তারাফা বিন আল্-‘আব্দ
(৫৪৩ – ৫৬৯ খ্রিঃ)
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
পরিচিতি ও জন্মঃ
প্রাক-ইসলামী যুগে আরবী কাব্যসাহিত্য চরম
উৎকর্ষ লাভ করেছিল। সে যুগে রচিত কাব্যকবিতাগুলো আজও
বিশ্বসাহিত্যের দরবারে বিপুলভাবে
সমাদৃত। আরবী সাহিত্য ও কাব্যাকাশের উজ্জল নক্ষত্রগুলির মধ্যে কবি তারাফা বিন্ আল্-আ’ব্দ উল্লেখযোগ্য ও অন্যতম। তাঁর প্রকৃত নাম ‘আম্র, পিতার নাম আল্-‘আব্দ, পিতামহের নাম সুফ্ইয়ান।
উপাধি তারাফা। তিনি এই উপাধিতেই অধিক পরিচিত। তাঁর মায়ের নাম ওয়ার্দাহ্। কায়েস গোত্রে ৫৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাহ্রাইনের আল্-মালেকিয়্যাহ্ গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা, পিতামহ, দুই পিতৃব্য ও মামা
মুতালাম্মিস সকলেই কবি ছিলেন।
বাল্যজীবনঃ
বাল্যকালে তিনি পিতাকে হারান। চাচারা যত্ন সহকারে তাঁর লালনপালন
ও তত্ত্বাবধায়ন না করায় তিনি উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়েন। ইন্দ্রিয়পরায়নতায় লিপ্ত হয়ে অল্প
দিনের মধ্যে প্রাপ্ত পৈত্রিক সম্পদ ব্যয় করে একেবারে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। ফলে পরিবারের
লোকজন তাকে ব্যধিগ্রস্ত উটের ন্যায় তাড়িয়ে দেয়। পরে অবশ্য অনুতপ্ত হয়ে পুনরায় পরিবারে শামিল হন।
কর্মজীবন ও বাসূস যুদ্ধে অংশ গ্রহণঃ
দুর্ভাগ্যের বিষয় অল্প দিনের মধ্যে কবির চরিত্রে আবার
উচ্ছৃঙ্খলতা ও ইন্দ্রিয়পরায়নতা দেখা দেয়। আবার নিঃস্ব হয়ে পড়েন। জীবন রক্ষার্থে
বাধ্য হয়ে ভাইয়ের পশুচারণের ভার গ্রহণ করেন। সে সময় বাহরাইনের বাক্র ও তাগ্লাব দুই
গোত্রের মধ্যে দীর্ঘ দিন ধরে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলছিল। ইতিহাসে যেটি ‘হার্বু বাসূস’ (বাসূস যুদ্ধ) নামে পরিচিত। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে এই
যুদ্ধ চলেছিল। কবি
এই যুদ্ধে যোগ দিয়ে তাগ্লাব গোত্রের বিরুদ্ধে অসিম সাহসিকতার
পরিচয় দিয়েছিলেন।
পরলোকগমনঃ
বাসূস যুদ্ধ চরম ভয়াবহ আকার
ধারণ করলে, সে সময় হীরার রাজা তৃতীয়
মুনযির নিজ প্রচেষ্টায় তার অবসান ঘটান। তা দেখে কবি হীরায় গিয়ে উপস্থিত হন। তখন
সেখানকার অধিপতি হয়েছিলেন তার ছেলে ‘আমর বিন হিন্দ। তিনি কবিকে সমাদরে গ্রহন করে তাঁকে ও
তাঁর মামা মুতালাম্মিসকে যুবরাজের শিক্ষকরূপে নিযুক্ত করেন।
কিন্তু কবি একদিন বাদশাহ সম্বন্ধে একটি ব্যাঙ্গাত্মক
শ্লোক রচনা করে ফেলেন। সেই ঘটনার পরে একদিন বাদশাহ
তাঁকে ও মুতালাম্মিসকে একটি মোহরাঙ্কিত পত্র দিয়ে বাহ্রাইনে গিয়ে নিজ
পুরষ্কার নেওয়ার আদেশ দিলেন।
মাঝপথে মুতালাম্মিসের মনে সন্দেহ জাগল। পত্র খুলে দেখলেন, তাতে মৃত্যুর আদেশ দেওয়া হয়েছে। তাই বাহ্রাইনে না গিয়ে অনত্রে পালিয়ে নিজের প্রাণ
বাঁচালেন। কিন্তু কবি তাঁর পরামর্শ অগ্রাহ্য করে বাহ্রাইনে গিয়ে হাজির হলেন। সেখানে পত্রাদেশ
অনুযায়ী বাহ্রাইনের শাসক তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিলেন। তখন তাঁর বয়স
হয়েছিল ২৬ বছর। তাই তাঁকে ‘নিহত বালক’ বলা হয়।
কাব্য প্রতিভাঃ
তিনি প্রখর মেধাবী ছিলেন। এই অল্প সময়ে তিনি অসাধারণ
মেধার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর দীওয়ানে ৬৫৭টি শ্লোক আছে আর মু’আ’ল্লাকায় ১০৪
টি। অতিরঞ্জন পরিহার করে
সঠিক তথ্য পরিবেশন করা তাঁর কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট।
তবে তাঁর কবিতায় কঠিন ও জটিল শব্দের
ব্যাবহার ও অস্পষ্ট বাক্যও লক্ষ করা যায়। ব্যাঙ্গাত্মক কবিতা রচনায় তিনি পারদর্শী
ছিলেন।
মুআ’ল্লাকাঃ
উন্নতমানের ভাষার জন্য তাঁর কাসীদাহটি মুআ’ল্লাকার
অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মুআ’ল্লাকা তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ। কবি ‘আম্র বিন কুল্সুমের ন্যায়
তিনিও মুআ’ল্লাকা
দ্বারাই খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছেছেন। পিতৃব্য তনয়কে ব্যঙ্গ
করাই তাঁর মুআ’ল্লাকা
রচনার মূল কারণ মনে করা হয়। অনেকে উৎকৃষ্ট উপমা, চমৎকার বর্ণনা, মানবিক ভাবের
প্রকাশ ও তরুণ মনের অবস্থার নিপুণ চিত্রায়নের জন্য তাঁর মুআ’ল্লাকাকে
প্রাধান্য দিয়েছেন। তাঁর মুয়া’ল্লাকায় যে বিষয় ও উপজীব্যগুলি লক্ষ্য
করা যায় সেগুলি হল প্রেম-নিবেদন, বাস্তুভিটার স্মৃতিচারণা, প্রেয়সী
খাওলার বর্ণনা, উটের বিবরণ, নিজের ও
পিতৃব্য তনয়ের তুলনামূলক আলোচনা, মৃত্যুর
উল্লেখ এবং পরবর্তী প্রজন্মের উদ্দেশ্যে কিছু অসিয়ত।
আমি কে? সে প্রসঙ্গে তিনি তাঁর রচনায় এক জায়গায় বলেছেন—
إذا القوم قالوا : من فتى؟ خلتُ
أنني عُنيت فلم اكسل ولـم
اتـبـلَّدِ
ولستُ بحلاّلِ التـلاعِ مـخـافةً ولكن متى يسترفدِ القـومُ أرفِـدِ
নিজ অভিমত ও অনুভূতির কথা এভাবে ব্যক্ত করেছেন—
فإن كنتَ لا تسطيعُ دفعَ مـنيـّتي فدعني أبادِرْهـا بـمـا ملكَتْ يدي
ولولا ثلاثٍ هنَّ من لـذّةِ الفتـى وجدِّكَ لـم أحفلْ متـى قام عُوَّدي
জ্ঞানগর্ভমূলক কথা, উপদেশ ও নীতিবাক্য ইত্যাদিও তাঁর কবিতায় রয়েছে। এক জায়গায় তিনি বলেছেন—
وظلمُ ذوي القربى أشدُّ
مضاضةً على المرءِ مـن وَقْعِ الحسامِ المهنَّدِ
ستبدي لكَ الايامُ ما كنتَ جاهلاً ويأتيكَ بـالأخبـارِ مـن لم تُزَوِّدِ
No comments:
Post a Comment