেক সময় একটি মাছিই সিংহের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তোলে।


আপনি বয়ঃপ্রাপ্ত।
কিন্তু আপনি যদি ভাবেন যে, কেউ হাত ধরে আপনাকে এগিয়ে  নিয়ে যাবে; তাহলে আপনি এখনো শিশুই।


“প্রলয় আসবে, আর সবকিছু তছনছ করে দেবে”
-আচ্ছা, তার জন্য কি আপনি হাল ছেড়ে দেবেন?
-না।
-তাহলে সম্মানের সাথে বাঁচার উপকরণ তৈরি করুন।


পরিতাপের বিষয় হল-
আমাদের যুবসমাজের কাছে প্রতিটা কাজের ক্ষেত্রে একটা ‘কিন্তু’ তৈরি আছে।

আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

Wednesday 20 April 2022

উমার (রাঃ)-এর বক্তব্য ও অন্যান্য আরবি গদ্যঃ সংক্ষিপ্ত আলোচনা


উমার (রাঃ)-এর বক্তব্য ও অন্যান্য আরবি গদ্যঃ সংক্ষিপ্ত আলোচনা 


خطبة عمر في الحكم
আলোচ্য প্রবন্ধে হজরত উমার ফারুক (রাঃ) কতৃর্ক নিজ শাসনামলে প্রদত্ত একটি বক্তৃতা বিবৃত হয়েছে। অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এই বক্তৃতায় তিনি চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করেছেন।
 
প্রথমতঃ
সম্পদের ব্যবহার এবং বিশেষত বায়তুল-মাল অর্থাৎ জনসাধারণের সম্পদের সঙ্গে দায়িত্বশিল আমীর বা তত্বাবধায়কের ব্যবহার কেমন হওয়া উচিত তার ইঙ্গিত দিয়েছেন। এখানে সম্পদের সদ্ব্যবহারেরে তিনটি দিক উল্লেখ করেছেন। যথা১) সৎপথে উপার্জন ২) সৎপথে ব্যয় ৩) এবং অপচয় রোধ। মানুষ ধনী হোক বা গরীব তার যে সৎপথ চলা উচিত সেটা তিনি বুঝিয়েছেন।
 
দ্বিতীয়তঃ
একজন প্রশাসক হিসাবে জনগণের প্রতি তার কী কর্তব্য সেটারও উল্লেখ করেছেন। যেমন১) অন্যায়ভাবে রাজস্ব আদায় না করা। ২) সংগৃহীত রাজস্ব সঠিক ক্ষেত্রে ব্যয় করা। ৩) প্রজাদের রোজগার ও নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা। আর এই আলোচনা থেকে তার উন্নত চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়া যায়।
 
তৃতীয়তঃ
তিনি জনগণকে সমাগত যুগ সম্বন্ধে সতর্ক করেছেন। যে সময় ধার্মিক থাকবে বটে কিন্তু বিশ্বস্ত লোকের অভাব হবে। পুণ্য কর্ম করলেও তার উদ্দেশ্য থাকবে পার্থিব স্বার্থসাধনের ইত্যাদি। এসব উল্লেখ করে তিনি জনসাধারণকে উপদেশ দিয়েছেন বিপদে ধৈর্য্য ধারণের এবং আল্লাহকে ভয় করার।
 
চতুর্থতঃ
তিনি একটি আয়াতে কারীমা উল্লেখ করতঃ জনগনকে তাঁর পাঠানো দূত সম্পর্কে সাবধান করেছেন। জনগণ যেন তাদের সঙ্গে মুর্খামি না করে, তাদেরকে বিভ্রান্ত না করে, কারণ তা হলে জনগন অজ্ঞাতে নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা তিনি বলেছেন যে، দূর্বলকে আঘাত করার থেকে তাকে ক্ষমা করে দেওয়াটা তাকে বেশী প্রাভাবান্বিত করবে।
 
অবশেষে তিনি প্রজাদেরকে নির্ভয় দেন এই বলে যে, আমার প্রেরিত প্রতিনিধিদের সম্পর্কে কারো কোনো অভিযোগ থাকলে সে তাঁর সামনে তা উত্থাপন করতে পারে।।
 
 
أشعب والبخيل
আশ্‌‘আব ওয়াল্‌-বাখীল শীর্ষক গল্পটি আবুল্‌ ফারাজ আল্‌-আস্‌বাহানী রচিত কিতাবুল্‌ আগানী হতে গৃহীত। আশ্‌‘আব-এর প্রকৃত নাম শু‘আয়েব, পিতার নাম যুবায়েরউক্ত গল্পটি তাঁর ও তদানিন্তন মদীনার শাসকের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল। আশ্‌‘আব নিজেই তা বর্নণা করেছেন।
 
আশআব ও কৃপণের সহাবস্থানঃ
তদানিন্তন মদীনার শাসক ছিলেন অত্যাধিক কৃপণ এবং রসিকতা প্রিয়। তাই আশআবকে সর্বদা সঙ্গে রাখতেন কিন্তু উপযুক্ত আহার ও বিশ্রাম কোনোটাই প্রদান করতেন না।
 
হজের উদ্দেশ্যে কাবার পথেঃ
একদা হজের মরশুমে আশআবকে সঙ্গী হতে বাধ্য করেন। পথিমধ্যে এক স্থানে অবতরণ করে নিজেকে সিয়ামব্রতী প্রকাশ করেন। আশআব নিজ কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়লে বখীল পাথেয় হতে তৃপ্তি সহকারে আহার করার পরে আশআবএর জন্য কেবল দুটি রুটি এবং লবন রাখে। আশআব সূর্যাস্তের পর তাঁর ইফতারের অপেক্ষায় ছিলেন। মাগরীবের পরে দাসের নিকট হতে তিনি প্রকৃত বিষয় সম্পর্কে অবহিত হন। রুটিদ্বয় ও লবন উদরস্ত করে অনাহারে ও কষ্টে রাত্রি যাপন করেন।
 
কৃপণ মাংস খেতে ব্যস্তঃ
পরবর্তী সকালে কিছুটা পথ অতিক্রম করে তারা অন্য একটি স্থানে অবতরণ করলেন। দাস মারফত একটি রৌপ্য মুদ্রা ব্যয়ে কিছু মাংস আনালেন। প্রথমে কাবাব، তারপর লবন গুড়ো মাখিয়ে، তারপর মশলা মাখিয়ে বখিল একাই সব খেলেন। অবশিষ্ট ঝোল ও হাড়গুলি আশআব-এর হস্তগত হল।
 
দাঁত ভেঙ্গে গেলঃ
কিছুক্ষণ পর একটি থলে হতে কিছু শুকনো ফল নিজে খেলেন এবং কয়েকটি বাদাম আশআবকেও দিলেন কিন্তু তার একটি ভাঙতে গিয়ে আশআবের দাঁতের এক কোনা ভেঙে গেল। তাই ভাঙার জন্য তিনি পাথর খুঁজতে লাগলেন।
 
আশ্‌’আবের নিষ্কৃতিঃ
ইতিমধ্যে যুবাইর-এর সন্তানদের সঙ্গে তার সাক্ষাত হল। তাদের নিকট তিনি আশ্রয় ও সাহায্য প্রার্থনা করলেন। তাঁরা তাঁকে সঙ্গে নিয়ে গেল। আহার ও বিশ্রামের পর একটু সুস্থ হয়ে নিজের ভাঙা দাঁতটি দেখিয়ে সম্পূর্ণ গল্পটা শুনালেন। শুনে হাঁসতে হাঁসতে তারা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। অতঃপর আশআব সেই কৃপণ গভর্নর হতে মুক্তির শপথ গ্রহণ করলেন। সুতরাং যতক্ষণ না সে ক্ষমতাচ্যুত হল আশআব মদীনায় প্রবেশ করলেন না।

 
القضاء والقدر
ইবনুল মুকাফ্‌ফা আব্বাসী যুগের বিশিষ্ট সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম। আল্‌-ক়াজ়া ওয়াল্‌-ক়াদ্‌র শির্ষক এই আলোচ্য গল্পটিতে তিনি  একথা স্পষ্ট করার প্রয়াস করেছেন যে, বিশ্বের সকল বিষয় পূর্ব নির্ধারিত ভাগ্যের মাধ্যমেই আবর্তিত হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন চার ব্যাক্তির কথা- একজন সম্রাট-তনয়, দ্বিতীয় জন সম্ভ্রান্ত ব্যাক্তির সন্তান, তৃতীয় জন ব্যবসায়ীর পুত্র, আর চতুর্থ জন কৃষকের ছেলে। তাঁরা নিঃস্ব হয়ে গৃহ ত্যাগ করেছিল। একদা নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় ব্যস্ত ছিল এমন সময় রাজপুত্রটি বলল— পৃথিবীর সবকিছুই ভাগ্যের মাধ্যমে সংঘটিত হয় ব্যবাসায়ীর ছেলে বলল— মেধা সর্বোত্তম বস্তু। সম্ভ্রান্ত ব্যাক্তির ছেলেটি বলল— তোমরা যে বিষয় দুটির আলোচনা করেছ তাঁর চেয়ে সৌন্দর্য্য অধিক উত্তমআর কৃষকের ছেলে বলল— সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হচ্ছে পরিশ্রম।
 
তাঁরা সকলে ‘মাতুন’ শহরের এক প্রান্তে আশ্রয় নিল। সকালবেলা কৃষকের ছেলে উপার্জনের জন্য বেরিয়ে পড়ল। জ্বালানী সংগ্রহের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে সে অর্ধেক দীরহাম উপার্জন করল, যা দিয়ে বন্ধুদের জন্য খাবার ক্রয় করল। মদীনার সদর দরজা দিয়ে অতিক্রম করার সময় সেখানে লিখে দিল— একদিনের পরিশ্রমের মূল্য অর্ধেক দিরহাম (রৌপ্যমুদ্রা)দ্বিতীয় দিন সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলেটি এক ধনকুবের মহিলার সঙ্গে দিন অতিবাহিত করে তাঁর সৌন্দর্য্যের মাধ্যমে ৫০০ দীনার উপার্জন করল প্রত্যাবর্তনের সময় শহরের সদর দরজায় লিখল— একদিনের সৌন্দর্যের মূল্য পাঁচ শ’ দীনার (স্বর্ণমুদ্রা)তৃতীয় দিন ব্যবসায়ীর ছেলে তাঁর মেধা ও বুদ্ধির সাহায্যে এক হাজার স্বর্ণ মুদ্রা উপার্জন করল এবং তাঁর কথা সদর দরজায় লিখে আসল
 
চতুর্থ দিন ছিল রাজপুত্রের পালা সে বেরিয়ে সদর দরজার একটি দোকানের পাশে বসে পড়লঘটনা চক্রে সেদিন সেই শহরের সম্রাটের মৃত্যু হয়েছিল। লোকেরা সেই দিক দিয়ে তাঁর জানাযা নিয়ে যাচ্ছিল এক ব্যক্তি তাঁর বসে থাকার কারণ জিজ্ঞেস করল। রাজপুত্রটি কোনো উত্তর না দেওয়ায় ব্যাক্তিটি তাকে ধমক দিয়ে সেখান থেকে তাড়িয়ে দিল। জানাযা থেকে প্রত্যাবর্তনের সময় তাকে পূর্বের অবস্থায় দেখে উক্ত ব্যক্তিটি রেগে গিয়ে তাঁকে বন্দি করে দিল।
 
পরের দিন সকলে মিলে নতুন সম্রাট নির্বাচনের জন্য সমবেত হয়েছিল। সেই ব্যক্তিটি উক্ত সভায় রাজপুত্রের ঘটনাটি বর্নণা করল এবং আশংকা প্রকাশ করল যে, সে গুপ্তচর হতে পারে। যখন তাঁকে উপস্থিত করে জিজ্ঞাসা করা হল সে বলল যে, সে কার্‌দনাদ রাজার পুত্র। পিতার মৃত্যুর পর ভ্রাতা সিংহাসনে আরোহণ করে, প্রাণের ভয়ে সে সেখান থেকে পলায়ণ করে। উক্ত সভার এক ব্যক্তি তাঁকে চিনতে পেরে তাঁর বিষয়টিকে সত্যায়িত করলঅতঃপর সকলে মিলে তাঁকে তাঁদের বাদশাহ রূপে গ্রহণ করল
 
তাঁদের রীতি ছিল নব-নির্বাচিত সম্রাটকে হস্তিপৃষ্ঠে আরোহন করিয়ে সমগ্র শহর পরিক্রম করানোতাই যখন সে শহরের সদর দরজার পাশ দিয়ে অতিক্রম করল আর তাঁর সঙ্গীদের লেখা মন্তব্যগুলি লক্ষ করল, নিম্নোক্ত মন্তব্যটি লেখার আদেশ দিল— নিঃসন্দেহে পরিশ্রম, বুদ্ধি, সৌন্দর্য এবং ভালোমন্দ যা কিছু মানুষ অর্জন করে সবই ভাগ্যের স্বারা নিয়ন্ত্রিত।
 
অতঃপর রাজ সিংহাসনে আরোহন করার পর নিজ বন্ধুদেরকে ডেকে পাঠাল তাদেরকে প্রচুর অর্থ প্রদান করে অভাবমুক্ত করল। অতঃপর সেখানকার শিক্ষাবিদ ও পণ্ডিতদের একত্রিত করে বলল- যে, আমার বন্ধুরা বিশ্বাস করেছে যে আল্লাহ্‌ তাদেরকে যে উত্তম জীবিকা প্রদান করেছেন তা তাঁদের ভাগ্যেই ছিল। আমি চাই আপনারা সে বিষয়টিকে উপলব্ধি করুন এবং বিশ্বাস করুন। আমাকে আল্লাহ্‌ যা কিছু প্রদান করেছে তা ভাগ্যের দৌলতে সৌন্দর্য্য, মেধা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে নয়। যখন আমার ভাই আমাকে বিতাড়িত করেছিল আমি আশা করিনি আমি এ মর্যাদা পুনরায় ফিরে পাব। কারণ, এই ভূ-পৃষ্টে আমার থেকে অধিক সুন্দর ও অধিক মেধাবি ও অধিক পরিশ্রমকারী ব্যাক্তির সংখ্যা প্রচুর। আজ আমি যা কিছুই পেয়েছি ভাগ্যের দৌলতেই পেয়েছি।
 
 
بين قاض وقور وذباب جسور
বাসরায় আব্দুল্লাহ বিন সাওয়ার এক স্থির চিন্তাশীল, নম্র ও সম্মানীয় বিচারক ছিলেন। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে তার দসর ছিলনা। তিনি ফজর নামায নিজ গৃহে আদায় করে অথচ গৃহ মসজিদের নিকটে অবস্থিত ছিল নিজ বৈঠকে গিয়ে উবু হয়ে বসতেন। আর এমন স্থির ভাবে বসে থাকতেন, যে না ঠেস দিতেন, না অঙ্গ-প্রতঙ্গ সঞ্চালনা করতেন, না এদিক ওদিক দৃষ্টিপাত করতেন। যেন তিনি একটা নির্মিত ভবন বা স্থির প্রস্তর। সারাদিন এভাবেই বসে থাকতেন, শুধু নামায-এর সময় নামায পড়তে যেতেন। বর্নিত আছে যে, তিনি এ সময়ে একবারও ওযু করতে যেতেন না, আর না তার ওযু বা পানি বা পানীয় কোন কিছুর প্রয়োজন অনুভূত হয়। কিবড়দিন, কিছোটদিন, কিগ্রীষ্ম কি শীত সর্বদা তাঁর অবস্থা একই রকম ছিল। তিনি অঙ্গ-সঞ্চালনা তো বহুদূর মস্তক দ্বারা ইঙ্গিতও করতেন না। আর যদি কখনও কথা বলতেন, তাহলে অতি সংক্ষিপ্ত ও অর্থপূর্ণ কথা বলতেন।
 
একদা তিনি উক্ত অবস্থায় বসে ছিলেন। আর তার সভাসদরা তার দুপাশে ও সম্মুখে উপবিষ্ট ছিল। এমন সময় একটি মাছি তার নাকের উপর এসে বসল। কিছুক্ষণ পর মাছিটি তাঁর চোখের কোনায় শুঁড় বিঁধতে লাগল। বিচারক অত্যন্ত ধৈর্য্যের সাথে সহয্য করতে লাগলেন। তিনি নাকের ডগা নড়ালেন না,আর না মুখ বাকালেন, না আঙুল দিয়ে সরিয়ে দিলেন। তারপর মাছিটি এমন জায়গায় জ্বালাতন করতে লাগল, যে বিচারক চোখের পাতা নড়াতে বাধ্য হলেন। চোখের পাতার সঞ্চালনা বন্ধ হতেই মাছিটি আবার পূর্বের জায়গায় ফিরে এসে অধিক জ্বালাতন করতে লাগল। বিচারক চোখের পাতা বারবার নড়াতে লাগলেন। আর তা বন্ধ হতেই মাছিটি আবার উক্ত স্থানে প্রত্যাবর্তন করে অধিক কঠোর ভাবে জ্বালাতন করতে লাগল।তাঁর সর্বাত্মক সহ্য ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে গেল, বাধ্য হয়ে তিনি হাত দিয়ে সরিয়ে দিলেনআবার মাছিটি ফিরে আসল। অবশেষে তিনি জামার হাতার কোনা দিয়ে মাছিটিকে তাড়িয়ে দিলেন।
 
উপস্থিত সভাসদরা এসব দেখেও না দেখার ভান করছিল। তিনি যখন অনুভব করলেন যে, এ সবকিছুই সভাসদের সম্মুখে সংঘটিত হয়েছে, তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করে বললেন যে, তিনি সাক্ষ্য প্রদান করছেন যে মাছি গোবরে পোকা অপেক্ষা অধিক একগুঁয়ে এবং কাক অপেক্ষা অধিক বিরক্তিকর। অতঃপর তিনি আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে বললেন যে, মানুষ নিজের মধ্যে লুক্কায়িত দুর্বলতা সম্পর্কে জ্ঞাত নয়, অথচ সে গর্বভরে বড় বড় বুলি আওড়াও, যা কোন প্রকারই শোভনীয় নয়। তিনি উদাহরণ স্বরূপ নিজেকে উপস্থাপন করে বললেন যে তিনি তাঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সম্মানীয়, অথচ তাকে পরাজিত ও লাঞ্ছিত করল আল্লাহ্‌র এক দুর্বলতম সৃষ্টি মাছি। অতঃপর এ আয়াতটি পরিবেশন করলেন— যদি মাছি তাদের (উপাস্য মূর্তিদের) নিকট হতে কোন কিছু ছিনিয়ে নেয় তাহলে তারা (মূর্তিরা) সেই বস্তুটিকে রক্ষা করতে পারে না। সুতরাং প্রার্থনাকারী ও প্রার্থীত সত্ত্বা উভয়ই দুর্বল। [সূরাতু আল্‌-হ়াজ্জ ৭৩]
 
তিনি অর্থাৎ বসরার এই বিচারক স্পষ্টবক্তা ছিলেন বন্ধুবান্ধবদের মাঝে অত্যন্ত সম্মানীয় ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর কার্যসম্পাদনা এত নিখুঁত যে সমালোচনার কোন অবকাশ থাকতনা।
 
 
مؤامرة قريش
ক্রমাগত ভাবে রাসূল (সাঃ)-এর অনুসারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগলো এবং তারা হিজরত করে অন্যত্রে বসবাস শুরু করলেন। কোরায়েশরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়লো এই ভেবে যে, নবী (সাঃ) তাদের সাথে মিলিত হয়ে কোরায়েশদের বিরুদ্ধে আক্রমন করতে পারেন।
 
দারুননাদওয়া প্রকৃত পক্ষে কোসায়েব বিন কেলাবের আবাসস্থল ছিল। কোরায়েশরা কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মত বিনিময়ের জন্য উক্ত গৃহে মিলিত হয়। তাই তারা পূর্ব প্রথা অনুসারা নবী-সমস্যা এর সমাধান খুঁজতে এক নির্ধারিত দিনে এই সভাকক্ষে উপস্থিত হলো। নাজ্‌দ প্রদেশের এক বৃদ্ধের রূপ ধারন করে ইবলিস উক্ত সভায় উপস্থিত হলো এবং তাদেরকে পরামর্শ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিল।    
 
আলোচনার সূচনাতেই জনৈক ব্যক্তি পরামর্শ দিলেন যে, নবীকে শিকলে বেধে গৃহ-বন্দি করে রাখা হোক, আর এ ভাবেই সে একদিন মৃত্যুর মুখে পতিত হবে। ইবলিস উক্ত মতের বিরোধীতা করে বলল যে তার অনুসারীরা তার বন্দিত্বের খবর পেয়ে বিদ্রোহ করবে এবং তাকে তোমাদের নিকট থেকে ছিনিয়ে নেবে। অতঃপর জনৈক ব্যক্তি পরামর্শ দিল যে তাকে নির্বাসিত করার। ইবলিস এই মতটিরও বিরোধীতা করে বলল যে, সে অনুসারীদের নিয়ে দলগঠন করে তোমাদের প্রতি আক্রমন করতে পারে। শেষে আবু জেহেল বলল যে, প্রত্যেক গোত্র হতে একজন করে শক্তিশালী যুবক চয়ন করা হোক। তারা সকলেই দলবদ্ধ ভাবে একসঙ্গে তাকে হত্যা করবে। তাহলে বনু আবদে মানাফ প্রতিশোধ গ্রহনের সাহস পাবেনা এবং মুক্তিপনে-ই সন্তষ্ট থাকবেতার এই মতটিকে সমর্থন করলো এবং এটিই গৃহীত হল।    
 
জিবরাইল (আঃ) নবী (সাঃ)-কে কোরায়েশদের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অভিহিত করে অন্য বিছানায় ঘুমানোর পরামর্শ দিলেন। তাই রাসূল (সাঃ) আলী (রাঃ)-কে নিজ বিছানায় শুইয়ে দিলেন। রাত্রি একটু গভীর হতেই কোরায়েশী যুবকরা রাসূলের গৃহ অবরোধ করলো। আবু জেহেল তাদের সম্মুখে বিদ্রুপের সুরে রাসূল সাঃ-এর কতিপয় শিক্ষাকে আওড়াতে লাগলো।এমন সময় রাসূল (সাঃ) এক মুষ্ঠি মাটি নিয়ে তাদের দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিলেন। তারা সকলে অবচেতন হয়ে পড়লো আর রাসূল (সাঃ) সূরা ইয়াসিনের প্রথম নয় আয়াত তেলাওয়াত করতে করতে বেরিয়ে পড়লেন। জনৈক ব্যক্তি তাদের নিকট উপস্থিত হয়ে বললো, তোমরা এখানে কার অপেক্ষা করছো? মোহাম্মদ, সে তো বেরিয়ে গেছেন। তারা উঁকি মেরে রাসূলের বিছানায় একজনকে শায়িত দেখে তাৎক্ষনিক ভাবে নিশ্চিত হলো। কিন্তু প্রভাতের আলোয় সে বিছানা থেকে আলীকে জাগ্রত হতে দেখে বিস্মিত হল আর রাতের সেই সচেতনকারী ব্যক্তিটি তাদের নিকত সত্য বলে বিবেচিত হল।
 
 
إن حملة العلم في الاسلام أكثرهم العجم 
জ্ঞানের জগতে আরবদের অবদান বেশী না অনারবদের, এ ব্যাপারে বরেণ্য ঐতিহাসিক ইবনে খালদুনের গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্তের নির্যাস হলো উল্লেখিত প্রবন্ধটি
   
প্রবন্ধের প্রারম্ভেই লেখক স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন, জ্ঞানকে জীবিত রাখতে অনারবদের অবদান আরবদের  তুলনায় অনেকাংশেই বেশী। এর কারন অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি বলেন, সাধারনভাবে আরবরা ছিল গ্রাম্য, মূর্খ। তারা জ্ঞানের উৎস বলতে কোরান হাদিস ছাড়া আর কিছু বুঝতো না, কিন্তু তা থেকে জ্ঞানের নির্যাস আহরনের ব্যাপারে তারা নির্বিকার ছিল। এভাবেই সময় আব্বসী যুগ পদার্পণ করল।
     
হারুনুর রশীদের যুগে তাফসীর ও হাদীসে সংকলন ও সংরক্ষন হলো। যেটা করতে গিয়ে প্রয়োজন পড়ল আরব ব্যাকরণ প্রয়নের। এর ফলে শারয়ী জ্ঞান পরিপূর্ণতা পেলবলা বাহুল্য এ সবের পিছনে অবদান ছিল অনারবদেরই। এর ফলে মানুষ পথভ্রষ্টতার হাত থেকে রক্ষা পেল। এর পাশাপাশি কারিগরী দক্ষতার বিষয়টিও উল্লেখ্য। আরবরা নিজেদেরকে এ থেকে সরিয়ে রাখলো। এটাকে তারা শহুরে বা অনারব সংস্কৃতি ভেবে নিল। তথাপি তাদের মধ্যে কিছু মানুষ এই কর্মযজ্ঞের মধ্যে নিজেদের মিশিয়ে ছিল।
    
ব্যাকরণের প্রণেতাগনের মতোই যারা ইলমে হাদীসের বাহক তারাও যথারীতি অনারব। অনুরূপ ভাবে ইলমে কালাম, উসুলে ফেকাহর যারা গবেষক তারা প্রত্যেকেই ছিল অনারব। এখানে লেখক একটি বড় ও গুরুত্বপূর্ণ কারন দেখিয়েছেন, তা হলো তৎকালীন আরবরা খিলাফত ও প্রশাসনিক বিষয়গুলি সম্পর্কে অধিক আগ্রহী ছিল। পক্ষান্তরে অনারবরা জ্ঞান চর্চাকেই পাথেয় করে নিয়েছিল।
    
এগুলো গেল শারয়ী জ্ঞানের ক্ষেত্রে, আকলী জ্ঞানের ক্ষেত্রেও একই রকম। এসব ক্ষেত্রে অনারবরা যতই বিশিষ্টতা অর্জন করতে লাগল, আরবরা ততই নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখল। সীমিত কিছু প্রবাসী আরবীয় এ ব্যাপারে আগ্রহ দেখালেও তা চিরকাল থাকলনা। যে সমস্ত শহর একটু সংস্কৃতি পূর্ণ হয়েছিল, সেগুলো ধ্বংস হতেই জ্ঞান ও সংস্কৃতির চর্চা অনেকটাই  স্তিমিত হয়ে যায়। বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে জানা যায়, তাফতাযানী, ইবনুল খাতিব ইত্যাদি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পর নতুন কোনো তাকার উদ্ভব হয়নি।
    
অবশেষে লেখক পাঠকবর্গকে এ বিষয়ে চিন্তভাবনা করার উপদেশ দিয়ে এবং পরম করুনাময়ের কাছে দোয়া প্রার্থনা করে প্রবন্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করেছেন।
 
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

Saturday 16 April 2022

আমর বিন বাহর আল-জাহিজঃ বিচারক ও মাছির গল্প


 
বিচারক মাছির গল্প
‘আম্‌র বিন্‌ বাহ়্‌র আল্‌-জাহ়িজ়
 
বসরায় আমাদের এক বিচারক ছিলেন। নাম আব্দুল্লাহ বিন সেওয়ার। লোকেরা কখনো তাঁর মতো এমন সম্মানীয় ও দৃঢ় চিত্তের শাসক দেখেনি, আর না বিনয়ী ও ভদ্র, যে নিজেকে ও নিজের নড়াচড়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে যেমনভাবে তিনি করতে পারেন। তিনি ভোরের সালাত (নামায) বাড়িতে পড়তেন; অথচ তাঁর বাড়ি ছিল মসজিদের কাছেই। তারপর তিনি বৈঠকে গিয়ে উবু হয়ে বসতেন। কোনো কিছুতে ঠেস দিতেন না, একদম সোজা ও স্থির। তাঁর হাত-পা নড়াচড়া করতো না, আর না এধার-ওধার তাকাতেন। তাঁর উবুর গেরো খুলেও যেত না, আর না তিনি একটা পাকে অপর পায়ের উপর চাপাতেন। এমনকি শরীরের কোনো একদিকে ঝুঁকে থাকতেন না। তিনি যেন কোনো নির্মিত ভবন বা স্থাপিত পাথর ছিলেন।
 
তিনি এভাবেই বসে থাকতেন যোহর অবধি। যোহরের নামায আদায়ের পর আবার বৈঠকে ফিরে আসতেন। আসরের নামায অবধি ওভাবেই বসে থাকতেন। আসরের নামায সেরে আবার বৈঠকে ফিরে আসতেন এবং আগের মতোই বসে থাকতেন। অতঃপর মাগরিবের আজান হলে নামাজের উদ্দেশ্যে বেরোতেন। তারপর কোনো কোনো দিন বৈঠকে ফিরতেন, অধিকাংশ সময় সন্ধি, চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি সম্পর্কিত কোনো কাজ অসমাপ্ত থাকলে ফিরতেন। তারপর ঈশার নামায পড়ে বাড়ি ফিরতেন। লোকাচার অনুযায়ী, তিনি এই দীর্ঘ সময়ে একবারও উঠতেন না, ওজুর জন্যও না; বলা বাহুল্য তাঁর ওজুর প্রয়োজনই পড়তো না। আর না জল বা অন্য কিছু পান করার জন্য উঠতেন।
 
কী গ্রীষ্ম, কী শীত, কী বড় দিন, কী ছোট দিন, সব সময় তিনি অমন ভাবেই বসে থাকতেন। না হাত নড়াতেন না অন্য কোনো অঙ্গ। না মাথা দিয়ে ইশারা-ইঙ্গিত করতেন আর না কথা বলতেন। যদি কখনও কথা বলতেন, খুবই সীমিত ও সংক্ষিপ্ত করে এবং স্বল্প কথায় সমগ্র মনের ভাব প্রকাশ করতেন।
 
এভাবেই একদিন তিনি বসে ছিলেনআর তাঁর সম্মুখে ও চারপাশে তাঁর সঙ্গীসাথীরা দুটো সারিতে বসে ছিল। এমন সময় হঠাৎ করে একটি মাছি তাঁর নাকের ডগায় এসে বসলো। দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলো। তারপর সেখান থেকে চোখের কোণে গিয়ে বসলো। বিচারক ধৈর্য ধরে বসে থাকলেন। মাছিটা তাঁর চোখের কোণে দংশন করলো, শুঁড় ফোটাল, তবুও তিনি ধৈর্য ধরে বসে থাকলেন। যেমনটা স্থির বসে ছিলেন, যখন মাছি তাঁর নাকের ডগায় বসেছিল। তিনি নাক-মুখ কিছুই নড়াননি, না আঙুল দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিলেন। মাছিটা দীর্ঘক্ষণ চোখের কোণে বসে জ্বালাতন করতে থাকলো। তাকে নানা ভাবে ব্যস্ত করে তোলার চেষ্টা করলো। ভীষণ রকম যন্ত্রণা দিল। তারপর এমন এক জায়গায় গিয়ে বসলো, বিচারকের পক্ষে আর ইগ্নোর করা সম্ভব হল না। বাধ্য হয়ে তিনি দুচোখের পাতা এক করলেন। তবুও মাছি উঠলো না। বাধ্য হয়ে তিনি বেশ কয়েক বার চোখের পাতা বন্ধ করলেন এবং খুললেন। আর মাছিটা ঠিক সেই মুহূর্তটুকু দূরে সরে থাকলো। অতঃপর যখন চোখ পুনরায় স্থির হল, আবার চোখের কোণে এসে বসে পড়লো এবং পূর্বের তুলনায় অধিক তীব্র ভাবে আঘাত করতে লাগলো। শুঁড়টা পূর্বের জায়গায় বিঁধিয়ে দিল। ফলে বিচারক অধৈর্য হয়ে পড়লেন সহ্য করতে না পেরে তিনি চোখের পাতা নড়াতে লাগলেন এবং তীব্র ভাবে নড়াতে থাকলেন। যতক্ষণ তিনি নিরন্তর চোখের পাতা বন্ধ-খোলা করতে থাকলেন, মাছিটাও দূরে সরে থাকলো। কিন্তু যখনই চোখের পাতার নড়া বন্ধ হয়ে গেল মাছিটা অমনি এসে পূর্বের জায়গায় বসে পড়লো। নানা ভাবে জ্বালাতন করতে লাগলো। বিচারক আর সহ্য করতে পারলেন না। এক পর্যায় তিনি বাধ্য হয়ে কোনো উপায় খুঁজে না পেয়ে হাত দিয়ে মাছিটাকে তাড়িয়ে দিলেন। অন্যদিকে উপস্থিত সবাই বিস্ফারিত চোখে তাঁকে দেখছিল। তবে এমন ভান করছিল, যেন তারা তাঁর এ আচরণ লক্ষ্যই করেনি। তাঁর হাতের নড়াচড়া বন্ধ হতেই মাছিটা আবার পূর্বের জায়গায় এসে বসলো। এবার তিনি বাধ্য হয়ে জামার হাতা দিয়ে বারবার মাছিটাকে তাড়াতে লাগলেন।
 
(কিছুক্ষণ পর) তিনি অনুভব করলেন, তাঁর এসব কর্মকাণ্ড উপস্থিত সভাসদ ও পারিষদদের সম্মুখে ঘটেছে। ফলে যখন তারা চোখ তুলে তাঁর দিকে তাকাল, তিনি বললেন— আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি, মাছি গুবরেপোকার চেয়ে অধিক একগুঁয়ে এবং কাক অপেক্ষা অধিক বিরক্তিকর। তিনি আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা চেয়ে আরও বললেন— আত্মবিমুগ্ধ ব্যক্তি বড্ড বাড়াবাড়ি করে। অতঃপর আল্লাহ্‌ তাকে তার অজানা ও গোপন দুর্বলতাগুলো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। তোমরা সবাই জানো, আমি নিজের কাছে এবং তোমাদের সবার কাছে অত্যন্ত সম্মানিত ও ওজনদার ব্যক্তি। কিন্তু আল্লাহ্‌র এক অত্যন্ত দুর্বল সৃষ্টি একটি মাছি আমাকে পরাজিত করল। ফলে আমি এক চরম লাঞ্ছনার মুখোমুখি হলাম। অতঃপর তিনি একটি আয়াত পরিবেশন করলেন— যদি একটি মাছি এদের থেকে কোনোকিছু ছিনিয়ে নেয়, এরা তা রক্ষা করতে পারে না; এরা এবং এদের নিকট প্রার্থনাকারীরা কতই না দুর্বল!
[কিতাবুল্‌ হ়াইয়াওয়ান, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১০৬, আত-তাক়াদ্দুম প্রকাশনী কায়রো মিশর, ১৯০৬]

অনুবাদ- আব্দুল মাতিন ওয়াসিম



بين قاض وقور وذباب جسور[1]
عمرو بن بحر الجـاحظ
 
كان لنا بالبصرة قاضٍ يقال له: عبد الله بن سوار لم ير الناس حاكما قط زميتاً ولا ركينا ولا وقورا حليما ضبط من نفسه وملك من حركته مثل الذي ضبط وملك. كان يصلي الغداة في منزله وهو قريب الدار من مسجده فيأتي مجلسه فيحتبي ولا يتكئ فلا يزال منتصبا لا يتحرك له عضو ولا يلتفت ولا تحل حبوته ولايحمل رجلا على رجل ولا يعتمد على أحد شقيه حتى كأنه بناء مبني أو صخرة منصوبة.

فلا يزال كذلك حتى يقوم إلى صلاة الظهر ثم يعود إلى مجلسه فلا يزال كذلك حتى يقوم إلى صلاة العصر ثم يرجع إلى مجلسه فلا يزال كذلك حتى يقوم لصلاة المغرب ثم ربما عاد إلى مجلسه بل كثيرا ما كان يكون ذلك إذا بقي عليه شيء من قراءة العهود والشروط والوثائق ثم يصلي العشاء وينصرف.‏ فالحق يقال لم يقم في طول تلك المدة والولاية مرة واحدة إلى الوضوء ولا احتاج إليه ولا شرب ماء ولا غيره من الشراب.

كذلك كان شأنه في طوال الأيام وقصارها وفي صيفها وفي شتائها وكان مع ذلك لا يحرك يدا ولا عضوا ولا يشير برأسه وليس إلا أن يتكلم. ثم يؤجز ويبلغ باليسير من الكلام إلى المعاني الكبيرة.

فبينما هو كذلك ذات يوم وأصحابه حواليه وفي السماطين بين يديه - أي كانوا في صفين – (إذ) سقط على أنفه ذباب فأطال المكث ثم تحول إلى مؤق عينه (طرف العين قرب الأنف) فرام الصبر على سقوطه على المؤق وصبر على عضته ونفاذ خرطومه كما رام الصبر على سقوطه على أنفه من غير أن يحرك أرنبته أو يغضن وجهه أو يذب بإصبعه فلما طال ذلك عليه من الذباب وشغله وأوجعه وأحرقه وقصد إلى مكان لا يحتمل التغافل أطبق جفنه الأعلى على جفنه الأسفل فلم ينهض فدعاه ذلك إلى أن يوالي بين الإطباق والفتح فتنحى ريثما سكن جفنه ثم عاد إلى مؤقه بأشد من مرته الأولى فغمس خرطومه في مكان كان قد آذاه قبل ذلك فكان احتماله أقل وعجزه عن الصبر عليه في الثانية أقوى فحرك أجفانه وزاد في شدة الحركة وألح في فتح العين وفي تتابع الفتح والإطباق فتنحى عنه بقدر ما سكنت حركته ثم عاد إلى موضعه فما زال يلح عليه حتى استفرغ صبره وبلغ مجهوده فلم يجد بدا من أن يذب عن عينه بيده ففعل وعيون القوم ترمقه وكأنهم لا يرونه فتنحى عنه بقدر ما رد يده وسكنت حركته ثم عاد إلى موضعه ثم ألجأه إلى أن ذب عن وجهه بطرف كمه ثم ألجأه إلى أن تابع ذلك.‏

وعلم أن فعله كله بعين من حضره من أمنائه وجلسائه فلما نظروا إليه قال:‏ أشهد أن الذباب ألج من الخنفساء وأزهى من الغراب.‏ قال واستغفر الله فما أكثر من أعجبته نفسه فأراد الله عزوجل أن يعرفه من ضعفه ما كان عنه مستورا وقد علمتم أني عند نفسي وعند الناس من أرزن الناس فقد غلبني وفضحني أضعف خلقه. ثم تلا قوله تعالى: وإن يسلبهم الذباب شيئا لا يستنقذوه ضعف الطالب والمطلوب.


 [1] الجاحظ - كتاب الحيوان- الجزء الثالث- مطبعة التقدم بمصر القاهرة- 1906- ص 106