মা-বাবা’র সাথে খুনসুটি
আমি তখন খুব ছোট। কত ছোট বা বয়স কত হবে, তা মনে নেই। একদিন হঠাৎ করে আব্বা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। একেবারে বিছানা ধরে নিলেন। বাবার একটা হাত ও একটা পা প্যারালাইজড হয়ে গেল। ফলে পুরো সংসারের দায়িত্ব এসে পড়লো বড়দার কাঁধে। সে তখন টুয়েলভে পড়ে। স্বাভাবিক ভাবেই তার পড়াশুনোর বেশ ক্ষতি হল। তার আর টুয়েলভ পাশ করা হল না। সেই থেকে সে সংসার সামলাতে আরম্ভ করলো। দিনমান মাঠে খাটে। চাষ করে। ফসল তোলে। আর তা দিয়েই সংসার চলে। আমাদের দু ভাইয়ের পড়াশুনোর খরচও চলে।
বাবা ধীরে ধীরে সুস্থ হলেন। অনেকটা স্বাভাবিক জীবন-ছন্দে ফিরলেন। তবে আগের মতো খাটাখাটুনি সম্ভব হচ্ছিল না। যেটুকু পারতেন দাদাকে চাষের কাজে সাহায্য করতেন। সময় দ্রুত ছুটতে লাগলো। আমরাও ধীরে ধীরে বড় হয়ে গেলাম। এরই মধ্যে মেজদাও ডিগ্রি কমপ্লিট না করেই জমি-জায়গায় দেখাশোনায় লেগে গেলেন। সত্যি বলতে, কৃষকের সংসার কি সেকাল, কি একাল সব সময় টেনেটুনেই চলে। ওই যে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। তবে আমার পড়াশুনো কখনও থামেনি। কারণ, বাবা-মা ও দুই দাদা সবাই চাইতেন, আমি মন দিয়ে পড়াশুনো করি। জীবনে কিছু করি। তাই তাঁদের পক্ষে যতটা সম্ভব তাঁরা আমার জন্য করতেন। এরই মাঝে সংসারে আরও কিছু বিড়ম্বনা দেখা দিলো। আমি বেনারস ছেড়ে বাড়ি ফিরলাম। পড়াশুনোর পাশাপাশি টিউশন আরম্ভ করলাম। কিছুদিন পর একটা মাদ্রাসায় পড়াতে আরম্ভ করলাম। পড়া ও পড়ানো দুটোই চলতে থাকলো।
আমি যখন থেকে রোজগার করতে আরম্ভ করেছি, একটা জিনিস ঠিক করেছিলাম, প্রতি মাসে কিছু টাকা বাবার হাতে তুলে দেবো। তিনি তাঁর মতো করে খরচ করবেন। সামান্য হলেও দেবো। দিতামও। সেই টাকা হাতে নিয়ে বাবা খুব খুশী হতেন। ওই টাকার দিকে তাকিয়ে বাবার মুখে এক নির্মল হাসি ছড়িয়ে পড়তো। এক অদ্ভুত তৃপ্তির রেখা লক্ষ্য করতাম বাবার কপালের রেখায়। মাঝে মাঝে বাড়ি ফেরার সময় বাবার জন্য বাবার পছন্দ মতো কিছু খাবার এবং মায়ের জন্য মায়ের পছন্দ মতো কিছু খাবার কিনে আনতাম। একদিন কিছু খাবার কিনে এনেছি, কী খাবার ছিল তা আজ আর মনে নেই। সবাই মিলে বিকেলে বসে সেই খাবার খাচ্ছি। বাবার খুব পছন্দের খাবার ছিল, তাই বাবাকে একটু বেশিই দিয়েছিলাম। সবাই পাশাপাশি বসে যে যার মতো করে খাচ্ছি। খাচ্ছি আর এটা-সেটা নিয়ে গল্পগুজব করছি। এমন সময় হঠাৎ আমার দৃষ্টি গেলো বাবার দিকে। দেখলাম, বাবা খানিকটা আড়াল করেই কিছু খাবার তাঁর থালা থেকে তুলে মায়ের থালায় দিচ্ছেন। আর মা হাত দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছেন এবং বাবাকেই তা খেতে বলছেন। বাবা যখন লক্ষ্য করলেন যে আমি দেখে ফেলেছি, জোর করে মায়ের থালায় খাবারটুকু রেখে দিলেন। সেই সুযোগে আমিও খুনসুটি করে বাবাকে বললাম, “বেশ তো আমার আনা খাবার দিয়েই প্রেম চলছে তাহলে”। আমার কথা শুনে বাবা ফিক করে হেসে উঠলেন, আর মা লজ্জায় আঁচল টানলেন। ওই নির্মল হাসি দিয়ে বাবা আমার দিকে তাকালেন, শিশুর মতো নিষ্পাপ দৃষ্টিতে, যেন কোনো আবদার তাঁর চোখের পাতায় ভেসে উঠেছে। যেন কোনো সন্তান বাবার কাছে কিছু চাইছে। যেন কোনো শিশু কিছু নেবে বলে বায়না ধরেছে মায়ের কাছে। আমার জীবনের অন্যতম প্রাপ্তি বাবার সেদিনের সেই নির্মল হাসি।
প্রায় দশ বছর হতে চলল, বাবাকে হারিয়েছি। সেই চেনা কণ্ঠ শুনিনি বহু বছর। ফজরের পর তাঁর সেই দরাজ কণ্ঠে কুরআনের তেলাওয়াত শুনিনি বহু দিন। বাবা, কত দিন, কত দিন দেখি না তোমায়!
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
১৯-০৫-২০২১
বাঁশকুড়ি, মহিপাল, দঃ দিনাজপুর
No comments:
Post a Comment