Friday 29 September 2017

ডক্টর তাহা হুসাইন


ডক্টর ত়াহা হ়ুসাইন
(১৮৮৯ ১৯৭৩ খ্রি)
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
 
পরিচিতি ও জন্মঃ
ত়াহা হ়ুসাইন আধুনিক আরবি সাহিত্যের ইতিহাসে একজন স্বনামধন্য লেখক, সাহিত্যিক সমালোচক। আরবি গদ্য সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর অসামান্য অবদান ও অনন্য ভূমিকার জন্য তাঁকে ‘আমীদুল-’আদাবিল-‘আরাবী বা আরবি সাহিত্যের পথিকৃৎ রূপে অভিহিত করা হয়। ডক্টর ত়াহা হ়ুসাইন ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ই নভেম্বর নীলনদের বাম তীরে অবস্থিত মাগাগাহ্‌ শহরের নিকটবর্তী আল-কীলূ গ্রামে এক নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা হুসাইন ‘আলী একটি সুগার মিলে চাকরী করতেন। তাঁর তেরোজন সন্তানের মধ্যে ত়াহা হ়ুসাইন ছিলেন সপ্তম। মাত্র তিন বছর বয়সে চক্ষুরোগে আক্রান্ত হয়ে চিরকালের মত দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেন। কিন্তু অদম্য ইচ্ছাশক্তি প্রখর মেধার দ্বারা পরবর্তী জীবনে এই দুর্বলতাকে তিনি পরাভূত করতে পেরেছিলেন
 
বাল্যকাল ও শিক্ষাঃ
সর্বপ্রথম তাঁকে গ্রামের মক্তবে ভর্তি করে দেওয়া হয়। সেখানে তিনি পবিত্র আল্‌-কুর্‌আন হিফ্‌য (মুখস্থ) করেন। অতঃপর আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রস্তুতি-স্বরূপ মাজমূ‘উল মুতূন সহ কিছু প্রাচীন গ্রন্থ ও কবিতা পাঠ করেন। ১৯০২ সালে তেরো বছর বয়সে তিনি বিখ্যাত আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। আর সেখানে সাহিত্যের শিক্ষক শায়েখ সাইয়েদ আল-মুর্‌সাফী-র দ্বারা দারুণ ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেনঅতঃপর ১৯০৮ সালের ২৮শে ডিসেম্বর মিসর বিশ্ববিদ্যালয় (বর্তমানে কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি সেখানে ভর্তি হন। সেখানে শায়েখ মাহ্‌দী ও মুহাম্মাদ আল-খুয্‌রীদ-এর পাশাপাশি নালিনো (Carlo Alfonso Nallino) ও লিট্‌মান (Littmann)-দের মতো ইউরোপীয় প্রাচ্যবিদদের লেকচার দ্বারা দারুনভাবে প্রভাবিত হন। এখানে তিনি সান্ধ্যকালীন ক্লাসে ফরাসি ভাষা শেখেন অতঃপর ১৯১৪ সালে উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্র হিসাবে জ়িক্‌রা ’আবিল-‘আলা বা আবুল্‌ আলার স্মৃতিচারণা বিষয়ের উপর অভিসন্দর্ভ লিখে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। এখানে ছাত্র থাকা অবস্থায় তিনি আল্‌-জারীদাহ্‌ সহ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লিখতে আরম্ভ করেন।
 
ফ্রান্স গমন ও বিবাহঃ  
গ্রাজুয়েশনের পরেই তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য ফ্রান্স যেতে মনস্থ করেন। অবশেষে লুতফী আস-সাইয়েদের সহযোগিতায় ফ্রান্স যেতে সক্ষম হন। ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যলয়ের স্কলারশিপ প্রাপ্ত হয়ে, ১৯১৪ সালে তিনি মন্টেপেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরবর্তীতে প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১৯১৮ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় হতেই ইবনু খালদূনের সমাজ-দর্শনের উপর অভিসন্দর্ভ লিখে দ্বিতীয় ডক্টরেট ডিগ্রী প্রাপ্ত হন। এছাড়া এখানে অবস্থানকালে তিনি গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষাও রপ্ত করেন এবং প্রাচীন ইতিহাসে একটি ডিপ্লোমা অর্জন করেন। এখানেই ১৯১৭ সালে তাঁর রিডার সুযান (Suzanne Bresseau) নামের এক ফরাসী মহিলার প্রণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তার গর্ভেই আমীনা ও মুওনিস জন্ম গ্রহণ করেন।
 
শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতার জীবনঃ
১৯২১ সালে তিনি মিসরে প্রত্যাবর্তন করে কায়েরো বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রীক ও রোমন ইতিহাসের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। অতঃপর ১৯২৫ সালে মিসরীয় বিশ্ববিদ্যালয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হলে তিনি সেখানে আরবি সাহিত্যের অধ্যাপক নিযুক্ত হন। পরের বছর, ১৯২৬ সালে তিনি ফিশ্‌ শে’রিল্‌ জাহেলী (প্রাক্‌-ইসলামী কবিতা) শীর্ষক গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। এতে তাঁর বিতর্কিত মতামতের জন্য প্রবল সমালোচনার মুখে তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে তার সুহৃদ লুত্‌ফি আস-সাইয়িদ সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে রেকটর থাকায় তিনি তার সমর্থনে এগিয়ে আসেন এবং পদত্যাগ পত্র গ্রহণে অসম্মতি জানান। পরের বছর, ১৯২৭ সালে বিতর্কিত কিছু বিষয়ের বিয়োজন ঘটিয়ে তিনি এটিকে ফিল্‌ আদাবিল্‌ জাহেলী (জাহেলী যুগের সাহিত্য) নামে প্রকাশ করেন।
 
অতঃপর ১৯২৮ সালে তিনি কলা বিভাগের ডীন নিযুক্ত হন। কিন্তু তা ছিল মাত্র একদিনের জন্য। এরপর ক্রমান্বয়ে ১৯৩০ এবং ১৯৩৬-৩৮ কলাবিভাগের ডীন নিযুক্ত হন। মাঝের সময়টিতে তিনি সাংবাদিকতার সূত্রে কয়েকটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। পরবর্তীতে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের কন্ট্রোলার নিরবাচিত হয়েছিলেন।       
 
সম্মাননা ও মৃত্যুঃ
১৯৫১ সালে অক্সফোর্ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সাম্মানীক ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদান করেএছাড়া মিসর সরকার কর্তৃক সাহিত্যে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৫৯ সালে জায়েযাতুদ্‌ দাওলাহ্‌ আত্‌-তাক্‌দীরিয়্যাহ্‌ নামের জাতীয় সাহিত্য পুরস্কারটি লাভ করেন। ১৯৭৩ সালের ২৮ শে অক্টোবর কায়রোতে এই বিরলতম প্রতিভাটির জীবন প্রদীপ নির্বাপিত হয়।
 
রচনাবলীঃ
লেখক সমালোচক ত়াহা হ়ুসাইন রচনা করেছেন একাধিক পুস্তক, যা তাঁকে মৃত্যুর পরও অমর করে রেখেছে। তাঁর কতকগুলি বিশ্বখ্যাত পুস্তক ও রচনা হল(১) জ়িক্‌রা ’আবিল-‘আলা (২) কাদাতুল্‌ ফিক্‌র (৩) হাদীসুল্‌ আর্‌বে’আ (৪) ফিল্‌ আদাবিল্‌ জাহেলী (৫) ফিস্‌ সায়েফ (৬) হাফিয ও শাওকী (৭) মা’আল্‌ মুতানাব্বী (৮) মুস্‌তাক্‌বিলুস্‌ সাকাফাতু ফী মিস্‌র (৯) মা’আ আবিল্‌ ‘আলা ফী সিজ্‌নেহী (১০) বায়েন বায়েন (১১) মির্‌আতুল্‌ ইস্‌লাআম (১২) আল্‌-আইয়াম (১৩) ‘আলা হামেশিস্‌ সীরাহ্‌ (১৪) আদীব (১৫) দু’আউল্‌ কির্‌ওয়ান (১৬) আল্‌-কাস্‌রুল্‌ মাস্‌হূর (১৭) আল্‌-হুব্বুদ্‌ দায়ে’ (১৮) আহ্‌লামু শাহার্‌যাদ (১৯) শাজারাতুল্‌ বুস (২০) জান্নাতুশ্‌ শাওক (২১) আল্‌-ওয়া’দুল্‌ হাক্‌ ইত্যাদি। 

Sunday 24 September 2017

হাম্মাম বিন গালিব আল-ফারাযদাক

আল্‌-ফ়ারায্‌দাক়্

(৬৪১ – ৭৩২ খ্রি)

আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

 

জন্ম বংশ পরিচয়ঃ

আরবী সাহিত্যের ইতিহাসে যুগে যুগে যে সকল কবিসাহিত্যিকদে আগমন ঘটেছে তাদের মধ্যে অন্যতম একটি নাম ফ়ারায্দাক়্ফ়ারায্দাক়্ আরবী সাহিত্যের আকাশে এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা। আরবী সাহিত্যে তাঁর অসামান্য অবদানের জন্যই বলা হয়ে থাকে

لولا شعر الفرزدق لذهب ثلث العربية 

(ফ়ারায্দাক়-এর কাব্যকবিতা না থাকলে আরবী ভাষার এক তৃতীয়াংশ বিলুপ্ত হয়ে যেতো।)  

তাঁর উপনাম আবু ফিরাস, প্রকৃত নাম হাম্মাম, পিতার নাম গালিব ও পিতামহের নাম সাসাআহ্‌। তবে তিনি আল্‌-ফ়ারায্দাক়্ নামে অধিক পরিচিত। তিনি কাযিমা নামক জায়গায়৪১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বিশিষ্ট তামীমী কবি। বানু তামীম গোত্র জাহলী যুগে জাযীরার পুর্বাঞ্চলে বসবাস করতো। এ গোত্রের শাখা ইয়ামামা থেকে ফোরাতের উপকূল এবং নজদের অভ্যন্তরীন অংশে বিস্তৃত ছিল। ফারাযদাকের পিতা পিতামহ সবাই উচ্চ বংশীয় অভিজাত ছিলেন। তার দাদা সাসা সম্পর্কে বিশেষ ভাবে উল্লেখ রয়েছে যে জাহেলী যুগে তিনি ফিদিয়া দিয়ে শত শত শিশুকে জীবন্ত সমাধিস্ত হবার হাত থেকে বাচিয়েছেন। তাই তাঁকে মুহ্‌য়িউল্‌ মাউঊদাত ( محيئ المؤودات) অর্থাৎ জীবন্ত সমাধিস্থদের জীবন প্রদানকারী নামে অভিহিত করা হয়।

 

জীবনযাপনের ধরণঃ  

ফ়ারায্দাক় ছিলেন একটু ভিন্ন প্রকৃতির কবি। তার জীবন ছিল অনিয়ন্ত্রীত। বিশেষ কারো অধীনে তার বল্গাহীন জীবন বাধা পড়েনি। দীর্ঘদিন তিনি দামেশকের উমাইয়া দরবার থেকে দূরে অবস্থান করেন। সম্ভবত তিনি ধারণা করেছিলেন যে তাঁর বংশ মর্যাদা এবং গৌরব উমাইয়াদের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। মদিনায় তিনি স্বচ্ছলেই জীবন অতিবাহীত করছিলেন। সারাক্ষণ আমোদ প্রমোদে লিপ্ত থাকতেন। ক্রিতদাসীদের ঘরে যেতেন নিয়মিত। এ কথা তিনি নিজের কবিতায় উল্লেখ করেছেন তেমনি ফারাযদাকের চারিত্রিক দুর্বলতার কথা কবি জারির নানা ভাবে সমালোচনা করতেন।

 

সংসার জীবনঃ 

রুক্ষ এবং কঠোর স্বভাবের কারণে ফারাযদাকের দাম্পত্য জীবন সুখের ছিল না। তাঁর স্ত্রী নায়রের সাথে বিচ্ছেদের ঘটনাই তাঁর অসুখী হবার প্রমা মেলে। কুরায়েশ বংশের এক লোক নায়ারকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল। নায়ার ফারাযদাককে নিজের অভিভাবক নিয়োগ করে। ফারাযদাকের জীবন সঙ্গীনী হিসেবে নায়ার কখনোই সুখী ছিল না। তাদের মধ্যে অশান্তি ,কলহ, দ্বন্দ্ব লেগেই থাকতো। ইবনু কুতাইবার বর্ণনা অনুযায়ী ফারায্‌দাকের জামাআ নামে একটা পুত্র সন্তান ছিল। এ ছাড়া তার কন্যাদের মধ্যে যাদের নাম উল্লেখ করা যায় তারা হলেন লাবাতা, সাবাতা, খাবাতা এবং রাককাতা। তার একমাত্র ছেলেটি ছিল কবি।

 

জীবনাবসানঃ 

১১৪ হিজরীতে ফ়ারায্দাক়্মৃত্যু মুখে পতিত হন। জুরযী জায়দান তার মৃত্যু সাল ১১০ হিজরী বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু তিনি ১১৪হিজরীতেই মারা গেছেন।

 

স্বভাব চরিত্রধর্ম বিশ্বাসঃ   

আরবী সাহিত্যের এই ক্ষণজন্মা কবি বাস্তব জীবনে কোন ধর্মই অনুসরণ করতেন না। পক্ষান্তরে তার স্ত্রী ছিলেন একজন পুণ্যশীলা ধার্মীক নারী। উভয়ে বনিবনা না হবার কারনে দুজনের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কবি ফ়ারায্দাক়্ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। এ কারনে তার মনে আত্মবিশ্বাস এবং গর্ব ছিল অনেক বেশি। তার কন্ঠ ছিল সে সময় তামীম গোত্রের সবার চেয়ে বেশি গুরুগম্ভীর। তিনি ইসলামে নিষিদ্ধ মদ পান  এবং অন্যান্য গর্হিত কাজে লিপ্ত ছিলেন। তার জীবন ছিল অনিয়ন্ত্রীত।

 

কবিতার বৈশিষ্ট্যঃ 

ফারাযদাকের কাব্য ভাষা ছিল অত্যন্ত তীক্ষ্ন। কবি হুতায়া ফারাযদাকের কবিতা শুনে বলেছিলেন এগুলোকেই বলে কবিতা। এতদিন যা শুনেছি তা কবিতা নয়। সেই সময়ে ফ়ারায্দাক়্বনু উমাইয়াদের কবি হিসেবে মনোনীত হন। অন্য কবিদের মত তিনি নিজে খলিফাদের গুনগান গেয়ে কবিতা লিখেছেন। ভাষা এবং ব্যাকরণবিদগণ ফারাযদাকের কাব্য থেকে অভিধানের কিছু উপকরণ সংগ্রহ করেছেন। কথিত আছে যে ফারাযদাকের কাব্য সম্ভার না থাকলে আরবী ভাষার এক তৃতীয়াংশ নিশেষ হয়ে যেত। তিনি তাঁর এক বিখ্যাত কবিতায় ইমাম যানুল আবেদীন-এর প্রশংসায় বলেছেন     

هذا الذي تعرف البطحاء وطأته     والبيت يعرفه والحل والحرم

তিনি অন্য এক কবিতায় আরও গর্ব করে বলেছেন    

أحلامنا تزن الجبال رزانة     وتخالنا جنّا إذا ما نجهل

Sunday 17 September 2017

আলোর সন্ধানে সালমান আল-ফারসীর সফরনামা

আলোর সন্ধানে সালমান আল-ফারসীর সফরনামা 

আব্দুল মাতিন ওয়াসিম


জাতিতে পারসিক সেজন্ম ইস্পাহানের জাইয়ান গ্রামে। পিতা ছিলেন সেই গ্রামেরই সর্দার এবং গ্রামবাসীদের মধ্যে সর্বাধিক ধনাঢ্য ও সম্মানীয়। সে ছিল পিতার নয়নের মণি। এক পলক দৃষ্টি-অগোচর হোক, পিতা সইতেই পারতেন না। তাই, পূজিত অগ্নির তত্ত্বাবধায়ক করে প্রায় গৃহবন্দী করে রাখলেন তাঁকে; যেমনভাবে কোন বাঁদিকে ব্যস্ততা ও কাজের বেড়াজালে বেঁধে রাখা হয়। এতে যুবকটি অগ্নিপূজায় মনোযোগী হল; মুহূর্তের জন্যও আগুন নিভতে দিত না।       
পিতার ছিল অঢেল ভূ-সম্পত্তি। একদিন গৃহ নির্মাণে ব্যস্ত থাকায় তিনি যুবককে বললেন- ‘সোনা আমার! তুমি তো দেখছই, আমি আজ একটু ব্যস্ত। তাই তুমি আজ একটু খামারে গিয়ে কাজের দেখাশোনা করো।’
যুবকটি খামারের দিকে রওয়ানা হল। পথিমধ্যে, একটি গির্জার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় শুনতে পেল কিছু অদ্ভুত শব্দগুচ্ছ। গৃহবন্দী থাকার কারণে মানুষের চাল-চরিত্র সম্পর্কে তাঁর খুব একটা ধারণা ছিল নাতাই কৌতূহলী হয়ে তাদের কর্মকান্ড দেখার জন্য গির্জার ভীতরে প্রবেশ করল তাঁদের প্রার্থনা-পদ্ধতিতে মুগ্ধ হয়ে মনে ধারণা জন্মাল, এ ধর্ম তাঁর ধর্ম অপেক্ষা উত্তম। প্রার্থনা শেষে খ্রিস্টানদের জিজ্ঞাসা করল- ‘এ ধর্মের উৎপত্তি কোথায়?’ তাঁরা বলল- সিরিয়ায়। এভাবে কখন যে সূর্য অস্ত চলে গেছে, সে টের পায়নি। 
ফিরে আসল। বাড়িতে ঢোকা মাত্র পিতা প্রশ্ন করলেন- কোথায় ছিলে? তোমাকে যে কাজ দেওয়া হয়েছিল তার কী খবর? সে বলে উঠল- আব্বা! আমি একটি গির্জার পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম। ভীতরে কিছু লোক প্রার্থনা করছিল। তাঁদের ধর্মাচরণ আমার খুব ভালো লেগেছে। সূর্যাস্ত পর্যন্ত আমি তাঁদের কাছেই ছিলাম।
- বাবা! ঐ ধর্মে কোন মঙ্গলই নেই। আমাদের ধর্ম তার চেয়ে অনেক ভালো।
- স্রষ্টার শপথ! কখনই নয়, ঐ ধর্ম আমাদের ধর্ম অপেক্ষা অধিক শ্রেষ্ঠ।    
এসব শুনে পিতার মনে আশংকার মেঘ ঘনীভূত হতে আরম্ভ করল। পাছে সে ধর্ম-বিমুখ না হয়ে যায়, ভয়ে পায়ে বেড়ি পরিয়ে তাকে গৃহেই বন্দী করে রাখলেন। অন্যদিকে যুবকটি লোক মারফৎ খ্রিস্টানদের নিকট অনুরোধ জানালো, সিরিয়াগামী কোন কাফেলার সংবাদ থাকলে জানাতে।   ভাগ্যক্রমে, কিছুদিন পর সিরিয়াগামী একটি যাত্রীদলের খবর সে তাঁদের কাছ থেকে জানতে পারলো। আর কৌশল করে পায়ের শিকল খুলে ফেলে লুকিয়ে সিরিয়ার পথে রওয়ানা দিল। 
সিরিয়া পৌঁছে, লোকেদেরকে সে প্রথম প্রশ্ন করল- এই ধর্ম সম্পর্কে সর্বাধিক অভিজ্ঞ ব্যক্তি কে? লোকেরা উত্তর করল- গির্জার পাদ্রী। অতঃপর সে পাদ্রীর নিকট সব বৃত্তান্ত খুলে বলে সাহচর্যের প্রার্থনা করল, যাতে তাঁর অনুকরণে সঠিক ধর্মাচরণের দীক্ষা লাভ করতে পারে। সুযোগও হল। কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই পাদ্রীর আসল রূপ তাঁর নিকট প্রকাশ পেল। সে অবাক- কীভাবে পাদ্রী ভক্তদের দানশীলতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করছে, আর তাঁদের দেওয়া দানের অর্থ অভাবীদের মাঝে বিলি না করে অনায়াসে সঞ্চয় করে চলেছে, নিজের জন্য! এভাবে সোনা-রূপায় পূর্ণ সাতটি কলস সঞ্চয় করে ফেলেছেআর এসব দেখে যুবকের মনে ভীষণ রাগ হচ্ছিল। ঘটনাক্রমে, কিছুদিন পর পাদ্রীর মৃত্যু হল। ভক্তরা যখন তাঁর অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়ার উদ্দেশ্যে সমবেত হল, যুবকটি তাঁর অসৎ চেহারাটা সবার সামনে প্রকাশ করে দিল। আর প্রমাণ স্বরূপ দেখিয়ে দিল তাঁর সঞ্চয়কৃত কলস সাতটি। তাঁরা রেগে গিয়ে শহরেরই কোনো এক চৌমাথায় তাঁকে শূলবিদ্ধ করল। অতঃপর প্রস্তর-আঘাতে দেহটিকে ক্ষতবিক্ষত করে ক্রোধাগ্নি খানিকটা প্রশমিত করল।
কিছুক্ষণ পরেই অপর এক ব্যক্তিকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা হল। সে প্রকৃত অর্থেই ছিল সৎ, ধর্ম-পরায়ণ ও পার্থিব-মোহমুক্ত। যুবক তাঁকে ভালোবেসে ফেলল। তাঁর সাহচর্যে ধর্মাচরণের কিছু নিয়মনীতিও রপ্ত করে ফেলল। এরই মধ্যে যখন সেই ধর্মযাজক মৃত্যু-শয্যায় পৌঁছে গেলন, যুবকের অনুরোধে তাঁকে ইরাকের মুসিল শহরে এক ব্যক্তির সন্ধান দিয়ে তাঁর সাথে সাক্ষাতের উপদেশ দিলেন। কারণ, ধর্মযাজকের দৃষ্টিতে সেই কেবল প্রকৃত খ্রিস্ট ধর্মের অনুসারী      
তাঁর মৃত্যুর পর যুবকটি মুসিলে গেল। সেই ব্যক্তিটি সব কিছু শুনে যুবককে তাঁর নিকট অবস্থানের অনুমতি দেয়। সে প্রকৃতার্থেই ছিল সৎ। কিন্তু কিছুদিন পরে সেও মৃত্যুবরণ করল। মৃত্যুর পূর্বে তিনি যুবককে বলে ছিলেন- হে বৎস! আল্লাহর কসম! আমার জানা মতে নাসিবাইনের এক ব্যক্তি আমাদের ধর্মের উপর অটল আছে। তুমি তার সাথে দেখা করো নাসিবাইনে পৌঁছে যুবক সেই ব্যক্তির সাথে দেখা করল। সব কিছু জানার পর তিনি তাঁকে নিজের কাছে থাকতে অনুমতি দিলেন। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই তারও মৃত্যুর ঘণ্টা বেজে গেল। তবে মৃত্যুর পূর্বে তিনি যুবককে বলেছিলেন- হে বৎস! আল্লাহর কসম! একজন ব্যক্তি ছাড়া আমি আর কাউকে আমাদের সঠিক পথে দেখছি না, যার কাছে তোমাকে যেতে বলব। তিনি থাকেন আম্মুরিয়্যাহ-তে অতঃপর যখন সে মারা গেল এবং তাঁকে দাফন-কাফন করা হ, তখন যুবকটি আম্মুরিয়্যাহ-র সেই ব্যক্তির কাছে উপস্থিত হল।  সকল বৃত্তান্ত শুনে তিনি বললেন, তুমি আমার নিকট অবস্থান করো
আমুরিয়াহ-তে অবস্থান কালে যুবকটি কিছু উপার্জনও করেছিলএক পর্যায়ে সে কিছু গাভী ও বকরীর মালিক হয়ে গেছিল কিছু দিন পর সেই গুরুরও মৃত্যু ঘনিয়ে আসল।  শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে গুরু শিশ্যকে ডেকে বললেন, হে বৎস! আমার জানা মতে এখন আর এমন কোন ব্যক্তি নেই যে আমাদের ধর্মে বিশ্বাসী। যার কাছে আমি তোমাকে যেতে অনুরোধ করবো। তবে শেষ নবী আবির্ভাবের সময় ঘনিয়ে এসেছে। তিনি ইবরাহীম (আঃ)-এর ধর্মে প্রেরিত হবেন। আরব ভূমিতে তিনি আত্মপ্রকাশ করবেন। আর তিনি এমন ভূমির দিকে হিজরত করবেন যা পাথরময় হবে এবং খেজুর গাছে ভরে থাকবে। তাঁর কিছু স্পষ্ট নিদর্শন থাকবে। তিনি হাদিয়া গ্রহণ করবেন, তবে সাদক্বাহ খাবেন না। তাঁর উভয় কাঁধের মধ্যভাগে নবুঅতের (নবিত্বের) সিলমোহর থাকবে। যদি তোমার ঐ দেশে যাওয়ার সামর্থ্য থাকে তবে তুমি যেয়ো।
তাঁর মৃত্যুর পর যুবকটি কিছু দিন আম্মুরিয়্যাহতে অবস্থান করলঅতঃপর সেদিক দিয়ে কালব গোত্রের একটি বাণিজ্যিক কাফেলা যাচ্ছিল। সে তাদের বলল, তোমরা আমাকে আরবে নিয়ে চল। বিনিময়ে আমি তোমাদের এই গাভী ও বকরীগুলো দিয়ে দেবোতারা বলল, ঠিক আছে। অতঃপর তাদের সেগুলো দিয়ে দিল আর তারা তাকে সঙ্গে নিয়ে রওয়ানা দিল। যখন তারা তাকে নিয়ে ওয়াদী আল-কুরায় (একটি স্থানের নাম) পৌঁছল, তাঁকে দাস-হিসাবে এক ইহুদীর নিকট বিক্রয় করে দিল। ফলে সে তার নিকট অবস্থান করে খেজুর গাছ দেখাশুনা করতে লাগল। অল্প কদিন বাদেই বনী কুরায়যার এক বাসিন্দা মনিবের চাচাত ভাই মদীনা হতে মনিবের কাছে আসল। আর তাঁকে ক্রয় করে মদীনায় নিয়ে গেল। মদীনা শহর দেখা মাত্রই যুবকের মনের ক্যানভাসে অন্তিম গুরুর কথাগুলি ভেসে উঠতে লাগল। সে মদিনাকে চিনতে পারল।
যুবকটি একদিন নিজ মালিকের খেজুর গাছের মাথায় কাজ করছিল। আর মনিব সেই গাছের নীচে বসেছিল। ইত্যবসরে তাঁর এক চাচাত ভাই তার নিকট এসে বলতে লাগল, আল্লাহ বনী কায়লাহদের ধ্বংস করুন। তারা কুবাতে মক্কা থেকে আগত এক ব্যক্তির নিকট সমবেত হয়েছে। তারা তাকে নবী বলে ধারণা করছে। একথা শুনে যুবকের শরীরে এক অদ্ভুদ রকমের কম্পন শুরু হয়ে গেল। এক পর্যায়ে তাঁর মনে হল যে সে মনিবের উপর পড়ে যাব। অতঃপর খেজুর গাছ থেকে নেমে আসল এবং মনিবের চাচাত ভাইকে শুধালো, আপনি কী যেন বলছিলেন? মনিব চটে গিয়ে খুব জোরে আঘাত করলেন এবং বললেন, এ ব্যাপারে তোমার কী হয়েছে? তুমি তোমার কাজে যাও।
সেদিন সন্ধ্যাবেলা কিছু জমানো খেজুর নিয়ে কুবাতে রাসুল সা-র নিকট হাজির হয়ে বলল,  আমি খবর পেয়েছি, আপনি একজন সৎ মানুষ। আর আপনার সাথে আপনার দরিদ্র সঙ্গীসাথী রয়েছে। এগুলো আমার নিকট সাদকাহর জন্য ছিলআমি এগুলোর ব্যাপারে আপনাদেরকে অধিক হকদার মনে করি।
রাসূল সা তাঁর সাথীদের উদ্দেশে বললেন, তোমরা খাও। কিন্তু তিনি নিজে কিছুই খেলেন না। এরপর যখন রাসূল সা মদীনায় চলে আসলেন। কিছু খেজুর নিয়ে সে আবার তাঁর নিকট গেল। বলল, আপনি সেদিন সাদকাহর একটা খেজুরও খাননি। তাই এগুলো আপনার জন্য হাদিয়া এনেছিরাসূল সা নিজে খেলেন এবং সাহাবীদেরও দিলেন।
নবিত্বের দুটি আলামত দেখতে পেয়ে আনন্দে নেচে উঠেছিল তাঁর মন। ফলে তৃতীয়টির খোঁজে সে বাকীউল গারকাদে নবী সা-র নিকট পৌঁছাল। সেখানে তিনি এক সাহাবির জানাযায় গেছিলেন। তাঁর পরিধানে ছিল দুটি চাদর। সঙ্গীসাথীদের মঝে বসেছিলেন। যুবক সালাম দিয়ে তাঁর পিঠের দিকে ঘুরে দেখতে লাগল; যাতে গুরুর বর্ণনা মোতাবেক ঐ মোহরটি দেখতে পায়। যখন রাসূল সা তাকে দেখলেন যে, পিছনে ঘুরছে, বুঝতে পারলেন এবং পিঠ থেকে চাদর সরিয়ে ফেললেন। মোহরটি দেখে তার উপর ঝুঁকে পড়ল এবং চুমু দিয়ে কাঁদতে লাগল
এসব দেখে রাসূল সা যুবকটিকে ডাকলেন- এদিকে এসো। বলো, কী ব্যাপার তোমার...?  সে তাঁর সমস্ত ঘটনা খুলে বলল। নবী সা সহচরদের সম্মুখে আরেকবার শোনাবার জন্য অনুরোধ করলেন।

গল্পের সেই যুবকটি বিখ্যাত সাহাবি সালমান আল-ফারসি...।


-----------------------------------------------
*তথ্যসূত্র-  মুসনাদ আহমাদ হা/২৩৭৮৮, সিলসিলা সাহীহাহ হা/৮৯৪



 Image result for আলোর সন্ধানে