Wednesday 23 June 2021

আরবি ছোটগল্পঃ উৎপত্তি ও বিকাশ

 

আরবি ছোটগল্পঃ উৎপত্তি ও বিকাশ

আরবি একটি অত্যন্ত প্রাচীন ভাষা ও সাহিত্য। পৃথিবীতে যে সকল ভাষার প্রাচীন রূপ নির্ণয় করা যায় এবং প্রাচীন রূপ থেকে বর্তমান অবস্থায় উপনীত হবার ক্রমধারাগুলো সর্বাংশে আবিস্কার করা যায়, আরবি ভাষা তাদের মধ্যে অন্যতম। কালের বিবর্তনে অনেক ভাষাই তার প্রাচীন ঐতিহ্যকে হারিয়ে বিলুপ্ত বা বিকৃত হয়েছে। কিন্তু আরবি ভাষা তার প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারা বর্তমান পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছে এবং উত্তরোত্তর আরও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে চলেছেঅধিকন্তু ইসলামের মূল উৎস কুরআন ও হাদীস আরবি ভাষায় সংরক্ষিত হওয়ার দরুন আরবি আন্তর্জাতিক ভাষায় উন্নীত হয়েছে। তাছাড়া রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণেও বিশ্বের সর্বত্র কমবেশি আরবি ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা কার্যক্রম চলছে; সেই সাথে ছোটগল্প রচনার কাজও চলছে। কারণ মধ্য প্রাচ্যের প্রায় বিশটি উন্নয়নশীল খনিজ সমৃদ্ধ দেশের মাতৃ ও রাষ্ট্রভাষা আরবী। জাতিসংঘে স্বীকৃত ও ব্যবহৃত ছয়টি দাপ্তরিক ভাষার মধ্যে আরবি অন্যতম।
 
ভাষা সব সময় সাহিত্যের মধ্যে বেঁচে থাকে। যে ভাষার সাহিত্যের ভাণ্ডার যত সমৃদ্ধ সে ভাষা তত সমৃদ্ধ। স্মরণাতীত কাল থেকে আরবি ভাষা ও সাহিত্য রচনা আরম্ভ হলেও খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীর পূর্বের সাহিত্য আমাদের নিকট লিপিবদ্ধভাবে আসেনি। তথাপি গদ্যসাহিত্য ও আরবি সাহিত্য প্রাচীনকাল থেকে দৃষ্টিগোচর হয়। সে যুগে আরবদের বীরত্ব, যুদ্ধ-বিগ্রহ প্রভৃতি বিষয়ের অনেক গল্প কাহিনী প্রচলিত ছিল। পবিত্র কুরআনেও গল্পকাহিনীর যথেষ্ট উপকরণ পাওয়া যায়। কিন্তু আরবি সাহিত্যের পরিপূর্ণ গল্প রচিত হয় খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীর ভারতীয় কথাসাহিত্যের অনুবাদের মাধ্যমে। ফলে আরবি সাহিত্যে সৃষ্টি হয় ইতিহাস খ্যাত রম্য রচনা আল্‌ফু লায়লা ওয়া লায়লাএবং কালীলাহ্‌ ওয়া দিমনাহ্‌
 
ছোটগল্পের সংজ্ঞাঃ  
ছোটগল্প কী বা ছোটগল্পের পূর্ণাঙ্গ সংজ্ঞা নির্দেশ করা খুব কঠিন। গল্পকার ও সমালোচকরা এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে বিচিত্র কথা বলেছেন। আর প্রত্যেকের ধারণাই কিছু না কিছু দিক থেকে প্রাসঙ্গিক ও সত্য। নিম্নে ছোটগল্প সম্বন্ধে কিছু উক্তি তুলে ধরা হল—
 
(ক) গল্প সাহিত্যের বিখ্যাত দার্শনিক ব্রান্ডার ম্যাথিউস এর মতে, ছোটগল্প তার অবয়বের মাধ্যমে একটা সুনির্দিষ্ট একক ধারণাকে তুলে ধরতে চায় যার ফলে এটা অন্যান্য ধরণের কাহিনী থেকে যথেষ্ট ভিন্নতর।
 
(খ) ওয়েবস্টার ডিকশনারীতে বলা হয়েছে, সাধারণত ছোটগল্প একটি মাত্র সমস্যাকেই উপস্থাপন করে।
 
(গ) বিখ্যাত আইরিশ গল্প-লেখক সিয়ান ওয়েলিয়ন বলেছেন, অন্যকথায় ছোটগল্প হলো এমন এক ধরণের গল্প যেখানে স্বল্প বিস্তৃতির ভেতর নিজের অভিব্যক্তিকে জোর দিয়ে তুলে ধরা হয়। যেটা প্রতিটি ব্যক্তির আকাঙ্খার বস্তু এবং যেটা সে উপভোগ করতে চায়, লেখক সেটাকেই তাৎক্ষণিকভাবে গল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নেন অন্য সকল বিষয় বা চাহিদাকে বাদ দিয়ে এবং এটাই হচ্ছে সাহিত্যিকদের সঠিক চেতনাবোধ যার ভেতর দিয়ে নিজেকে নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারেন।
 
(ঘ) ইন্সাইক্লোপেডিয়া অফ ব্রিটেনিকাতে বলা হয়েছে, ছোটগল্পও এক ধরণের ফিকশন। তবে তা উপন্যাসের তুলনায় সাধারণত ছোট ও একমুখী হয়।  
 
(ঙ) এইচ, জি ওয়েলস বলেন, ছোটগল্প এমন এক ধরণের গল্প কাহিনী যা বাস্তব ও কল্পনার মধ্যে একত্রিত করা হয় এবং তা দশ হতে পঞ্চাশ মিনিটের মধ্যে শেষ হওয়া বাঞ্চনীয়।
 
(চ) সাহিত্যিক শ্রীস চন্দ্রদাসের ভাষায়, যে গল্পে প্রবাহমান জীবন সংগ্রামের কোন একটি আবর্তকে গভীর ও স্পষ্টভাবে উপস্থিত করা হয়, উহাকে ছোটগল্প বলা হয়।
 
(ছ) বিখ্যাত আরবি সাহিত্যিক আনীস আল্‌-মাকদাসী বলেন, ছোটগল্প বলতে এমন এক প্রকার সংক্ষিপ্ত কাহিনীকে বুঝায় যা কয়েক পৃষ্ঠার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে এবং এর ঘটনা একটি চরিত্র বা স্বল্প সংখ্যক চরিত্রকে নিয়ে পরিক্রম করবে।
 
উপরে উল্লেখিত এই সংজ্ঞাসমূহের আলোকে আমরা একটি প্রামাণ্য ও সহজ সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে পারি যে, ছোটগল্প হল প্রতীতিজাত একটি সংক্ষিপ্ত গদ্যকাহিনী যার একক বক্তব্য কোন ঘটনা বা কোন পরিবেশ বা কোন মানসিকতাকে অবলম্বন করে এক সংকটের মধ্যে দিয়ে সমগ্রতা লাভ করে। উল্লেখ্য যে, প্রতীতির সমগ্রতা লেখকের প্রধান পালনীয় শর্ত।
 
আরবি ছোটগল্পের সূচনা ও বিকাশঃ  
আরবি সাহিত্যে আধুনিক ছোটগল্পের ইতিহাস খুব দীর্ঘ নয়। ১৭৯৮ সালের ফরাসী সেনাপতি নেপোলিয়নের মিসর আক্রমনের পর আরবি সাহিত্যের স্থবিরতার যুগের পরিসমাপ্তি ঘটে এবং রেনেসাঁর যুগ আরম্ভ হয়। নেপোলিয়ন মিসরে পণ্ডিত, সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিকদের একটি বিশাল দল নিয়ে এসেছিলেন। আরও সাথে করে এনেছিলেন আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র। তারা ফরাসী ভাষার কিছু কিছু গ্রন্থ আরবি ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। ১৮০১ সালে ফরাসীগণ মিশর ত্যাগ করার পর মিশরের শাসক মুহাম্মদ আলী মিসর ও মিসরীয় সেনাবাহিনীকে আধুনিক ইউরোপের ছাঁচে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে নানাবিধ সংস্কার সাধন করেন এবং শিক্ষা-ব্যবস্থার পরিবর্তনের জন্য ইউরোপীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের মূল্যবান গ্রন্থগুলো আরবি ভাষায় অনুবাদ করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেনফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গ্রন্থাবলীর সাথে সাথে প্রচুর ফরাসী ও ইংরেজী নাটক, উপন্যাস ও ছোটগল্প আরবীতে অনূদিত হয়। মিসরীয় সাহিত্যিকদের মধ্যে কথাসাহিত্যের নতুন নতুন রূপ ও স্টাইল গ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহ সৃষ্টি হয়। ক্রমান্বয়ে অনুবাদের সহায়তায় মৌলিক রচনার মাধ্যমে আরবি ছোটগল্পের আবির্ভাব হয়। তাই বলা যায় দ্বাদশ শতাব্দীর আরবি গল্পের যে সারবীজ ইউরোপীয়গণ আরবদের নিকট হতে গ্রহণ করেছিল, তাকে নব রূপে অংকুরিত করে পত্র-পল্লবে সজ্জিত করে ঊনবিংশ শতাব্দীতে তাদেরকে ফিরিয়ে দিয়ে ঋণ পরিশোধ করল।
 
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে মৌলিক আরবি ছোটগল্পের অগ্রযাত্রা আরম্ভ হয় এবং দীর্ঘ এক শতাব্দী কাল পর্যন্ত আরবি সাহিত্যিকদের প্রতিভা, ত্যাগ, প্রচেষ্টা, আন্তরিকতা ও শৈল্পিক চেতনার মাধ্যমে আরবি ছোটগল্প বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধশালী সাহিত্যের অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
 
আরবি ছোটগল্পের ইতিহাস আলোচনা করতে গেলে সর্ব প্রথম যে, মহান ব্যক্তিত্বের নাম উল্লেখ করা যায় তিনি হলেন মিসরের সাইয়্যিদ মুস্তফা লুতফী আল-মানফালূতী। তিনি প্রথমে ফরাসী ও ইংরেজী ছোটগল্প অনুবাদ করেন এবং পরে মৌলিক ছোটগল্প রচনা করে আরবি সাহিত্যে ছোটগল্প লেখার টেকনিক ও কলা- কৌশল সৃষ্টি করেছেন।
 
নেপোলিয়ানের সাথে যে বিদ্বানেরা এসেছিলেন তারা আল্‌-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনা করেছিলেন। তাছাড়া তাঁরা ইতিহাস ও সাহিত্য ইত্যাদি বিষয়ে অধ্যয়ন ও গবেষণা করেছিলেন। এবং মিসরে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করে দুটি পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন। পত্রিকা দুটি ১৭৯৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। আমরা জানি যে, মিসরের তৎকালীন শাসক মুহাম্মদ আলী পাশ্চাত্যের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেছিলেন। তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে মিসরের ছাত্র ও শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধিদল ইতালী ও ফ্রান্সে উচ্চি শক্ষার জন্য প্রেরণ করেন। সে সব দেশ হতেও কিছু শিক্ষককে মিসরে নিয়ে আসেন। এতদ্ব্যতীত চিকিৎসা ও প্রকৌশর বিষয়েও তিনি মনোযোগ দিয়েছিলেন। অতঃপর ইসমাঈল পাশা গভর্ণর হলে এ ব্যাপারে সহায়ক ভূমিকা পালন করেন।
 
মুহাম্মদ আলী মিসরে ১৮২১ সালে মাত্‌বাআহ আল্‌-আমীরিয়াহ নামক একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এবং পাশ্চাত্য ভাষা থেকে আরবীতে অনুবাদের জন্য মাদ্‌রাসাতুল্‌ আল্‌সুন নামক একটি প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলেনঅনুবাদের ক্ষেত্রে প্রথমে সিরীয় খ্রিষ্টানরাই মনোনিবেশ করেছিলেন বেশি। বিজ্ঞান ও কারিগরী বিষয়ক বই পুস্তক তখন বেশির ভাগ অনুদিত হয়েছিল। সাহিত্য সম্পর্কিত বই পুস্তকের অনুবাদ সাধারণত ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে মিসরে আরম্ভ হয়েছিল। অবশ্য সিরিয়ায় পাশ্চাত্যের প্রভাব সাহিত্য ক্ষেত্রে তারও পূর্বে পরিলক্ষিত হয়। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে সিরিয়ায় খ্রিষ্টান মিশনারীদের কাজ চলছিল। শহরে ও গ্রামে তারা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৮৭৪ সালে বৈরুতে সেন্ট জোসেফ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। তারও পূর্বে আমেরিকানরা একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি পরবর্তীতে আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হয়। সিরিয়াতেই সর্ব প্রথম ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি কল্পে ১৮৪৭ সালে জা্‌ম‘ইয়াতুল্‌ আদাব ওয়াল্‌ উলুম (সাহিত্য ও বিজ্ঞান সমিতি) নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। এ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা ছিলেন বুতরুস আল্‌-বুস্তামী (১৮৮৩) ও নাসিফ আল্‌-ইয়াযিজী (১৮৭১)। ১৮৫৭ সালে সিরিয়ায় আল্‌-জাম্‌‘ইয়াতু আল্‌-‘ইলমিয়াতু আস্‌-সুরিইয়্যাহ্‌ নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল। পাশ্চাত্যের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপনে ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের ক্ষেত্রে সিরিয়া যথেষ্ট অগ্রগামী ছিল। এখানকার অধিবাসীদের একটা বিরাট অংশ খ্রিষ্টান ছিল। তাদের জন্য পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সভ্যতা গ্রহণে ধর্মীয় কোন বাধা ছিল না। তা ছাড়া ইসলামী ঐতিহ্যের আওতা থেকে তারা মুক্ত ছিল। ফলে সিরিয়া ও লেবাননে সাহিত্য ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য ভাবধারার আগমন ও অনুপ্রবেশ অতি সহজে ও দ্রুত সম্ভব হয়েছে। মিসরা ও সিরিয়া ব্যতীত অন্যান্য আরব ভূখণ্ডে পাশ্চাত্যে প্রভাব পড়েছে আরও পরে।
 
এমনিভাবে পাশ্চাত্যের সাথে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে আরবি সাহিত্যে কথাসাহিত্যের নতুন নতুন আঙ্গিকের আবির্ভাব ঘটে। ধীরে ধীরে আরবিতেও রচিত হয় ছোটগল্প, উপন্যাস ও নাটকসেই সাথে আরম্ভ হয় সাহিত্য-সমালোচনার ধারাওআধুনিক আরবি সাহিত্যের এই সূচনাকালকে আরবি ভাষায় আন্‌-নাহ্‌দা বা আল্‌-ইন্‌বি‘আস অর্থাৎ নবজাগরণ বা রেনেসাঁর যুগ বলা হয়। এ সময়ে মধ্যপ্রাচ্য সহ পৃথিবীর সর্বত্র শিল্প বিবর্তনের ফলে নতুন ধরণের গদ্যরীতি আরবি সাহিত্যে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। এ কারণেই রচিত হতে থাকে সম্পুর্ণ নতুন আঙ্গিকের ছোটগল্প ও উপন্যাস যা ইতিপূর্বে সনাতন ধর্মী আরবি সাহিত্যে কখনো দৃষ্টিগোচর হয়নি। তবে কালীলাহ্‌ ওয়া দিমনাহ্‌এবং আল্‌ফু লায়লা ওয়া লায়লা সহ মধ্যযুগীয় রম্য সাহিত্য যে আধুনিক আরবি ছোটগল্পে প্রভাব বিস্তার করেনি, এমন কথা বলা যায় না। এ সকল ক্লাসিক ধর্মী রচনা যে আধুনিক কালের ছোটগল্পে প্রভাব বিস্তার করেনি, এমন কথা বলা যায় না। এ সকল ক্লাসিক ধর্মী রচনার সঙ্গে আধুনিক কালের ছোটগল্পের তফাৎ শুধু আঙ্গিক গঠনে সীমাবদ্ধ নয় বরং টেকনিক, বিষয়বস্তু, বর্ণনাভঙ্গি, রচনাশৈলী এবং ভাষা ও শব্দ চয়নেও প্রচুর তফাৎ পরিলক্ষিত হয়।
 
অষ্টাদশ শতাব্দী হতে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ পর্যন্ত আরবি কথা সাহিত্যে তেমন উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ রচিত হয়নি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আব্দুল্লাহ ফিকরী পাশা (১৮৯০), নাসিফ আল-ইয়াযিজী (১৮৭১) এবং আহ্‌মাদ ফারিস আশ্‌-শিদ্‌ইয়াক মাকামাহ্‌ পদ্ধতিতে গ্রন্থ রচনা করেন। তার মধ্যে আহ্‌মাদ ফারিস আশ্‌-শিদ্‌ইয়াক এর বর্ণনায় আধুনিক ছোটগল্পের আঙ্গিক ও প্রকৃতি কিছুটা পরিদৃশ্য হয়। তাঁর 'আকালু কাল' ও 'ফাত্‌বীর' গল্প দু’টি এর নিদর্শন। তাঁর গল্পে পাঠককে আনন্দ দেওয়ার শক্তি ছিল। কিন্তু তিনি এদিকে বিশেষ মনোযোগ দেননি। কতিপয় সমালোচকের মতে আধুনিক ছোটগল্পের মাকামাহ্‌র মাধ্যমেই উদ্ভব হয়, যা আলী মুবারক ও আব্দুল্লাহ ফিকরী পাশা-এর হাতে অস্তিত্বে আসে। আবার কারো মতে আব্দুল্লাহ নাদিম (১৮৪৫-৯৬) এর কতিপয় প্রবন্ধ ছোট গল্পের উৎপত্তির ক্ষেত্রে প্রতিনিধিত্ব করেছিল, যা তাঁরই সম্পাদিত আত-তানকিত ওয়াত্‌ তাবকীত নামক সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রবন্ধগুলো অত্যন্ত মনোরম ও বাকপটু রচনাশৈলীতে লেখা হয়েছিল যা অধিকাংশই বিনোদনমূলক কাহিনী হতে বিকাশ লাভ করেছে এবং হাদীকাতুল্‌ আখবার (১৮৫৮) এবং আল-জিনান (১৮৭০) সহ বিভিন্ন লেবাননী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। পাশ্চাত্যের সাথে যোগাযোগ হওয়ার প্রায় ৫০ বছর পর আরবি সাহিত্যে পাশ্চাত্যের ছোটগল্পের অনুবাদ নিয়মিত ভাবে আরম্ভ হয়। ১৮৪৯ সালে রিফাআহ রাফে’ আত্‌-তাহাতাবী (মৃত ১৮৭৩) ফেনোলোনের একটি ছোটগল্প আরবীতে অনুবাদ করে মাওয়াকিউল আফলাক ফী ওয়াকাইয়াতীল মার্কনামকরণ করেন। গল্পটি ১৮৬৭ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি এক হাজারেরও অধিক বই ইউরোপীয় ভাষা হতে আরবীতে অনুবাদ করেছিলেন। এ ছাড়া তাঁর সমসাময়িক কিছু লেখকও অনুবাদ কাজে হাত দেন। অতঃপর ধীরে ধীরে এ ক্ষেত্রে মৌলিক রচনারও সূত্রপাত ঘটে। তবে ছোটগল্পের অনুবাদ ও রচনার পূর্বেই নাটক ও উপন্যাস লেখার কাজ আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল।
 
ছোটগল্প অনুবাদ ও রচনার কাজটি যে বিলম্বিত হয়েছে তার কিছু কারণও রয়েছে, যেমন— (ক) তৎকালে জ্ঞান-বিজ্ঞানের গ্রন্থাবলী অনুবাদ করা বিশেষ প্রয়োজন ছিল। তাই লেখকগণ গল্প ও উপন্যাসের তেমন দিকে মনোযোগ দেননি। (খ) শিক্ষার প্রসার স্বল্প ছিল বলে পাশ্চাত্যের গল্প উপন্যাস পড়ার মতো লোকের অভাব ছিল। পাশ্চাত্যের গল্পের ভাব ও বিষয়বস্তু সাধারণ আরবদের রুচিসম্মত না হওয়ার কারণে এগুলো পাঠক সমাজে আগ্রহের সৃষ্টি করতে পারেনি। (গ) ছাপাখানার স্বল্পতার দরুন এসব বই প্রকাশনার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। (ঘ) পত্র-পত্রিকায় সাধারণত ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। তৎকালে আরবি পত্রিকার স্বল্পতার কারণে ছোটগল্পের প্রকাশ ও প্রচার সীমিত ছিল। (ঙ) পাশ্চাত্যের ভাষায় অভিজ্ঞ লেখকের অভাব ছিল বিধায় অনুবাদের কাজ অগ্রসর হয়নি। (চ) সর্বোপরি গল্প লেখার জন্য যে সহজ লিখন পদ্ধতি বা স্টাইলের প্রয়োজন তা তখন পর্যন্ত লেখকদের আয়ত্বে আসেনি। তাই গল্প রচনা ত্বরান্বিত হয়নি। এ প্রসঙ্গে প্রফেসর গীব বলেছেন, আনন্দ দানের নিমিত্তে আধুনিক স্টাইলের আদর্শ গদ্য রচনা ক্লাসক্যাল আরবীতে অনুপস্থিত ছিল।
 
আর তাই ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে আরবি ছোটগল্প লেখার যাত্রা আরম্ভ হয়। ক্রমান্বয়ে অগ্রসর হয়েছে সাহিত্যের এই নতুন শাখাটিপাশ্চাত্য গল্প ও উপন্যাসকে আরবি সাহিত্যে স্থান দেওয়ার বিষয়টি সূধী সমাজে প্রাথমিক পর্যায়ে তর্কের বিষয় ছিল। অতঃপর মিসরের জাতীয় মুফতী শায়খ মুহাম্মদ আব্দুহু (১৮৫০-১৯০৫) এবং তাঁর ছাত্র রাশিদ রেযা (১৯৬৫-১৯৩৫) এ ধরণের সাহিত্যের সমর্থনে প্রবন্ধ লেখার ফলে বিষয়টির চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে যায় এবং ধার্মিক মহলেও এই সাহিত্য রীতি সমাদৃত হয়। শিল্পী সাহিত্যিকগণ এগিয়ে আসেন এই সাহিত্য রচনার প্রতি। তাঁদের রচনাবলী প্রকাশ করা ও জনগণের নিকট পৌছানোর ক্ষেত্রে সাহায্য করে বেশ কিছু পত্রিকা ও সাময়িকী। তখন মিসর ও সিরিয়ার পত্র-পত্রিকায় প্রায় সাধারণ ভাবে গল্প ও উপন্যাসের জন্য বিশেষ পৃষ্ঠা নির্ধারিত হতে দেখা যায়। এ সত্ত্বেও আল্‌-মুকতাতাফআল্‌-মাশরিকপত্রিকাদ্বয় বেশ কিছুকাল পর্যন্ত (১৮৮২-১৮৯৮) গল্প উপন্যাস প্রকাশনায় অনীহা প্রদর্শন করেছে। ১৮৯৯ সালে প্রথম আল-মুকতাতাফে কিস্সাতু লুভিস দিহারজামুনধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। ধীরে ধীরে বেশ কিছু পত্র-পত্রিকা বিশেষভাবে ছোটগল্প, উপন্যাস নাটক প্রকাশনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এ প্রসঙ্গে বুতরুস আল বুস্তানী (১৮৮৩) সম্পাদিত আল-জিনান, আহমাদ লুতফী সাইয়্যেদ (মৃত ১৯৬৪) সম্পাদিত আল-জারীদা, মুহাম্মদ হুসাইন হায়কল (মৃত ১৯৫৬) সম্পাদিত আস-সিয়াসাহ্‌, রাজ্জাক গাম্মাম সম্পাদিত আল-ইরাক, জুরযী যায়দান (মৃত ১৯২৪) সম্পাদিত আল-আদব (১৮৮৮) ও আলেকজান্দ্রীয় থেকে প্রকাশিত আল-রাভী (১৮৮৮)-এর মত পত্রিকাগুলোর নাম উল্লেখযোগ্য। এতদ্বতীত আল-মাশরিক  (বৈরুত ১৮৯৮) আয-যিয়া, কায়রো (১৮৯৮) এবং ফাতাতুশ-শারক, কায়রো (১৯০৬)-এর ভুমিকাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।
 
আরবি সাহিত্যের সর্বাধুনিক ও সর্বকনিষ্ঠ শাখা ছোটগল্প রচনার কার্যক্রমকে তিন ভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যায়নিয়মিত আরবি ছোটগল্প রচনার প্রথম পর্যায় আরম্ভ হয় ১৮৭০ সালে। বুতরুস আল-বুস্তানীর ছেলে সলীম আল-বুস্তানী (১৮৪৮-১৮৮৪) ছিলেন সর্ব প্রথম নিয়মিত ছোটগল্প লেখক। তিনি ১৮৭০ সালে রামযাতুন মিন গায়রি রামিননামক প্রায় ১৫০০ শব্দের একটি মৌলিক ছোটগল্প রচনা করে তাঁর পিতার সম্পাদিত আল-জিনান (প্রথম প্রকাশ-১৮৭০) পত্রিকায় প্রকাশ করেন। সালীম ইংরেজী, ফরাসি ও তুর্কী ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। ১৮৭৫-১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দ মধ্যবর্তী সময়ে অন্যান্য লেখকের আরও অনেকগুলো ছোটগল্প পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হয়েছিল। সনাতন পদ্ধতির গল্প উপাখ্যান হতে ইউরোপীয় স্টাইলের ছোটগল্পে রুপান্তরিত হওয়ার জন্য যে সকল ক্ষেত্রে পরিবর্তন আবশ্যক হয়েছিল, তারমধ্যে বর্ণনার সংক্ষিপ্তকরণ, ভাষার সহজীকরণ, আলংকারিক চিন্তার সংক্ষিপ্তকরণ, ঘটনা মুখ্য ও অপ্রয়োজনীয় কথামালার পরিহার প্রভৃতি উল্লেখ্য। আর সালীম-এর রামযাতুন মিন গায়রি রামিন গল্পটি এ সকল পরিবর্তন ধারণ করেছিল। এর সহজ সাবলীল রচনাশৈলী ও প্রাচীন শব্দের পরিহার ইয়াযিজী ও শিদইয়াক-এর স্টাইল হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল।
 
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষাবধি সালীম আল-বুস্তানী ব্যতিত অন্য কেউ ছোটগল্প রচনার ব্যাপারে তেমন আগ্রহ প্রদর্শন করেননি। অবশ্য নাসীব আল-মাস্‌আলানী ও মিসরে বসবাসকারী লেবাননী লেখিকা লাবীবা হাশিম কিছু মৌলিক ছোটগল্পে লেখার চেষ্টা করেছেন। তিনি হাসানাত আল-হুব নামক ছোটগল্প রচনা করে ১৮৯৮ সালে আয-যিয়া নামক পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এই পত্রিকাটি কায়রো হতে ১৮৯৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল এবং ১৯০৬ সালে এর প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। পত্রিকাটিতে প্রথম থেকেই নিয়মিত ছোটগল্প প্রকাশিত হয়। প্রথম বছর পত্রিকাটিতে প্রায় তেইশটি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছিলো তারমধ্যে একুশটি গল্প ইংরেজী হতে অনূদিত এবং বাকী দুটি লাবীবা হাশিম ও মুসা সায়দা কর্তৃক রচিত। এতদ্বতীত এই পত্রিকাটির বন্ধ হওয়ার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত এতে একশ সাতষট্টিটি ছোট গল্প প্রকাশিত হয়েছিল। এ গুলোর অধিকাংশ ইংরেজী হতে অনুদিত, কয়েকটি ফরাসী ও রুশ ভাষা হতেও অনুবাদ করা হয়েছিল। এগুলোর কিছু ছিল শার্লক হোমসের গল্প। এই অনুবাদের কাজে নাসীব আল-মাসআলানী ও লাবীবা হাশিম-এর ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। লাবীবা হাশিম ১৯০৬ সালো কায়রো হতে ফাতাতুশ-শারক নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি অনেক মৌলিক ছোটগল্প রচনা করে এবং ইংরেজী হতে অনুবাদ করে নিজ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন। যেমন জাযাউল-ইহসান ও হাসনাতুল্‌-হুব ১৯০৬ সালে এই পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর দু’টি ছোটগল্প। প্রথম গল্পটিতে মিসরের দরিদ্র শ্রেণীর দুর্দশা বর্ণিত হয়েছে। গল্পটি আগাগোড়া ভাবাবেগে পরিপূর্ণ। গল্পে ঘটনার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়নি এবং গল্পটি স্বাভাবিক ভাবে অগ্রসর হয়নি। দ্বিতীয় গল্পটি আরো নিম্নমানের। গল্প রচনায় লেখিকার হাত তখনও পরিপক্ক হয়নি বললে অত্যুক্তি হবে না।
 
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে আরবি ছোটগল্পে মুস্তফা লুতফী আল-মানফালুতীর (১৮৭৬-১৯২৪) আবির্ভাব হয়। তিনি প্রাথমিক জীবনে ছিলেন একজন প্রবন্ধকার। পরবর্তীতে সার্থক ছোটগল্পকার হিসেবে আবির্ভুত হন। তিনি তাঁর সাবলীল ও প্রাঞ্জল গদ্যরীতির জন্য প্রশংসা লাভ করেছিলেন। তাঁর প্রাথমিক পর্যায়ের রচিত এবং অনূদিত গল্পগুলো ছোটগল্প হিসেবে সার্থক না হলেও সামাজিক অসাম্যের প্রতি গল্পের মাধ্যমে পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার ব্যাপারে তিনি অগ্রনী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি ১৯০৭ সালে আল-মুয়াইয়্যাদ (১৮৮৯ সালে কায়রোতে প্রথম প্রকাশিত) পত্রিকায় চাকুরী লাভ করেন। তখন তিনি অসংখ্য ছোটগল্প ও প্রবন্ধ লেখেন, পরবর্তীতে সেগুলোকে আন-নাযরাত নামে সংকলন করে ১৯১০ সালে প্রকাশ করেন।
 
পরবর্তীতে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে মুহাম্মদ তাইমূর রচিত ‘ফিল্‌ কিতার’-এর মাধ্যমে আরবি ছোটগল্প একটি স্বতন্ত্র বিষয় ও রূপ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এবং তাঁর ‘মা তারাহুল্‌ উইয়ূন’ নামক ছোটগল্প সংকলন প্রভূত খ্যাতি অর্জন করে। অনেকে মনে করেন, মুহাম্মাদ তাইমূর এর উদ্ভাবক হলেও ছোটগল্পের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয় তাঁর ভাই মাহমুদ তাইমূরকে।
 
মিশরে উৎপত্তি হলেও আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ছোটগল্পের গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে। লেবানন, সিরিয়া, জর্ডন, সুদান, ইরাক প্রভৃতি দেশের বহু লেখক অসংখ্য ছোটগল্প রচনা করে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে আরবি ছোটগল্পকে উচ্চাসন দান করেন। মুহাম্মাদ তাইমূর ও তাঁর ভাই মাহমুদ তাইমূর ছাড়াও হাফিয ইবরাহীম, হুসাইন হাইকাল, মানফালুত্বী, খালীল জিবরান, তাওফীক আল্‌-হাকীম প্রমুখ ছোটগল্পের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন। এছাড়াও নাজীব মাহফুয, ত্বাহা হুসিয়ান, প্রবাসী সাহিত্যিক মিখাইল নুয়াইমা প্রমুখ তাঁদের সাহিত্য প্রতিভা দ্বারা ছোটগল্পের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ হতে সমৃদ্ধতর করেন। আরবি ভাষার কয়েকটি প্রসিদ্ধ ছোটগল্প হল—
 الأجنحة المتكسرة، مكتوب على الجبين، اليتيم، في الطريق، في القطار، صباح الورد، الحب تحت المطر، ثرثرة فوق النيل.

- আব্দুল মাতিন ওয়াসিম 

Tuesday 22 June 2021

জামাআতু আবুলু বা অ্যাপোলো গ্রুপ

 


জামাআতু আবুলু বা অ্যাপোলো গ্রুপ
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
 
পরিচয়ঃ
আধুনিক আরবি জগতে এটি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য সংগঠন। এখানে একত্রিত হয়েছিল মিশর তথা আরব বিশ্বের আবেগপ্ররণ কবিদের একটি গোষ্ঠী। এদের মধ্যে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল তারা হলেনঃ ইবরাহীম নাজী, আলী মাহমুদ তহা, আলী আল-আনানী, কামিল কিলানী, মাহমূদ ইমাদ, জামীলা আলাইলী প্রমুখ।
 
প্রতিষ্ঠা ও সম্পাদকগণঃ
১৯৩২ খ্রীষ্টাব্দে বিখ্যাত কবি আহমাদ যাকী আবু শাদীর-এর হাত ধরে এই সংগঠনের সূচনা। এর প্রথম সম্পাদক রূপে নিযুক্ত হন আমীরুশ শুআরা আহমদ শাওকী। এক বছরের মধ্যেই তার মৃত্যু হলে তার স্থলাভিষিক্ত হন খালীল মুত্বরানতার পর এই দায়িত্বে আসেন প্রতিষ্ঠাতা আবু শাদী। এই আন্দোলন স্থায়ী থাকে ১৯৩২-৩৬ খ্রীষ্টাব্দ।
 
নামকরণের কারণঃ
এই সংগঠনের কার্যকলাপের যে অভিনবত্ব এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে বিস্তৃতি তা অ্যাপোলো নামক একটি গ্রীক যন্ত্রের কার্যকলাপের ভিন্নমুখীনতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। তাই এই সংগঠনের নাম রাখা হয় অ্যাপোলোএদের কর্মসূচীর মধ্যে ছিল সাংস্কৃতিক প্রগতি, দর্শন-প্রেম, ধর্মীয় মূলনীতির দৃঢ়ীকরণ এবং চারিত্রিক উন্নতি। এদের লক্ষ্য ছিল রোমান্টিসিজ্‌ম্‌।
 
প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেঃ
দেওয়ান-গোষ্ঠীর মতো এটা কোনো নির্দিষ্ট কবি গোষ্ঠী ছিল না। তারা কবিতা রচনার কোনো নিয়মাবলী লিপিবদ্ধ করেনি যা লিখন-পদ্ধতি, বিষয়, চিন্তাধারা সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় ও অভিনবত্বের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গীকে সীমাবদ্ধ করবে। এক্ষেত্রে আবু শাদী একটি প্রশাসনিক সংবিধান প্রতিষ্ঠা-ই যথেষ্ট মনে করেছিলেন, যার মধ্যে লিখিত থাকবে কিছু সাধারণ উদ্দেশ্যাবলী, যা আরবি কবিতাকে প্রগতিশীল করে তুলবে এবং এই লক্ষ্যের দিকে কবিদের প্রচেষ্টাকে আরো এগিয়ে দেবে, আর শৈল্পিক, সামাজিক এবং বস্তুগত ভাবে কবিদের স্তরকে উন্নীত করবে। কবিতার নবজাগরণ এবং প্রসার আরও সম্মুখবর্তী করা এর আরও একটি উদ্দেশ্য ছিল।
 
সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে অবদানঃ
মাজাল্লাতু আবুলু (مجلة أبولو) নামে একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হতো যা ১৯৩৪ সালে স্থগিত হয়ে যায়। এটিকে এই সংগঠনের সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক এবং চিন্তাধারার একটি প্রামান্য উৎস রূপে গণ্য করা হয়। এটি দেওয়ান-আন্দোলনের প্রভাবকে স্তিমিত করে দিয়েছিল এবং তার জায়গা দখল করেছিল। এই সংগঠন একটি নতুন কবি-প্রজন্মের জন্ম দেয়, যারা রোমান্টিসিজ্‌মের ভাবধারার সঙ্গে একাত্ম হয়েছিল। যেমনইবরাহীম নাজী, আলী মাহমূদ ত্বহা, মাহমূদ হাসান ইসমাইল প্রমুখ।
 
সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্টসমূহঃ
এই রোমান্টিক কবি গোষ্ঠী, দুঃখী ও বঞ্চিতের প্রেমের চিত্রায়ণের মাঝেই অভিনবত্বের  ভিন্নতা খুঁজে পেয়েছিলেন, যেটা বিচ্ছেদ বা মৃত্যুতে গিয়ে শেষ হয়েছে। এদের সাহিত্যে মানবরূপ পরিস্ফুটিত হয়েছিল একাকী, বঞ্চিত দুঃখী রূপে, যা আমরা ইবরাহীম নাজী, আলী মাহমূদের কবিতায়; আব্দুল হালীম, মুহাম্মদ যারীদের উপন্যাসে খুঁজে পাই। এছাড়াও তাদের নাটক, উপন্যাস প্রভৃতিতে বাস্তবের সামনে থেকে মানুষের পলায়নপর মানসিকতা স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে। দেওয়ান-গোষ্ঠীর তুলনায় অ্যাপোলো-গোষ্ঠী অনেকাংশে বিতর্ক মুক্ত ছিল।

Saturday 12 June 2021

আরবি সাহিত্যের রোমান্টিক কবি আবুল-কাসিম আশ-শাব্বি


আরবি সাহিত্যের রোমান্টিক কবি আবুল্‌-ক়াসিম আশ্‌-শাব্বি
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
 
তিউনিসিয়ার জাতীয় কবি তিনি।শায়েরুল্খায্‌রায়ি’(চিরসবুজের কবি) হিসেবেই তিউনিসিয়দের কাছে অধিক পরিচিত। তিউনিসিয়ার তুযার প্রদেশের শাবিয়া গ্রামে ১৯০৯ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম। বিচারক পিতার ট্র্যান্সফারেব্‌ল চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়ান; সেই সাথে প্রত্যক্ষ করেন তিউনিসিয়ার মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পিতা মুহাম্মদ শাব্বি ছিলেন একজন সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও ধর্মপ্রাণ মানুষ। আদালত, বাড়ি ও মসজিদ এ তিনের মাঝেই দিন অতিবাহিত করতেন। আর তাই শাব্বি বেড়ে উঠেছিলেন ধর্মীয় ও রক্ষণশীল পরিবেশে।
 
১৯২৮ সালে জায়তুনা বিশ্ববিদ্যালয় হতে স্নাতক এবং ১৯৩০ সালে তিউনিসিয়া বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। পরের বছর, ১৯২৯ সালে তাঁর হার্টের অসুখ ধরা পড়ে। তবে তখনও তা ভয়ানক আকার ধারণ করেনি। এ সময়ে পিতা তাঁর বিয়ে দেওয়ার মনস্থ করেন। কিন্তু কবি অসুস্থতার কারণে বাবার ইচ্ছায় আপত্তি করেন এবং শীঘ্রই ডাক্তার মুহাম্মদ আল্‌-মাতেরি-র শরণাপন্ন হোন। কিছু দিন পর, বাবার চাপাচাপিতে বিয়ে করেন এবং দুপুত্রের পিতা হন। তবে শারীরিক অবস্থার ক্রমশ অবনতি হতে থাকে। রোজ নতুন নতুন সমস্যার মুখোমুখি হতে থাকেন। তিনি অবশ্য ছোটবেলা থেকেই ক্ষীণকায় ও দুর্বল ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হয়েছিল।
 
এক বাল্যবান্ধবীর মৃত্যুতে মর্মাহত হয়ে ডাক্তারের পরামর্শ ও নির্দেশকে উপেক্ষা করতে আরম্ভ করেন। অন্যদিকে বিয়ে ও সাংসারিক দায়দায়িত্ব তাঁকে আরো চিন্তাগ্রস্থ করে তুলেছিল। দৌড়াদৌড়ি, হাঁটাহাঁটি, পাহাড়ে ওঠা, সাইকেল চালানো অনেক কিছুই বারণ ছিল তাঁর জন্য। আর তাই জায়তুনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে বন্ধুদের খেলাধুলা করতে দেখে একদা ডুকরে কেঁদে ওঠে বলেছিলেন-হায়রে আমার হৃদয়! তুমি যে বড়োই দুর্বল। তুমিই আমার যতো কষ্টের মূল। আমার সকল চিন্তার উৎসভূমি তুমিই। তুমিই আমার জীবনকে করেছ অর্থহীন”।
 
ক্রমশ বাড়তে থাকা অসুস্থতার দরুন, ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী, ১৯৩২ সালে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের জন্য আইনু দারাহিম-এ যান। সেখানে তাব্‌রাকা নগরী পরিদর্শন করে কিছুটা সুস্থ বোধ করেন। পরবর্তী বছর যান সমুদ্র-সৈকত ও তার তীরবর্তী এলাকা ভ্রমনে। দৃষ্টি নন্দন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে তাঁর চোখ ও মন শীতল হয়। পুরো গ্রীষ্ম সেখানে কাটিয়ে শীতের শুরুতে ফিরে আসেন তুযারে। ১৯৩৩-এর শেষ দিকে তাঁর শারীরিক অবস্থা ভয়ানক অবনতি হয়। শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন তিনি। শীত যায়, বসন্ত আসে, কিন্তু কবির অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না। তাই একটু আরোগ্য লাভের উদ্দেশ্যে এবার যাত্রা করেন হিম্মা-র। কিন্তু হিতে বিপরীত হয়। বাধ্য হয়ে ফিরে আসেন তিউনিসিয়া শহরে। এখানে-সেখানে বহু ছুটোছুটি করেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। দিনদিন অবনতির দিকেই এগোতে থাকে তাঁর শারীরিক অবস্থা। ফলে ৩রা অক্টোবর ভর্তি হোন তালইয়ান হাসপাতালে। ছ’দিন পর ৯ অক্টোবর সোমবার ভোর চারটায় ইহজীবনের মায়া ত্যাগ করেন। সেদিনই তাঁর মরদেহ তিউনিসিয়া সিটি থেকে তুযারে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং সেখানেই সমাধিস্থ করা হয় তাঁকে।
 
কবিকে তিউনিসের দীপ্তি এবং আরবির প্রতীচ্য উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। তার কালজয়ী কবিতাসমূহের কারণে তাকে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সেতুবন্ধন হিসেবে অভিহিত করেছেন আরবি কাব্যের বোদ্ধা সমাজ। তাকে আরবি রোমান্টিক কবিতার পথিকৃৎদের অন্যতম গণ্য করা হয়। তিনি ছিলেন আধুনিক তিউনিসিয়ার সাহিত্যাকাশের উজ্জ্বল তারকা। প্রবাদ পুরুষ। লেখালেখিতে তিনি মিসরীয় সাহিত্যিক ও ইসলামি সংস্কারক মুহাম্মদ আব্দুহুর দ্বারা অতি মাত্রায় প্রভাবিত ছিলেন। ১৯২৬ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তিনি ক্লাসিক ধর্মী ঐতিহ্যিক আরবি কবিতার অনুরক্ত ছিলেন। তবে তার সাথে তিনি ফ্রান্সীয় রোমান্টিকতার সংমিশ্রণে প্রচণ্ড আগ্রহী ছিলেন। তার কবিতা পাঠে ডি-মাসেট, লা-মারটিন, টি-গাশিয়ার প্রমুখ রোমান্টিক কবিদের প্রভাব অতিমাত্রায় লক্ষ্য করা যায়।
 
কবির অত্যল্পকালে আমাদের জন্য রেখে যাওয়া কবির শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে. আগানি আল্‌-হায়াৎ (জীবনসঙ্গীত) ১৯৬৬ ২য় সংস্করণ, খ. আল্‌-খিয়াল আল্‌-শি’রি ইনদাল আরব (আরবদের কাব্যকল্পনা) ১৯৬১, গ. রাসাইল আশ্‌-শাব্বি (শাব্বির পত্রাবলী) ১৯৬৬, ঘ. মুজাক্কারাত (স্মরণ), . সাদিকি (বক্তৃতা সংকলন)।
 
কবি আশ্‌-শাব্বি সাহিত্যের প্রতি অতিমাত্রায় অনুরক্ত ছিলেন। বিশেষত আধুনিক সাহিত্যের প্রতি তার অনুরক্ততা ছিলো প্রবল। তবে তা কোনোভাবে ইক্ল্যাসিক সাহিত্য বা সাহিত্যিক ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে নয়। তার লেখা প্রায় প্রতিটি কবিতাই যুগপৎ প্রাচীনত্ব ও আধুনিকতার সমন্বিত রূপ। আরবি প্রাচীন কবিতার মাত্রা, ছন্দ, বৃত্ত, তার কবিতায় রয়েছে আবার আধুনিক কবিতার বিষয়বস্তু, রসদ, ঢঙ প্রভৃতিও সেখানে মূর্তিমান। তিনি ছিলেন প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতি প্রেমী চিরসবুজের কবি। প্রকৃতির প্রতি তার নিখাঁদ ভালোবাসার শেষ ঠিকানা দেশ প্রেম। তাই কবি আশ্‌-শাব্বিকে পোয়েট অফ ন্যাচার টু প্যাট্রিওটিজম বলা হয়ে থাকে।
 
চিরসবুজের কবি আশ্‌-শাব্বি প্রকৃতির বন্দনা করেছেন চিরায়ত। তিউনিসিয়ার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ভূগোলকে উপস্থাপন করেছেন কবি দেশপ্রেমের নব মাত্রায়। মিন আগানি আল-রু‘আত (রাখাল সঙ্গীত) কবিতায় নিঃসীম প্রকৃতির সাথে দেশপ্রেমের যুগপৎ পথ চলার অনবদ্য দৃশ্য এঁকেছেন অনুপম নান্দনিকতায়। কবি বলেছেন
 
জীবনের বন্দনা- আসে সুবহে সাদিক
দোল খায় গাছেরা,  স্বপ্ন দেখে সুপ্রভাতের
শিশির সিক্ত গোলাপ পাত্রে নিত্য নাচে প্রভাত
আলো হয় উপত্যকা, কেটে যায় তমসা রাত
সুবহে সাদিকের আগমনে দিগন্ত হয় দীপ্যমান
ফুলপাখি হাই তোলে আর সমুদ্র করে কলতান
এভাবেই পৃথিবী সজীব হয় জীবন বন্দনায়
তুমি সুখনিদ্রা ছেড়ে ওঠো, পৌঁছে যাও নিজ ঠিকানায়।
 
এভাবেই প্রকৃতির বন্দনায় নিরত কবি প্রকৃতিকে সৌন্দর্যমণ্ডিত ও কারুকার্যখচিত করে তোলেন পাঠক হৃদয়ে। তিউনিসিয়ার নিসর্গ প্রকৃতির বিমূর্ত প্রতিচ্ছবি তার অনেক কবিতায়ই আমরা দেখতে পাই। তবে নিতান্ত প্রকৃতি বন্দনা কবির কবিতার শেষ কথা নয়। বরং সেখানেও দেশ, দেশমাতৃকা কবির কাছে অনেক বড় বিষয়। উপরুল্লেখিত কবিতায় আমরা প্রভাত, শিশির সিক্ত গোলাপ, উপত্যকা, সমুদ্রের কলতান এ সবের নিঃসীম সৌন্দর্য অবলোকন করি। কিন্তু কবি দেশ গঠনে জাতিকে জাগাতে ভোলেননি। সুখনিদ্রা ছেড়ে জাতি গঠনে মনোনিবেশের অকৃত্রিম আহ্বান কবির নিখাঁদ দেশপ্রেমের প্রতি ইঙ্গিত করে। এ কবিতার মাঝামাঝি দেশ গঠনে কবির আকুতি যেনো দেশের প্রতি কঠোর দায়বোধেরই আর্তি।
 
তুলে ফেলো আগাছা, চাষ করো নতুনের
নলখাগড়ার বাঁশীর ওই ডাক শোনো গঠনের।
 
কী চমৎকার কবির আহ্বান! প্রকৃতি প্রীতির পশ্চাতে দেশপ্রেমের কী অনবদ্য নমুনা। দেশের প্রতি প্রেম কতোটা নিখাঁদ হলে এভাবে জাতিকে দেশের উন্নয়নে আহ্বান করা যায়। কবির উপমা-উৎপ্রেক্ষাতেও রয়েছে চমৎকারিত্বের যাদু। আগাছা মুক্ত নতুনের চাষাবাদ, নলখাগড়ার বাঁশীর আহ্বান সত্যিই মনোমুগ্ধকর।
  
কবি আশ্‌-শাব্বি ছিলেন স্বল্পায়ু। তার জীবন ছিলো মাত্র পঁচিশ বছরের। তার সাহিত্যের খাজাঞ্চীও অতিকায় ছিলো না। তবে তার লেখা ছিলো মানোত্তীর্ণ। ডাক্তারী তথ্য মতে হার্টের অসুখে তার মৃত্যু হলেও মনে করা হয় তার মৃত্যুর কারণ তিনটি- . দুর্বল হার্ট খ. বাল্যবান্ধবীর অকাল মৃত্যু গ. ডাক্তারের পরামর্শ উপেক্ষা করা। কবি সত্যিই ভালোবাসার কাঙাল ছিলেন। মাতাম আল-হুব্ব (ভালোবাসার আর্তি) কবিতায় কবি আর্তনাদ করেছেন—
 
হায় আমি! কোন পাখি
কান্না শুনি হৃদয় উৎসারিত
প্রত্যুষেও নির্বাক অউদ্বেলিত
বিনম্র, বিষণ্ণ সে পাখি।
কী সে আমি জানি না!
নির্বাক বুলবুল শব্দহীন নিষ্প্রাণ
জগৎ জোড়া সুখ্যাতি কলতান
নাকি মেঘের আড়ালে শুধুই কান্না।
কেঁদেছি কতো ঘোর অমানিশা
কবরের আলাপন, দুঃখের আর্তি
আর্তির অনুরনন শুনেছি সবই
দুঃখ কাতর আমি সর্বদা।
 
দুঃখ, কষ্ট, জ্বরা ইত্যাদিতে জাতি নিমজ্জিত। কবি জাতিকে নানাবিধ জ্বরা হতে মুক্তি দিতে উদগ্রীব। নতুন দিনের প্রতি, নতুন স্বপ্নের প্রতি কবির টান দুর্নিবার। আল-সাবাহ আল-জাদিদ (নতুন ভোর) কবিতায় নতুনের আহ্বানে কবির সুদীপ্ত আবেদন—
 
ভীরু কাপুরুষ এবার তুমি থামো
কান্নার সময় শেষ, আহাজারিরও
উদয় হয়েছে নতুন সূর্যের
দাফন করেছি কষ্টের
গেয়েছি জীবনের জয়গান
ছেড়েছি অশ্রু
জামানার অবদান।
 
এভাবেই নতুনের জয়গান গেয়েছেন কবি আশ্‌-শাব্বি এই কবিতার প্রতিটি ছত্রে। খাফিফ ছন্দ মাত্রায় রচিত এই কবিতা আধুনিক তিউনিসিয়ায় কোরাস গানের মর্যাদা পেয়েছে। উদ্দীপ্ত জনতার মুখে মুখে তার এই কবিতার কোরাস উচ্চারিত হতে শোনা যায়। কবিতার শেষে কবির আহ্বান—
 
বিদায় হে চিন্তা পর্বত
বিদায় হে কষ্ট কুহেলি
বিদায় হে হাবিয়া গিরিপথ
নৌকার বাদাম তুলেছি মহা সমুদ্রে
নতুনের বিজয় সমাসন্ন
অস্পৃশ্য হোক পুরাতন, জ্বরা, জীর্ণ।
 
দেশ ও জাতির জন্য নিবেদিত কবির কবিতাসমূহ এমন ঘন আবেগে জাতিকে আপ্লুত করে। উদ্যমী করে। তিউনিসিয়ার সবুজ প্রকৃতিকে আরো এক নতুন সবুজের আগমনের জন্য প্রস্তুত করে।
 
জীবনকে কে না ভালোবাসে। কবিও ভালোবাসতেন। তিনি জানতেন তার আর বেশি দিন বেঁচে থাকা হবে না। নিশ্চিত মৃত্যুতে জীবনের প্রতি উদগ্র ভালোবাসা কবিকে খানিকটা বিচলিত করে। জীবনের আর্তি দুমড়ে-মুচড়ে কবি কণ্ঠে বেরিয়ে আসে বিণা অবলীলায়—
 
ভালোবাসা! ভালোবাসা!
তুমিই আমার বিষণ্ণতা কিংবা বিস্ময়
বিপদ কিংবা সংশয়
তুমিই আমার সঙ্গীত মূর্চ্ছণা
কষ্ট যন্ত্রণা
তুমিই আমার আসক্তি কিংবা অশ্রু
রাগ, ক্রোধ, প্রত্যাশা, আভিজাত্য
আত্মসম্মান এমনকি আমার অস্তিত্ব
আমার সবই তোমার জন্য
হে ভালোবাসা।
 
দেশ, জাতি ও জগতের প্রশ্নে কবি অবশ্যই আশাবাদী। তবে নিজের প্রশ্নে কবি ভুগতেন হতাশায়। তার জীবনের পরতে পরতে হতাশার ছায়া প্রলম্বিত। নিজের জীবন, পরিবার, সন্তানদের ভবিষ্যৎ ইত্যাদি প্রশ্নে হতাশা কবিকে করে আরো হতাশ। অসংখ্য কবিতার নাম করা যাবে যেখানে কবির হতাশা নানা মাত্রিকতায় রূপ পেয়েছে। শিকওয়া আল-ইয়াতিম (ইয়াতিমের অভিযোগ) কবিতায় কবি নিজেকে ইয়াতিম হিসেবে উপস্থাপন করে অনুযোগ করেছেন—
 
বিলাপ করেছি অর্থহীন
মাকে ডেকেছি নিরুত্তর
কষ্টের রাজ্যে আমি একা
একাই কেঁদেছি
কান্নার গোঙানি শুনেছি
একাই থেকেছি
আর বলেছি নিজেকে
তোমার চুপ থাকাই শ্রেয়।
 
প্রকৃতির প্রতি দুর্বলতা কবি আশ্‌-শাবির আজন্মের। এমনিতেই তিউনিসিয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। বাবার চাকুরির সুবাদে বাবার সাথে তিউনিসিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। তিউনিসিয়ার নির্মল, নির্ঝর প্রকৃতির প্রতি ক্রমশ দুর্বল হতে থাকেন তিনি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের বর্ণনায় প্রবৃত্ত হয় তার অবচেতন মন। তিউনিসিয়ার নিসর্গ প্রকৃতি যেনো সুন্দরের পুজারি কবির অস্তিত্বের অংশে পরিণত হয়। প্রকৃতি বৈ কবিতার অস্তিত্বকেই চিন্তা করতে পারতেন না। প্রকৃতির বর্ণনাসমৃদ্ধ তার শতসহস্র শ্লোক রয়েছে। কবিতার দেশের নিসর্গ প্রকৃতি দেখেছেন। তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজতে চাননি তিনি। বলেছেন—
 
একা আমি সুখী নই
পাহাড় বনানী বৈ
পাইন গাছের স্পর্শ বিনে
সুখ খুঁজে পাবো কই।
 
কবি এভাবেই পাহাড়, উপত্যকা, বন-বনানীর নিঃসীম সৌন্দর্যের মাঝেই জীবনের অর্থ খুঁজে পান। কবির বাল্যবান্ধবীর মৃত্যুর কথা আমরা আগেই জেনেছি। বান্ধবীর প্রতি কবির ভালোবাসা ছিল খনি আহরিত কাঁচা সোনার মতোই খাঁটি। তাদের প্রেম ও বয়সের পরিণতির আগেই বান্ধবীর অকাল মৃত্যু কবিকে চপেটাঘাত দেয়। কবি অসংলগ্ন জীবন যাপন শুরু করেন। যদিও তার বয়স তখনও কুড়ি পেরুয়নি। সে সময়ে তার লেখা কবিতাগুলো ছিল অনেকটা কাঁচা হাতের। তবে মর্ম বেদনা ও প্রেমানুভূতির যৌথ অনুপ্রবেশে তা ছিল মধুসঞ্চারী। বান্ধবীর স্মরণে কবির অভিব্যক্তি—
 
মরে গেছে তোমার ভালোবাসা
এই তার সমাধি
কাঁদো রে মন কাঁদো
কান্নায় পাও স্বস্তি।
কিংবা
আমার নয়ন দেখেছে তোমাকে
তোমার পদ সঞ্চালনার মূর্চ্ছণা
ত্রস্ত হয়েছে বিক্ষত অন্তর
কেঁপেছে গোলাপ বৃন্ত।
সমূহ সৌন্দর্যের আকর তুমি
স্ফীত বক্ষ, হরিণীর দৃষ্টি
বসনে-ভূষণে মাদকতা
কণ্ঠে দুরাগত শিঞ্জিনি।
 
কবির বান্ধবীর সাথে অভিসারের বর্ণনায় মুগ্ধ হয় পাঠক সমাজ যখন তিনি বলেন—
 
এই বন তলে গাছের নিচে
জাইতুনের ছায়ায়
তোমাতে আমাতে হারিয়ে গেছি
দুজন দুজনায়।
ডুবে যেতাম স্বপ্ন জালে
আকাশের নিচে বন তলে
ভুলে যেতাম বাঁচা-মরা
আশা যতো ঢাকা মখমলে।
 
কবি আশ্‌-শাব্বির মাঝে পাওয়া যায় দ্বৈত স্বত্ত্বার অস্তিত্ব। দেশ, জাতি, জাতীয়তা ইত্যাদি প্রশ্নে আমরা কবির মাঝে আশাবাদী স্বত্ত্বার উপস্থিতি টের পাই। কবি দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন, দেশের উন্নয়নে স্বপ্নের জাল বুনেন। উন্নত জাতি হিসেবে তিনি তিউনিসিয়দের বিশ্বদরবারে উপস্থাপন করতে প্রয়াসী হোন। এ নিয়ে কবির স্বপ্ন অন্তহীন। আশা অফুরন্ত। কবির অসংখ্য কবিতায় এর দ্যোতনা বিদ্যমান। আবার নিজের জীবন, প্রেম, ভালোবাসা, চলৎ জীবনের আশু সমাপ্তির নিশ্চিত সম্ভাবনা, তীব্র আকাঙ্ক্ষা, অপূর্ণ বাসনা ইত্যাদি বিষয়ে তিনি চরম হতাশাবাদী একজন কবি পুরুষ। তার অনেক কবিতায় এই হতাশা ঝরে পড়েছে বারবার। হতাশা তার জীবনকে করেছে সংশয়াচ্ছন্ন। তার এই দ্বৈত সত্ত্বা আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় তিনি যতোটা ছিলেন কবি তার চেয়ে বেশি ছিলেন মানুষ। তিনি নিজেও তাই মনে করতেন। বলতেন
 
আমার নিজস্ব অভিব্যক্তিই আমার কবিতা। আর আমার কবিতাই আমার আপণ অভিব্যক্তি।
 
কবির এই দ্বৈত স্বত্ত্বার মাঝেও একটি মজার বিষয় লক্ষণীয়। তা হলোপ্রত্যেক হতাশার শেষ প্রান্তে এসে তিনি আলোকের ফুলকি দেখতে পান। সে আলোক রেখায় তিনি হোন আশান্বিত। সবাইকে জাগতে বলেন, নতুনের চাষ করতে বলেন। এখানেই কবি আশ্‌-শাব্বির স্বাতন্ত্রতা।
 
কবি আশ্‌-শাব্বির লেখার বয়স খুবিই সংক্ষিপ্ত। তবুও লিখেছেন প্রচুর। তার সমসাময়িক প্রায় সকল কবির মাঝে কবিতার মান ও সংখ্যা উভয় দিক বিচারে তার মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত। আশাবাদী বা হতাশাবাদী নয় আসলে তিনি ছিলেন জীবনবাদী কাব্যের প্রতিভূ। তিনি পাহাড়-বনানী, গাছ-পালা, তরু-লতা, পাখ-পাখালি, হেমন্ত-বসন্ত, গোধুলি-সন্ধ্যা, জীবন-মৃত্যু, প্রেম-ভালোবাসা, অভিসার-প্রণয়, দেশ-জাতি-ধর্ম, হতাশা প্রভৃতি বিষয়কে আশ্রয় করে লিখেছেন। কিন্তু সবার উপরে স্থান দিয়েছেন দেশকে। দেশের মানুষকে। দেশের জন্য তার ভালোবাসা ছিল অবারিত। তার সব কবিতাই ছিল দেশের জন্য উৎসর্গিত।