সহাবস্থান ও ইসলামঃ কিছু কথা
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
বহু কাল আগের কথা। পৃথিবীতে তখন কোনো
ধর্মীয় বিভাজন ছিল না। সকলে বিশ্বাস করতো, সবার স্রষ্টা এক। তিনিই এই নিখিল
বিশ্বের প্রতিপালক। পরবর্তীতে মানুষ বিভক্ত হয়ে পড়ল নানা ধর্মে-বর্ণে-জাতিতে। আর মনুষ্য সমাজের
এই বিভক্তি প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। অবশেষে এই বিভক্তিই ধরিত্রীর বুক খণ্ডক্ষুদ্র
করে তৈরি করেছে একটি মানচিত্র; যেখানে সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্ব ক্রমশ ভয়াবহ রূপ ধারণ
করছে। চিন্তা-চেতনা-ধর্ম-বর্ণের এই বিভক্তি পৃথিবী থেকে দূর করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়
বলে আমার ধারণা। তাই জীবনে সুষ্ঠুভাবে বাঁচতে সহাবস্থানের কোনো
বিকল্প নেই।
সহাবস্থানের গুরুত্ব— ইসলাম একটি সার্বজনীন জীবন ব্যবস্থা। সকল মানবজাতির জন্যই এর অবতারণা। তাই
সমগ্র মনুষ্য সমাজকে ইসলামে ‘উম্মাতুন্ ওয়াহিদাহ্’ (একটি সম্প্রদায়) হিসেবে
গণ্য করা হয়েছে। এবং পবিত্র আল্-কুরআনে
মহান আল্লাহকে ‘রাব্বুল ‘আলামিন’ (বিশ্বজাহানের
পালনকর্তা) হিসেবে
ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ
তিনি মুসলিম-অমুসলিম সবার স্রষ্টা, সবার
রব ও প্রতিপালক। একইভাবে
নবী মুহাম্মদ (সা)-কে
‘রাহ্মাতুল্লিল্ ‘আলামিন’ (সমগ্র
বিশ্বজগতের জন্য করুণার মূর্তপ্রতীক) বলা হয়েছে। এছাড়া মহাগ্রন্থ আল্-কুর্আনকে ‘হুদাল্-লিন্-নাস’
(সকল মানবজাতির জন্য গাইডবুক ও পথপ্রদর্শক) আখ্যায়িত
করা হয়েছে। সুতরাং, মুসলিম-অমুসলিম সকলে একই মানব সমাজের অংশ। একই সমাজে, একই প্রাকৃতিক গণ্ডি ও আবহে সবার বাস। তাই
সহাবস্থান ও বহুত্ববাদী জীবনব্যবস্থা ইসলামে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সহাবস্থানের কাঠামো— সহাবস্থান, পারস্পরিক সহিষ্ণুতা, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সহানুভূতি
ও সদ্ব্যবহার, মানবতাপূর্ণ উদারতা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলির অন্তর্গত। তাই নবী-জীবনে এ আদর্শের প্রজ্বল নমুনা উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি (সা) নিজ জীবনে অমুসলিমদের সাথে মেলামেশা-লেনদেন ও আচার-আচরণের ক্ষেত্রে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তাছাড়া ঐতিহাসিক ‘মদিনার সনদ’
ইসলামের পরম উদারনীতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
আর তাই একজন মুসলিমের সহিষ্ণু
হওয়া খুবই জরুরী। কেননা ইসলাম অমুসলিমদের সাথে
সদাচরণ ও উত্তম ব্যবহারের
নির্দেশ
দিয়েছে। কুরআনের ঘোষণা— “যারা ধর্মের ব্যাপারে তোমাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়নি এবং তোমাদেরকে তোমাদের দেশ থেকে বিতাড়ন করেনি, তাদের সাথে সদাচরণ ও নিষ্ঠাপূর্ণ ব্যবহার করতে আল্লাহ নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ নিষ্ঠাবানদের পছন্দ করেন।” [সূরা আল্-মুম্তাহ়িনা ৮] অন্য স্থানে বলা হয়েছে, “আহ্লে কিতাব (অন্যান্য ঐশী গ্রন্থের অনুসারী)-দের সাথে তোমরা উত্তমভাবে বাদানুবাদ করো।” [সূরা আল্-আনকাবুত ৪৬] অন্য
ধর্মের মানুষদের
কষ্ট দেওয়া তো দূরের কথা,
তাঁদেরকে
গালমন্দ করতেও ইসলাম
কঠোরভাবে
নিষেধ করেছে,
বিশেষ করে তাদের উপাস্যদের ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপ করাকে, “তারা আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উপাসনা করে,
তোমরা তাদের উপাস্যদের সম্পর্কে অশ্রাব্য কথা বলো না।” [সূরা আল্-আন্‘আম ১০৮]
তাছাড়া, মুসলিম সমাজে বসবাসরত অমুসলিমরা
যাতে
নিজেদের সম্মানবোধ বজায় রেখে চলতে পারে, তাদের
আর্থসামাজিক নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয়, তাদের প্রাণ, স্থাবর-অস্থাবর অর্থসম্পদ ও সম্ভ্রম সব কিছুই নিরাপদ থাকে ইসলাম তার ব্যবস্থা ও নিশ্চয়তা দিয়েছে। বলা
হয়েছে— “মুসলিম রাষ্ট্রে অমুসলিমরা হচ্ছে
যিম্মাহ্ অর্থাৎ
আমানতস্বরূপ।” তাই রাসূল
(সা) বলেছেন, “সাবধান! যদি
কোনো মুসলিম কোনো অমুসলিম নাগরিকের উপর অত্যাচার করে, তার অধিকার খর্ব করে, তাকে কষ্ট দেয় এবং বলপ্রয়োগ করে তার কোনো কিছু দখল করে
নেয়,
তাহলে কেয়ামতের দিন আমি ওই মুসলিমের বিরুদ্ধে আল্লাহর নিকট অভিযোগ করব।” [সহিহ
আবু দাউদ, আল্বানি ২৬২৬]
ধর্মীয় সহিষ্ণুতার দৃষ্টিকোণ— নবী (সা) যখন মক্কায় জনমানসকে
ইসলামের পথে আহ্বান করলেন। তখন তাওহীদ (একত্ববাদ) ও শির্ক (পৌত্তলিকতা)-এর সংঘাত
দেখা দিল। এবং নিপীড়িত ও নির্যাতিত লোকেরা ইসলামের সমানাধিকার নীতিকে গ্রহণ করতে
লাগল। ফলে কোরায়েশের এক প্রতিনিধি দল রাসুল (সা)-কে প্রস্তাব দিল, “আমরা ছ’ মাস
আপনার প্রভুর ইবাদত করবো, আর বাকি ছ’ মাস আপনারা আমাদের উপাস্যের উপাসনা করবেন”।
ইসলামে যেহেতু বিশ্বাসের উপর কর্মকাণ্ড নির্ভরশীল, তাই তাদের প্রস্তাব নাকচ করে
সমাধান দেওয়া হল, “তোমরা তোমাদের ধর্ম পালন করো, আমি আমার দ্বীন পালন করবো।” [সূরা
আল্কাফিরূন ৬] পরবর্তীতে বিষয়টিকে আরও একধাপ এগিয়ে স্পষ্ট করা হল, “নিশ্চয়
আলো-অন্ধকার ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নিরূপিত হয়েছে; ফলে ধর্মপালনে কোনো প্রকার বল
প্রয়োগ বৈধ নয়।” [সূরা আল্-বাকারাহ্ ২৫৬]
তারপর হিজ্রত (মক্কা
ত্যাগ করে মদিনায় আগমন)-পরবর্তী সময়ে নবী (সা) মদিনায় একটি নতুন ইসলামি রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন। এবং সেই রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন ‘মদিনা সনদ’-এর উপর। ওই সনদের একটি ধারায় লেখা হয়েছিল– মদিনায়
সব ধর্মের লোকেরা স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। কেউ
কারোর ধর্মে কোনোরকম হস্তক্ষেপ করবে না...।
[সিরাহ্, ইব্নু হিশাম ১/৫০৩-৫০৪] শুধু তাই নয়, মদিনার ইহুদিরা চরমভাবে ইসলামের বিরোধিতা করত; তা
সত্ত্বেও রাসুল (সা) তাদেরকে ধর্ম-পালনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করেননি। বরং সহিষ্ণুতার নজির সৃষ্টি করেছেন, একবার মদিনার মসজিদে নবী (সা) নাজ্রানের এক খ্রিস্টান প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। আলোচনা শেষে, তারা নিজ ধর্ম-অনুসারে (স়ালাত) প্রার্থনা করার
অনুমতি চাইলে নবী (সা) তাদেরকে মসজিদ-ই-নববি (মদিনার মসজিদ)-তে প্রার্থনা করার অনুমতি দিয়েছিলেন। [তাফসির, ইব্নু কাসির ২/৪২, যাদুল্ মা‘আদ ৩/৫৪৯]
বিতর্ক ও সমালোচনার পদ্ধতি— সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের জন্য সহাবস্থানের প্রতি উৎসাহিত করার পাশাপাশি মতপ্রকাশেরও স্বাধীনতা দিয়েছে
ইসলাম। সেই সাথে নির্দিষ্ট করে দিয়েছে স্বাধীনতার সীমারেখা এবং
দায়িত্ব
পালনের বিধিনিষেধ। কারণ, এই
সমাজবদ্ধ জীবনযাপনে কথায়,
কাজে, আচরণে ভুলত্রুটি ও পদস্খলন একটি অনিবার্য বিষয়। এবং তার সংশোধন
ও উত্তরণের জন্য প্রয়োজন যথাযথ সমালোচনা। আর এ
ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সমালোচনাকারীর
হিতাকাঙ্ক্ষী হওয়া। কেননা “কল্যাণ কামনাই ধর্ম।” [মুসলিম ২০৫] তাই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশদ তথ্য উপস্থাপন করে তার ভালো–মন্দ তুলে ধরে পক্ষে ও বিপক্ষে মতপ্রকাশ করা বা কখনো গভীর বিশ্লেষণ ও বিষয়ের নেতিবাচক দিক
এবং তার নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট করা বাঞ্ছনীয়। এবং এই তর্কবিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনা হবে বুদ্ধিদীপ্ত,
উপদেশমূলক ও উত্তম পন্থায় [সূরা আন্-নাহ়াল ১২৫]। কেননা ইসলামে
পরনিন্দা,
পরচর্চা, অহেতুক সমালোচনা ও অনর্থক
তিরস্কার নিষিদ্ধ [সূরা আল্-হুজ্রাত ১২]।
সহযোগিতা ও সহমর্মিতার পাঠ— আমরা প্রত্যেকে পরস্পরের পরিপূরক। আমাদের
সকলের যৌথ প্রয়াসই আমাদের সমাজ ব্যবস্থার কারিগর। তাই আমাদের
সকলকেই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের মানসিকতা ও মানবিক প্রেমবোধ দেওয়া হয়েছে। যাতে আমরা সবার সঙ্গে মিলেমিশে প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করতে পারি। সত্য-সুন্দর ও জনকল্যাণকর কাজকে গ্রহণ করতে পারি। কাউকে ঘৃণা, অবহেলা ও অবজ্ঞা করা চলবে না। সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সম্মান ও ভালোবাসা প্রদর্শন করতে হবে,
সে যে পথের বা দলমতের হোক না কেন। কারণ সব মানুষই পরস্পর ভাই ভাই। আমাদেরকে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত ঘুচাতে বলা হয়েছে। স্রষ্টা আদেশ করেছেন, “নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে না,
তাহলে তোমরা সাহস হারাবে এবং তোমাদের শক্তি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।” [সূরা আল্-আন্ফাল ৪৬]
বর্তমানে ভালোবাসা ও সহমর্মিতার মহাসংকটে
ভুগছে পৃথিবী। মানবপ্রেম নেই মনুষ্যসমাজে। অথচ মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে মানবজাতির
কল্যাণ সাধনের জন্য;
“তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, মানবজাতির কল্যাণের জন্য তোমাদের উদ্ভব ঘটেছে।” [সূরা
আলে ইমরান ১১০]
অতএব তোমরা মানুষের পাশে দাঁড়াবে, আশ্রয়হীনদের
আশ্রয় দেবে, অভুক্তদের ক্ষুধা মিটাবে, বিপদগ্রস্তদের উদ্ধার করবে। মনে রাখবে, “বিধবা ও অসহায়দের সাহায্যকারী ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায়
জিহাদকারীর সমতুল্য।” [বুখারি ৬০০৭, মুসলিম ৭৬৫৯] অন্য হাদিসে আদেশ
করেছেন, “অসুস্থ লোকের সেবা করো, ক্ষুধার্তকে অন্ন দাও
এবং বন্দিকে মুক্ত করো।” [বুখারি ৫৬৪৯, মুস্নাদ আবু ইয়া’লা
৭৩২৫] কারণ, “আল্লাহ তখনই কোনো মানুষের সাহায্য করেন যখন সে নিজ ভাইয়ের সাহায্য করে।’ [মুসলিম
৭০২৮, আবূ দাঊদ ৪৯৪৮, তিরমিযি ১৪২৫]
যেহেতু ইসলাম সবার জন্য শান্তি, সাম্য, উদারতা ও মানবিকতার কথা বলে। তাই মুসলিম-অমুসলিম, সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলামের নির্দেশ অত্যন্ত কঠোর। সেজন্যই যে-কারোর প্রতি নিপীড়ন ও অত্যাচারকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, “হে আল্লাহ্র বান্দারা (হে মানবজাতি)! আমি তোমাদের সকলের জন্য যে-কোনোরকমের নিপীড়নকে নিষিদ্ধ করেছি।” [মুসলিম
৫৫]। সহাবস্থানের
বিষয়টিকে স্পষ্ট করে অন্য এক হাদিসে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি যদি “অমুসলিম নাগরিক”-কে হত্যা করে,
সে জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না;
যদিও জান্নাতের সুগন্ধি চল্লিশ বছরের দূরত্বে অবস্থান করেও অনুভব করা যাবে। [বুখারি
৩১৬৬] অতএব
প্রকৃত মুসলিম হতে হলে ভালো মানুষ হতে হবে, অন্যদের ভালোবাসতে হবে। নবীজি বলেছেন,
“যতক্ষণ না অন্যদের ভালোবাসবে তুমি মুমিন হতে পারবে না।” [মুস্লিম ৫৪]
[পূবের কলম, ২৪ জানুয়ারি, ২০২০-এর দ্বীনদুনিয়া ক্রোড়পত্রে "সহাবস্থান ও ইসলামের নীতি" নামে প্রকাশিত]
No comments:
Post a Comment