পরমা দেবী
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
গ্রামের নাম শান্তিপুর। ঝাড়গ্রাম রেলস্টেশন থেকে
পশ্চিমে দু’ক্রোশ হাঁটা পথে। গ্রামটি ৩-নং সম্বলপুর পঞ্চায়েতের অধীনে। গ্রামের উত্তর-পূর্ব কোণে পরমা
দেবীর বাড়ি। তিনি পঞ্চাশ বছরের বৃদ্ধ সুব্রত বাবুর দ্বিতীয় স্ত্রী। তারা দু’জন ছাড়া বাড়িতে থাকে পরমার মৃত
সতীনের মেয়ে সুলগ্না। পরমা দেবী ভীষণ সুন্দরী। সবেমাত্র পঁচিশে পদার্পন করেছেন। তাই নিজের থেকে
প্রায় দ্বিগুন বড় সুব্রত বাবুকে তিনি খুব একটা পছন্দ করেন না। তার কোন কথায় তিনি
আমল দেন না। নিজ ইচ্ছায় তিনি আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন। ঐ
গ্রামেরই দক্ষিন-পূর্ব কোণে বাস করেন তার বিপরীত পার্টির প্রার্থী, নাম সরলা দেবী।
গ্রামে বউদের মধ্যে তারা দু’জনেই কেবল মাধ্যমিক পাস। দু’জনই সুন্দরী। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সন্তান। বিয়েও
হয়েছে মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাই উভয়ের মধ্যে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। একে অপরকে ছোট
করে দেখবার প্রবল ইচ্ছা উভয়েরই মনে। তাই, যেকোন জঘন্য পদক্ষেপ গ্রহনে তারা কখনও
পিছ্পা হন না।
নির্বাচনের আর মাত্র দু’দিন বাকি। উভয় প্রার্থীর
নির্বাচনী প্রচার চলছে জোর কদমে। দু’জনেই বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকেদের বোঝাতে ব্যস্ত। বিভিন্ন
দৃষ্টিকোণ থেকে সমীক্ষা ও বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, দু’জনেরই জেতার সম্ভাবনা রয়েছে।
সুতরাং দু’জনেরই দৃষ্টি এখন গ্রামের পশ্চিম
কোণে, যেখানে বাস করেন গ্রামের শ্রমিক সংঘের নেতা মনোহর বাবু। তার অধীনে রয়েছে
প্রায় চল্লিশটি ভোট। তিনি যাকে সমর্থন করবেন নিঃসন্দেহে সেই জিতবে, একথা উভয়েই
ভালোভাবে বোঝে। তাই তার সমর্থন পেতে তার যেকোন প্রকারের আবদার পূরণ করতে তারা
সদাশয় প্রস্তুত।
একদিন মাত্র বাকি নির্বাচনে। রাতের অন্ধকারে
পরমা দেবী কিছু ভাড়াটে গুন্ডাদের দিয়ে পিটিয়ে দিলেন সুব্রত বাবুকে। গুরুতর আহত অবস্থায়
তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। পরদিন ভোর হতেই প্রচারে বেরিয়ে পড়লেন পরমা দেবী,
বিপরীত পার্টির লোকেরা তার স্বামীকে পিটিয়েছে এবং তাকেও প্রান নাশের হুমকি দিয়েছে।
মিথ্যা অশ্রু ঝরিয়ে আম জনতার সমর্থন অর্জনের প্রানপণ চেষ্টা করলেন। পেয়ও গেলেন
কিছু লোকের সমর্থন। এতদসত্ত্বেও জয়ের সম্ভাবনা প্রবল হলেও নিশ্চিত বলে মনে হলনা,
তাই ভাবলেন, আগামী কাল ভোট, যা করার আজকেই করতে হবে। সুতরাং শ্রমিক সংঘের নেতা
মনোহর বাবুকে লোক মারফত ডেকে পাঠালেন। সারা দিনের কাজ সেরে বিকেল বেলা বাড়ি ফিরছিলেন তিনি, পরমা দেবীর ডাক
পেয়ে তার বাড়িতে উপস্থিত হলেন। পরমা দেবী তার অপেক্ষায় ছিলেন। দরজা খুলে ভেতরে
নিয়ে গেলেন। দু’জনে দুটি চেয়ারে মুখোমুখি বসলেন। অতঃপর মনোহর বাবুকে কর জোড়ে অনুরোধ করতে
লাগলেন। এক শ্বাসে বলে ফেললেন অনেক কথা, “আপনি শ্রমিক সংঘের নেতা,আপনার অধীনে চল্লিশের
অধিক ভোট রয়েছে। তারা কখোনও আপনার কথা অমান্য করবে না। আপনি আমাকে জিতিয়ে দিন, আর
এর পরিবর্তে আপনি যা চাইবেন তা-ই পাবেন, ইত্যাদি ইত্যাদি.........”। এরই মধ্যে সুলগ্না যে কখন চা নিয়ে পৌঁছে
গেছে তারা কেউ জানতে পারেন নি। ‘মা’ ডাক শুনে তার দিকে হাত বাড়িয়ে পরমা দেবী চায়ের কাপটি
নিলেন। মাকে চা দেওয়ার পর সুলগ্না যখন টেবিলের এপাশ থেকেই মনোহর বাবুকে চা দেওয়ার
জন্য হাত বাড়ালো, স্বাভাবিক ভাবেই তার শরীরটা একটু সামনের দিকে ঝুকে পড়ল, আর সেই
ফাঁকে তার বুকের অসমতলতা ফ্রকের ওপর দিক দিয়ে এক ঝলক দেখা গেল। চতুর্দশী সুলগ্নার বুকের মৃদু অসমতলতায় আটকে গেল
মনোহর বাবুর দৃষ্টি। তিনি এমন ভাবে কল্পনাচ্ছন্ন হয়ে পড়লেন কিছুই জানতে পারলেন না,
কখন সুলগ্না সেখান থেকে প্রস্থান করেছে। পরমা দেবী কাপে এক চুমুক দিয়ে তার প্রতি
দৃষ্টিপাত করলেন। মনোহর বাবুর মনের ভাব বুঝতে তার বিলম্ব হলনা। তাই, রাজনৈতিক
তুনের শেষ তীরটিও নিক্ষেপ করতে তিনি উদ্যত হলেন। তার হাতে টোকা মেরে বললেন, “আমার শুধু জয় চাই। আপনার কাজ
আপনি করুন, আমার কাজ আমি করছি”। পরম দেবীর এমন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গে মনোহর
বাবু ক্ষিপ্র গতিতে সুলগ্নার ঘরে প্রবেশ করলেন। চল্লিশ বছরের সেই দৈত্যাকার দেহটি
মুহুর্তের মধ্যে আচ্ছন্ন করে ফেলল চোদ্দ বছরের একটি কোমল-কচি-দূর্বল একটি শরীরকে।
আত্মরক্ষার শত চেষ্টা ও চিৎকার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল। শুকিয়ে গেল সেই যৌবন মুখী কচি
শরীরের সমস্ত জীবন-রস। সূর্য্য তখনও পুরোপুরি অস্ত যায়নি। সেই আলো আধাঁরীর মধ্যে
অস্তমিত হল এক চতুর্দশীর কুমারীত্ব। পড়ে রইল শুধু ক্ষত বিক্ষত অজ্ঞান দেহটি। মনোহর
বাবুর চলে যাওয়ার পর পরমা দেবী বাইরে থেকে শিকল তুলে তালা ঝুলিয়ে দিলেন।
নির্বিঘ্নে রাত অতিবাহিত হল। পরদিন সকালে সূর্যদয়ের এক দন্ড অতিক্রম না হতেই বুথ
কেন্দ্রে ভোটারদের তুমুল সমাগম দেখা গেল। দুপুর বারোটা নাগাদ ভোট প্রদান শেষ হল।
মধ্যাহ্ন ভোজন ও অল্প বিশ্রামের পর অধিকর্তা গননা শুরু করলেন। বিকেল বেলা গননা শেষ হল।
নির্বাচনী অধিকর্তা ঘোষনা করলেন, পরমা দেবী পয়তাল্লিশ ভোটে জয়ী হয়েছেন। বিদ্যুতের
ন্যায় খবর ছড়িয়ে পড়ল সারা পাড়ায়। শুরু হয়ে গেল বিজয়োৎসবের আয়োজন। অলি-গলি ভরে গেল
সমর্থকদের করতালি ও জয় ধ্বনিতে। অন্যদিকে দুপুর বেলায় সূর্য যখন রৌদ্রের সমস্ত প্রখরতা
নিয়ে জ্বলে উঠল ঠিক তখনই সুব্রত বাবুর জীবন প্রদীপ নিভে গেল। বিকেলের দিকে নির্বাচনী ফল
প্রকাশের পূর্ব মূহুর্তে সুলগ্না মায়ের সুলগ্নের সূচনা করতে বৈদ্যুতিক পাখার
সাহায্যে ওড়নার ফাঁসে আত্ম্বত্যাগ করল।
সন্ধার সময় দুটি লাশই
নিয়ে যাওয়া হল গ্রামের শ্বসান ঘাটে। মহান পরমা দেবী নিজেই স্বামী ও মেয়ের
অন্ত্যষ্টি ক্রিয়া সম্পন্ন করলেন। কিন্তু, তখন তার আর কান্না পেলনা। শত চেষ্টা
করেও চোখ দিয়ে একফোঁটা অশ্রু ঝরাতে ব্যর্থ হলেন। শ্মসান থেকে ফিরে কিছুক্ষণ
সমর্থকদের নিয়ে নিরবতা পালন করলেন। তার পরেই শুরু হল বিজয় উৎসবের ধূম্। ক্রমশ
পার্টি আরও জমে উঠল। মধ্যরাতে আরম্ভ হল ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। চিতার আগুন নিভে গেলেও,
কাঠে তখনও আগুন ছিল। বৃষ্টির জলে তা ধীরে ধীরে ঠান্ডা হতে লাগল। হালকা বৃষ্টি জয়ের
উন্মাদনাকে আরও উদগ্রীব করে তুলল। পরমা দেবী মনোহর বাবুর প্রশ্বস্থ বাহুদ্বয়ে নিজের সুঠাম দেহটিকে
অর্পণ করে দিলেন। জয়ের আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে শ্রমিক নেতা ও বিজয়ী নেত্রী ঠোটে ঠোট
রেখে পরস্পরকে আস্বাদন করতে লাগলেন। শরীর দুটি ক্রমশ নিকটবর্তী হতে লাগল। সেই
মিলিত দেহ দুটির মধ্য দিয়ে আর চুল অতিক্রম করার অবকাশও রইল না। আস্তে আস্তে
ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোঁটায় সুলগ্নার ক্ষত ও সুব্রত বাবুর আঘাত ধুয়ে গেল। বৃষ্টি
ফোঁটাগুলি নিজ ভাষায় বলতে থাকল। “অভিনন্দন তোমাকে, পরমা দেবী, বিজয়ী নেত্রী! পরম অভিনন্দন!!”
(প্যানজিয়া, মার্চ ২০১৩)