এক অন্য বাঁধন
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
— শোনো সাল্মা, তুমি মন খারাপ করো না। ধৈর্য ধরো। কপালের লিখন তো আর খণ্ডানো যায় না...
এই ক’টা কথাই ছিল শেষ কথা। এর বেশি আর কিছুই বলতে পারল না সালাম।
সাল্মার সাথে ওর প্রথম আলাপ হয়েছিল কোলকাতা ইউনিভার্সিটিতে এম এ-তে ভর্তি হতে গিয়ে। তারপর সেকেন্ড ইয়ারে উভয়ের গার্জিয়ান মিলে আক্দ সম্পন্ন করেছিল। তারও আট মাস পর, সালাম যখন একটা বেসরকারি স্কুলে জয়েন করল, কিছু দিনের মধ্যেই উভয়ের গার্জিয়ান অত্যন্ত অনাড়ম্বর ভাবে তাদের বিয়েটা দিয়ে দিল। বিয়ের এক বছরের মাথায় একদিন হঠাৎ করে সালাম অসুস্থ হয়ে পড়ল এবং এক মাসের মধ্যেই তার মৃত্যু হল।
ইদ্দতের চার মাস দশ দিন সাল্মা বাপের বাড়িতেই অতিক্রান্ত করল। তবে এর মাঝে বেশ ক’বার তাকে সেখানে দেখতে গেছিল তার শ্বশুর বাড়ির লোকেরা। তার বাবা ও তার শ্বশুর উভয়ে তার সাথে বেশ ক’বার দফায় দফায় আলোচনাতেও বসেছে। প্রথমত সে কোনো উত্তর করেনি। পরে অবশ্য তাদের কথা মেনে নিয়েছে। আর তাই ইদ্দত পূর্ণ হওয়ার ক’দিন পরেই সাল্মার আব্বাকে ডেকে পাঠালেন তার শ্বশুর। সাল্মা’র ব্যাপারে আরও কিছু আলাপআলোচনা করবেন ভেবে।
নির্ধারিত দিনে সকাল বেলা সাল্মা, তার বাবা ও ছোট ভাই গাড়ি করে পৌঁছে গেল। সাল্মার শ্বশুর ও দেওর বাপ-বেটা মিলে গতকালই টুকিটাকি বাজারঘাট করে নিয়েছে। আজ যাতে আর বেরোতে না হয়। সকালের নাস্তার পর দোতলার বড় ঘরটায় সবাই মিলে আলোচনায় বসেছে। গ্রামের ইমাম-মেম্বার সহ আরও কিছু গুণীজন হাজির হয়েছেন। সবাই যে যার মতো করে দু’চার কথা বলল। সাল্মার বাবা চুপচাপ শুনছিলেন। তিনি ইমাম সাহেবের কথার খেই ধরে বললেন— ইমাম সাহেব যথার্থই বলেছেন। শরিয়তের নির্দেশ মতো সাল্মার বিয়ের ব্যবস্থা করা উচিৎ। এ বিষয়ে আমি সাল্মার সাথেও কথা বলেছি। আপাতত আমি ওকে বি এডে ভর্তি করে দেবো এবং মনে মনে পাত্রের খোঁজ করতে থাকবো। তারপর সময় সুযোগ বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
সাল্মার শ্বশুরও চুপচাপ সবার কথা শুনছিলেন। তিনি সাল্মার বাবাকে ডেকে বললেন— “তোমাদের মাঝে স্বামী নেই এমন মেয়েদের তোমরা বিয়ের ব্যবস্থা করো।” [সূরা আন্-নূর ৩২] আল্লাহ্র এই আদেশ অমান্য করবো অমন অবাধ্য আমি নই। তাই সাল্মা যখন বিয়ের জন্য প্রস্তুত হবে। আমি তার সিদ্ধান্তকে অবশ্যই মেনে নেবো। তবে আমার একটা শর্ত আছে। আমার তো দুই ছেলে ছিল। বড় ছেলে তো এখন আর নেই। তাই আমি সাল্মাকে মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করতে চাই...
— ঠিক বুঝলাম না, একটু খোলাসা করে বলুন। সাল্মার বাবা প্রশ্ন করলেন।
— আমার বড় ছেলে তো আর নেই। আর কোনোদিন ফিরেও আসবে না। ওর জায়গাটা আমি সাল্মাকে দিতে চাই। তাই ওর বিয়ের যাবতীয় খরচ আমিই বহন করবো। এবং বিয়ের পর, যেখানেই ওর বিয়ে হোক, ও যেমন আপনার কাছে যাবে, ঠিক তেমনই আমার বাড়িতেও আসবে। আজ থেকে আমার এক ছেলে এবং এক মেয়ে। এবং আমি আমার যৎসামান্য সম্পত্তির অল্পকিছু তাকে হেবা করতে চাই।
শ্বশুর মশাইর এসব কথা সাল্মাও দরজার ও পাশ থেকে শুনছিল। নিজের কান্নাকে আর সংবরণ করতে পারল না সে।
২৯ জুলাই ২০২০
বাঁশকুড়ি, দঃ দিনাজপুর
No comments:
Post a Comment