Thursday 9 September 2021

হাসসান বিন সাবিত রাঃ রাত কাটে নির্ঘুম, আমি নিঃস্ব ও নিশ্চুপ!



রাত কাটে নির্ঘুম, আমি নিঃস্ব ও নিশ্চুপ!
হ়াস্‌সান বিন সাবিত (রাঃ)
  
আমার চোখের এ কী অবস্থা?! এক ফোটা ঘুম নেই দু’ চোখে, যেন চোখের কোনে অক্ষিপ্রদাহের সুরমা লাগানো হয়েছে।
 
কারণ, আমি অস্থির হয়ে পড়েছি সে সুপথপ্রাপ্ত ব্যক্তির কথা ভেবে, যিনি মৃত্যু বরণ করেছেন। প্রস্তরময় ভূখণ্ডে পদচারীদের মাঝে (অর্থাৎ মদীনাবাসীদের মাঝে) হে শ্রেষ্ঠ মানব, তুমি (আমাদের ছেড়ে) দূরে চলে যেও না।
 
হায়, আমার পোড়া কোপাল! যদি আমি তোমার পূর্বে বাক়িউল্‌ গ়ার্‌ক়াদ কবরস্থানে সমাধিস্থ হতাম, তাহলে আমার পার্শ্বদেশ তোমাকে মাটি স্পর্শ হতে রক্ষা করত!
 
তোমার (তিরোধানের) পর আমি কি মদীনাবাসীদের মধ্যে আর থাকতে পারব? হায়, যদি আমাকে কৃষ্ণকায় সাপের বিষ পান করানো হতো (এবং তাতে আমার মৃত্যু হতো, তাহলেই ভালো হতো)!
 
সোমবারের দিন যার মৃত্যুকে আমি প্রত্যক্ষ করেছি, তিনি হলেন সুপথ প্রাপ্ত নবী (মুহ়াম্মদ সাঃ); তাঁর প্রতি আমার পিতামাতা উৎসর্গীত হোক!
 
তাঁর প্রয়াণের পর আমি ব্যাকুল ও দিশেহারা হয়ে পড়েছি; হায় আমার পরিতাপ, যদি আমার জন্মই না হতো (তাহলে কতই না ভালো হতো)!
 
অথবা, যদি আমাদের ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ (অর্থাৎ মৃত্যুর পরোয়ানা) অগ্রিম অবতীর্ণ হতো, আজ সন্ধ্যায় অথবা আগামী কাল সকালে (তাহলে কতই না ভালো হতো)!
 
কেননা, তারপর কেয়ামত ও প্রলয় সংঘটিত হবে আর (তখন) আমরা (আবার) সাক্ষাৎ করবো তাঁর সাথে; তিনি উত্তম, নিষ্কলুষ চরিত্রবান ও উচ্চবংশীয়।
 
হে আমিনার প্রথম সন্তান, তোমার স্মৃতি তত কল্যাণময়, তোমাকে জন্ম দিয়েছেন সৌভাগ্যশালীনীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতমা ও পুণ্যময়ী এক নারী।
 
(তিনি তোমাকে জন্ম দিয়েছেন) এক আলোকবর্তিকা স্বরূপ, যে আলোকবর্তিকা সমস্ত সৃষ্টিকুলকে আলোকিত করে তুলেছে; অতএব যে ব্যক্তিকে ই মঙ্গলময় জ্যোতির দিকে পথ প্রদর্শিত করা হয়, সে-ই প্রকৃত সুপথপ্রাপ্ত।
 
প্রভু, তুমি আমাদেরকে ও আমাদের নবীকে এমন এক স্বর্গে একত্রিত ও সম্মিলিত করো, যার আড়ম্বর ও জাঁকজমক দেখে হিংসুকদের চোখ ধাধিয়ে যাবে।
 
(তুমি আমাদেরকে একত্রিত করো), আল্‌-ফ়ির্‌দাউস স্বর্গে, আর আমাদের জন্য ওই স্বর্গকে নির্ধারিত করে দাও হে মহিমান্বিত সত্ত্বা, সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী ও মহা পরিচালক!
 
আল্লাহর শপথ, আমি যতদিন জীবিত থাকবো যখন কারও মৃত্যুর খবর শুনবো, নবী মুহ়াম্মদ (সাঃ)-এর মৃত্যুর কথা স্মরণ করে কেঁদে ফেলবো।
 
(নবীজির মৃত্যুর পর) মদিনার আন্‌সারদের জন্য তাদের ভূখণ্ড যেন সংকীর্ণ হয়ে গেছে, তারা (তাঁর মৃত্যুশোকে) বিহ্বল ও কৃষ্ণকায় হয়ে গেছে আর তাদের চেহারা সুরমা তরীর ইস্‌মিদ পাথরের মতো (কালো) হয়ে গেছে।  
 
আমরাই তো তাঁকে জন্ম দিয়েছি (কারণ তাঁর মা আমিনা ছিলেন মদীনার মেয়ে), আর তাঁর সমাধিও রয়েছে আমাদের মাঝে, এমনকি তাঁর বহু অনুগ্রহ ও আশীর্বাদ রয়েছে আমাদের উপর, আর আমরা তা (কখনও) অস্বীকার করিনি।  
 
সেই কল্যাণময় সত্ত্বা আহ়্মাদ (সাঃ)-এর উপর আল্লাহ্‌ রহমত ও করুণা বর্ষিত হোক! আর যে ফেরেশতারা আল্লাহ্‌র আরশ বেষ্টন করে আছে তারা এবং সৎ লোকেরা (সর্বদা) তাঁর জন্য রহমত ও অনুগ্রহ কামনা করে।  
 
(মৃত্যুর পর) যখন তিনি বগলী কবরে সমাহিত হয়েছিলেন, তা দেখে মদিনার ইহুদিখ্রিস্টানেরা আনন্দিত ও উল্লসিত হয়েছিল।


মূল কবিতা—  

ما بال عيني لا تنام

حسان بن ثابث

قال يرثي النبي صلى الله عليه وسلم:  

ما بالُ عَيني لا تَنامُ كَأَنَّما                   كُحِلَت مَآقيها بِكُحلِ الأَرمَدِ

جَزَعاً عَلى المَهدِيِّ أَصبَحَ ثاوِياً      يا خَيرَ مَن وَطِئَ الحَصى لا تَبعُدِ

جَنبي يَقيكَ التُربَ لَهفي لَيتَني               غُيِّبتُ قَبلَكَ في بَقيعِ الغَرقَدِ

أَأُقيمُ بَعدَكَ بِالمَدينَةِ بَينَهُم                   يا لَهفَ نَفسي لَيتَني لَم أولَدِ

بِأَبي وَأُمّي مَن شَهِدتُ وَفاتَهُ             في يَومِ الاِثنَينِ النَبِيُّ المُهتَدي

فَظَلِلتُ بَعدَ وَفاتِهِ مُتَلَدِّداً                    يا لَيتَني أُسقيتُ سَمَّ الأَسوَدِ

أَو حَلَّ أَمرُ اللَهِ فينا عاجِلاً             مِن يَومِنا في رَوحَةٍ أَو في غَدِ

فَتَقومُ ساعَتُنا فَنَلقى طَيِّباً                  مَخصاً ضَرائِبُهُ كَريمَ المَحتِدِ

يا بِكرَ آمِنَةَ المُبارَكَ ذِكرُهُ                وَلَدَتكَ مُحصَنَةٌ بِسَعدِ الأَسعَدِ

نوراً أَضاءَ عَلى البَرِيَّةِ كُلِّها              مَن يُهدَ لِلنورِ المُبارَكِ يَهتَدِ

يا رَبِّ فَاِجمَعنا مَعاً وَنَبِيَّنا               في جَنَّةٍ تُنبي عُيونَ الحُسَّدِ

في جَنَّةِ الفِردَوسِ وَاِكتُبها لَنا         يا ذا الجَلالِ وَذا العُلا وَالسُؤدُدِ

وَاللَهِ أَسمَعُ ما حَيِيتُ بِهالِكٍ              إِلّا بَكَيتُ عَلى النَبِيِّ مُحَمَّدِ

يا وَيحَ أَنصارِ النَبِيِّ وَرَهطِهِ           بَعدَ المُغَيَّبِ في سَواءِ المُلحَدِ

ضاقَت بِالاَنصارِ البِلادُ فَأَصبَحوا        سوداً وُجوهُهُمُ كَلَونِ الإِثمِدِ

وَلَقَد وَلَدناهُ وَفينا قَبرُهُ                    وَفُضولَ نِعمَتِهِ بِنا لَم نَجحَدِ

وَاللَهُ أَكرَمَنا بِهِ وَهَدى بِهِ                أَنصارَهُ في كُلِّ ساعَةِ مَشهَدِ

صَلّى الإِلَهُ وَمَن يَحُفُّ بِعَرشِهِ           وَالطَيِّبونَ عَلى المُبارَكِ أَحمَدِ

فَرِحَت نَصارى يَثرِبٍ وَيَهودُها            لَمّا تَوارى في الضَريحِ المُلحَدِ 


কবিতার সারসংক্ষেপ—
কবি হ়াস্‌সান বিন সাবিত (রাঃ) একজন মহৎ সাহাবী ও বিখ্যাত কবি। তিনি শায়েরুর্‌ রাসূল (বা রাসুলের কবি) নামে বিখ্যাত। ইসলাম গ্রহণের পর রাসুলের সাহচর্য ও সঙ্গকে নিজের জন্য আবশ্যক করে নিয়েছিলেন। তিনি রাসুলকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তাই তাঁর মৃত্যুতে কবি প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিলেন আর সেই মানসিক যন্ত্রণাকে এই শোকগাথায় সার্থক ভাবে প্রকাশ করেছেন।

কবিতার সূচনালগ্নে কবি রাসুল (সাঃ)-এর মৃত্যুতে যে দুঃখকষ্ট পেয়েছিলেন তারই বিবরণ করেছেন যে, রাসুল (সাঃ)-এর পরলোকগমনের সংবাদ শোনার পর তাঁর দু’চোখে ঘুম নেই; যেন তাতে অক্ষিপ্রদাহের সুরমা রঞ্জিত হয়েছে। কারণ রাসুল (সাঃ) তাঁর নিকট সকল মদীনাবাসীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, তাঁর মৃত্যুতে কবি অস্থির। অতঃপর কবি নিজ আকাঙ্খা প্রকাশ করে বলেছেন যে, কবি যদি রাসুলের পূর্বেই মৃত্যু বরণ করে বাক়িউল্‌ গ়ার্‌ক়াদ নামক মদিনার সমাধিক্ষেত্রে সমাধিস্ত হতেন এবং নিজ পার্শ্বদেশ দিয়ে রাসুলকে মৃত্তিকার স্পর্শ হতে রক্ষা করতে পারতেন, তাহলে তা তাঁর পক্ষে মঙ্গলময় হত।

অতঃপর কবি উল্লেখ করেছেন যে, তিনি (সাঃ) সোমবার মৃত্যু বরণ করেন। আর তার পর মদিনায় জীবন যাপন করা কবির পক্ষে অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক। মনে কোনও আনন্দ নেই। তাই মনের অব্যক্ত বাসনা, যদি কালো বিষাক্ত শাপের ছোবলে তাঁর মৃত্যু হতো অথবা তাঁর জন্ম না হতো তাহলে খুব ভালো হতো। আর যদি সময়ের পূর্বেই তাঁর মৃত্যু হতো তাহলে রাসুলের সাক্ষাৎ তিনি সহজেই পেয়ে যেতেন।

তারপর নবীজির প্রশংসা করে বলেছেন, নবী-জননী আমেনা এক সতী নারী ছিলেন। তিনি এক জ্যোতির্ময় ব্যক্তিকে জন্ম দিয়েছেন যে জগত হতে অন্ধকারকে দূরীভূত করে সৃষ্টিকূলকে আলোর সন্ধান দেবে। আর কবি প্রার্থনা করেছেন, পরম করুণাময় যেন জান্নাতে তাঁকে নবীর সান্নিধ্য প্রদান করেন, তাতে হিংসুকরা সদুত্তর পাবে।

কবিতার শেষে তিনি ক্রন্দনের সুরে বলেছেন যে, যখনই তিনি কোনও মৃতের কথা শুনবেন তখনই তাঁর নবীর স্মরণে কান্না পাবে। আর নবীর শোকে আনসারদের চেহারা ইস্‌মিদ পাথরের ন্যায় কালো হয়ে গেছে। সেই সঙ্গে তিনি নবীর প্রতি করুণা ও শান্তি বর্ষণের প্রার্থনাও করেছেন। কবিতার অন্তিম চরণে নবীর মৃত্যুতে ইসলামের শত্রু ইহুদী-খ্রিষ্টানদের উল্লাসের কথাও আলোচনা করেছেন।

অনুবাদ ও সারসংক্ষেপ- আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

6 comments: