Wednesday 28 April 2021

আল-কুরআনের ভাবানুবাদঃ (৭১) সূরাতু নূহ়্ (নূহ়্ নবী)


৭১) সূরাতু নূহ়্ (নূহ়্ নবী)
মক্কায় অবতীর্ণ, আয়াত ২৮, রুকু ২
 
بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمـَنِ الرَّحِيمِ

আল্লাহ্‌র নামে (শুরু করছি), তিনি পরম করুণাময় ও অতি দয়ালু।

إِنَّا أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ أَنْ أَنذِرْ قَوْمَكَ مِن قَبْلِ أَن يَأْتِيَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

আমি নূহ (আঃ)-কে প্রেরণ করেছিলাম তাঁর জাতির দিকে এই আদেশ দিয়ে যে, তুমি তোমার জাতিকে সতর্ক করো তাদের প্রতি মর্মন্তুদ শাস্তি আসার আগেই।

قَالَ يَا قَوْمِ إِنِّي لَكُمْ نَذِيرٌ مُّبِينٌ

ফলে নূহ (আঃ নিজ জাতিকে উদ্দেশ্য করে) বললেন, হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা! আমি তোমাদের জন্য একজন স্পষ্ট সতর্ককারী (রূপে প্রেরিত হয়েছি);

أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاتَّقُوهُ وَأَطِيعُونِ

(তাই আমি তোমাদেরকে সতর্ক করছি) যে, তোমরা কেবল আল্লাহর এবাদত-উপাসনা করো, তাঁকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো।

يَغْفِرْ لَكُم مِّن ذُنُوبِكُمْ وَيُؤَخِّرْكُمْ إِلَى أَجَلٍ مُّسَمًّى إِنَّ أَجَلَ اللَّهِ إِذَا جَاء لَا يُؤَخَّرُ لَوْ كُنتُمْ تَعْلَمُونَ

(যদি তোমরা তা মেনে চলো তাহলে) তিনি তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন এবং নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদেরকে অবকাশ দেবেন। আর (মনে রেখো) আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত সময় অতি অবশ্যই উপস্থিত হবে, আর যখন তা উপস্থিত হবে তখন কাউকেই অবকাশ দেওয়া হবে না, যদি তোমরা তা জানতে!

قَالَ رَبِّ إِنِّي دَعَوْتُ قَوْمِي لَيْلًا وَنَهَارًا

অতঃপর নূহ়্ (আঃ নিজ রবের নিকট অভিযোগ ও অনুযোগ করে) বললেন, প্রভু! আমি আমার সম্প্রদায়ের লোকেদেরকে রাতদিন (সত্যের প্রতি) আহ্বান জানিয়েছি;  

فَلَمْ يَزِدْهُمْ دُعَائِي إِلَّا فِرَارًا

কিন্তু আমার আহ্বানে কেবল তাদের পলায়ন-প্রবণতাই বৃদ্ধি পেয়েছে।

وَإِنِّي كُلَّمَا دَعَوْتُهُمْ لِتَغْفِرَ لَهُمْ جَعَلُوا أَصَابِعَهُمْ فِي آذَانِهِمْ وَاسْتَغْشَوْا ثِيَابَهُمْ وَأَصَرُّوا وَاسْتَكْبَرُوا اسْتِكْبَارًا

আমি যখনই তাদেরকে (সত্য পথ অবলম্বনের) আহ্বান জানিয়েছি, যাতে তুমি তাদেরকে ক্ষমা করে দাও, তখনই তারা আঙুল ঢুকিয়ে কান বন্ধ করে নিয়েছে, কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে নিয়েছে, জেদ করেছে এবং ঔদ্ধত্য আচরণ করে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

ثُمَّ إِنِّي دَعَوْتُهُمْ جِهَارًا

অতঃপর আমি তাদেরকে প্রকাশ্যে উচ্চস্বরে (সুপথ অনুসরণের) আহ্বান জানিয়েছি,

ثُمَّ إِنِّي أَعْلَنتُ لَهُمْ وَأَسْرَرْتُ لَهُمْ إِسْرَارًا

আমি তাদের জন্য কখনো ঘোষণা সহকারে প্রচার করেছি, আবার কখনো গোপনে-চুপিসারে।

فَقُلْتُ اسْتَغْفِرُوا رَبَّكُمْ إِنَّهُ كَانَ غَفَّارًا

আমি (তাদেরকে) বলেছি, তোমরা তোমাদের প্রভুর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো; তিনি অত্যন্ত ক্ষমাশীল।

يُرْسِلِ السَّمَاء عَلَيْكُم مِّدْرَارًا

তিনি তোমাদের উপর অজস্র বৃষ্টিধারা বর্ষণ করবেন,

وَيُمْدِدْكُمْ بِأَمْوَالٍ وَبَنِينَ وَيَجْعَل لَّكُمْ جَنَّاتٍ وَيَجْعَل لَّكُمْ أَنْهَارًا

তোমাদেরকে ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি দিয়ে সমৃদ্ধ করবেন, তোমাদের জন্য উদ্যান স্থাপন করবেন এবং তোমাদের জন্য নদীনালা প্রবাহিত করবেন।

مَّا لَكُمْ لَا تَرْجُونَ لِلَّهِ وَقَارًا

তোমাদের কী হয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর (শাস্তিকে ভয় করছ না, তাঁর কাছ থেকে অনুগ্রহ আশা করছ না এবং তাঁর) শ্রেষ্ঠত্ব (ও একত্ববাদকে) স্বীকার করছ না।

وَقَدْ خَلَقَكُمْ أَطْوَارًا

অথচ তিনি তোমাদেরকে বিভিন্ন পর্যায়ে (প্রথমে নুত্‌ফা, তারপর ‘আলাকা, তারপর মুদ্‌গাহ্‌, তারপর আরও নানা পর্যায়ে [সূরাতু আল্‌-মুমিনূন ১৩ -১৪]) সৃষ্টি করেছেন।

أَلَمْ تَرَوْا كَيْفَ خَلَقَ اللَّهُ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ طِبَاقًا

তোমরা কি লক্ষ্য করো না, আল্লাহ কীভাবে সাতটি আকাশকে স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছেন!

وَجَعَلَ الْقَمَرَ فِيهِنَّ نُورًا وَجَعَلَ الشَّمْسَ سِرَاجًا

এবং তাতে চাঁদকে সৃষ্টি করেছেন আলো রূপে এবং সূর্যকে প্রদীপ রূপে।

وَاللَّهُ أَنبَتَكُم مِّنَ الْأَرْضِ نَبَاتًا

তিনিই তোমাদেরকে মাটি থেকে উদগত করেছেন, যেমন করে উদ্ভিদকে করেন।

ثُمَّ يُعِيدُكُمْ فِيهَا وَيُخْرِجُكُمْ إِخْرَاجًا

অতঃপর তোমাদেরকে মাটিতেই ফিরিয়ে দেবেন, তারপর আবার (মহাপ্রলয় দিবসে মাটি থেকেই) পুনরুত্থিত করবেন।

وَاللَّهُ جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ بِسَاطًا

মহান আল্লাহই তোমাদের জন্য পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছেন;

لِتَسْلُكُوا مِنْهَا سُبُلًا فِجَاجًا

যাতে তোমরা পৃথিবীর বুকে তার প্রশস্ত পথ ধরে চলাফেরা করতে পারো।

قَالَ نُوحٌ رَّبِّ إِنَّهُمْ عَصَوْنِي وَاتَّبَعُوا مَن لَّمْ يَزِدْهُ مَالُهُ وَوَلَدُهُ إِلَّا خَسَارًا

অতঃপর নূহ়্ (আঃ) বললেন, প্রভু! আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা আমাকে অমান্য করেছে। এবং (আমাকে বাদ দিয়ে) তারা এমন একজনকে অনুসরণ করেছে যার ধনসম্পদ ও সন্তানসন্ততি কেবল তার ক্ষতিই করেছে এবং বেশী বেশী করে করছে।

وَمَكَرُوا مَكْرًا كُبَّارًا

আর তারা ভয়ানক চক্রান্ত করেছে;

وَقَالُوا لَا تَذَرُنَّ آلِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلَا سُوَاعًا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًا

তারা বলেছে, তোমরা তোমাদের উপাস্যদের ত্যাগ করো না, না ওয়াদকে, না সূয়াকে, না ইয়াগুসকে, না ইয়াউককে আর না নাস্‌রকে, কাউকেই না।

وَقَدْ أَضَلُّوا كَثِيرًا وَلَا تَزِدِ الظَّالِمِينَ إِلَّا ضَلَالًا

এভাবে তারা অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে। অতএব (প্রভু!) তুমি এই জালিমদের (অর্থাৎ মুশ্‌রিক ও পৌত্তলিকদের) জন্য পথভ্রষ্টতা ছাড়া আর কিছুই বর্ধিত করো না।

مِمَّا خَطِيئَاتِهِمْ أُغْرِقُوا فَأُدْخِلُوا نَارًا فَلَمْ يَجِدُوا لَهُم مِّن دُونِ اللَّهِ أَنصَارًا

(পরবর্তীতে) তাদেরকে তাদের রাশি রাশি পাপের কারণেই নিমজ্জিত করা হয়েছে, অতঃপর তাদেরকে প্রবেশ করানো হবে জাহান্নামে। আর তারা আল্লাহর মুকাবেলায় অন্য কাউকে তাদের সাহায্যকারী রূপে পায়নি এবং পাবেও না।

وَقَالَ نُوحٌ رَّبِّ لَا تَذَرْ عَلَى الْأَرْضِ مِنَ الْكَافِرِينَ دَيَّارًا

নূহ়্ (আঃ) আরও বললেন, প্রভু! তুমি কোনো কাফিরকে (অর্থাৎ অবিশ্বাসীকে) পৃথিবীতে গৃহবাসী রূপে রেহাই দিও না।

إِنَّكَ إِن تَذَرْهُمْ يُضِلُّوا عِبَادَكَ وَلَا يَلِدُوا إِلَّا فَاجِرًا كَفَّارًا

যদি তুমি তাদেরকে রেহাই দাও, তাহলে তারা তোমার বান্দাদেরকে (দাসদেরকে) পথভ্রষ্ট করবে এবং তারা কেবল পাপাচারী ও কাফিরদের জন্ম দেবে।

رَبِّ اغْفِرْ لِي وَلِوَالِدَيَّ وَلِمَن دَخَلَ بَيْتِيَ مُؤْمِنًا وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَلَا تَزِدِ الظَّالِمِينَ إِلَّا تَبَارًا

প্রভু! তুমি আমাকে, আমার পিতামাতাকে, যারা মুমিন (অর্থাৎ বিশ্বাসী) হয়ে আমার গৃহে প্রবেশ করেছে তাদেরকে এবং সকল মুমিন পুরুষ ও নারীদেরকে ক্ষমা করে দাও। এবং জালিমদের জন্য ধ্বংস ছাড়া আর কিছুই বৃদ্ধি করো না ।

ভাবানুবাদ- আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

Thursday 22 April 2021

উমার বিন আল-খাত্তাব (রাঃ)



উমার ইব্‌নুল্‌ খ়াত়্ত়াব (রাঃ)

(৫৮৪  ৬৪৪ খ্রি)
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
 
উমার (রাঃ) ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা এবং প্রধান সাহাবীদের অন্যতম। আবু বাক্ (রাঃ)-এর মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় খলীফা হিসেবে দায়িত্ব নেন। উমর (রাঃ) ইসলামী আইনের একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করার কারণে তাকে আল-ফারুক (সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী) উপাধি দেওয়া হয়। আমীরুল মুমিনীন উপাধিটি সর্বপ্রথম তার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। ইতিহাসে তাকে প্রথম উমার হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। সাহাবীদের মর্যাদার ক্ষেত্রে সুন্নীদের কাছে আবু বাক্ (রাঃ)-এর পর উমারের স্থান। তাঁর শাসনামলে খিলাফতের সীমানা অকল্পনীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। এসময় সাসানীয় সাম্রাজ্য  বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের দুই তৃতীয়াংশ মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে আসে। তার শাসনামলে জেরুজালেম মুসলিমদের হস্তগত হয়। তিনি পূর্বের খ্রিষ্টান রীতি বদলে ইহুদিদেরকে জেরুজালেম-এ বসবাস ও উপাসনা করার সুযোগ দিয়েছিলেন।

ইসলাম ধর্ম গ্রহন
নবী (সাঃ)-এর নবুওয়াতের প্রথম পর্যায়ে উমার (রাঃ) ছিলেন ঘোর ইসলাম বিরোধীমক্কার নবদীক্ষিত মুসলিমদের উপর তিনি নির্যাতন চালাতেনতিনি ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতা করছিলেন বটে, কিন্তু পক্ষান্তরে ইসলামের প্রভাবে তাঁর শুভবুদ্ধি ক্রমশ উদয় হচ্ছিলরাসূল (সাঃ)-এর অজ্ঞাতসারে একদা তাঁর মুখে আল-কুরআনের আবৃত্তি শুনে তাঁর মনে ভাবান্তর ঘটার বর্ননা পাওয়া যায়একদিন ভগিনী ও ভগ্নীপতিকে ইসলামে গ্রহণের জন্য নির্দয়ভাবে শাসন করতে গিয়ে তিনি নিজেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং রাসূল (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের ফলে তাঁর জীবনের আমূল পরিবর্তন ঘটেপরবর্তীকালে তিনি ইসলামের সেবার অকল্পনীয় ইতিহাস সৃষ্টি করেন

খিলাফত লাভের পূর্বে
হিজরতের চার বছর পূর্বে যখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তার বয়স ছিল ছাব্বিশ বছরতার পর থেকে তিনি পূর্ন শক্তিতে ইসলামের সেবায় ঝাপিয়ে পড়েন। তার গোত্র বানু আদি ইব্‌নু কাআব হতে এই ব্যাপারে তিনি কোন সাহায্য পাননিমদিনায় তার ব্যক্তিগত উদ্যম এবং মনোবলের প্রভাবেই তিনি রাসূল (সাঃ)-এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সমাজে মর্যাদা লাভ করেন, গোত্রীয় মর্যাদার কারণে নয়। সৈনিক হিসাবেও তার প্রভূত খ্যাতি ছিলতিনি বদর, উহুদ ও অন্যান্য যুদ্ধে যোগদান করেন। একাধিক বর্ণনায় আছে যে, কুরআনের কয়েকটি স্থানে উমার (রাঃ)-এর সমর্থনে ওহি অবতীর্ন হয়েছেসাহাবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বে আবু বাক্‌র (রাঃ) উমার (রাঃ)-এর অগ্রগণ্য ছিলেন। উমার (রাঃ) বিনয় সহকারে তা স্বীকার করতেন এবং সর্বদা আবু বাক্‌র (রাঃ)-কে যথোপযুক্ত সম্মান করতেনরাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যুর পর উমার (রাঃ)-ই সর্বপ্রথম আবু বাক্‌র (রাঃ)-এর নিকট বায়আত করেন

খেলাফত লাভ ও শাসনকার্য
আবু বাক্‌র (রাঃ)-এর খিলাফাত কালে উমার (রাঃ)-ই ছিলেন তাঁর প্রধান উপদেষ্টা। মৃত্যুর পূর্বে তিনি উমার (রাঃ)-কেই তাঁর স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করেন। অতঃপর সকল সাহাবা সর্ব-সম্মতভাবে উমার (রাঃ)-কে তাঁদের খলীফা রূপে গ্রহণ করেন। অতঃপর ঘরে-বাইরে উমার (রাঃ) যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন পূর্ব হতেই তিনি তার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন। মুসলিম রাষ্ট্রের পরিধি বৃদ্ধি করার জন্য যুদ্ধ করা তাঁর অভিপ্রেত ছিল না। নৌ-যুদ্ধ তাঁর দৃষ্টিতে অধিকতর অবাঞ্ছিত ছিল, কিন্তু মুসলিম শক্তিকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করার জন্য বদ্ধপরিকর বিরোধী শক্তিগুলির সাথে মুকাবিলায় তিনিই ছিলেন অধিনায়ক। যে সকল সেনাপতি মুসলিমদের প্রয়াসকে সাফল্যমণ্ডিত করেছিলেন তিনি ছিলেন তাদের সকলের নিয়ন্তা। এক্ষেত্রে তাঁর কৃতিত্ব সর্বজনবিদিত। ইসলামের স্বার্থে খালিদ (রাঃ)-এর ন্যায় একজন সুদক্ষ সেনাপতিকেও তিনি পদচ্যুত করেছিলেন এবং খালিদ (রাঃ)-ও এই পদচ্যুতি অবনত মস্তকে মেনে নিয়েছিলেন। এই ঘটনা তাঁর বলিষ্ঠ কৃতিত্বেরই পরিচায়ক। এই ঘটনা হতে রাসুল (সঃ)-এর সাহাবীদের (রাঃ) চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যেরও পরিচয় মিলে। আম্‌র ইবনুল 'আস (রাঃ)-এর মিসর বিজয়ের প্রস্তাবে সম্মতি দান করে তিনি খুবই দূর-দৃষ্টির পরিচয় দেন। তিনি রাসূল কারীম (সাঃ)-এর বিশিষ্ট সাহাবীদেরকে সম্ভ্রমবশত সাধারণ সরকারী চাকুরীতে নিয়োগ করতেন না। কিন্তু প্রয়োজন হলে গুরুত্বপূর্ন পদে তাদেরকে নিয়োগ করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। আর এভাবেই ইরাক ও সিরিয়ার শাসনকর্তা হিসাবে তিনি কয়েকজনকে নিযুক্ত করেছিলেন। 

উমার (রাঃ)-এর সময়েই ইসলামী রাষ্ট্রের বাস্তব ভিত্তি স্থাপিত হয়। এ সময়েই অনেকগুলি ইসলামী বিধি-ব্যবস্থা বাস্তব রূপ লাভ করে। এগুলির পূর্ন রূপায়ন ঐতিহাসিক বিকাশ ধারা অনুসারে ক্রমে ক্রমে সাধিত হলেও এসবের সূচনা উমার (রঃ)-এর সময়েই হয়েছিল। যখনই কোন প্রশ্ন বা সমস্যার উদ্ভব হত, তিনি সাহাবীদেরকে (রাঃ) একত্রিত করে জিজ্ঞেস করতেন যে, এ ব্যাপারে নবী (সাঃ)-এর কোন উক্তি বা সিদ্ধান্ত আছে কিনা, অতঃপর তাদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। কুরআন ও সুন্নাহ্‌ই ছিল তাঁর সংবিধান এবং বিশিষ্ট সাহাবী যথা আলী, আব্দুর রাহমান বিন আওফ (রাঃ) প্রমুখ ছিলেন তাঁর পরামর্শ সভার সদস্য। দীনতম নাগরিকও তাঁর কর্মের সমালোচনা করতে শুধু সাহসই করতেন না বরং উৎসাহিতও হতেন- এ ধরণের বহু নজির বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়। তাঁর জীবন যাপনের মান সাধারণ নাগরিকের অনুরূপ ছিল। এ বিষয়ে উমার (রাঃ)-এর দৃষ্টান্ত সত্যই বিরল ।

এছাড়া তাঁর শাসনামলে জিম্মি অর্থাৎ মুসলিম রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকগণের অধিকার সংরক্ষণ, সরকারি আয় জনগণের মধ্যে বণ্টনের জন্য দীওয়ান ব্যবস্থার প্রবর্তন, সামরিক কেন্দ্র যথা বসরা ও কুফা সামরিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন হয়। এবং এসব কেন্দ্র হতেই উত্তরকালে কয়েকটি বৃহৎ নগরীর সৃষ্টি হয়এতদ্বব্যতিত ধর্মীয়, পৌর এবং দণ্ডবিধি সঙ্ক্রান্ত বিশেষ বিধিও তিনি প্রবর্তন করেন। যথা তারাবীহ্র‌ সালাত জামাআতে সম্পন্ন করা, হিজরি সনের প্রবর্তন ও মদ্যপানের শাস্তি ইত্যাদি ।

আবু বাক্‌র (রাঃ) খালীফাতু রাসুলিল্লাহ বা রাসুলের প্রতিনিধি বলে অভিহিত হতেন। তদনুসারে উমার (রাঃ) ছিলেন রাসূলের খলীফার খলীফা। নবী (সাঃ) নেতা অর্থে সাধারণত আমীর শব্দ ব্যবহার করতেন এবং আরবদের মধ্যে এই শব্দের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। আর তাই ১৯ হিজরিতে তিনি আমীরুল্‌ মুমেনীন অর্থাৎ মুমিনদের নেতা উপাধি গ্রহণ করেন। সম্ভবত তিনি নিজকে রাসূল (সাঃ)-এর খলীফা বা স্থলাভিষিক্ত বলা বা মনে করাকে ধৃষ্টতারূপ গণ্য করতেন। বেশ কিছু বর্ণনায় বিবৃত হয়েছে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “আমার পর কেউ নবী হলে উমার নবী হতো ।

শাহাদত
উমার (রাঃ)-এর অন্তরে আল্লাহ্‌র ভয় ও ভক্তির মধ্যে দৃশ্যত ভয়ই ছিল প্রবলতর। তিনি যে সম্মান অর্জন করেছিলেন তা তাঁর চরিত্রগুণের কারনে, শারীরিক শক্তির জন্য নয়। যদি আবু উবায়দা (রাঃ) জীবিত থাকতেন তবে তাকেই তাঁর স্থলাভিষিক্ত রূপে মনোনীত করতেন, তাঁহার এরূপ ইচ্ছা প্রকাশের বিবরণ পাওয়া যায়। নবী (সাঃ)-এর সত্যিকারের সাহাবী এবং কুরআন ও সুন্নাহ্‌র পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসারী খলীফা রূপে মর্যাদার উচ্চ শিখরে সমাসীন থাকাকালে ২৬ জুল হিজ্জা ২৩ হিঃ মোতাবেক ৩ নভেম্বর ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে মুগীরাহ্‌ বিন শুবাহ্‌র অগ্নি উপাসক ক্রীতদাস আবু লুলুর ছুরিকাঘাতে শহীদ হন। ইতিহাসে বর্ণীত হয়েছে যে, উমার (রাঃ)-এর নিকট আবু লুলুতার মনিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। উমার (রাঃ)-এর বিচারে অসন্তুষ্ট হয়ে সে ব্যক্তিগত আক্রোশের বশে অতর্কিতভাবে উমার (রাঃ)-কে আঘাত করে। মৃত্যুর পূর্বে উমার (রাঃ) ছয়জন বিশিষ্ট সাহাবীর নাম উল্লেখ করে পরামর্শক্রমে তাদের মধ্যে একজনকে খলীফা মনোনীত করার উপদেশ দেন। পরবর্তীতে তার ফলে উস্‌মান (রাঃ) খলীফা মনোনীত হন।

Sunday 4 April 2021

আব্দুল মাতিন ওয়াসিমঃ স্নেহের মুনিস

 

স্নেহের মুনিস,

আস্‌সালামু আলাইকুম

মুনিস, তুমি কেমন আছো জানি না! তবে বুকের মধ্যে এ আশাই লালন করছি যে, তুমি ভালোই আছো। স্বর্গের কোনো এক উদ্যানে ফুল-পাখীদের সাথে খেলা করছ। ‘শারাবান তাহুরা’ স্বর্গীয় সুধা হাতে নিয়ে ছুটছো স্বর্গোদ্যানের এধার থেকে ওধার। আর সোনার থালায় রূপোর পেয়ালায় রকমারি আহার পরিবেশন করছ আগুন্তুকদের...।

মুনিস, আমার মনে ইদানিং তোমার প্রতি ভীষণ অভিমান জন্মেছে। সেই অভিমানের হাত ধরেই আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে, কেন তুমি হঠাৎ করে এলে। এলেই যদি, তাহলে কেন অমন করে অবেলায় চলে গেলে! আর যাবেই যদি, তাহলে কেনই বা এলে?

মুনিস তুমি জানো, পথ চলতে গিয়ে আমি যখন দেখি, কোথাও কোনো বাবা সন্তানকে বুকে আগলে হাঁটছে; আর সেই সন্তান তার কচি হাত দিয়ে বাবার মুখে হাত বোলাচ্ছে, আমারও খুব ইচ্ছে হয় তোমার হাতের ছোঁয়া পেতে। বুকের ভেতরটা খাঁ খাঁ করে ওঠে। ইচ্ছে হয় তোমায় বুকে জড়িয়ে ধরি। আর অমনি হাত দু’টো আপনা থেকেই একটা শূন্য অবয়বকে কোলে তুলে নেয়। মাঝেমধ্যেই মনে সাধ জাগে, তোমার সাথে একটু খুনসুটি করি, আলতো করে তোমার কান মুলে দিই। একটু নাকটা টিপে দিই। একটু কাতুকুতু দিই। আর তুমি ফিক করে হেসে ওঠো এবং তোমার নরম-কচি হাত দিয়ে তুমি আমার নাক-কান-চশমা টেনে ধরো...!

মুনিস, আমি একজন অপরাধী, আমি তোমার প্রতি অবহেলা করেছি, অপরাধ করেছি। এবং আমি তা জানি। আর কেউ জানুক বা না জানুক, আমার আল্লাহ্‌ জানে।  আমি এক অধম পুত্র। এক অভাগা পিতা। কেরিয়ার-চাকরির জন্য গ্রামে তেমন যাওয়া হয় না আমার। নিজ জননীর তেমন ভাবে খোঁজখবর ও যত্ন নিতে পারিনি, এখনও পারি না বিভিন্ন সময়ে নানা উপযুক্ত ও অনুপযুক্ত কারণে সাহানাকে আমি অবহেলা করেছি। ওর পছন্দ-অপছন্দকে তেমন গুরুত্ব দিইনিতুমি আসবে জেনেও মাসের পর মাস কোলকাতায় থেকেছি। হয়তো এই অবহেলা ও অযত্নের কারণে তুমি ভীষণ রেগে ছিলে আমার উপর। হয়তো সে-কারণেই সময়ের পূর্বে পৃথিবীতে এসে চলেও গেলে। এবং আমার জন্য রেখে গেলে শূন্যতার এক মহাসাগর!


আব্দুল মাতিন ওয়াসিম 

কোলকাতা- ৩৯
২৮-১১-২০১৮  

Saturday 3 April 2021

বদিউর রহমানঃ প্রাতঃস্মরণীয় অধ্যাপক অরুণ কুমার বসু



প্রাতঃস্মরণীয় অধ্যাপক অরুণ কুমার বসু

বদিউর রহমান 

মারা গেলেন অধ্যাপক অরুণ কুমার বসু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগের অন্যতম ছাত্র দরদী অধ্যাপক অরুণ বাবু তাঁর প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী তাঁকে আজীবন স্মরণ করতে বাধ্য হবেন তাঁর পড়ানোর টেকনিকের জন্য ব্লাক বোর্ডে তাঁর আর্টিস্টের মত লেখা গুলো অনেকের মনে পড়বে দীর্ঘদিন

তাঁকে আমার মনে পড়ে আমার সঙ্গে তার মার্জিত ব্যবহারের জন্য আমি তাঁকে অরুণদা বলে ডাকতাম তাঁর সঙ্গ সেভাবে পেয়েছি তা নয় তবুও তাঁকে ইদানিং আমার ভীষন মনে পড়ে আমি ১৯৮৩ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি তখন আমার দেশের বাড়ি পান্ডুয়া থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সাড়ে দশটা থেকে পোনে এগারোটায় পৌঁছাতাম আশুতোষ বিল্ডিং-এর তিন তলার প্রফেসর রুমের পুব দিকের সুইং ডোরটা দিয়ে ঢুকলে ডান দিকের একেবারে শেষ চেয়ারটা এবং তার পাশের চেয়ারটার দুজন অধ্যাপককে প্রায় দেখতাম কাজে ডুবে আছেন একজন অরুণদা আর দ্বিতীয় জন হলেন অধ্যাপক সুদীপ্তী ব্যানার্জি পরে জেনেছিলাম যে ওরা দুজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্স বিভাগের পরীক্ষা সংক্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সুসম্পাদন করে যান নিঃশব্দে নিরলস ভাবে একদিকে যেমন অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ওই সমস্ত কাজ করতেন অন্যদিকে ঠিক সেরকমই গুরুত্ব সহকারে নিতেন ছাত্রদের ক্লাস তাছাড়াও কমার্স বিভাগের অ্যালুমুনীর কাজ এবং সেমিনার ইত্যাদিরও অনেক কাজ ওরা দুজনে সামলাতেন অক্লান্তভাবে ওনারা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে পরিশ্রম করেছেন কাজগুলো শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ বলে

অরুণদা যে চেয়ারটায় বসতেন ঘটনাক্রমে তার ডান দিকে ছিল আমার একটা তালামারা ছোট্ট সেলফ্ আমি সেই সেলফ্ খোলার জন্য এগিয়ে গেলে অরুণদা খুব সন্তর্পনে তাঁর ছড়ানো কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন সদা হাস্য অরুণদা বলতেন আমি কি একটু সরে বসব”? আমিই বরং কুন্ঠিত হয়ে বলতাম, “না না তার দরকার হবে না, আমার এক মিনিটের কাজ দেখতাম আবার তিনি নিমগ্ন হয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছেন বিভাগের কাজে বলতে পারেন এই ছিল তাঁর নিত্য দিনের রুটিন

কুটা কলেজস্ট্রিট শাখার টি-ক্লাবে আমাকে কিছু একটা লেখা শোনানোর প্রায়ই আদেশ থাকতো বিদগ্ধ গুণীদের মাঝে বৌদ্ধিক আলোচনা থেকে হাজার মাইল দূরে আমার চেষ্টা ছিল মন হালকা করার মত সাধারণ কিছু লেখা অনেকের মত অরুণদাকেও লক্ষ করেছি আমার ---- শুনতে

বন্ধুস্থানীয় কয়েকজন অধ্যাপক লেখা নিয়ে কখন সরস কখন নিরস মন্তব্য করতেন টি-ক্লাবে একবার আমার একটা প্রেম সর্বস্য কবিতা পড়ার পর অধ্যাপক স্বপন প্রামাণিক মন্তব্য করেন বদিউর বয়সে সব কি হচ্ছে আবার ছাতা কাহিনী শোনানোর পর অধ্যাপক লয়ের মন্তব্য কোথা থেকে ঝাড়লেন- হজম করতে হয়েছে আমার দুর্ভাগ্য অরুণদার কোনো মন্তব্য কোনোদিন আমি পাইনি তবে প্রশ্রয় ছিল আমাকে কিছু শোনাতে সুযোগ দেওয়ার অন্তত ব্যাপারে তাঁর বিরোধিতা ছিল না বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্স বিভাগের বন্ধু বিদগ্ধ এবং খ্যাতনামা ব্যক্তিদের মধ্যে অনিল, বি.কে বসু, বি ব্যানার্জি, রতন খাসনবিস (পরবর্তীকালে ম্যানেজমেন্ট বিভাগে আলিপুর ক্যাম্পাসে চলে যান) এবং সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে আসতেন এম রহমান সাহেবকে দেখেছি বেশ কেতাদুরস্ত হয়ে থাকতে বিশেষত শীতকালের তাদেরকে স্যুটেড-বুটেড হয়ে থাকতে দেখে বেশ ভালো লাগতো তবে অরুণদা আজীবন খুব সাদামাটা জীবন যাপন করতেন আমার মনে হয় আকাশী রংটার প্রতি ওঁর একটা দুর্বলতা ছিল ওঁর লেখা বই শুধু ছাত্রদের কাছে কেন অনেক অধ্যাপকের কাছেও উচ্চ প্রশংসিত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চাপানো কাজের ভারে অরুণদা নিজের পিএইচডি করার ফুরসত পাননি তার জন্য ইউজিসির নিয়মের গেরোয় আখেরে ওঁর ব্যক্তিগত ক্ষতি হয় ছাত্রতুল্য অনেক ডিগ্রিধারীকে ওঁর প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা অনুমান করেছি টিচার্স রুমে কমার্স বিভাগ-এর মিটিংয়ে অরুণদার স্বর ছাপিয়ে উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখে অরুণদা কতটা আহত হতেন, ব্যথা পেতেন জানিনা তবে পরে দেখেছি ওর ব্যবহারে তাদের প্রতি স্নেহের কোন অভাব তিনি রাখেননি ওইরকম উদার মনস্ক মানুষের স্মৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি সভা করা হয় জুন ২০১৬ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে পুরো হল কানায় কানায় ভর্তি হয়েছিল বিখ্যাত শিক্ষাবিদ অশিক্ষক কর্মচারীদের উপস্থিতিতে গুনমুগ্ধ মানুষজনের অভূতপূর্ব উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল একজন সত্যিকারের মানুষের চলে যাওয়ার ব্যথা অরুণদার শিক্ষক অধ্যাপক বি ব্যানার্জি অন্যান্য সহকর্মী শিক্ষকরা তাঁর ছবিতে ফুল মালা দিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন, তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করেন। বিদগ্ধ শিক্ষকদের বক্তব্যে অরুণদার শিক্ষক জীবনের অনেক প্রসঙ্গ আলোচিত হয় অরুণদার ছাত্র মালয়েন্দু সাহা অরুণদার স্মৃতিচারণা করতে উঠে বাকরুদ্ধ হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপিকা শর্মিস্ঠার অবস্থাও হয় প্রায় তথৈবচ তবে ওই বিভাগের স্বনামধন্য রতন খাসনবিশের বক্তব্য শুনে আমার মত অনেকেই হয়েগিয়েছি অধ্যাপক খাসনবিশ অরুণদার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একদিন দুজনের ফেরার কথা বলেছিলেন অরুণদা সেদিন বলেছিলেন তার কলকাতা আগমনের কথা তখন বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ তুঙ্গে। পাকসেনার মদতপুষ্ট রাজাকারদের তান্ডব চলছে পূর্বপাকিস্তানে বিশেষ করে যশোর, খুলনা, ফরিদপুর এলাকায় নির্বিচারে হত্যালীলা চালিয়ে যাচ্ছিল ধর্মান্ধ রাজাকাররা

অধ্যাপক অরুণ বসু বলে চলেন প্রতিনিয়ত অবস্থা খারাপ হতে থাকে পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে তাদেরকে সহমর্মিতা দেখানো এবং রক্ষা করতে কেউ এগিয়ে আসেননি অবস্থা বেগতিক দেখে বাবা দেশ ছাড়ার সংকল্প করেন একদিন শেষ রাতে বাড়ি ছেড়ে যৎসামান্য কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বের হবার মুহূর্তে বাবা আমাদের সকলকে এগিয়ে যেতে বলে একটু পরে উনি আমাদের সঙ্গে রাস্তায় যোগ দেবেন বলেন অরুণ বাবু বলতে থাকেন, মা আমরা পাঁচ ভাই-বোন কিছুদূর এগিয়ে বাবার অপেক্ষা করতে থাকি মা সবিশেষ অধৈর্য হয়ে বড় ছেলে (অরুণ বাবু)-কে বলেন বাড়ি গিয়ে বাবাকে সঙ্গে করে নিয়ে এস বাড়ির দরজার কাছে পৌঁছাতে তিনি দেখেন একদল রাজাকার তাঁর বাবাকে নৃসংশ ভাবে হত্যা করছে চোখে দেখা যায় না রাজকারদের বর্বর হত্যালীলা কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্য বিমূঢ় অরুণ বাবু পরমুহূর্তে তার মা অন্যান্য ভাই বোনদের রক্ষা করার তাগিদে আলো-আঁধারির মধ্যে পরিবারের সকলের কাছে ফিরে গিয়ে তিনি তাঁর মাকে বলেন, দরকারী কিছু কাগজ পত্র খুঁজে নিয়ে বাবার আসতে একটু দেরি হবে, আমাকে বলেছেন তোমাদের সকলকে নিয়ে এগিয়ে যেতে ভারতের বর্ডার পৌঁছানো পর্যন্ত অরুণ বাবুর মায়ের অস্থিরতাকে কোনক্রমে সামাল দেন শরণার্থী শিবিরে থাকাকালীন তার মা অন্যান্য ভাই-বোনেরা বাবার ভারতবর্ষে পৌঁছানোর সংবাদ পেতে আকুল হয়ে পড়েন তিনি দিনের পর দিন তাঁর মাকে কোন ভাবে বুঝিয়ে শান্ত করে রাখেন কিন্তু প্রতিদিন সকালে উঠে তাঁর মা স্নান করার পর যখন মাথায় সিঁথিতে সিঁদুর দিতেন তখন অরুণ বাবুর বুকটা টনটন করত প্রায় দেড় বছর পর অরুণ বাবুদের বাংলাদেশের পাড়ার এক ভদ্রলোকের মুখে তাঁর মা জানতে পারেন তার স্বামী বর্বর ধর্মান্ধ রাজাকারদের হাতে কি নৃসংশ ভাবে খুন হন সেদিন তাঁর মা নিজের সন্তান তরুণ বাবুর কাছে জানতে চান তিনি আগে ওই কথাটা তাঁর মাকে বলেননি কেন তিনি প্রশ্ন করেন, দেড় বৎসর ধরে বিধবা হওয়া সত্ত্বেও সধবার মতো হাতে নোয়া শাঁখা পরে এবং মাথায় সিঁদুর পরার পাপ করতে কেন দিল? কেন আমাকে পাপের ভাগী করলে?

অরুণদার মায়ের সেদিনের হাহাকার ছিল গভীর মর্মভেদী ততোধিক গভীর অরুণদার তাঁর মায়ের জন্য তিনি ভেবেছিলেন সর্বহারা উদ্বাস্তু হওয়ার পর মা হয়তো স্বামীর মৃত্যুর শোক সহ্য করতে পারবেন না অরুণ বাবু তাঁর মাকে সাধারণ বেশে দেখে ভেতরে ভেতরে গুমরে উঠতেন চাপা কান্নায় ভেতর থেকে মুষড়ে পড়তেন প্রতিদিন চোখের পানি সামনে ভেসে উঠত তার বাবাকে হত্যা করার ক্রর দৃশ্য

ওইরকম মর্মান্তিক ঘটনা শোনার পর বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম তৎক্ষণাৎ মনে হয়েছে ওঁর বাবার প্রতি রাজকারদের ওরকম অমানবিক আচরণের পরে আমাদের মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর বীতশ্রদ্ধ হওয়াই স্বাভাবিক কিন্তু অরুণ বাবুর ব্যবহারে কথাবার্তায় সেরকম কিছু কখনো পাইনি আমার সঙ্গে হাসিমুখে অতীব সম্প্রীতি সৌহার্দ্য রক্ষা করে একজন স্বজনের মতো ব্যবহার করে গেছেন ঘুণাক্ষরও জানতে দেননি তাঁর ব্যক্তিগত ব্যথার কথা সে দিনের স্মৃতি সভায় যেভাবে তাঁর ব্যথায় ভারাক্রান্ত মনে ফিরেছিলাম আজ তাঁকে আমার বিনম্র শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে ভারমুক্ত হয়ে বলতে চাই এইরকম মহৎ মানুষজনই প্রাতঃস্মরণীয়, সর্বান্তকরণে তাঁর আত্মার কল্যাণ কামনা করি। 

২৬-০৬-২০২০

 
অধ্যাপক বসুর অসামান্য অবদান ও নিরলস সেবার দরুন কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ৯ই ডিসেম্বর ২০১৫-তে তাঁকে এই বিশেষ সম্মাননা জ্ঞাপন করে