Tuesday 26 November 2019

ইচ্ছে করে ওই লাল বাড়িটায় ফিরে যেতে!



ইচ্ছে করে ওই লাল বাড়িটায় ফিরে যেতে!
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

কোনো নির্ঘুম রাতে, কখনো বিকেলের অলসক্ষণে, কাজের মাঝে পাওয়া অবসরে, হঠাৎ করে মনে পড়ে স্মিথ লেনের ওই লাল বাড়িটার কথা। মনে পড়ে বেকারের ৮০ নম্বর রুমের কথা। মনে পড়ে সেই স্মৃতি বিজড়িত দিনগুলিআমার জীবনের অত্যন্ত আনন্দমুখর দিন ছিল সেগুলি। জমিয়ে আড্ডা দেওয়া, একসঙ্গে খেতে যাওয়া, দীর্ঘ রাত পর্যন্ত বিষয়হীন বিরামহীন আলোচনা আর ‘তানিয়া’কে নিয়ে পরস্পরের খুনসুটি সব মনে পড়ে। আজও ভাবি, কীভাবে হারিয়ে গেল সেই দিনগুলি! সকলের চোখে ছিল কত স্বপ্ন, চাকরি-বাড়ি...; সেই স্বপনগুলো আজ নিখোঁজ, হারিয়ে গেছে তাদের ঠিকানা 

আরও মনে পড়ে, ভীষণ ভাবে মনে পড়ে ওদের কথা। সাহেব, ভাজি ভাই ও সরলমতি কামিল দার কথা। ছোটা হাতি-  নাজমুল, প্রাইসট্যাগ-জোন্স, চার্মিং বয় আলি ও রিয়াজ খ্যাপার কথা। কোনোকিছু হলেই কি সকাল কি সন্ধ্যা আলি ডাকতো, “ও মাতিন দা!” তাঁরা আজ যে যার পথে। বড্ড কষ্ট হয়, তাদের কথা মনে পড়লে। ওই দিনগুলোর ছবি চোখে ভেসে উঠলে। মাঝেমাঝেই ভাবি, তাদের ফোন করবো। কিন্তু কী বলব ফোনে! সবাই যে পুড়ছে। বেকারত্ব সহ নানা রকম আর্থসামাজিক সমস্যায় জ্বলছে বর্তমান। আতঙ্কিত ভবিষ্যৎ।

চোখের আয়নায় ভেসে ওঠে তাদের নিষ্পাপ মুখগুলো। আর মনে পড়ে যায় তাদের নানা ভাবনার কথা। চাকরিবাকরি নিয়ে তাদের হাহুতাশ করার ছবি। সাহেবের দুর্গম সংগ্রাম, জোন্সের অব্যক্ত বেদনা, মাথার মধ্যে বিড়বিড় করে আরও কতশত না-বলা কথা

বোধ করি, জীবন এক স্মৃতিমাল্য। তার এক দু’টো পাপড়ি হঠাৎ করে ভেসে ওঠে স্মৃতিপটে। আর অশ্রুরা ভিড় করে চোখের কোণে। আজকাল আমার বড্ড ইচ্ছে করে বেকারের সেই ৮০-তে ফিরে যেতে। যেখানে রিয়াজ ফুচকা খেতো কামড়ে। নাজ শিশুর মতো অভিমান করত। জোন্স কী খেয়েছে, রোজ রাতে টিভি-বিজ্ঞাপনের মতো করে শোনাত। আর কামিল দা হরহামেশাই ঝগড়া করত ফোনে। আলি সর্বদা ব্যস্ত থাকতো সাজুগুজু নিয়ে। ভাজ্জি বড়াই করত সবকিছুতে। আর সাহেব মজে ছিল এক বিরঙ্গনাতে। রোজ ঘটা করে শোনাত তার কথা। আরও একজন ছিল ৮০-র ওই আড্ডায়। সে ছিল সবার সব গল্পের নির্বাক শ্রোতা!  

ইচ্ছে করে আজও, তাদের না-বলা গল্পের শ্রোতা হতে। ইচ্ছে করে, বড্ড বেশি ইচ্ছে করে স্মিথ লেনের ওই লাল বাড়িটায় ফিরে যেতে। রোজ রাতে মিনার্‌ভা, পবিত্র বা জগন্নাথ থেকে ফিরে ৮০-র আড্ডায় শামিল হতে!

Friday 22 November 2019

বৃক্ষরোপণ ও ইসলাম



বৃক্ষরোপণ ও ইসলাম
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

আমরা সকলেই জানি যে, গাছ পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্য রক্ষা করতে এবং দূষণমুক্ত সবুজাভ পরিবেশ তৈরি করতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খাদ্যশস্য ও মৌসুমি ফলমূল উৎপাদনের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রাণী জগতের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার বন্দোবস্ত করে। খাদ্য তৈরীর সময় সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় পরিবেশ হতে কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে। এছাড়া মানুষের জন্য ওষুধ ও আসবাবপত্র তৈরিতে মূল্যবান উপকরণ জোগান দেয় উদ্ভিদের এই প্রয়োজনীয়তা ও অপরিসীম গুরুত্ব বোঝাতেই মহান আল্লাহ্‌ আল্‌-কুর্‌আনে গাছের নামে শপথ করেছেন—“ত্বিন (এক প্রকার উদ্ভিদ) ও যায়তুনের (জলপাইজাতীয় এক ধরণের ফল) শপথ! [সূরা আত্‌-ত্বিন ১] এবং সূরাটির নামকরণও গাছের নামেই করা হয়েছে।  

প্রাকৃতিক পরিবেশ— আল্‌-কুর্‌আনের ভাষ্য অনুযায়ী, মহান আল্লাহ এই প্রাকৃতিক পরিবেশকে মানুষের জন্য সুস্থ, সুন্দর, স্বাভাবিক, বাসোপযোগী অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ করে সৃষ্টি করেছেন। মানুষের অশেষ কল্যাণ ও উপকারের জন্য নানা প্রজাতির পশু-পাখি ও জীবজন্তু সৃষ্টি করেছেন। আরও সৃষ্টি করেছেন নানা ধরণের উদ্ভিদ ও গাছপালা; যা মানুষ সহ প্রাণী জগতের জীবনধারণের জন্য অত্যন্ত জরুরী। এবং উদ্ভিদ ও প্রাণি জগতকে বাঁচিয়ে রাখতে জল, বায়ু ও আলোর বন্দোবস্ত করেছেন। তাছাড়া, পাহাড়-পর্বত সৃষ্টি করে একদিকে ধরিত্রীর ভারসাম্য রক্ষা করেছেন তো অন্যদিকে নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর সৃষ্টি করে পরিবেশের অন্তর্নিহিত প্রাণপ্রবাহ অব্যাহত রেখেছেন। এবং পবিত্র কোরআনে এ বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে ঘোষণা  করেছেন—তিনিই আল্লাহ, যিনি বায়ু প্রেরণ করেন। বায়ু মেঘমালাকে সঞ্চারিত করে। অতঃপর তিনি মেঘমালাকে যেভাবে ইচ্ছা আকাশে ছড়িয়ে দেন এবং তা স্তরে স্তরে রাখেন। এরপর তুমি দেখতে পাও, তার মধ্য থেকে বারিধারা নির্গত হয়। তিনি তার বান্দাদের মধ্যে যাদের ইচ্ছা বৃষ্টি পৌঁছে দেন, তখন তারা আনন্দিত হয়। [সূরা আর্‌-রূম ৪৮]

উদ্ভিদ ও শস্য স্রষ্টার এক অমূল্য অনুগ্রহ— ইসলামে হালাল জীবিকা উপার্জন ও জনকল্যাণমূলক বিষয় হিসেবে কৃষিকাজ, ফলদ বৃক্ষরোপণ ও শস্যবীজ বপনের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিত রয়েছে। মহান আল্লাহ মানুষকে প্রকৃতির যতগুলো আশীর্বাদ ও অনুগ্রহ দান করেছেন, তার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হচ্ছে এই বৃক্ষরাজি। সৃষ্টিকুলের জীবন-জীবিকা ও বৃহৎ কল্যাণের জন্য গাছপালা, বৃক্ষলতা এবং মৌসুমি ফল-ফসলের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। এ প্রসঙ্গে আল্‌-কুর্‌আনের ঘোষণা— “তারা কি লক্ষ্য করে না, আমি উষর ভূমিতে পানি প্রবাহিত করে তার সাহায্যে উদগত করি শস্য, যা থেকে তাদের গবাদি পশু এবং তারা নিজেরা আহার গ্রহণ করে।” [সূরা আস্‌-সাজ্‌দাহ্‌ ২৭]

তিনি মানুষ সৃষ্টি করে প্রয়োজনীয় জীবনোপকরণ হিসেবে ভূপৃষ্ঠে ফলবান বৃক্ষরাজি সবুজ-শ্যামল বনভূমি সৃষ্টি করেছেনএবং এসবের দ্বারা পৃথিবীকে সুশোভিত অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত করেছেনগাছপালা দ্বারা ভূমণ্ডল, পরিবেশ প্রকৃতির ভারসাম্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন মর্মে তাঁর ঘোষণাআমি ভূমিকে বিস্তৃত করেছি তাতে পর্বতমালা স্থাপন করেছি এবং নয়নাভিরাম সর্বপ্রকার উদ্ভিদ উদ্গত করেছিএতে প্রত্যেক অনুরাগী ব্যক্তির জন্য জ্ঞান উপদেশ রয়েছেআর আমি আকাশ থেকে কল্যাণময় বৃষ্টি বর্ষণ করি এবং এর দ্বারা উদ্যান পরিপক্ব শস্যরাজি উদ্গত করি, যেগুলোর ফসল আহরণ করা হয়। এবং লম্বা লম্বা খেজুর গাছ; যাতে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ খেজুর। মানুষের জন্য জীবিকা স্বরূপ। এভাবেই আমি মৃত জনপদকে জীবিত করে তুলি।” [সূরা ক্বাফ ১১]  

গাছপালা যে স্রষ্টার বড় আশীর্বাদ আল্‌-কুর্‌আনের একাধিক আয়াতে তার উল্লেখ রয়েছেআল্লাহ্‌ বলেছেন— “অতঃপর বৃষ্টির জল দ্বারা আমি মনোরম উদ্যান সৃষ্টি করেছি। তার বৃক্ষরাজি উদ্গত করা তোমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।” [সূরা আন্‌-নাম্‌ল ৬০] উদ্ভিদ থেকে আগুন জ্বালানোর কথার উল্লেখ করে বলেছেন— তিনিই তোমাদের জন্য সবুজ বৃক্ষ থেকে আগুন উৎপাদন করেছেন, তা থেকে তোমরা আগুন জ্বালিয়ে থাকো।” [সূরা ইয়াসীন ৮০] গাছপালা থেকে আমরা কেবল কাঠ, ওষুধ ফলমূলই পাই নাগাছপালা থেকে বিভিন্ন রকমের সুগন্ধি দ্রব্য তেলও পাওয়া যায় এ বিষয়ের প্রতি মহান আল্লাহ্‌ এভাবে ইঙ্গিত করেছেন— “(এবং আমি সৃষ্টি করেছি) এমন এক বৃক্ষ, যা জন্মায় সিনাই পর্বতে, তাতে উৎপন্ন হয় আহারকারীদের জন্য তেল ব্যঞ্জন।’ [সূরা আল্‌-মুমিনূন ২০]  

উদ্ভিদ বিষয়ক গবেষণার আহবান— এভাবে তিনি কোরআনের নানা জায়গায় এই বৈচিত্র্যময় প্রকৃতির বেশ কিছু দৃশ্য মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন। যাতে এর বিচিত্র প্রকার, বর্ণ, গন্ধ ও সৌন্দর্য দেখে মানুষ পুলকিত ও অভিভূত হয়। এবং এসবের উন্নতি, অগ্রগতি ও সক্রিয়তা দেখে প্রকৃতি ও উদ্ভিদ জগত নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে। ঘোষণা করেছেন— “তিনিই তোমাদের জন্য আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। সেই জল তোমরা পান করো। এবং সেই জল থেকেই উদ্ভিদ উৎপন্ন হয়, যাতে তোমরা পশুচারণ করো। এবং তিনি ঐ জল দ্বারা তোমাদের জন্য উৎপাদন করেন ফসল, যায়তুন, খেজুর, আঙুর ও সর্বপ্রকার ফলমূল। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীলদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।” [সূরা আন্‌-নাহ্‌ল ১০ – ১১] অন্য এক জায়গায় রয়েছে, “নিশ্চয় আল্লাহ্‌ শস্যবীজ ও আঁটি বিদীর্ণকারী। তিনিই প্রাণহীন বস্তু হতে প্রাণবান বস্তু নির্গত করেন এবং প্রাণবান বস্তু হতে নিষ্প্রাণ বস্তু নির্গতকারী। হে মানব সকল, তিনিই আল্লাহ্‌। সুতরাং তোমাদেরকে বিভ্রান্ত করে কোন্‌ অজ্ঞাত দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?... তিনিই তোমাদের জন্য আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেছেন। তারপর ঐ জল দিয়ে সর্বপ্রকার উদ্ভিদচারা উদ্গত করেছেন। তা থেকে সবুজ গাছপালা। তাতে থরে থরে বিন্যস্ত শস্যদানা উৎপন্ন করেন। খেজুর গাছের চুমরি থেকে ঝুলন্ত কাঁদি নির্গত করেন। আঙুর, যায়তুন ও আনার উদ্গত করেছেন। সেসব একটি অন্যটির সদৃশ ও বিসদৃশ। যখন ঐ গাছ ফল দেয় তখন তার ফলের প্রতি ও ঐ ফলের পরিপক্কতার প্রতি গভীরভাবে লক্ষ্য করো। এসবের মধ্যে বিশ্বাসী লোকেদের জন্য অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে।” [সূরা আল্‌-আন্‌‘আম ৯৫, ৯৯]

পবিত্র কুর্‌আনে বেশ কিছু জায়গায় গাছপালা উদ্ভিদরাজি যে আল্লাহর একটি বিশেষ আশীর্বাদ সে-বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করার আহ্বান করা হয়েছে। আল্লাহ্‌ বলেছেন— মানুষ তার খাদ্যের প্রতি লক্ষ্য করুকআমি প্রচুর বারি বর্ষণ করিঅতঃপর আমি ভূমিকে ভালোভাবে বিদীর্ণ করে তাতে উৎপন্ন করি শস্য, আঙুর, শাক-সবজি, যায়তুন (তেল), খেজুর, বহু বৃক্ষবিশিষ্ট উদ্যান, ফলমূল এবং গবাদিপশুর খাদ্যএটা (আমি করি) তোমাদের ও তোমাদের গবাদিপশুর ভোগের জন্য।” [সূরা আবাসা ২৪-৩২] অন্য এক জায়গায় বলেছেন— তাদের জন্য একটি নিদর্শন হচ্ছে মৃত ধরিত্রী, যাকে আমি জীবিত করি এবং তা থেকে উৎপন্ন করি শস্য যা তারা ভক্ষণ করেতাতে আমি উৎপন্ন করি খেজুর আঙুরের উদ্যান এবং এতে আমি উৎসারিত করি প্রসবন, যাতে তারা এর ফলমূল ভক্ষণ করতে পারেএগুলো তো তাদের হাতে সৃষ্ট নয়তবুও কি তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে না? [সূরা ইয়াসিন ৩৩৩৫]  

বৃক্ষরোপণ একটি পুণ্যময় কাজ— হাদিস শাস্ত্রের নানা গ্রন্থে একাধিক হাদিস বর্ণীত হয়েছে উদ্ভিদ জগতের নানা বিষয়ে। কোথাও ইসলামে ফলদ বৃক্ষরোপণ ও ফসল ফলানোকে বিশেষ পুণ্যময় কাজ ‘সাদ্‌ক্বাহ্‌ জারিয়াহ্‌(অবিরত দান) রূপে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি একটি বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা করে, তাহলে ওই গাছটি যত দিন বেঁচে থাকবে এবং মানুষ ও অন্যান্য জীবজন্তু যত দিন তার ফল বা উপকার ভোগ করতে থাকবে, ততদিন ওই ব্যক্তির আমলনামায় (কৃতকর্মের তালিকায়) পুণ্য লেখা হতে থাকবে। রাসূল (সা) ঘোষণা করেছেন— “যখন কোনো মুসলিম গাছ লাগায় অথবা কোনো ফসল বোনে, আর মানুষ সহ পশু-পাখি তা থেকে খায়, তা রোপণকারীর জন্য সাদ্‌কা হিসেবে গণ্য হয়।” [বুখারি ২৩২০]

এমনকি ফলমূল বা ফসলের চুরি হয়ে যাওয় অংশটুকুও দান স্বরূপ গণ্য হবে। রাসুল (সা) বলেছেন, “যখন কোনো মুসলিম একটি ফলবান বৃক্ষের চারা রোপণ করে, আর তাতে ফল আসার পর সে নিজে অথবা অন্য কোনো মানুষ তা থেকে ভক্ষণ করে সবই তার জন্য সাদকা (দানস্বরূপ)। এমনকি যা চুরি য়ে যায়, এবং যা কিছু অর্থাৎ খোসা, আঁটি, বীজ ইত্যাদি গৃহপালিত পশু এবং নানা পাখপাখালি খায় সব তার জন্য সাদকা।” [মুসলিম ১৫৫৩]

শুধু তাই নয়, গাছে যত ফল হবে এবং যতদিন গাছটা বেঁচে থাকবে ততদিন ওই পরিমাণ পুণ্য তাঁর খাতায় যোগ হতে থাকবে। রাসুল (সা) বলেছেন— কোনো ব্যক্তি গাছ লাগাল গাছে যত ফল হবে তার আমলনামায় ততো সওয়াব (পুণ্য) লেখা হবে।” [আল্‌-জামে’ আস্‌-সাগীর, সুয়ূতি ৮০১৬, মুস্নাদ আহ্মাদ ২৩৪১২, ১৫৬১৬] এবং যতদিন গাছটা বেঁচে থাকবে, তার থেকে উপকার গ্রহণ করা হবে অর্থাৎকেয়ামত পর্যন্ত সেই গাছ তার জন্য সাদ্কাহ্জারিয়াহ্হিসেবে গণ্য হবে।” [মুস্লিম ১৫৫২]  

শুধু জীবিত অবস্থায় নয়, মৃত্যুর পরেও ওই রোপণকারী ব্যক্তি গাছ-লাগানোর পুণ্যফল পেতে থাকবে। যদিও মৃত্যুর পর মানুষের সকল কর্মের দরজা বন্ধ হয়ে যায়শুধু তিনটি উপায় খোলা থাকেনবী (সা) মর্মে বলেছেন— “যখন কোনো মানুষ মৃত্যুবরণ করে তার সমস্ত আমলের দরজা বন্ধ হয়ে যায় তিনটি উপায় ছাড়া। () যদি সে কোনো সাদ্কাহ্জারিয়াহ্রেখে যায়, () এমন জ্ঞান রেখে যায় যা মানুষের উপকারে আসে, () সু-সন্তান যে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেএই তিনটি ভালো কাজের ফল সে মৃত্যুর পরেও পেতে থাকবে।” [মুস্‌লিম ১৬৩১] উল্লেখ্য যে, বৃক্ষরোপণ অন্যতম সাদ্‌কাহ্‌ জারিয়াহ্‌।   

বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ— এভাবে নিজ অনুগামীদের উৎসাহিত করার পাশাপাশি নবী (সা) নিজেও বৃক্ষরোপণ করেছেন। একদিন তিনি (সা) সালমান ফারসি (রা)-এর মুক্তির জন্য তাঁর মনিবের কাছে বার্তা পাঠালেনতাঁর মনিব মুক্তিপণ হিসেবে ৪০ উকিয়া (আনুমানিক ১১৩৩.৯৮ গ্রাম) সোনা ও ৩০০ খেজুর চারা রোপণের শর্ত আরোপ করলরাসূল (সা) খুশী হয়ে চারা রোপণের ব্যবস্থা করলেন। এবং নিজ হাতে খেজুর-চারা রোপণ করে তাঁকে মুক্ত করলেন। [মুস্তাদ্রাক হাকিম ৬৫৪১, তাবারানি, আল্‌-মু’জামুল্‌ কাবীর ৬০৪০]   

এই নশ্বর পৃথিবীতে একজন বিশ্বাসীর মূল লক্ষ্য হলো মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা এবং বৃক্ষরোপনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব। কেননা গাছ লাগানো নবী (সা)-এর অতি পছন্দনীয় একটি কাজ এবং তাঁর সুন্নত। সহজ করে বললে, বৃক্ষরোপণও এক ধরণের ইবাদত। অতএব বৃক্ষ রোপণ এবং বীজ বপনের পাশাপাশি সেসবের রক্ষণাবেক্ষণ করাও আমাদের একান্ত কর্তব্য। এবং শুধু নিজেদের জন্য নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবেও বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ নিতে হবে। একটি বর্ণনায় এসেছে, একদিন বিখ্যাত সাহাবি আবু দার্‌দা (রা) একটি ফল গাছ লাগাচ্ছিলেন। এক ব্যক্তি তাঁর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো। তাঁকে গাছ লাগাতে দেখে বলল, আপনি একজন সাহাবি। আপনি গাছ লাগাচ্ছেন! আবু দার্‌দা (রা) উত্তরে বললেন— আমি রাসুল (সা)-কে বলতে শুনেছি, এই গাছের যে ফলমূল মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীকুল খাবে সবই রোপণকারীর জন্য সাদকা রূপে গণ্য হবে। [মুস্‌নাদ আহ্‌মাদ ২৭৩৭৯] অন্য বর্ণনায়, “আপনি তো বৃদ্ধ। মৃত্যু ঘনিয়ে এসেছে। আপনি এখন গাছ লাগাছেন! এই গাছের ফল হতে তো অনেক বছর লেগে যাবে। আবু দার্‌দা (রা) উত্তর দিলেন, তাতে কী! এর ফল অন্য মানুষ খাবে। আর আমি তার সুফল পাবো।” [শার্‌হুস্‌ সুন্নাহ্‌, বাগাবি ১৬৫২]

অন্য এক হাদিসে চাষাবাদ ও বৃক্ষরোপণের প্রয়োজনীয়তাকে অনুভব করে মহানবী (সা) আদেশ করেছেন, কেয়ামত (মহাপ্রলয়) এসে গেছে, এমন অবস্থায় তোমাদের কারো হাতে যদি ছোট একটি খেজুর-চারা থাকে, তাহলে সে যেন চারাটি রোপণ করে দেয়।” [মুস্‌নাদ আহ্‌মাদ ১২৯০২, আল্‌-আদাবুল্‌ মুফ্‌রাদ ৪৭৯, মুস্‌নাদ বায্‌যার ৭৪০৮]

মানুষের কল্যাণেই যেহেতু অধিক সবুজ ভূমির প্রয়োজন। তাই নবী (সা) সবুজায়নের নতুন পথও উদ্ভাবন করেছেন। অনাবাদী জমিগুলো যেন আবাদ হয়, সবুজ ভূমি বৃদ্ধি পায়, মানুষকে উৎসাহিত করতে ঘোষণা করেছেন— “যে ব্যক্তি কোনো পতিত ও পরিত্যক্ত ভূমি আবাদ করবে সেই ব্যক্তিই ঐ জমির মালিক হবে।” [বুখারি ২৩৩৫]

একটি গাছের মূল্য— গাছের প্রয়োজনীয়তা ও উপকারিতার কথা মাথায় রেখে তিনি (সা) আদেশ করেছেন, আমরা যেন বিনা-প্রয়োজনে গাছ না কাটি। একদিকে এটা যেমন অকৃতজ্ঞতা। অন্যদিকে নিজের হাতে নিজের ধ্বংসকে অনিবার্য করে তোলা। কারণ, একটি গাছ বাতাস থেকে ৬০ পাউন্ডেরও বেশি ক্ষতিকারক গ্যাস শোষণ করে এবং ১০টি শীততাপ নিয়ন্ত্রণ-যন্ত্রের সমপরিমাণ তাপ নিয়ন্ত্রণ করেএকটি পূর্ণবয়স্ক গাছ বছরে যে পরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করে তা কমপক্ষে ১০ জন পূর্ণবয়স্ক মানুষের বার্ষিক অক্সিজেনের চাহিদা মেটায়কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক টি এম দাস ১৯৭৯ সালে পূর্ণবয়স্ক একটি গাছের অবদান আর্থিক মূল্যে বিবেচনা করে দেখান যে ৫০ বছর বয়সী একটি গাছের আর্থিক মূল্য প্রায় এক লাখ ৮৮ হাজার মার্কিন ডলার৫০ বছর বয়সী একটি গাছ বছরে প্রায় ২১ লাখ টাকার অক্সিজেন সরবরাহ করেবছরে প্রাণিসম্পদের জন্য প্রোটিন জোগায় এক লাখ ৪০ হাজার টাকার। [ইন্ডিয়ান বায়োলজিস্ট, ভলিয়ম-১১, সংখ্যা--২, পৃষ্ঠা ৭৩-৭৯ (১৯৭৯)] তাই একটি দেশের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্য সে দেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগের মতো বনাঞ্চল থাকা জরুরিতা না হলে প্রাকৃতিক পরিবেশ ভারসাম্যহীন হতে বাধ্য   

গাছ কাটা নিষেধ— সুতরাং গাছ যত কমতে থাকবে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে। ফলস্বরূপ খরা, অনাবৃষ্টি ও নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দেবে। মানুষসহ পশুপাখি বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। তাই অনর্থক গাছকাটা এবং বন উজাড় করা ইসলামে গর্হিত কাজ। যদি তা কুল গাছ হয় তবুও। নবী (সা) বলেছেন, “কেউ যদি (অকারণে) কুল গাছ কাটে তাকে আল্লাহ অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন [আবু দাউদ ৫২৩৯, শায়েখ আল্‌বানি হাদিসটিকে সাহিহ বলেছেন] অর্থাৎ যে ব্যক্তি অকারণে বা না-হক ভাবে মরুভূমির কোনো বড় গাছ কাটবে, যেখানে পথিক তার ছায়ায় বা কোনো প্রাণী তার ডালে আশ্রয় গ্রহণ করে আল্লাহ্‌ তাকে অধোমুখে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। [মিশ্‌কাত ২৯৭০] তাই মুসলিম সেনাবাহিনী যুদ্ধে রওনা হওয়ার সময় রাসূল (সা) ও তাঁর উত্তরসূরি পরবর্তী সকল খলিফা কঠোরভাবে সৈন্যদের নির্দেশ দিতেন, তারা যেন বিজিতদের বাগান, গাছপালা শস্যক্ষেত্র ধ্বংস না করে

ইসলামের ভাষ্য অনুযায়ী মানুষের জন্যই প্রকৃতি, পরিবেশ ও পৃথিবীর এই বিশাল আয়োজন। নির্মল বায়ু সুপেয় জলসহ গাছপালা, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, সাগর-সমুদ্র ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপকরণগুলো মানুষসহ সকল প্রাণীর জন্য আবশ্যিক। অথচ মানুষই বিশ্বব্যাপী শিল্পায়ন ও নগরায়নের আড়ালে এই প্রকৃতিকে ধ্বংস করছে। কল-কারখানার নির্গত কালো ধোঁয়া একদিকে যেমন বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা কমিয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বাড়িয়ে জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলছে। অন্যদিকে কল-কারখানার নির্গত শিল্পবর্জ্য পানিতে মিশে পানিকে করছে দূষিত, যা মানুষের স্বাস্থ্য, পরিবেশ ও মৎস্য প্রজাতির জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। আর তাই আল্‌-কুর্‌আন স্পষ্ট করে দিয়েছে, “জলে ও স্থলে বিপর্যয় ঘটে মানুষের কৃতকর্মের ফলে” [সূরা আর্‌-রূম ৪১]।

যেহেতু গাছ প্রকৃতির অন্যতম উপকরণভূমি, জল পরিবেশগত বৈচিত্র্যের অন্যতম কারিগরগাছ ছাড়া প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করা অসম্ভব এবং আমাদের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, নীতিকথা, বাণিজ্য, দর্শন, শিল্প-সংস্কৃতি সব কিছুই গাছকে ঘিরে গাছকে নিয়েতাই একটি গাছ নিহত হলে মানুষসহ সব প্রাণসত্তার জন্যই তা ঝুঁকি উত্কণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়ায়সুপেয় পানি নির্মল বায়ুর ঘাটতি দেখা দেয়দূষণ বৃদ্ধি পায়ধীরে ধীরে প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারায়এবং ধ্বংস অনিবার্য হয়ে ওঠে পরিবেশ পৃথিবীর

তাই, ইদানীং সমগ্র বিশ্বে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে ও তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। তার মধ্যে অন্যতম হল বৃক্ষরোপণ। ইসলামও এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি করতে বহু কালজয়ী নির্দেশনা দিয়েছে। প্রাণী জগতের বসবাসের জন্য অনুকূল পৃথিবী গড়ার আহ্বান জানিয়েছে। শুধু বৃক্ষরোপণ নয় বরং তা রক্ষাণাবেক্ষন বিষয়েও গুরুত্ব আরোপ করেছে। অতএব মানুষ রূপে, মুসলিম হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের ঈমানি দায়িত্ব হল,  আমরা যেন পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে উদ্যোগী হই। পরিবেশের প্রকৃত বন্ধু গাছকে নির্বিচারে না-কেটে বরং বৃক্ষরোপণের শুভ উদ্যোগ গ্রহণ করি। বিশ্বকবির ভাষায়, “আমরা যেমন স্নান করি এবং শুভ্র বস্ত্র পরিধান করি, তেমনি বাড়ির চারিদিকে যত্নপূর্বক একখানি বাগান করিয়া রাখা ভদ্র প্রথার একটি অবশ্যকর্তব্য অঙ্গ হওয়া উচিত।” [বাগান, রবীন্দ্র-রচনাবলী, খণ্ড ৩০ (বিশ্বভারতী, ১৪০৪)]

[এই প্রবন্ধটি দু’ কিস্তিতে পূবের কলম-এর দ্বীনদুনিয়া ক্রোড়পত্রে ১৫-১১-২০১৯-এ “উদ্ভিদের গুরুত্ব আল্‌-কুর্‌আনের আলোকে” এবং ২২-১১-২০১৯-এ “বৃক্ষরোপণে উৎসাহ দিয়েছেন নবী মুহাম্মদ সা.)” শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছে।]