Thursday 7 September 2017

বাশ্‌শার বিন বুর্‌দ

বাশ্‌শার বিন বুর্‌দ  

(৭১৪ ৭৮৪ খ্রী)

আব্দুল মাতিন ওয়াসিম 

বংশ-পরিচয়জন্মঃ 

তিনি আব্বাসী যুগের এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন। তাঁর কবিতার ভাষা ছিল খুবই প্রাঞ্জল ও হৃদয়গ্রাহী। প্রশংসামূলক কবিতা রচনায় তিনি খুবই দক্ষ ছিলেন। এছাড়া প্রেমের কবিতা ব্যঙ্গ কবিতা, গৌরব গাঁথা  ও শোক গাঁথা ইত্যাদিতেও তিনি পারদর্শী ছিলেন। নাম বাশশার। উপনাম আবু মুয়ায, উপাধি মুরাআস। পিতার নাম বুরদ, দাদার নাম ইয়ারজুখ। পিতার দিক থেকে তিনি পরসিক বংশোদ্ভূত এবং মাতার দিক থেকে হাবশীয় ছিলেনকবির পিতৃপুরুষের আদি বাসস্থান ছিল পূর্ব ইরানের তুখারিস্তান। তিনি ৯৬ হিজরি মোতাবেক ৭১৪ খ্রিস্টাব্দে বসরায় জন্ম গ্রহণ করেন।


বাল্যকাল ও শিক্ষা জীবনঃ 

শিশু অবস্থায় দাসত্ব শৃঙ্খল হতে মুক্তি লাভের পর কবি তাঁর পিতা ও মাতার তত্ত্বাবধানে বসরা নগরীতে তাঁর শৈশবকাল অতিবাহিত করেন। এখানে তিনি তাঁর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। উল্লেখ্য বাশ্‌শার বিন বুরদ ছিলেন জন্মন্ধ। তাই বই পুস্তক স্বচক্ষে অধ্যয়ন করার সুযোগ তাঁর হয়নি। তবে তাঁর স্মৃতি শক্তি ছিল প্রখর। একারণে তিনি শিক্ষক ও পন্ডিতদের বক্তব্য শুনেই জ্ঞানার্জন করতেন। বসরা ছিল সে যুগের জ্ঞান চর্চার একটি শ্রেষ্ঠ কেন্দ্র। সেখানে আরবী ভাষা ও সাহিত্যের পন্ডিতদের সহচর্যে এসে আরবী ভাষা ও সাহিত্যে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন। ছাড়া শহরতলীর আরব বেদুঈনদের সাথে তিনি এ সময় মেলামেশা করতেন। ফলে তিনি শুদ্ধ আরবী ভাষা অতি সহজে আয়ত্ব করতে সক্ষম হন। তাই তার কবিতায় হৃদয়গ্রাহী শব্দের সমাহার লক্ষ্য করা যায় বানু উকাইল ও কাইস ইবনু আইলা এ দু গোত্রের সান্নিধ্য লাভের সুবাদে কবির ভাষা হয়ে উঠেছিল বিশুদ্ধ ও ত্রুটিমুক্ত। এ ব্যাপারে আবুল ফারাজ ইস্পাহানীর বক্তব্য— “একদা কবি বাশ্‌শার বিন বুরদকে জিজ্ঞাসা করা হলে কিছু না কিছু শব্দ বিচ্যুতি সব কবিরই থাকে। আপনি শুধু ব্যতিক্রম। এটা কিভাবে সম্ভব হলোতিনি উত্তরে বলেন বেদুঈন পরিবার আমার জন্ম এবং বনু উকাইল গোত্রের ৮০ জন সাহিত্যিক পন্ডিতদের মাঝে আমার প্রতিপালন যাদের কেহ একটি শব্দ ভূল করে না। তাছাড়া তাদের মহিলারা তাদের থেকেও শুদ্ধভাষী তাহলে তোমরা বল; ভুল শব্দ কীভাবে আমার নাগাল পাবে।”


কর্মজীবনঃ 

তাঁর কর্মজীবন বৈচিত্রময়। দাসত্বের শৃংখল থেকে মুক্ত হয়ে তৎকালিন সমাজের নেতৃত্বস্থানী ব্যক্তিদের প্রশংসা করে জীবন যাপন করেন। তিনি একাধারে মারওয়ান ইবনু মুহাম্মাদ। কাইয়ুম ইবনে পায়লান, আব্দুল্লাহ্‌ ইবনু উমর, সোলাইমান ইবনে হিশাম এবং ইয়াজিদ ইবনু কুতায়রা প্রমুখ খলিফা ও গভর্ণরদের প্রশংসা করে কাব্য সাধনা করছেন। উমাইয় খিলাফতের পতনের পর আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে তার স্বভাবজাত প্রতিভা বলে নতুন শাসকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। তিনি খলিফা মানসূর, আল মাহদী, ওজীর  খালিদ িন বারমাক, ইয়াকুব ইবনু দাউদ, ওকবা বিন সালাম এবং ওমর ইবনুল আলার প্রশংসা করে কবিতা রচনা করেন।


বৈবাহিক জীবন ও ধর্মমতঃ 

তাঁর পারিবারিক অবস্থা সম্পর্কে তেমন তথ্য পাওয়া  যায়না। তবে হাম্মাদ আজরাদ এর কুৎসামূলক কবিতা হতে তার ইমামা নামক একজন স্ত্রীর কথা জানা যায়। এছাড়া তার কবিতায় কয়েকজন ছোট ছোট ছেলের সন্ধান পাওয়া যায়। যাদের মাধ্যমে প্রশংসিত ব্যক্তির নিকট অনুগ্রহ কামনা করতেন।

তিনি ধর্মের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন। পারসিক বংশোদ্ভত হওয়ার কারনে অগ্নি পূজার দিকে তাঁর ঝোঁক থাকলেও প্রকৃত পক্ষে তিনি ছিলেন (যিন্দিক) নাস্তিক। তিনি তার ধর্ম বিশ্বাস কে কবিতার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলেন। তিনি আদম (আঃ)-এর প্রতি ইবলিসের সিজদা করতে অস্বীকা করাকে সমর্থন করে ছিলেন।


মৃত্যুঃ

আরবী সাহিত্যের এই মহান পণ্ডিত ৭০ বছর বয়সে ১৬৮ হিজরি মোতাবেক ৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে বসরার বাতিহা নাম স্থানে ইন্তেকাল করেন।


আরবী কাব্যকবিতায় তাঁর অবদানঃ 

আরবী সাহিত্যকে সমৃদ্ধশালী করার নিমিত্তে বাশ্‌শার অনেক কবিতা রচনা করেছেন। নিজেই দাবী করেছেন যে, তিনি ১২০০ পক্তি রচনা কছেন। তবে তাঁরসামান্য কবিতাংশ আমাদের নিকট পৌঁছেছে। যে সকল কবি সাহিত্যিক আরবী কাব্যসাহিত্যকে প্রাচীনত্বের গন্ডী থেকে বের করে আনতে সচেষ্ট হয়েছিলেন বাশ্‌শার তাদের মধ্যে অগ্রগন্য। তিনি উমাইয়া ও আব্বাসী উভয়ই যুগের সেতুবন্ধন রচনাকারী। তিনি প্রাচীন আরবী ভাষা ও সাহিত্য, ইসলামের ইতিহাস প্রচীন জ্ঞান বিজ্ঞানের সাথে আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের যোগসুত্র স্থাপন করেন। তিনি আরবী সাহিত্যের সকল শাখায় কাব্য চর্চা করেছেন। স্তুতিগাঁথা রচনায় কবি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। নিজের জীবিকা নির্বাহ ও খ্যাতির জন্য তিনি খলিফা, গভর্ণর মন্ত্রী ও নেতৃস্থানীয়দের স্তুতিগাঁথা রচনা করেছেন।


প্রেমমূলক কবিতাঃ  

প্রেম কবিতা রচনায় বাশ্‌শার অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। বাশ্‌শারের প্রেম কবিতা নারী-পুরুষ পরস্পরকে দ্রুত কাছে টেনে নিয়ে আসতে সক্ষম ছিল। তিনি ছিলেন তরুন-তরুনীদের পূজনীয় কবি। কেননা তাদের সামনে তিনি মেলে ধরে ছিলেন উপভোগের ময়ূর পেখম। গোটা ইরাক যেন দোল খাচ্ছিল তার কবিতার ছন্দে, কবি বলেন

لم يطل ليلي ولكن لم أنم    ونفى عني الكرى طيف ألم

نفّسي يا عبد عني واعلمي     أنني يا عبد من لحم ودم

(রাত্রি আমার দীর্ঘ হয় না, কেননা আমি ঘুমুতে পারি না বিরহের জ্বালা আমার দু চোখের ঘুম কেড়ে নিয়ে যায়। হে আব্দা আমার প্রতি দয়া করো আর একথা জেনে রাখো আমার শরীর রক্তমাংসেই গঠিত।)


ব্যঙ্গঁ কবিতাঃ   

স্তুতি কাব্যের ন্যায় হিজা রচনায়ও তিনি ছিলেন সিদ্ধ হস্ত। কবিতায় এ শাখার প্রতি তার ছিল দারুন উৎসাহব্যক্তিগত ভাবে তিনি অকেটা দুমুর্খ স্বাভাবের ছিলেন, কারনে অকারনে অনেকের সম্পর্কে বিদ্রুপত্মিক কবিতা রচনা করেছেন। মুতাজেলী ইমাম ওয়াসিল বিন আতীব ভক্ত থাকা সত্ত্বেও তাকে ব্যঙ্গঁ করতে তিনি কুন্ঠিত হন নি। খলিফা মাহদীর কুৎসায় কবি বলেন

হে বনী উমাইয়া সম্প্রদায় তোমাদের ঘুম দীর্ঘ হয়েছে জাগ্রত হও কারণ এখন তোমাদের খলিফা ইয়াকুর বিন দাউদ। হে লোকসকল তোমাদের খিলাফত চলে গেছে। তোমরা খিলাফত হারিয়েছো। তাই তোমাদের (যুক ও উদ) এর মধ্যে আল্লাহ্‌র খিলাফত অন্বেষন কর।


শোকগাঁথাঃ 

শোক গাঁথায় বাশ্‌শার বিন বুরদের কবিতা একেবারে নগণ্য। কারণ তিনি পার্থিব জীবনকেই একমাত্র ভোগ বিলাসের স্থান বলে গণ্য করতেন। তাই যখন তার খেলতামাসার সাথীরা মারা যান তখন তাদের শোক গাঁথা বলেনকীভাবে আমার সুখ এককভাবে আনন্দ দিতে পারে। অথচ আমার বন্ধুরা সবাই কবরে


গৌরব গাঁথাঃ 

বাশ্‌শার বিন বুরদ ছিলেন বনু উকাইল গোত্রের মাওলা। তাই তিনি উকাইল গোত্রের পিতৃ পুরুষদের নিয়ে গৌরব করতেন। তার গৌরব গাঁথা থেকে দুটি চরণ

إذا الملك الجبار صعّر خده    مشينا إليه بالسيوف نعاتبه


সমসাময়িক কবিদের মধ্যে তাঁর স্থানঃ 

আরবী সাহিত্যের সমালোচকবৃন্দ এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, বাশ্‌শার বিন বুরদ আধুনিক কবিদের অগ্রনায়ক ছিলেন। আল-আসমায়ী বলে বাশ্‌শার সর্বশেষ কবি ছিলেন। আর যদি তার যুগ দেরী না হত তবে তাকে অনেক কবির উপর প্রাধান্য দিতাম।

No comments:

Post a Comment