Monday 31 December 2018

মাহমুদ দারবিশঃ রিতা ও রাইফেল


রিতা ও রাইফেল

মাহ্‌মুদ দার্‌বিশ, ফিলিস্তিন
অনুবাদ- আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

 

রিতা আর আমার চোখের মাঝে
একখানা রাইফেল।

যারাই চেনে রিতাকে
বসে হাঁটু গেড়ে
আর প্রার্থনা করে
ঈশ্বরের নিকট; মায়াময় চোখে 

আমি চুমু খেয়েছি রিতাকে...!
যখন সে ছিল এক টগবগে-তরুণী;
আমার এখনো মনে পড়ে-  
কীভাবে এগিয়ে এসেছিল সে
কীভাবে ঢেকে গেছিল তাঁর সুন্দর খোঁপা
আমার তালুতে।
আমি স্মরণ করি রিতাকে
যেমনভাবে স্মরণ করে চড়ুইপাখি
নিজ জলাধারকে।
আহ্‌... রিতা !
আমাদের শত-সহস্র চড়ুই আর দৃশ্যকল্প
আন্‌গিনাত ওয়াদে, সব  
ছাই হয়ে গেল..., রাইফেলের আগুনে।


রিতার নাম আমার মুখে
বারবার আসে, ঈদের আবহ নিয়ে;
আর তাঁর শরীর আমার রক্তে
বইয়ে দেয় বাসর রাতের অনুভূতি।
আমি দুদুটো বছর মজে ছিলাম রিতাতে
আর সেই-দুবছর সে
ঘুমিয়ে ছিল আমার বাহুতে;
আমরা প্রতিজ্ঞা করেছিলাম
উৎকৃষ্ট পেয়ালার পরে
আর ছুঁয়ে ছিলাম আঙুর-সুরা দুঠোঁটে; 
মনে হয়েছিল, আমরা
দ্বিতীয়বার জন্মালাম।

আহ্‌ রিতা, কে পেরেছে
তোমার চোখ থেকে আমার চোখকে সরাতে
দুটো ভাতঘুম ও মধু-রঙা সেই বাদল ছাড়া;
এই রাইফেল-নিক্ষেপিত স্ফুলিঙ্গের পূর্বে...!

একদিন সকালে
হে গোধূলির নৈঃশব্দ
আমার চাঁদ দেশান্তরী হল বহু দূরে
মধু-রঙা চোখে;
আর শহর, ঝেড়ে ফেলে দিল
সকল গায়ক ও রিতাকে। 

রিতা আর আমার চোখের মাঝে
একখানা রাইফেল।

  

ريتا والبندقية
محمود درويش - فلسطين


بين ريتا وعيوني ... بندقية
والذي يعرف ريتا، ينحني
ويصلي
لإله في العيون العسلية

وأنا قبَّلت ريتا...
عندما كانت صغيرة
وأنا أذكر كيف التصقت
بي، وغطت ساعدي أحلى ضفيرة
وأنا أذكر ريتا
مثلما يذكر عصفورٌ غديره
آه... ريتا
بينما مليون عصفور وصورة
ومواعيد كثيرة
أطلقت ناراً عليها ... بندقية

اسم ريتا كان عيداً في فمي
جسم ريتا كان عرساً في دمي
وأنا ضعت بريتا ... سنتين
وهي نامت فوق زندي سنتين
وتعاهدنا على أجمل كأس ، واحترقنا
في نبيذ الشفتين
ووُلدنا مرتين
آه... ريتا
أي شيء ردَّ عن عينيك عينيَّ
سوى إغفاءتين
وغيوم عسلية
قبل هذي البندقية!

كان يا ما كان
يا صمت العشيّة
قمري هاجر في الصبح بعيداً
في العيون العسلية
والمدينة
كنست كل المغنين، وريتا
بين ريتا وعيوني... بندقية. 

মালালাঃ কিছু কথা কিছু ভাবনা

Image result for malala
মালালাঃ কিছু কথা কিছু ভাবনা 
['আই অ্যাম মালালা' থেকে]

"গ্রামে অতি ভোরে দিন শুরু হয়ে যায়। আমি এমনিতে দেরি করে উঠি। কিন্তু গ্রামে গেলে ভোরের আলো ফোটার সময় মোরগের বাক এবং নাস্তা বানানোর জন্য মহিলাদের থালাবাসন মাজার শব্দে উঠে যেতাম। ভোর বেলায় সূর্যের আলো তোরঘার পাহাড়ের চূড়ায় প্রতিফলিত হতো। ফজরের নামায পড়ার জন্য ঘুম থেকে জেগে দেখতাম স্পিনঘারের তুষার চূড়ায় সূর্যের প্রথম রশ্মি জ্বলজ্বল করছে। মনে হতো যেন এক ফর্সা নারী কপালে জুমার টিকা (এক ধরণের স্বর্ণালঙ্কার) পড়ে বসে আছে।"  [পৃষ্ঠা- ৬৫]




পাঠ ও সংগ্রহ- আব্দুল মাতিন ওয়াসিম 

আর-রাবেতাতু আল-কালামিয়্যাহঃ একটি প্রবাসী সাহিত্য সংগঠন


আর্-রাবেত়াতু আল্‌-ক়ালামিয়্যাহ

পরিচয়
এটি ছিল আমেরিকায় আরবী সাহিত্যের একটি সংগঠন। আমেরিকার প্রবাসী আরবীয় সাহিত্যিকগণ এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা করেন। সাহিত্য রচনার বিষয়বস্তু এবং পদ্ধতিগত ক্ষেত্রে তারা আমূল পরিবর্তন সাধন করেন। তার সংগঠকদের মধ্যে কয়েকজন বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন। বিশেষ করে এই সংগঠনের প্রাণপুরুষ জুবরান খালীল জুবরান ছিলেন একজন বিশ্ববিখ্যাত সাহিত্যিক।

প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
এই সংগঠনের ব্যাপারে চিন্তাভাবনা শুরু হয় ১৯১৬ খৃষ্টাব্দে, কিন্তু তা সরকারী ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২০ সালে, নিউইয়র্কে। কয়েকজন নির্বাচিত সাহিত্যিকদের হাত ধরে এর পথ চলা শুরু। মিখাইল নুয়াইমা তাঁর “জীব্‌রান – হ়ায়াতুহু, মাওতুহু, আদাবুহু, ফান্নুহু” নামক বইটিতে লেখেন যে— “এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয় দু’টি আলোচনা সভার পর। তার মধ্যে প্রথমটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল আব্দুল মাসীহ আল-হাদ্দাদ-এর বাড়ীতে।” আর হাদ্দাদ ছিলেন নিউইয়র্ক থেকে আরবী ভাষায় প্রকাশিত একটি পত্রিকার সম্পাদক ও পৃষ্ঠপোষক।

প্রথম মিটিংয়ের দিনটি ছিল ২০শে এপ্রিল, ১৯২০। এই মিটিং থেকে যে আলোচনা উঠে এসেছিল তা অত্যন্ত যত্ন সহকারে মিখাইল নুয়াইমা একত্রিত করেন। আলোচনার মূল নির্যাস ছিল— তাঁদের মধ্য থেকে একজন মন্তব্য করলেন যে, প্রবাসী কবিসাহিত্যিকদের একটি সংগঠন থাকা দরকার। যে সংগঠনটি তাঁদের সকলকে একত্রিত করবে। আরবি ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষ সাধনের ক্ষেত্রে তাঁদের প্রয়াসগুলোকে সংগ্রহ ও সংকলন করে রাখবে।

এই প্রস্তাবটী উপস্থিত বিদগ্ধ সাহিত্যিকদের প্রশংসা ও সমর্থনে সিদ্ধান্তের রূপ পায়। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক’জন হলেন— জিব্‌রান খালিল জিব্‌রান, নাসীব উরাইজাহ্‌, উইলিয়াম ক্যাটস্ফিলস, রাশীদ আইয়ুব, আব্দুল মাসীহ হাদ্দাদ, নুদরাহ হাদ্দাদ, মিখাইল নুয়াইমাহ, ইলিয়াহ আবু মাযী প্রমুখ।

ওই মাসেরই ২৮ তারিখে দ্বিতীয় তথা চূড়ান্ত মিটিংটি আয়োজিত হয় জিবরান খালিল জিবরানের বাস ভবনে। এখানে প্রথম মিটিংয়ের সদস্যগণ সহ ইলিয়াস আতাউল্লাহ যোগদান করেন। সংগঠনের গৃহীত সিদ্ধান্তের উপর সকলে সহমত পোষন করেন। অন্যান্য সদস্যদের সমর্থনে সভাপতি নিযুক্ত হন জিব্‌রান। মিখাইলকে উপদেষ্টা এবং উইলিয়ামকে কোষ্যাধ্যক্ষ করা হয়। সংগঠনের নিয়মাবলী রচনার দায়িত্ব দেওয়া হয় মিখাইল নুয়াইমাকে। ১৯২০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠন ১২ বছর স্বমহিমায় ব্বিরাজ করে। অতঃপর ১৯৩২ সালে সভাপতি জিব্‌রানের মৃত্যুর সাথে অস্তমিত হয়।

সংগঠনের উদ্দেশ্য
এই সংগঠনটির উদ্দেশ্য ছিল আরবী ভাষার সংরক্ষণ, দীর্ঘকালীন স্থাবরতা থেকে এর মুক্তি, ভাষার বৈশিষ্ট সমূহের উন্নতিকরণ, নতুন প্রজন্মের কাছে গ্রহণযোগ্যতা তৈরী করা, আরবি গদ্য ও পদ্যের নবজাগরণের উন্মেষ ঘটানো ইত্যাদি। তারা গতানুগতিক অন্ধ অনুকরণ ছেড়ে চিন্তাভাবনায় নতুনত্ব নিয়ে আসেন। তবে এসব করতে গিয়ে তারা প্রাচীন সাহিত্যের ধ্যানধারণাকে কোনোভাবেই কোনোরকম অবহেলা করেননি, বরং সেগুলিকে কেন্দ্র করেই তাদের চিন্তাভাবনা আবর্তিত হতো।

সংগঠনের কর্মকান্ড
জীবন সম্বন্ধে ভাবনাচিন্তা, অস্তিত্বের রহস্য, মানব চরিত্রের বোধের গভীরতা, মানব সমাজের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীর উদারতা, আরবদেশ সম্পর্কিত বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ, মত প্রকাশের ক্ষেত্রে ইঙ্গিত ব্যবহারের বাহুল্য- ইত্যাদি দৃষ্টিকোণ থেকে এদের সাহিত্যকর্ম শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল।এর সদস্যরা সম্মিলিত ভাবে এই প্রবাসমুলুকে কয়েকটি আরবী সাময়িকী এবং পত্রিকা প্রকাশ করেন। তার মধ্যে কয়েকটি হলো— (ক) মাজাল্লাতু আল্‌-ফুনূনঃ এর উদ্দেশ্য ছিল নিছক সাহিত্যচর্চা, এর সম্পাদক ছিলেন নাসীব উরাইযাহ। (খ) জারীদাতু আস্‌-সায়েহ়ঃ এর উদ্দেশ্য ছিল প্রবাসী আরবীয়দের অবস্থাকে তুলে ধরা। এর সম্পাদক ছিলেন আব্দুল মাসীহ আল-হাদ্দাদ। (গ) মাজাল্লাতু আস্‌-সামীরঃ ইলিয়া আবু মাযী সম্পাদিত এই পত্রিকার উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকায় আরবী চর্চা। এটা সপ্তাহে পাঁচদিন প্রকাশিত হতো। সংগঠকদের মৃত্যুর পর এর যবনিকা পতন ঘটে।

-আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

আব্দুল মাতিন ওয়াসিমঃ বাবা, এখন আমায় আর কেউ বকেনা...!



বাবা, এখন আমায় আর কেউ বকেনা...!
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

বাবা!
অনেক দিন হয়ে গেল, তোমার সাথে আমার দেখা নেই। কথাও হয়নি বহুদিন।জানো, এখন আমি আগের থেকে অনেক বেশি উশৃঙ্খল, অনেক বেশি দুরন্ত।আচ্ছা বাবা, তোমার মনে পড়ে, আমার ছেলেবেলার দুরন্তপনার সেসব কথা, পাড়ার দক্ষিণ প্রান্তের সেই তেঁতুল গাছটার কথা? রোজ বিকেলে সেই গাছটায় উঠতাম। লাফ মেরে এ-ডাল থেকে সে-ডালে যেতাম।বাদুড়ের মতো উল্টো হয়ে ঝুলে থাকতাম কোনো সরু ডালে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা।খবর পেয়ে ছুটে আসতে তুমি, হাঁপাতে হাঁপাতে।ছড়ি দেখিয়ে, শাসিয়ে, নামিয়ে বাড়ি নিয়ে যেতে আমায়

ক্লাস টুতে পড়ার সময় একবার নদীতে স্নান করতে গিয়েছিলাম।বেশি দূরে নয়, পাশের তুলাই নদীতে। যে-নদীটা আমাদের প্রাইমারী স্কুলের গা-ঘেঁষে, মিয়াঁদের আম বাগানের আঁচল ছুঁয়ে নাচতে নাচতে গিয়ে মিশেছে টাঙনের বুকে।মেজদা খুব মেরেছিল সেদিন। পা ধরে ছুড়ে দিয়েছিল পুকুরের মাঝে।যখন এলোপাথাড়ি হাত-পা ছুড়ছি, ডুবে যাচ্ছি প্রায়, ঝাঁপিয়ে পড়েছিল হালি দি।কোলে করে তুলে নিয়ে গেছিল পাড়ে। তুমিও বকেছিলে। মনে আছে তোমার সেসব কথা!

মাগরিবের আযান হলে, তুমি আমায় সঙ্গে করে মসজিদে নিয়ে যেতে।সেদিনও বলেছিলে। কিন্তু আমি যাইনি। ফুটবল খেলছিলাম।খেলতে গিয়ে কীভাবে বুড়ো আঙুলটা ভেঙে গেছিল সেদিন, মনে নেই সে-কথা।তবে এখনো মনে আছে, সারা রাত মা  তুমি ঘুমোওনি।আমার ব্যথায় কাতর মুখটি দেখে সেবার তুমি কিছুই বলোনি আমায়।একবার বাম হাতটাও ভেঙেছিল, চৌকি থেকে পড়ে গিয়ে!

গ্রামের আর পাঁচটা ছেলের মতোই, আমিও সারা পাড়া চষে বেড়াতাম।পুন্যা দীঘির পাঁকে মাছ ধরতাম। এর-ওর গাছে ঢিল ছুড়তাম। আম-জাম-কুল কত কিছু পেড়ে, পকেটে জমিয়ে, চিবোতে চিবোতে গ্রাম-মাঠ-দীঘি এফোঁড় ওফোঁড় করতাম। বেসুরো কণ্ঠে গান-গযল-সূরা-আযান যা মনে আসত বিড়বিড় করতাম।তবে বাড়ি ফিরতে দেরি হলে, পাড়ার ছেলেদের সাথে বেশিক্ষণ খেলা করলে, দীর্ঘক্ষণ আড্ডা দিলে, দূরে কোথাও বেড়াতে গেলে, তুমি আমায় দ্রুত বাড়ি ডেকে আনতে।সর্বক্ষণ আগলে রাখতে। তোমার মনে পড়ে সেসব কথা!

বাবা, বাঁশকুড়ি-কদমডাঙ্গা-চণ্ডীপুর-মহিপালের সেই চেনা পরিসর ছাড়িয়ে এখন আমি থাকি এক অচেনা শহরে; কলকাতাতে। এখানে রাস্তাঘাটে, অলিগলিতে অনেক চায়ের দোকান। বেশ জমজমাটে ভিড়ও থাকে সে-সব দোকানকে ঘিরে। মাঝে মাঝে সেই ভিড়ের উপর এক আধবার নজর বুলাই, যদি দেখা পাই! তবে, এখানে চায়ের দোকানে বসে কেউই ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দেয় না। এখানে সবাই ছোটে, যে যার মতো; কেউ কাজে তো কেউ কাজের খোঁজে। 

এখানে চারপাশে অনেক গাছপালা। ঠিক আমাদের গ্রামটার মতো। আম-জাম-কাঁঠাল সব গাছ আছে
; এমনকি তালগাছও আছে এখানে। তবে এখানকার গাছগুলো কংক্রিটের তৈরি। ডালপালাগুলো কাঁচ-টিন-ফাইবারের। কিছু কিছু জায়গায় সেসব ডালপালা থেকে ফল-ফুল-রসও পড়ে। বলতে পারো এটা একটা জঙ্গল; কংক্রিটের। এই জঙ্গলেও গরু, মোষ, ছাগল, ভেড়া, বাঘ, ভাল্লুক, সিংহ, হায়েনা, হাতি, হরিণ সবই আছে। মানুষও আছে; তবে তাঁরা সংখ্যায় কম!      
  
সারাদিন ছুটে বেড়াই। চেতনা-অবচেতনার আলোয়ানে নিজেকে মুড়ে, চাকরি-দায়িত্ব-স্বপ্ন-বাসনার বোঁচকা পীঠে নিয়ে ক্ষতবিক্ষত করে তুলি তিলোত্তমার বুক  পীঠ।সময় মতো খাইনা। ঘুমাইনা। পড়াশুনাটাও আগের মতো করিনা।বড্ড বেশি রোগা হয়ে গেছি ইদানীং। কিন্তু, এখন আমায় আর কেউ বকেনা, বাবা। বড়দা-মেজদা কেউ না, মা না!