‘ইঁট ছুঁড়লে
পাটকেল খেতে হয়’...!
বদিউর রহমান
(১)
‘ইঁট ছুঁড়লে
পাটকেল খেতে হয়’— কথাটার মর্ম ৭ মে, ২০১৮-তে সম্যক উপলব্ধি করলাম। অন্যতম প্রিয় গবেষক ছাত্রের অভিসন্ধর্ভ জমা
করার কথা সেদিন। তত্ত্বাবধায়কের
কোনো সই-সাবুদের প্রয়োজন না
পড়ে তাই ব্যক্তিগত তাগিদে তাকে বলেছিলাম আমি
এগারোটা তিরিশে বিশ্ববিদ্যালয় পৌঁছাব। এবং সে যেন সাড়ে দশটার মধ্যে পি এইচ ডি বিভাগে তার থিসিস জমা দেওয়ার কাজ আরম্ভ করে দেয়। তারপর থেকেই আমার
কাজের ছন্দ পতন হ’তে শুরু করে। অন্য দু’টো পিএইচডি-র রিপোর্টও পোষ্ট করার ছিল। সব কাজ যথাযথ আগের রাতে গুছিয়ে
রেখেছিলাম। সকালে সেগুলোর জেরক্স করব। যথাযোগ্য খামে প্রাপক ও প্রেরকের নাম লিখে
পাঠাব। আর একজন গবেষককে সাড়ে বারোটায় বিশ্ববিদ্যালয় ডাকলাম, পোষ্ট অফিসের কাজগুলো করে দেবে বলে।
সেদিন সকাল পৌনে আটটায় দরজায় বেল বাজল। সেই সময়ে ‘আনন্দবাজার’-টা কাগজ ওয়ালা দিয়ে যায়। দরজা খুলে দেখি এক অপরিচিত মূর্তিমান। বলল “গতকাল গেটের
কাছে রাখা আমার সাইকেলটা আপনি গাড়ীতে ধাক্কা দিয়ে সেটার দফা-রফা করেছেন। আমি গরীব
মানুষ। সাইকেল ছাড়া চলে না। আমার কাজের ক্ষতি করে দিয়েছেন”। গায়ে শার্টটা গলাতে গলাতে বললাম চলুন দেখি কী হয়েছে? আগের
দিন সন্ধ্যায় আমাদের দারোয়ান (নামেই দারোয়ান, বাস্তবে কাঠের মিস্ত্রী – সদা অন্যত্র ব্যস্ত)
ব্যাপারটার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দিয়েছিল। এও বলেছিল “আমি যখন গেটের তালা খুলে দিই তখন
পিছনে সাইকেল ছিলনা”। আমিও লক্ষ করিনি। গাড়ীটা পিছতেই ঘটল অঘটন। সারাদিন গরমের মধ্যে বোখারী খতমের
অনুষ্ঠান সেরে আবার রাত ৮.৩০শে স্ত্রীকে পার্ক সার্কাস দিয়ে ফেরৎ এসে তখন আর দারোয়ানের কথা শোনার মত ধৈর্য বা এনার্জি
ছিলনা। জানতাম যার ক্ষতি করেছি সে ক্ষতিপূরণ নিতে আসবে। কিন্তু সকালে নিজের হাতে
চা বানিয়ে খাওয়ার পর সিগারেটটায় সুখটান দেওয়ার মূহুর্তে কেউ ব্যাঘাত করবে কল্পনাও করিনি।
গায়ে শার্টটা গলাতে গলাতে
প্রফেসর কিশোর রাঢ়িকে নীচে আসতে ফোন করলাম। বললেন “পাঁচ মিনিট সময় দিন”। একাই নিচে গেলাম। ভদ্রলোক যথারীতি রাগারাগি শুরু করলেন। আমাদের দারোয়ান মাথা নিচু করে চুপচাপ অন্যান্য
গাড়ী ধোওয়া-ধুয়ি করে যাচ্ছিল। আমার জন্য কোন বাক্য খরচ করল
না। রা কাড়ল না। ভদ্রলোকটিকে জিজ্ঞেস
করলাম ‘কী ভাবে সাইকেল রেখেছিলেন?’ বললেন ‘ঐ তো আজকে যেমন রেখেছি’। বললাম ‘সাইড
করে কেন রাখেন না’! বললেন “রাস্তায় রেখেছি; তা রাস্তাটা
কি আপনার ...।” বুঝলাম দম্দার মানুষ। সাইকেল সারানোর খরচ স্বীকার করে বললাম সি.
কে মার্কেটের সাইকেল মিস্ত্রী আমার পরিচিত; সাইকেলটা ওখানে দিন; আমি না হয় গিয়ে
কথা বলে নেব। তখন আমাদের দারোয়ানের বুলি ফুটলো; বলল ’১০ নম্বর ট্যাঙ্কের ছেলেটা ভাল, বেশি চার্য করবে না’– ঐ ভদ্রলোকও তাই বললেন। বললাম
তাহলে তাকে দিয়ে কাজ করান, খরচটা যা লাগে দিতে বাধ্য থাকব’।
পৌনে দশটা নাগাদ অধ্যাপক রাঢ়ি
মেয়েকে স্কুল ছেড়ে আমার ফ্ল্যাটে এলেন। বললাম ‘চা খান’। চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বললেন “আপনার ফোন
পেয়ে ঘুম থেকে সময় মত উঠতে পারলাম। তারপর টয়লেট-বাথরুম ও মেয়েকে স্কুলে ছাড়তে যাওয়ার প্রস্তুতি করে যখন নীচে গেলাম দেখি কেউ নেই, আপনিও গায়েব।
দারোয়ান বলল আপনি ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়েছেন। আমি বলছি ‘এক পয়সাও দেবেন না’। বললাম
‘ব্যাপারটা যখন মিটে গেছে আর
ও নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই। নিন, চা খান। আজ আমার কলেজ ষ্ট্রীট যাওয়ার তাড়া আছে’। সিগারেট
দিলাম, আমারটা না খেয়ে নিজের ব্রাণ্ডেরটা ধরালেন ও আমাকেও একটা পরখ করতে বললেন।
মাফ চাইলাম তাড়া আছে বলে।
ইত্যবসরে প্রায় সাড়ে এগারোটা
বাজে। স্নানঘরে ঢুকতে যাব ফোন এল গবেষক ছাত্রের নাম্বার থেকে আর একজন বর্তমান অতীব মেধাবি ছাত্রের উক্তি “স্যার, উনি
বলছেন “গবেষণা বিভাগ একটা কাগজে অ্যাটেষ্টেশন চাইছে”। জিজ্ঞাসা করলাম “সইটা কি সুপারভাইজার হিসাবে আমারই চাই, না যে কোন
অধ্যাপকের সই হলে চলবে?” উত্তর এলো “যে কোন অধ্যাপকের সই হলেই হবে।” অযথা মেজাজ হারালাম।
ঝাঁঝের সঙ্গে বললাম ‘তা বিভাগীয় যে কোন অধ্যাপককে দিয়ে সই করাতে পারছ না কেন?”
উত্তরে শুনলাম “কোনও স্যার এখনও আসেননি।” আমার প্রেসার সাধারণতঃ স্বাভাবিক থাকে কিন্তু ‘সাদা
মিথ্যা’ শুনে চিৎকার করে ফেললাম ‘হতেই পারে না। আমাদের বিভাগের সব স্যারেরা
প্রতিদিন সাড়ে দশটায় যথারীতি হাজির থাকেন – ‘কেউ নেই’ বললে বিশ্বাস করব না। আমাদের বিভাগে যাও যে কোন স্যারকে অনুরোধ করলে
তিনি নিশ্চয় অ্যাটেষ্টেশন করে দেবেন। আমার পৌঁছাতে সাড়ে বারোটা হবে। অপেক্ষা করো না। থিসিস জমা
করার জন্য যা প্রয়োজন করো।”
মেজাজটা সপ্তমে চড়েছিল।
স্নানঘরে ঠাণ্ডা পানি বার বার মাথায় ঢালতে একটু স্বাভাবিক হলাম। ফ্রিজের বাসি
খাবার গরম করে যৎসামান্য গলধঃকরণ করতে করতে ভাবছি আজ আর বাস-অটো নয় গাড়ি নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয় যেতে
হবে। গাড়ি বের করার সময় সাইকেলে ধাক্কার কথাটা মনে পড়তেই বেশ
শঙ্কিত হয়ে উঠলাম। একশো টাকা করে বারো তেরশো টাকা শার্টের বুক পকেটে নিয়ে তারই
মধ্যে দুটো মোবাইল রেখে বের হলাম। এত কিছুর মধ্যেও ঠিক মনে ছিল উত্তেজনার কারণে সব
কটা সিগারেট শেষ, অতএব সিগারেট নিতে হবে। তপনবাবুর দোকানে গাড়িটা সাইড করে দাঁড়াতে উনি এক প্যাকেট ফিল্টার উইলস ও ফেরৎ
যোগ্য দুটো টাকা এগিয়ে দিতে ওঁকে বুক পকেটের টাকা থেকে একশো টাকা দিলাম। হাতে রইল-থুড়ি-পকেটে রইল বারোশো
টাকা।
কলেজ ষ্ট্রীটের দিকে এগোচ্ছি –
সল্টলেকের দত্তাবাদ পার করার পর বেঙ্গল ক্যেমিক্যালস পার হতেই সামনে দেখি গাড়ির
জঙ্গল। দূর থেকে ভেসে আসছে ফায়ার ব্রিগেডের ঘন্টার আওয়াজ। অনুমান করলাম যা গরম
পড়েছে হয়তো কোথাও আগুন
লেগেছে। গাড়ি ঘুরিয়ে আবার বাইপাস দিয়ে এগিয়ে গিয়ে একটা সিগন্যালের পর বাঁদিকের
রাস্তা ধরে সাহা ইনিষ্টিটিউটের পাস দিয়ে এগোচ্ছি। কাঁকুড়গাছির কাছে লাল সিগন্যালে
দাঁড়ানোর পর সবুজ হতে ছোট ফোনটা বাজতে শুরু করল। বাজতেই থাকল। গাড়ির বাঁদিকের ইন্ডিকেটর দিয়েও গাড়ির স্রোত আর থামে না; ঐ সারি ভেদ করে জায়গা পেলে পরে একেবারে ডেড স্টপ করে দাঁড়ালাম – মোবাইল কানে গাড়ি চালানোর দায়ে তিন হাজার টাকার খেসারতের ভয়ে। ও প্রান্তে
বার্ক সাহেব বললেন “আমাকে যে বলেছিলেন বারোটায় পৌঁছাব, তা কোথায় আপনি?” উত্তরে
আমার অবস্থান জানালাম। হুকুম হল “জলদি চলে আইয়ে।” আরে বাবা আমিতো ‘জলদি’ পৌঁছাতে
চাই, তা আর হচ্ছে কোথা। আমহার্স্ট ষ্ট্রীটে আমার তত্বাবধানের গবেষকের দু’বার ফোন এল।
কোনক্রমে বললাম আসছি। বৌবাজার –কলেজ ষ্ট্রীটের ক্রসিংএ আবার ফোন। এবার আর এক ছাত্রের। বলল “স্যার আপনি কোথায়?” বললেন যে সাড়ে বারোটায় পোষ্ট অফিস যেতে হবে?” ট্রাফিক
পুলিশের ভয় আর সামনের দিকে ট্র্যাম আসার জন্য মেডিক্যাল কলেজের সামনে ট্যাক্সি, ওলা ও মাল-বোঝাই মেটাডোর গাড়িগুলো জট পাকিয়ে
ফেলে আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় পৌঁছাতে
দিচ্ছে না। ফোনে চিৎকার করে
উঠলাম (স্বাধারণতঃ যা করি না) “পাঁচ মিনিট অপেক্ষা কর আমি প্রায় পৌঁছে গেছি।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে ছাত্র-ছাত্রীদের
যথারীতি ভিড়। কোন প্রকারে ভিতরে ঢুকলাম। গাড়ী রাখার জায়গায় গাড়ীর ফুল ফুটেছে। ধীরে
ধীরে এগোই একটু মাথা গোঁজার জায়গার জন্য,
বলাবাহুল্য- আমার নয়, গাড়িটার। ক্যাশ কাউন্টারের
দিকে গেটের কাছে একটু জায়গা দেখে গাড়ী রাখতে যাচ্ছি ধেয়ে এলো এক সিকিউরিটি। পাশে
বসে থাকা ইউনিভার্সিটির স্টাফ (যিনি আমার দীর্ঘ দিনের পরিচিত) নির্বিকারে বসে
রইলেন। নিষেধ সত্ত্বেও সেখানেই গাড়ী রেখে নামার পর পরিচিত ভদ্রলোক বললেন “আপনি
ছিলেন লক্ষ্য করিনি। তা একটু চেপে
রাখুন। ক্যাশের গাড়ী আসবে। ঠুঁকে দিতে পারে।
তখন আপনারই হবে জ্বালা।” অগত্যা আবার উঠে সাধ্যমত ‘চেপে’ রাখলাম।
রাখালদার ক্যান্টিনের লিফট উপরে
আঁটকে। অনেকবার সুইচ দিয়েও নামল না। কোনক্রমে আশুতোষ বিল্ডিঙয়ে প্রফেসরদের হ’লে
যেতেই শুভ্রকেশ বার্ক সাহেব চিৎকার করে বললেন ‘অভি কিতনা বাজ রাহা হ্যায়।’ আমার
হাতঘড়িটা কয়েকদিন থেকে খারাপ। হাতে পরে গিয়েছিলাম যদি সময় হয় মৌচাকের কাছে এক মোটা
ভদ্রলোকের কাছে ব্যাটারিটা পাল্টাব বলে। ঘড়িটা বার্ক সাহেবের দিকে দেখালাম “দেখিয়ে বারা বাজনে কো
পাঁচ মিনিট বাকি হ্যায়।” উচ্চস্বরে হেসে বললেন “চালিয়ে আন্দার কিউবিকল মেঁ বায়েঠতে
হেঁ।” আমার বিভাগের অন্যান্য
জুনিয়র অধ্যাপকরা বুঝে গেলেন আমি সিগারেট ধরাবো, বার্ক সাহেব যথারীতি ভাগ নেবেন।
ঠিক তক্ষুণি হামলে পড়ল আমার গবেষক ছাত্র। মুখটা মলীন। তার ব্যাপারটা
শুনে বললাম ‘পাঁচ মিনিট সময় দাও আমরা দু’জনেই পিএইচডি সেকশনে যাব। জল খেলাম, চা খেলাম, আমার সিগারেট ধরালাম, সেটা দু’জনে ভাগাভাগি করে খেলাম। চিঠি পোষ্ট করার জন্য আমার আর এক প্রিয় ছাত্র হাজির। ওকে
সব বুঝিয়ে দিয়ে পকেট থেকে পাঁচশো টাকা দিলাম। হাতে রইল সাতশো। মনে পড়ল একটা
হোমিওপ্যাথি ওষুধের কথা, যা আমার এক শুভান্যুধায়ী (আমারই মত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক) আমার কল্যান কামনায় সিগারেট
ছাড়ার জন্য সদ্য প্রেসক্রাইব করেছেন। সেটার নাম লিখে ঐ ছাত্রের হাতে দিলাম। চিঠি
পোস্ট করার জন্য বড়বাজার পোস্ট অফিস যাওয়ার পথে কিং কোম্পানিতে ওটার অর্ডার দিয়ে
চলে যাবে আর ফেরার সময় ওষুধটা নিয়ে আসবে। সে চলে
গেল। আমি, বার্ক সাহেব ও গবেষক তিনজন দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিংয়ের দোতলায় পিএইচডি সেকশনে গিয়ে ব্যাপারটা জানতে পারলাম
যে ওর সব কাগজপত্র ঠিকই আছে শুধুমাত্র Peer referred journal-এ প্রকাশিত প্রবন্ধর জন্য আমার শংসাপত্র সহ প্রবন্ধের off print দিলেই হবে। ব্যাটা সব এনেছে প্রবন্ধগুলো ছাড়া। বললাম
ট্যাক্সি করে খিদিরপুরের বাসস্থান থেকে ওগুলো আনো আমি টিচার্স রুমে অপেক্ষা করছি।
সেকশন অফিসার বললেন ‘আমরা দু’টোর মধ্যে সব
জমা নিই’। আর তো পনেরো
মিনিট বাকি। তাসত্ত্বেও আমি আমার গবেষককে বললাম ‘তুমি যাও আর ওগুলো নিয়ে এসো’। উনি গেলেন। টিচার্স রুমে আমরা অপেক্ষা করতে করতে চা
সিগারেট খেলাম। শেখরকে পয়সা দিতে দিয়ে
দেখি আমার টাকাগুলো পকেটে নেই।
মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। সেই দিনই আমাদের বিভাগীয়
পরীক্ষার একটা মিটিং ছিল তিনটের
সময়। সকলেই হাজির। সকলে টাকা হারানোর কথা শুনলেন। আমার অনুশোচনা দেখে দু’ একজন অধ্যাপক করুণা করে বললেন
‘যা গেছে তার জন্য মন খারাপ করবেন না। ওটা সদকা করে দিন।’
আমিতো নিজেকে চিনি। কোন দুঃস্থ
মানুষ দশ টাকা চাইলে এক টাকার বেশি ঠেকাই না। আর অতগুলো টাকা! একজন বললেন ‘আপনি সদকা করে দিলে টাকাটা যে পাবে তার আর
কোন পাপ হবে না।’ ভাবলাম টাকা গেছে আমার আর যে পাবে তাকে পাপমুক্ত করতে আমাকে সদকা
করতে হবে! অতটাকা তো হাতে তুলে কাউকে দান করি না। আর আজ টাকাগুলো হারিয়েছে বলে সদকা করতে হবে!! অন্য সময় তো
তা করি না। এক রকম বাধ্য হয়ে পুণ্য অর্জনের অপচেষ্টা।
ইতিমধ্যে গবেষক সব নিয়ে হাজির
হলে পিএইচ ডি সেকশন যেমন বলেছিল
সেই মর্মে শংসাপত্র আমার নিজের লেটার হেডে লিখে ব্যাক্তিগত সিল দিয়ে ছাত্রটিকে সেকশনে পাঠালাম চেক করে
নিতে। সে ফেরত এসে বলল এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধটির off print হলেই আর কিছু লাগবে না। আশ্বস্ত হলাম। কিন্তু মনটা
খচখচ করছে। ঐ সাত শ’ টাকায় আমার সাত প্যাকেট
সিগারেট হত!
ততক্ষণে পরীক্ষার মিটিংয়ের সময় হয়ে গেছে। দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিংয়ের চার তলায় পরীক্ষার
গোপনীয় কাজ করার সময় একটু বেশি কথা বলে ফেলেছিলাম। সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত এক কবিতা- যা অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট বলে খ্যাত, নিয়ে নাতিদীর্ঘ ও অযাচিত
বক্তব্য দিয়ে দুই নবীন – স্বাত্বিক, অধ্যাপকদ্বয়ের বিরক্তের কারণ হয়ে উঠলাম। পরীক্ষানিয়ামক বিভাগের কাজ শেষে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কক্ষে ফেরৎ।
(২)
এতক্ষণ যা হল তাতে ইটও নেই
পাটকেলও নেই। শিরোনামে সোজাসুজি না গিয়ে এতক্ষন যা বকবক করলাম তা হ’ল ‘ধান ভাঙতে
শিবের গাজন’। বেশ কয়েকজন নবীন অধ্যাপক তখনও আমাদের সঙ্গে হাজির ছিলেন। বয়সের নিরীখে
আমিই প্রবীণতম। শুভ্রকেশ বার্ক সাহেব আপাতঃদৃষ্টিতে আমার থেকেও বৃদ্ধ। তিনি প্রয়োজন
মাফিক তা জাহির করতে ছাড়েন না। তিনি হঠাৎ আমাকে বলে বসলেন “রহমান সাহেব, আজ আপ
গাড়ী লায়ে হ্যাঁয় তো মুঝে পার্ক সার্কাস ছোড়কে আপ সল্টলেক যাইয়ে।” একে সকাল থেকে
আমার দিনটা খারাপ চলেছে তার উপর বলেন কিনা অতটা ঘুরপথে আমায় ফিরতে। বললাম
‘আপনার পাড়ার অধ্যাপক সাগির রয়েছেন ওর সঙ্গে গল্প করতে করতে চলে যান। আমার পক্ষে পার্ক
সার্কাস হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়’। উত্তরে জ্ঞান দিলেন “হামে উতার কার শাশুরাল চলে
যাইয়ে আউর মুরগা তোড় কর ঘর চলে যাইয়ে। আর ইস বুডঢে পর ভি এহসান হো জায়েগা।” বললাম
“আপ আউর বুডঢা! লেকিন হাম লোগুঁ মেঁ এক সাহাব হেঁ জো হিলানে সে ভি নেহি হিলতে, গুদগুদি দেনে সে ভি নেহি হাঁসতে। হাম লোগ, খাস
কারকে ম্যায়নে আজ ইতনা যিয়াদা বক দিয়া কে গালিব কি বাত ইয়াদ আতি হ্যায়— ‘বাক রাহাহুঁ জুনুঁ মেঁ কিয়া কিয়া কুছ, কুছ না সামঝে খুদা
কারে কোঈ।’ সাগির সাহাবকো দেখিয়ে কিত্নে খামোশ আওর সান্জিদা লাগতে
হ্যাঁয়; শায়েদ ওহ আপসে যেয়াদা বুড্ঢে হ্যাঁয়।” আমার খোঁচাটা নবীন অধ্যাপকের ভাল লাগেনি। মুখ খুললেন; স্বভাবসুলভ মৃদুস্বরে বলতে শুরু করলেন। যা বললেন তা উর্দু থেকে বাংলা করে নিম্নে বলার চেষ্টা
করলাম—
“আল্লাহ্ তায়ালা প্রাণীকুল সৃষ্টি করার সময় সর্ব প্রথম চারটে প্রাণী
সৃষ্টি করেন। মানুষ, গরু, কুকুর আর পেঁচা। সকলকে দিলেন চল্লিশ বৎসরের আয়ু। মানুষ
বুদ্ধিমান ও লোভী। দীর্ঘদিন বাঁচতে
চায়। গরু ভাবল দীর্ঘ চল্লিশ বৎসর বেঁচে কী লাভ! হয় হাল চষতে জোয়াল কাঁধে নিতে হবে
নয়তো বোঝা বইতে হবে।
অতদিনের আয়ু প্রয়োজন নেই। কুকুরও ভাবল দীর্ঘ চল্লিশ বৎসর ধরে রাত জেগে মানুষকে পাহারা দিতে দিতে
ক্লান্ত হতে বাধ্য হব। কাজের গাফিলতি দেখলেই মানুষ আমার ঠ্যাঙ খোঁড়া করে দেবে।
অতদীর্ঘ দিন বাঁচার দরকার নেই। পেঁচাও দেখল সারা দিনতো আমার কোন কাজই নেই। রাতের
অন্ধকারে দু-চারপাক দেওয়ার পর আমারও তো করার কিছু থাকেনা। এই শেষোক্ত তিন শ্রেণীর
প্রাণীরা আল্লাহর দরবারে গিয়ে তাদের মনের কথা জানাল। আল্লাহ বললেন ‘তা তোমরা কি
চাও? সকলে বললঃ ‘আমরা ঠিক করেছি আমাদের আয়ু কুড়ি বৎসর করে হলেই চলবে আর আমাদের থেকে উদ্বৃত্ত শাট বৎসর মানুষ নামি প্রাণীকে দিয়ে দিন। তাছাড়া, তারাও দীর্ঘজীবী হতে চাইছে।
আবেদন মঞ্জুর করা হল। প্রথম প্রাপ্য চল্লিশ বৎসর মানুষ আনন্দঘন উন্মত্ত জীবন যাপন করে।
গরুর দেওয়া পরবর্তি কুড়ি বৎসর সংসারের বোঝা বহন করে। কুকুরের দেওয়া পরবর্তি কুড়ি
বৎসরের জীবনটা মানুষ ঘেউ ঘেউ করে কাটায় আর পেঁচার দেওয়া কুড়িটা বৎসর মানুষ চলৎশক্তিহীন হয়ে
পেঁচার মত মাথাটা এদিক ওদিক করে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে আয়ুস্কাল শেষ করে।”
সাগির সাহেব থামলেন।
হিসেব করে দেখলাম আমি ও বার্ক সাহেব বর্তমানে
তিন নম্বর স্তরে জীবন যাপন করছি। ইটটা ছুড়েছিলাম, তা পাটকেলটা আশাতীতভাবে খাব ভাবতে পারিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের
নবীন-প্রাক্তন অধ্যাপকবৃন্দ সকলেই জ্ঞানীগুণী– পণ্ডিত। সকলেই নমস্য। শিক্ষালয়ের শীর্ষস্থানে তাঁরা সকলেই জ্ঞান চর্চায় নিবেদিত প্রাণ।
ফার্সি সাহিত্যের রত্নভাণ্ডার থেকে বুদ্ধিদিপ্ত ও স্বল্প পরিসরের মধ্যে আমার
অহেতুক খোঁচাটার উত্তর নিমেষে
আমাকে বাকরুদ্ধ করে দিল। হ্যাটস অফ টু প্রচ্ছন্ন, প্রাসঙ্গিক,
প্রত্যুত্তপন্নমতিত্ব্য ও সংক্ষিপ্ত কিন্তু শিক্ষণীয় উত্তরের। মনে পড়ে গেল ছোট বেলায় শোনা কথা – ‘আকালমান্দ কে লিয়ে
ইশারা কাফি হ্যায়’।
কয়েকদিন পরে একই
কথা বাংলায় পড়লাম, আনন্দবাজার পত্রিকায়। খুব সহজেই ধরতে পারলাম যে ঐ নীতি
বাক্যগুলি লোকসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত। সেই সাথে মনের গভীরে কৌতূহল জন্ম নিল তার উৎস
জানার। ঐ নীতি বাক্যগুলো পারস্য না ভারতীয় লোকসাহিত্যের— তা জানতে আমি উদগ্রীব এবং
আগ্রহী।