Wednesday 9 November 2016

তালাক - এক না তিন, কখন ও কীভাবে...?

তালাক - এক না তিন, কখন ও কীভাবে...?  
ড. মহাঃ মসিহুর রহমান
বিভাগীয় প্রধান (আরবি), আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় 
বর্তমানে তালাককে কেন্দ্র করে তুমুল বিতর্ক চলছে। বিশেষত, তিন তালাক ইস্যুতে বেশ ধুন্ধুমার লেগে গেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠনের মধ্যেতাই এ বিষয়ে আলোচনা করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে বলে আমি মনে করি।
তালাকের পূর্বে যা করণীয়ঃ 
মনে একটা প্রশ্ন জাগে, ইসলামি শরিয়তে তালাক কেন বৈধ? এ কথা সবাই জানে যে তালাক হলো বিবাহবন্ধন ছিন্ন করার নাম। সাধারণ অবস্থায় বিবাহ প্রত্যেক মানুষের প্রয়োজন। এটা রসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাত। বিবাহের মাধ্যমে একটি নতুন পরিবার অস্তিত্ব লাভ করে। এভাবেই মানবপ্রজন্মের ধারাবাহিকতা চলে। বিবাহ একটি ইবাদতও বটেকারণ তার মাধ্যমেই বৈধ পদ্ধতিতে জৈবিক চাহিদা পূরণ হয় এবং অবৈধ যৌনসম্পর্ক হতে নিরাপদ থাকে। তাই এই কল্যাণময় বন্ধনটি আরও বলিষ্ঠরূপে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিতকেননা এই সম্পর্ক যতো মজবুত হবে তার ফলাফল ততটাই উত্তম ও সুখকর হবে। ইসলাম বিবাহসম্পর্ককে বলিষ্ঠতম অঙ্গীকার এবং অত্যন্ত শক্তিশালী বন্ধন আখ্যা দিয়েছেপবিত্র কুরআনে আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: এবং তারা তোমাদের নিকট হতে সুদৃঢ় অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিল[সূরা নিসা : ২১]
কুরআন কারিমে “মিসাক্ব” (অঙ্গীকার) শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে প্রভু ও বান্দার মধ্যে উপাসনায় একত্ববাদের বিষয়ে । ওই একই শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে বিবাহ-বন্ধনের জন্য। কুরআনের এই বর্ণনাশৈলীর দিকে লক্ষ্য করলে আমরা অনুমান করতে পারি কুরআন বৈবাহিক সম্পর্ককে কতটা গুরুত্ব দিয়েছে। অতঃপর আমরা দেখছি কুরআন কারিমে “মিসাক্ব” শব্দের বিশেষণরূপে “গলীয” (বলিষ্ঠ) শব্দটি শুধুমাত্র বৈবাহিক সম্পর্ক এবং আল্লাহ্‌ ও তাঁর বান্দার মধ্যে অঙ্গীকারের জন্যই ব্যবহৃত হয়েছেআর তারা তোমাদের থেকে নিয়েছিল দৃঢ় অঙ্গীকার [সূরা নিসা: ২১] 
কুরআনের দৃষ্টিতে বিবাহ একটি বলিষ্ঠ অঙ্গীকার। রসূলুল্লাহ্‌ (সা.) একজন সাহাবিকে বললেন যে, যার পক্ষ থেকে বিবাহের সম্বন্ধ এসেছে সেই মহিলাকে একবার দেখে এসোএর কারণস্বরূপ তিনি বললেন: “এর ফলে তোমাদের সম্পর্ক স্থায়ী হবে”(তিরমিযি: ১৮৭)
সুতরাং বিবাহের স্থায়িত্ব ও বলিষ্ঠতার জন্য বিবাহের আগেও চেষ্টা করা উচিত এবং পরেও। বিবাহের পরে এই বন্ধনকে বলিষ্ঠ করার জন্য আল্লাহ্‌ তাআলা রসূলুল্লাহ্‌ (সা.)-কে দুটি বিষয়ের নির্দেশ দেন:
(১) স্বামী-স্ত্রী উভয়ের অধিকার ও দায়িত্ব স্পষ্ট করা; যাতে তাঁরা নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে পারে কারণ স্বামী যদি স্বীয় দায়িত্ব পালন করে তাহলে স্ত্রী নিজ অধিকার পেয়ে যাবে আর স্ত্রী যদি স্বীয় দায়িত্ব পালন করে তাহলে স্বামীও তার অধিকার পেয়ে যাবে। এই মর্মে রসূলুল্লাহ্‌ (সা.) পুরুষদের বললেন: তোমরা যা খাও স্বীয় স্ত্রীকে তাই খাওয়াও, যা পরো তাই পরাও এবং তাকে গালমন্দ করো না। স্ত্রীকে বললেন যে তোমরা স্বামীর আনুগত্য করো এবং তাঁর ঘরে ও বিছানায় এমন কাউকে আহ্বান করো না স্বামী যাকে অপছন্দ করে(তিরমিযি: ১১৬৩; আবুদাউদ: ১৮৩০)
(২) জীবনের যাত্রাপথে উত্থান-পতন হতে থাকে। সুখ দুঃখ উভয় অবস্থায় যেন একে অপরের মানসিকতাকে বোঝার চেষ্টা করে এবং পরস্পরের সঙ্গে ন্যায়নিষ্ঠার সম্পর্কটি যেন ছিন্ন না করে। পুরুষদেরকে রসূলুল্লাহ্‌ (সা.) বলেন: (কোনো মু’মিন পুরুষ যেন কোনো মু’মিন স্ত্রীকে ঘৃণা না করে, যদি তার কোনো একটি  স্বভাব  তোমাকে ভালো না লাগে তবে তার অন্য স্বভাবগুলি ভালো লাগতে পারে)। (মুসলিম : ২৬৭২) 
এটি একটি অত্যন্ত জ্ঞানগর্ভমুলক উপদেশ এবং এমন এক বাস্তবতা যার অভিজ্ঞতা প্রত্যেক ব্যক্তির আছে। প্রত্যেকের মধ্যে যেমন কিছু ত্রুটি থাকে, ঠিক তেমনি কিছু গুণও থাকে। তাই, ক্রোধের সময় স্ত্রীর ভাল গুণগুলির কথা স্মরণ করে স্বামীর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং ক্রোধ প্রশমিত করা সহজ হয়ে যায়। এ প্রসঙ্গেই স্বামীদের সম্বোধন করে আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন:
আর যদি তোমরা তাদেরকে অপছন্দ করো, তবে এমনও হতে পারে যে, তোমরা কোন কিছুকে অপছন্দ করছ আর আল্লাহ তাতে অনেক কল্যাণ রেখেছেন[সূরা নিসা : ১৯]  
আর স্ত্রীদের উদ্দেশ্যে প্রিয় নবি (সা.) বলেন: “যদি আমি কাউকে কোনো ব্যক্তির সামনে সেজদা করার নির্দেশ দিতাম তাহলে স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম, সে যেন নিজ স্বামীকে সেজদা করে”। (তিরমিযি,অধ্যায়: বিবাহ, ১১৫৯)  
এই দু’টি কথার বাস্তবায়নের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের বন্ধু হতে পারে পক্ষ বিপক্ষ নয় একে অন্যের অঙ্গ হয়ে যায় একে অপরের বিরোধী নয়। এরূপ ধারণা জন্মালে অনেক সমস্যা উৎপন্ন হওয়ার অবকাশই পাবে না এই অনুভূতি থাকলে, যদি কারো মধ্যে কোনো অভাব বা ত্রুটি থেকে থাকে বা কোনো  দিক থেকে অবহেলা দেখা যায় বা কোনো কাজ সম্পন্ন না হয় তাহলে তার উপর রাগ না করে তাকে সহানুভূতি দেখানো উচিত তাকে ভর্ৎসনা না করে তাকে বোঝানো উচিৎ প্রতিশোধ নেওয়ার জায়গায় সংশোধনের কথা ভাবা উচিৎ যখন এক পক্ষ হতে এমন প্রবণতা এবং আচরণ দেখা যায় তখন অপর পক্ষ নিজ আচরণের প্রতি লজ্জিত হয় এবং সম্মান ও শ্রদ্ধার প্রবণতা জাগ্রত হয় পরস্পরের প্রতি ঘৃণা ও দূরত্ব শেষ হয়ে যায় আর কেনই বা হবে না ? তাঁরা একে-অন্যের অঙ্গ, উভয়ে মিলেই পূর্ণতা লাভ করে, তারপরে কেউ কি নিজ অঙ্গের সাথে এধরণের কথা ভাবতে পারে? কুরআন প্রজ্ঞাময় শৈলীতে এই সম্পর্কের কথা বলছে : তোমরা একে অপরের অংশ[সূরা আলে ইমরান: ১৯৫] আরও অর্থপূর্ণ ভাষায় কুরআন এর স্বরূপ বর্ণনা করছে : তারা তোমাদের আচ্ছাদন আর তোমরা তাদের আচ্ছাদন[সূরা বাকারা : ১৮৭]  রসূলুল্লাহ্‌ (সা.) এই পারস্পরিক সম্পর্কের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন : “নারী পুরুষের অঙ্গ”। (আবুদাউদ : ২৩৬)
স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে সহানুভূতির এই দিকটি যখন সামনে থাকে না তখন ছোটো ছোটো ব্যাপারে সমস্যা দেখা দেয় সামান্য ব্যাপারে অনর্থক সমস্যা তৈরি হয় কথায় কথায় ধরপাকড় শুরু হয়ে যায়। অতঃপর একপক্ষের সন্দেহ এবং তিরস্কার অন্য পক্ষের মধ্যে ক্রোধ এবং প্রতিশোধের প্রবণতা সৃষ্টি করে। অতঃপর বালির পর্বত তৈরি হয় এবং স্ফুলিঙ্গ অগ্নিকুণ্ডে বদলে যায় যাতে সম্পূর্ণ ঘর জ্বলে যায়। ধারাবাহিক আগুন ছড়াতে থাকে আর সবকিছুকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দেয়। শুধু স্বামী-স্ত্রীই নয়, বরং দুটি পরিবারই পুড়ে যায়। আর সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি সন্তান-সন্ততির হয়। যখন একে অপরকে বন্ধু ও অঙ্গ মনে করবে না তখন প্রতিপক্ষ ও পার্টি হয়ে যাবে। সর্বদা দ্বন্দ্ব থাকবে, দায়িত্ব পালনের স্থলে নিজ অধিকার কামনা করতে শুরু করবে। এটাই বিপরীতমুখী শিক্ষা এবং ভাবনা যা জীবনের বাহনকে পিছনে ঠেলে দেয়। যদি এই ভাবনাকে সঠিক করা যায় এবং শিক্ষায় পরিবর্তন আনা যায় তাহলে সে জায়গায় থেকেও উভয় একে-অন্যের শুভাকাঙ্খী হয়ে যায় এবং সুন্দরভাবে নিজেদের সমস্যার সমাধান করতে পারে। রসূলুল্লাহ্‌ (সা.) বলেছেন: “দেখো, মহিলাদের ব্যাপারে তোমরা সদাচরণের উপদেশ গ্রহণ করো, তারা তোমাদের শুধুমাত্র সহায়ক”(তিরমিযি : ১১৬৩)
তালাক দেবেন নাঃ
এইভাবে দাম্পত্য সম্পর্ক যখন বলিষ্ঠ হয় তখন সেটা নষ্ট করার কোনো প্রয়োজন থাকে না। এটাই বিবাহের ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গী। এটাই আল্লাহ্‌ এবং তাঁর রসূলের উদ্দেশ্য রসূলুল্লাহ্‌ (সা.)-এর নির্দেশ যথাসম্ভব তালাক থেকে বিরত থাকা বাঞ্ছনীয়। তালাকের অনিষ্টের কথা বিভিন্ন ভাবে বর্ণনা করেছেন। দ্বিতীয় বিবাহের জন্য ইসলাম তালাককে সমর্থন করে না। যৌনাকাঙ্ক্ষা যদি বেশি হয় তাহলে ন্যায়সঙ্গত পথে তা পূরণ করার অনুমতি আছে। ন্যায় ও সামর্থ্যের সাথে একাধিক বিবাহের দ্বার উন্মুক্ত আছে। কিন্তু বস্ত্র জুতো পরিবর্তন করার ন্যায় স্ত্রী পরিবর্তন করা অত্যন্ত নিকৃষ্ট কাজ।
যদি এই একই অবাঞ্ছিত চাহিদা ও নোংরা কামভাব নারীর মধ্যে জাগ্রত হয় এবং কোনো বৈধ কারণ ছাড়াই স্বামীর নিকট তালাক চায় তাহলে সে হবে আল্লাহ্‌র পক্ষ হতে কঠিন শাস্তির অধিকারী।  হাদিসে এই সম্পর্কে বলা হয়েছে: “যে মহিলা তার স্বামীর নিকট কোনো উপযুক্ত কারণ ছাড়াই তালাক চায় তাহলে তার জন্য জান্নাতের সুগন্ধি হারাম করে দেওয়া হয়”। (আবুদাউদ : ১৮৯৯)
তালাক সামান্য কথা এবং রাগে দেওয়ার বিষয় নয়। যেভাবে বিবাহের সময় দুটি বাক্য বলে দুজন পুরুষ ও নারী এতটাই নিকটস্থ হয়ে যায় যেটা পরিবারের অন্য কারো সঙ্গে থাকে না, একইভাবে একটি শব্দ সেই বলিষ্ঠ সম্পর্ককে নষ্ট করে দেয়। সম্পর্ককে অটুট রাখার জন্য সেই একটি শব্দ থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে। এই শব্দাবলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামান্য কথাবার্তায় এবং সাধারণ বিবাদ-বিতর্কের জন্য সেই শব্দগুলির প্রয়োগ বিষ পান করার মতোই। সুতরাং সামান্য কথায় এমন ভয়ানক ত্রুটি হতে সাবধান। রসূলুল্লাহ্‌ (সা.) বলেছেন: “তিনটি ক্ষেত্রে দৃঢ় সংকল্প ও ঠাট্টা সমান, যথা: বিবাহ, তালাক এবং প্রত্যাবর্তন (স্ত্রীকে এক বা দুই তালাক দেওয়ার পর ফিরিয়ে নেওয়া)” (তিরমিযি: ১১৮৪, আবুদুউদঃ ২১৯৪, ইবনে মাজাহঃ ২০৩৯) অর্থাৎ ভেবেচিন্তে বললে যেমন এই তিনটি জিনিস সংগঠিত হয়ে যায়, অনুরূপ ঠাট্টার স্বরেও এই শব্দগুলি উচ্চারণ করলে এগুলো সাব্যস্ত হয়ে যায় প্রকৃতপক্ষে ইসলাম এই তিনটি বিষয়ের গুরুত্বের কারণে সেগুলোকে ঠাট্টার পাত্র বানানো থেকে বাধা দিতে চেয়েছে তাই এমন শব্দাবলি সাধারণ ব্যাপারে উচ্চারণ করা এবং সামান্য কথায় সেগুলি ব্যবহার করা আল্লাহ্তাআলার নিকট অত্যন্ত অপছন্দনীয় এবং মারাত্মক ভুল তাই এ বিষয়ে সচেতন ও সতর্ক হোন অযথা তালাক দেওয়া থেকে বিরত থাকুন যদি জিজ্ঞাসা করা হয় বিশ্বে সবচেয়ে নিকৃষ্ট জিনিস কী, তাহলে তার উত্তর হবে তালাক এই উত্তর বিশ্বের সবচেয়ে সত্যবাদী ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবি মুহাম্মাদ (সা.)-এর তিনি বলেন : “আল্লাহ্তাআলার নিকট বৈধ জিনিসের মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণ্য ও অপছন্দনীয় হচ্ছে তালাক (আবু দাউদ : ১৮৬৩)
কোনো বৈধ কাজ এর থেকে খারাপ ন তালাক এতো খারাপ এইজন্য যে, এর প্রভাব কোনো একক ব্যক্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, এর দ্বারা শুধু ব্যক্তিই প্রভাবিত হয় না বরং এর প্রভাবে পরিবারের ঐক্য নষ্ট হয়ে যায় অতঃপর দুই পরিবারের মধ্যে অবজ্ঞা ও শত্রুতা জন্ম নেয় নবপ্রজন্মের ভিত নড়বড়ে হয়ে যায় ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ সমাজে ভাঙন দেখা যায় এতো গভীর প্রভাবের জন্যই তালাক সবচেয়ে নিকৃষ্ট জিনিস
যদি মতানৈক্য দেখা দেয়?
        হতে পারে স্বামী-স্ত্রী উভয়ই স্ব স্ব দায়িত্বের ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন এবং চিন্তাশীল, তবুও অনেক সময় তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়এমন অবস্থায় কী করা উচিৎ? ক্রোধবশে কী তালাক দিয়ে দেওয়া উচিৎ? একদম না। তালাকের মতো গুরুত্বপূর্ণ জিনিস ক্রোধবশে হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। যদি মতভেদ দেখা দেয় তাহলে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি দিন:  
·         মতভেদ কেন হলো? আপনার বিরুদ্ধে কি কোনো সত্যি অভিযোগ আছে? যদি থাকে তাহলে সেটা দূর করুন। আপনি কোনো হক প্রদান না করে থাকেন তাহলে তা পূরণ করুন। নিজের ত্রুটি দূর করুন। দেখবেন মতভেদ নিজে নিজেই শেষ হয়ে যাবে।  
·         আপনারা দুজনই বসে শান্তভাবে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করুন। একে অপরকে বোঝান। এতে মতভেদের অবসান ঘটবে।
·         পরিবারের কোনো শুভাকাঙ্ক্ষীকে মাঝে বসান সে দুজনের কথা শুনে উভয়কে বুঝিয়ে অভিযোগ দূর করবে। যার ত্রুটি দেখবে তাকে সচেতন করবে। এটা জয়-পরাজয়ের কোনো ব্যাপার নয়। নিজের জীবনকে সুখময় করার ব্যাপারসুতরাং নিজের ত্রুটি তৎক্ষণাৎ গ্রহণ করে সেটাকে দূর করুন।
·         যদি মতভেদ আরও এগিয়ে যায় তাহলে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের পরিবার থেকে এক একজন করে বিচারক নির্ধারণ করুন। পরিবারের সদস্যদের এই জন্য নেবেন যে, তারা গৃহের ব্যাপারে অধিক ওয়াকিবহাল থাকে এবং ঠিকমতো সেটা যাচাইও করতে পারে। এরা যেন অবশ্যই আন্তরিক ও শুভাকাঙ্ক্ষী হয়। এদের লক্ষ্য হবে মতভেদের অবসান ঘটিয়ে স্বামী-স্ত্রীকে মিলানো। উভয় বিচারক পূর্ণ ঈমানদারি ও ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে মতভেদের পর্যালোচনা করবে এবং দুজনের জন্য নীতি নির্ধারণ করবে। যেসব কারণে মতভেদ হয়েছে সেগুলোর পথ রুদ্ধ করবে অথবা সেগুলোর সীমা নির্ধারণ করবে।
·         কিছু ক্ষেত্রে মতভেদের কারণ স্বামী-স্ত্রী হয় না, বরং কোনো তৃতীয় ব্যক্তি হয়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসা রয়েছে, একে অপরের জন্য শুভকাঙ্ক্ষা রয়েছে, কিন্তু যৌথ পরিবারের কোনো ব্যক্তি এদিকের কথা ওদিকে এবং ওদিকের কথা এদিকে লাগিয়ে, অথবা মিথ্যা রনা করে, অথবা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কাউকে নিজের মতো করে চালানোর জন্য দুজনের মধ্যে ঝগড়া বাধিয়ে দেয়অনেক সময় পাড়া-প্রতিবেশীর কোনো মহিলা বা পুরুষ স্বামীকে স্ত্রীর বিরুদ্ধে অথবা স্ত্রীকে স্বামীর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে। এহেন অবস্থায় স্বামী-স্ত্রী উভয়ের উচিৎ সেই ষড়যন্ত্রকারীর কথা কর্ণপাত না করা। বরং তাকে স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দেওয়া যে আমাদের সমস্যার সমাধান আমরা নিজেরাই করে নেব। যদি এমন স্বগৃহের কোনো ব্যক্তি করে তাহলে স্বামী-স্ত্রীকে এমন একটি পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে যাতে কোনো তৃতীয় ব্যক্তি হস্তক্ষেপ করতে না পারে। প্রয়োজনে বাসস্থান পরিবর্তন করে নিতে হবে। কারণ পরিবেশ পরিবর্তিত হলে পূর্বের পরিবেশে সৃষ্ট মতভেদ দূর হতে পারে। মতভেদ দূর করা একজন মু’মিনের বৈশিষ্ট্য। এটা আল্লাহ্‌র নির্দেশ। বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার চাহিদাও এটা। তাই কুরআনে পুরুষদের উপদেশবাণী দেওয়া হয়েছে : আর তোমরা তাদের সাথে সদ্ভাবে বসবাস করো [সূরা নিসা : ১৯]
কুরআনে আল্লাহ্‌ তাআলা অঙ্গীকার করেছেন যে, যদি তোমরা মতভেদ দূরীকরণের চেষ্টা করো তাহলে আল্লাহ্‌ তাআলা তোমাদের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরি করে দেবেন। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেছেন : আর যদি তোমরা তাদের উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের আশঙ্কা করো তাহলে স্বামীর পরিবার থেকে একজন বিচারক এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন বিচারক পাঠাও। যদি তারা মীমাংসা চায় তাহলে আল্লাহ উভয়ের মধ্যে মিল করে দেবেন [সূরা নিসা : ৩৫]
কী সুন্দর সমাধান! কতো ভগ্নহৃদয়কে আল্লাহ্‌ তাআলা জোড়া লাগিয়েছেন! মতভেদ হলে কুরআনের এই ফর্মূলা ব্যবহার করুন। শুধু আনন্দা নয়,বরং পূর্বাপেক্ষা অধিক ভালোবাসা ও সম্পর্ক গড়ে ওঠবে, ইন শা- আল্লাহ্‌।
বিচ্ছেদের জন্য শুধু এক তালাক
সর্বজনবিদিত যে, জীবনে উত্থান-পতন আসে পরস্পরের বিরুদ্ধে কখনো অভিযোগ হয় তো কখনো কষ্ট এসব জীবনে অবিচ্ছদ্দ অংশ বোধ হয় কারো জীবন এইসব থেকে মুক্ত ন এসব হতেই থাকে আজ অভিযোগ আছে, কাল সেটা থাকবে না আর্থিক সঙ্কট আছে, উভয়ে মিলে চেষ্টা করলে আল্লাহ্তাআলা স্বাচ্ছন্দ্য দান করতে পারেন এসব ব্যাপারে বিচ্ছেদ ঘটে না এসব কারণে তো বিচ্ছেদের কথা ধারণায় আসা উচিৎ নয় সুরাংত এমন কখনো করবেন না সামান্য কথায় বা রাগে তালাক শব্দ উচ্চারণ করবেন না খুব ভালোভাবে চিন্তা করুন তালাক কী
যেভাবে বিবাহ দুই অপরিচিত ব্যক্তিকে যুক্ত করে, একইভাবে তালাক বিবাহকে নষ্ট করে দেয় সুতরাং তালাক সেই মুহূর্তের জন্য যখন বিবাহ বিচ্ছেদ করার প্রয়োজন হয় বিবাহের জন্য মাসের পর মাস কথাবার্তা ও আলাপ-আলোচনা হয়; পরিবারের বয়োজ্যষ্ঠদের এবং বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে পরামর্শ করা হয় সর্বতোভাবে সম্মতি অর্জন করা হয় অতঃপর বিশেষ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে এবং বড়োদের উপস্থিতিতে বিবাহকার্য সম্পন্ন করা হয় একইভাবে যখন বিবাহ-বিচ্ছেদে কথা উঠবে তখন সবদিক থেকে সে ব্যাপারে আলোচনা করতে হবে, পরিবারের বয়োজ্যষ্ঠদের ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে ধর্মীয় বিদ্বানদের নিকট সেই সংক্রান্ত নির্দেশনা নিতে হবে এসবের পর পূর্ণ স্থির হতে হবে যে বিবাহ-বিচ্ছেদের প্রয়োজন আছে। এটাই আল্লাহ্‌ তাআলার নির্দেশ। ওই সময় বড়োদের উপস্থিতিতে বিবাহ-বিচ্ছেদের কার্য সম্পাদন করতে হবে। এরই নাম তালাক। খুব সংক্ষিপ্ত বাক্যে আল্লাহ্‌ তাআলা একথা বলেছেন : অতঃপর বিধি মোতাবেক রেখে দেবে কিংবা সুন্দরভাবে ছেড়ে দেবে [সূরা বাকারা : ২২৯]
অর্থাৎ বিবাহের উদ্দেশ্য উত্তম পদ্ধতিতে জীবন কাটানো। যদি এটা সম্ভব না হয় এবং মতভেদ দূরীকরণ ও পরামর্শের যাবতীয় স্তর পরিক্রম করার পর এই সিদ্ধান্ত হয় যে, বিচ্ছেদই স্বামী-স্ত্রী উভয়ের জন্য কল্যাণকর, তখন বিচ্ছেদকার্য সম্পন্ন করা বাঞ্ছনীয়। এহেন পর্যায়ে বিবাহবিচ্ছেদকে কুরআন সঠিক বলেছে। কুরআন বলছে যখন স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মনে হবে যে তারা আর সুখময় জীবন অতিবাহিত করতে পারবে না, পরস্পরের অধিকার দিতে পারবে না এবং দাম্পত্য জীবনের ক্ষেত্রে আল্লাহ্‌ প্রদত্ত বিধানসমূহ বাস্তবায়িত করতে পারবে তখন তাদের বিচ্ছিন্ন হওয়াই বাঞ্ছনীয়। অতঃপর যদি তোমরা (উভয় পক্ষের শালিসগণ) আশঙ্কা করো যে উভয়পক্ষ আল্লাহর আইনসমূহ ঠিক রাখতে পারবে না, তাহলে উভয়ের প্রতি কোন গুনাহ নেই যদি কোন কিছুর বিনিময়ে স্ত্রী নিজেকে মুক্ত করতে চায়। এগুলো আল্লাহর আইন, কাজেই তোমরা এগুলোকে লঙ্ঘন করো না [সূরা বাকারা : ২২৯]
এই পর্যায়ে এসে তালাকের কার্য সম্পন্ন করা হবে। আর তার জন্য নিম্নের নিয়মগুলি মেনে নিতে হবে।
·         যদি আপনি স্ত্রীকে মোহর না দিয়ে থাকেন তাহলে তালাকের পূর্বে তাকে দিয়ে দিন।
·         দেখুন, স্ত্রী এই সময় কী অবস্থায় আছে। যদি সে মাসিকের অবস্থায় থাকে তাহলে তার পবিত্র হওয়ার সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করুন এবং পবিত্র হওয়ার পর যেন তার সঙ্গে আপনার যৌনসঙ্গম করার পূর্বে তালাক দিন
·         এবার কমপক্ষে দুইজন প্রবীণের সামনে শুধু এক তালাক দিন। মুখে একবার একথা বলা বা লিখে দেওয়াই যথেষ্ট হবে “আমি তালাক দিচ্ছি”। ব্যাস, তালাক হয়ে যাবে। এই বাক্যের পুনরাবৃত্তি করবেন না। তালাক শব্দটি দুবার উচ্চারণ করবেন না। এমন করা মহামূর্খামীর কাজ। দুবার বা তিনবার বলা মহাভুল। এমন ভুল কখনো করবেন না। আপনি জানেন এটা কতো বড়ো ভুল? এটা এতো সাংঘাতিক ভুল যখন রসূলুল্লাহ্‌ (সা.) জানতে পারলেন যে জনৈক সাহাবি এই ভুল করেছেন এবং তিনবার তালাক দিয়েছেন তো দয়ার প্রতিমূর্তি রসূলুল্লাহ্‌ (সা.)-এর চেহারা রাগে রক্তিম হয়ে উঠেছিল। রাগান্বিত হয়ে একথা বলেছিলেন: “আমার জীবিত থাকা অবস্থায় তোমরা আল্লাহ্‌র পুস্তকের (বিধান) সঙ্গে খেলা করছ”। (নাসায়ী : ৩৪৩০)
·         ক্রোধ এবং ভাষার কঠোরতা দেখুন এবং চিন্তা করুন একাধিক তালাক কতো বড়ো পাপ এবং কতো ভয়ঙ্কর অপরাধ। কিছু অজ্ঞ মানুষ এসব মুহূর্তে তিনবার তালাক লখায় অথবা বলায়। তাদের যথাযথ শরিয়তের জ্ঞান নেই। কোনো আইনি কাগজে তালাক লেখার প্রয়োজন হলে শুধু একবার লিখুন। মনে রাখুন বিচ্ছেদের জন্য এক তালাক-ই যথেষ্ট।
·         এক তালাক দিলেই তালাক সম্পন্ন হয়ে যায়। তখন থেকে ইদ্দত শুরু হয়ে যায়। তিন মাসিক বা তিনমাসের সময় অতিবাহিত হলেই স্বামী-স্ত্রীর সমস্ত সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। ইদ্দতের সময়কাল পর্যন্ত নারীর সমস্ত ব্যয়ভার পুরুষের উপর থাকে। এই সময়কালে নারী স্বামীর গৃহেই ইদ্দত পালন করবে। অনেক সময় এমন হয় ইদ্দতের তিনমাসের মধ্যে বিচ্ছিন্ন জীবন কাটাতে কাটাতে নিজের বিগত সিদ্ধান্তের উপর অনুশোচনা হয় এবং অন্য কাউকে বিবাহবন্ধনে না এনে সেই স্ত্রীকে গ্রহণ করার ইচ্ছে হয়। এমন সময় শুধু রুজু করে নেওয়াই যথেষ্ট হবে। রুজু বলতে বোঝায়, স্বামী স্ত্রীকে বলবে আমি তোমাকে আবার স্ত্রীরূপে গ্রহণ করছিঅথবা তার স্ত্রীর ন্যায় কোনো ব্যবহার করবে। রুজু করার ব্যাপারটিও বড়োদের সামনে আলোচিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। রুজুর পর নতুন সম্পর্ক আবার আরম্ভ হবে। যদি ইদ্দতের তিনমাস কেটে যাওয়ার পর এমন ইচ্ছে হয় তাহলে দ্বিতীয়বার সম্পর্ক গড়ার নিয়ম হলো, দ্বিতীয়বার নতুন মোহর দিয়ে তার সঙ্গে বিবাহকার্য সম্পন্ন করতে হবে। বিবাহের পর আবার তারা স্বামী-স্ত্রী হয়ে যাবে। এক তালাকের পর ভবিষ্যতে এমন সম্ভাবনার পথ খোলা থাকে। আর যদি সম্ভাবনার কথা ভাবা না হয় তবুও বিচ্ছেদ এক তালাকেই হয়ে যায়।
তিন তালাক-এর বিষয়ঃ
        আজকাল তিন তালাকের বিষয়টি বহুলচর্চিত। মানুষ বিভিন্ন ধরনের মন্তব্য করছে। সর্বপ্রথমে একথা ভালোভাবে জেনে নিন যে তিন তালাক দেওয়া পাপের কাজ। আর যদি আপনি পূর্বের আলোচনাগুলি অধ্যয়ন করে থাকেন তাহলে আপনার সামনে স্পষ্ট যে তিন তালাকের কোনো প্রয়োজ নেই। তালাক অত্যন্ত চিন্তাভাবনা এবং পরামর্শ করে দেওয়া উচিৎ। আর শুধু এক তালাকেই বিচ্ছেদ ঘটে যায়। এক ব্যক্তি আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসকে বলল, আমার কাকা নিজের স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়ে ফেলেছে। উত্তরে ইবনে আব্বাস বললেন, তোমার কাকা আল্লাহ্‌র বিধান অমান্য করেছে। পাপের কাজ করে ফেলেছে। শয়তানের আনুগত্য করেছে। (তাহাবী) 
        যদি কেউ বিচ্ছেদের জন্য এক তালাকের উল্লেখিত পদ্ধতি অবলম্বন না করে তিন তালাক দেয় তাহলে এই বিষয়ে কয়েকটি কথা তার জেনে রাখা ভালো-  
·         এক সঙ্গে তিন তালাক দেওয়া অবাধ্যতা ও পাপকার্য এবং যে এমন করে সে পাপী এবং রসূলুল্লাহ্‌ (সা.)-এর চরম অবাধ্য।
·         এক সঙ্গে তিন তালাক দিলে তালাক সম্পন্ন হয়ে যায়। সারাবিশ্বের মুসলমানগণের মধ্যে ইসলামি বিধি-বিধানের চারটি মাযহাব প্রচলিত আছে। এই চারটি ফিক্‌হী মাসলাক অর্থাৎ হানাফি, শাফিয়ী, মালিকী এবং হাম্বালী-এদের নিকট এমন তিন তালাক তিন তালাকই গণ্য হয় যাকে তালাকে মুগাল্লাযা বলে। এর মানে এখন তাদের মিলিত হওয়ার পথ একদম বন্ধ।
·         আমাদের দেশে এবং বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে কিছু মুসলমান আহ্‌লে হাদিস রয়েছে। আর শিয়াদের একটা বড়ো অংশ জা’ফারি ফিক্‌হ অনুযায়ী আমল করে। এই দু’টি মতবাদে যদি তিন তালাক দেওয়া যায় তাহলে তালাক তো হয়ে যাবে, কিন্তু তিন তালাক গণ্য হবে না, বরং এক তালাক গণ্য হবে।
·         উভয় প্রকার ফিকহী মতামতের পক্ষে শরয়ী দলিল বিদ্যমান। যে ব্যক্তি যে মতবাদের সঙ্গে জড়িত সে স্বীয় বিদ্বানগণের নিকট জিজ্ঞাসা করে আমল করবে।
·         এক সঙ্গে তিন তালাক দেওয়ার সময় যদি কোনো মুসলমান শুধু তালাক শব্দটি বা বাক্যটি পুনরাবৃত্তি করে, যেমন- “তালাক, তালাক, তালাকঅথবাতালাক দিচ্ছি, তালাক দিচ্ছি, তালাক দিচ্ছিএবং সংখ্যা না বলে অর্থাৎতোমাকে তিন তালাক দিচ্ছিএমন না বলে এবং তালাক প্রদানকারী বলে যে শব্দগুলির পুনরাবৃত্তির উদ্দেশ্য তালাকের বিষয়টিকে জোরালো করা তাহলে হানাফি মতবাদ অনুযায়ী সেটা এক তালাক গণ্য হবে
যাইহোক, এক তালাক গণ্য হোক বা তিন তালাক, এতটা তো স্পষ্ট যে তিনি তালাকের না তো প্রয়োজন আছে আর না এমন করা ঠিক আর এটা ভাবুন যে ইসলাম তো তালাককে বন্ধ করার কথা বলেছে তালাক হবেই বা কেন? মতভেদ দূর করুন; একে-অপরের ত্রুটি সংশোধন করুন; ক্রোধের বহিঃপ্রকাশের জন্য তালাক শব্দটির উচ্চারণ বর্জন করুন, দেখবেন তালাক হবেই না হ্যাঁ, তালাক শুধুমাত্র ওই সমস্ত লোকের জন্য যাদের এটা পরিষ্কার হয়ে যায় যে তাদের ভবিষ্যত জীবনের কল্যাণ তাদের বিচ্ছেদের মধ্যেই রয়েছে এবং এই উদ্দেশ্যে যখন তালাক দেওয়া হয় তখন এক তালাকেই বিচ্ছেদ ঘটে যায়।
এই দৃষ্টিকোণ নিয়ে তালাকের বিষয়টি চিন্তা করুন যেটি ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের দৃষ্টিকোণ। এমন করলে তিন তালাককে এক বা তিন গণ্য করার বিতর্কই মূলত শেষ হয়ে যাবে। সুতরাং সিদ্ধান্ত নিন- এক তালাক এখন নয় এবং তিন তালাক কখনোই নয়।
তিন তালাকের পরবর্তী পর্যায়
যেমন আপনি অধ্যয়ন করলেন এবং বুঝতে পারলেন যে যেখানে এবং যে অবস্থার জন্য ইসলাম তালাকের বিধান রেখেছে সেখানে শুধুমাত্র এক তালাকে উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে যায়। এক তালাকের পরবর্তী সময়ের জন্য বিধান পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এক তালাকের পরে আবার যদি দ্বিতীয় তালাকের অবস্থা তৈরি হয় কিংবা কেউ একের স্থানে দুই তালাক দিয়ে ফেলে তাহলে উভয় ক্ষেত্রেই এক তালাকের মতোই দুই তালাকের বিধান হবে।
তিন তালাক তিনবারে হোক বা এক সঙ্গে, তার ফলস্বরূপ তাদের মধ্যে চিরবিচ্ছেদ তৈরি হয়ে যাবে। তারজন্যই তার নাম দেওয়া হয়েছে “মুগাল্লাযা”। তিন তালাকের পরে মিলিত হওয়ার পথ অন্বেষণ করা মহা মুর্খামি কাজ
    এই ক্ষেত্রের জন্য কুরআন কারিম একটা কথা বলেছে এবং তার ব্যাখ্যা হাদিসে বিদ্যমান। সেটা হলো, যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তিন তালাক সম্পন্ন হয়ে যায়, অতঃপর অন্যত্র অন্য কোনো পুরুষের সঙ্গে বিবাহ হয়, তারপর কোনো কারণে দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গেও তার বিচ্ছেদ ঘটে যায়, বিচ্ছেদের কারণ স্বামীর মৃত্যু হতে পারে, আবার বৈধ কারণে তালাক হতে পারে এবং ইদ্দত পালন করে; এবার সে তৃতীয় পুরুষে সঙ্গে বিবাহ করতে পারে। এই তৃতীয় ব্যক্তি তার প্রথম স্বামীও হতে পারে। শুধু এই ক্ষেত্রেই তিন তালাকের পরে প্রথম স্বামীর বিবাহবন্ধনে পুনর্বার যেতে পারে, এই সুযোগ ইসলাম দিয়েছে। রসূলুল্লাহ্‌ (সা.)-এর যুগে একজন মহিলা সাহাবি ছিলেন। তাঁর বিবাহ রিফা’আ ক্বারযী নামক এক সাহাবির সঙ্গে হয়েছিল। তার তিন তালাক হয়ে যায়। তিনি দ্বিতীয় পুরুষ আব্দুর রহমান যুবাইরকে বিবাহ করেন। বিবাহের পর তিনি বুঝতে পারেন যৌনতার প্রেক্ষিতে এই স্বামী তার উপযুক্ত নয়। তিনি মহানবি (সা.)-এর সেবায় এসে তাঁর নতুন স্বামীর অভিযোগ করেন। রসূলুল্লাহ্‌ (সা.) ব্যাপারটি বুঝতে পারেন। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি প্রথম স্বামী রিফা’আ ক্বারযীর নিকট ফিরে যেতে চাও? তবে যতক্ষণ না দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে তোমার যৌনসম্পর্কে স্থাপন হয় তার থেকে তুমি বিচ্ছিন্ন হতে পারবে না। (তিরমিযি : ১১১৮)
সম্ভাবনা ও আকস্মিক অবস্থার জন্য তিন তালাকের পর প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিবাহের এই পথ ইসলাম খোলা রেখেছে। তিন তালাকের পর প্রথম স্বামীকে দ্বিতীয়বার বিবাহ করার উদ্দেশ্যে পরিকল্পনা করে সাময়িকভাবে অন্য কাউকে বিবাহ করার পরিকল্পনা করার পদ্ধতি একেবারে বৈধ নয়।
ইসলামের মতো পবিত্র ধর্ম কীভাবে এমন অশ্লীল, লজ্জাহীন ও নোংরা পথকে মেনে নিতে পারে? যারা এমন ঘৃণ্য পথ অবলম্বন করে তাদের জন্য কতো কঠিন কথা বলা হয়েছে: “যে হালালা করে এবং যার জন্য হালালা করা হয় উভয়ের উপর রসূলুল্লাহ্‌ (সা.) অভিসম্পাত করেছেন”। (তিরমিযি : ১১২০)
    অভিসম্পাত থেকেও নিকৃষ্ট ও কঠিন কথা আর কী হতে পারে? আল্লাহ্‌ ও তাঁর রসূলের অভিসম্পাত থেকে মুক্ত থাকার জন্য এমন পদ্ধতি বর্জন করুন।
তালাক কার জন্য, পুরুষ নাকি মহিলা?
    তালাক যখন পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে হয় এবং উভয়ই তালাকের মাধ্যমে বিচ্ছেদকে ভালো মনে করে তখন এমন প্রশ্নের কোনো অর্থ থাকে না যে তালাকের অধিকার কার। এমন অবস্থার জন্যই ইসলাম তালাককে সমীচীন রেখেছে।
    এখন প্রশ্ন হলো বিচ্ছেদ কে নিতে পারে? এর উত্তর হলো, ইসলামের দৃষ্টিতে বিচ্ছেদের কয়েকটি পথ রয়েছে। সেগুলি ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার জন্য। এর উদ্দেশ্য, যেন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কারো প্রতি অবিচার না হয়। অত্যাচারিতকে অত্যাচার হতে নিষ্কৃতি দেওয়ার জন্য ইসলাম বিচ্ছেদের বিভিন্ন উপায় বলে দিয়েছে।
    তার মধ্যে প্রথম ও প্রসিদ্ধ পথ হলো তালাক। এই অধিকার ইসলাম পুরুষদের দিয়েছে। পুরুষকে এই অধিকার দেওয়ার পিছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে।
প্রথম কারণ : বাড়ি একটি অফিসের ন্যায়। এর প্রধান বানানো হয়েছে পুরুষকে। কুরআন বলছে : পুরুষগণ নারীদের উপর কর্তৃত্বশীল [সূরা নিসা : ২৪] 
    দ্বিতীয় কারণ : বিবাহের পর দাম্পত্য জীবনে পুরুষের উপর ইসলাম দুটি দায়িত্ব অর্পন করে। এক- পুরুষ স্বীয় স্ত্রীকে মোহরস্বরূপ উপযুক্ত অর্থ দেবে। দুই- সারাজীবন স্ত্রীকে তার ভরণপোষণ দেবে। স্ত্রী নিজের জায়গায় যতই অর্থশালী হোক, তার ভরণপোষণের দায়িত্ব বাধ্যতামূলকভাবে স্বামীর উপর অর্পিত হয়। এই দায়িত্ব স্ত্রীকে দেওয়া হয়নি। এইসব কারণে বিচ্ছেদের অধিকার পুরুষকে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই অধিকার কোন্‌ অবস্থায় এবং তার নিয়ম কী? পূর্বে তার আলোচনা করা হয়েছে।  
বিচ্ছেদের পদ্ধতিগুলি-
প্রথম পদ্ধতি তালাকআর এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা ইতিপূর্বে পাঠকের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। 
রসূলুল্লাহ্‌ (সা.) বলেছেন : “তালাক সেই ব্যক্তির জন্য যে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে”। (ইবনে মাজাহ্‌ : ২০৮১)
    দ্বিতীয় পদ্ধতি সমর্পিত তালাক। এই পদ্ধতির মাধ্যমে বিচ্ছেদের সুযোগ নারীকে দেওয়া হয়েছে। এতে পুরুষ তালাকের আপন অধিকার স্ত্রীকে সমর্পণ করে দেয়। সুতরাং বিবাহের সময় অথবা বিবাহের পর যদি স্বামী স্ত্রীকে তালাকের অধিকার দিয়ে দেয় তাহলে সেটা হবে সমর্পিত তালাক। যদি স্বামী এর জন্য কোনো শর্তারোপ করে তাহলে শর্ত পূরণের পর স্ত্রী তার এই অধিকার প্রয়োগ করে নিজে নিজেই তালাক দিতে পারে। তালাক সম্পন্ন হয়ে যাবে।
    তৃতীয় পদ্ধতি খোলা’এই পদ্ধতিও নারীর জন্য। যদি তার মনে হয় সে দাম্পত্য জীবনের অধিকার ও দায়িত্বসমূহ পালন করতে পারে না তাহলে সে স্বামীর নিকট বিচ্ছেদ চাইতে পারে। নারী মোহর ফিরিয়ে দেবে, অথবা যে পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে, ততটা ফেরত দেবে। সেই অর্থের বিনিময়ে পুরুষ তাকে তালাক দিয়ে দেবে। এরই নাম খোলা’। রসূলুল্লাহ্‌ (সা.)-এর যুগে হাবিবা বিন্‌তে সাহ্‌ল নামে একজন মহিলা সাহাবিয়া হযরত সাবিত বিন কায়েস-এর বিবাহবন্ধনে ছিলেন। কিন্তু সেখানে কোনোভাবেই তাঁর মন বসল না। তিনি রসূলুল্লাহ্‌ (সা.)-এর নিকট এসে বললেন, সাবিতের বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই, তাঁর ধার্মিকতা ও আচার-আচরণ নিয়েও আমার কোনো অসুবিধা নেই, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তাঁর ব্যাপারে আমি আল্লাহ্‌ তাআলার বিধানসমূহ সম্পন্ন করতে পারব না। রসূলুল্লাহ্‌ (সা.) হাবিবা বিনতে সাহ্‌লকে বললেন, সাবিত মোহরস্বরূপ যে বাগানটি তোমাকে দিয়েছে সেটি তুমি তাকে ফিরিয়ে দাও অতঃপর সাবিতকে বললেন, তার বিনিময়ে তুমি তাকে তালাক দিয়ে দাও। এটাই খোলা’।
    ফাস্‌খ: বিচ্ছেদের আরেকটি পদ্ধতি ইসলামি আদালত এবং মুসলিম কাজী। পুরুষের বিরুদ্ধে নারীর অভিযোগ রয়েছে। যেমন- সে যৌনাক্ষম, অথবা ব্যায়ভার চালাতে পারে না, অথবা ভালো ব্যবহার দেখায় না, অথবা স্বামী হারিয়ে গেছে, অথবা পাগল হয়ে গেছে প্রভৃতি। এমতাবস্থায় সে কাজীর নিকট নিজের বিষয়টি পেশ করবে। কাজী ব্যাপারটি যাচাই করে আদালতের কার্য সম্পাদন করবে। তিনি ব্যাপারটিতে পরিতৃপ্ত হলে নিজে বিবাহবন্ধন ছিন্ন করে দেবেন।

(https://web.facebook.com/photo.phpfbid=1827335504156104&set=a.1585050785051245.1073741827.100006390156360&type=3&theater)
(দৈনিক কলম, ৬ই নভেম্বর, ২০১৬-তে প্রকাশিত) 

তুর্কির এক সেমিনারে 


1 comment: