আরবি সাহিত্যের রোমান্টিক
কবি আবুল্-ক়াসিম আশ্-শাব্বি
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
তিউনিসিয়ার জাতীয়
কবি তিনি। ‘শায়েরুল্ খায্রায়ি’(চিরসবুজের কবি) হিসেবেই তিউনিসিয়দের কাছে অধিক পরিচিত। তিউনিসিয়ার তুযার প্রদেশের শাবিয়া গ্রামে ১৯০৯ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি তাঁর জন্ম। বিচারক পিতার ট্র্যান্সফারেব্ল চাকরির সুবাদে দেশের বিভিন্ন
অঞ্চলে ঘুরে বেড়ান; সেই সাথে প্রত্যক্ষ করেন তিউনিসিয়ার মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। পিতা মুহাম্মদ শাব্বি ছিলেন একজন সৎ, ন্যায়পরায়ণ ও
ধর্মপ্রাণ মানুষ। আদালত, বাড়ি ও মসজিদ এ তিনের মাঝেই দিন অতিবাহিত করতেন। আর তাই শাব্বি বেড়ে উঠেছিলেন ধর্মীয় ও রক্ষণশীল পরিবেশে।
১৯২৮ সালে জায়তুনা বিশ্ববিদ্যালয়
হতে স্নাতক এবং ১৯৩০ সালে তিউনিসিয়া বিশ্ববিদ্যালয় হতে আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রী
অর্জন করেন। পরের বছর, ১৯২৯ সালে তাঁর হার্টের অসুখ ধরা পড়ে। তবে
তখনও তা ভয়ানক আকার ধারণ করেনি। এ সময়ে পিতা তাঁর বিয়ে
দেওয়ার মনস্থ করেন। কিন্তু কবি অসুস্থতার কারণে বাবার ইচ্ছায় আপত্তি করেন এবং শীঘ্রই
ডাক্তার মুহাম্মদ আল্-মাতেরি-এর শরণাপন্ন হোন। কিছু দিন পর, বাবার চাপাচাপিতে
বিয়ে করেন এবং দু’ পুত্রের পিতা হন। তবে শারীরিক অবস্থার
ক্রমশ অবনতি হতে থাকে। রোজ নতুন নতুন সমস্যার মুখোমুখি
হতে থাকেন। তিনি অবশ্য ছোটবেলা থেকেই ক্ষীণকায় ও দুর্বল ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে
থাকাকালীন স্বাস্থ্যের আরও অবনতি হয়েছিল।
এক বাল্যবান্ধবীর মৃত্যুতে
মর্মাহত হয়ে ডাক্তারের পরামর্শ ও নির্দেশকে উপেক্ষা করতে আরম্ভ
করেন। অন্যদিকে বিয়ে ও সাংসারিক দায়দায়িত্ব তাঁকে
আরো চিন্তাগ্রস্থ করে তুলেছিল। দৌড়াদৌড়ি, হাঁটাহাঁটি, পাহাড়ে ওঠা, সাইকেল চালানো অনেক
কিছুই বারণ ছিল তাঁর জন্য। আর তাই জায়তুনা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে বন্ধুদের খেলাধুলা
করতে দেখে একদা ডুকরে কেঁদে ওঠে বলেছিলেন- “হায়রে আমার হৃদয়! তুমি যে বড়োই দুর্বল। তুমিই
আমার যতো কষ্টের মূল। আমার সকল চিন্তার উৎসভূমি তুমিই। তুমিই
আমার জীবনকে করেছ অর্থহীন”।
ক্রমশ বাড়তে থাকা
অসুস্থতার দরুন, ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী, ১৯৩২ সালে গ্রীষ্মকালীন অবকাশ যাপনের
জন্য আইনু দারাহিম-এ যান। সেখানে তাব্রাকা নগরী পরিদর্শন করে কিছুটা সুস্থ বোধ করেন। পরবর্তী বছর যান সমুদ্র-সৈকত ও তার তীরবর্তী এলাকা ভ্রমনে। দৃষ্টি নন্দন ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে তাঁর চোখ ও মন শীতল হয়। পুরো গ্রীষ্ম সেখানে কাটিয়ে শীতের শুরুতে ফিরে আসেন তুযারে। ১৯৩৩-এর শেষ দিকে তাঁর শারীরিক অবস্থা ভয়ানক অবনতি হয়। শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন
তিনি। শীত যায়, বসন্ত আসে, কিন্তু কবির অবস্থার কোনো পরিবর্তন হয় না। তাই একটু আরোগ্য লাভের উদ্দেশ্যে
এবার যাত্রা করেন হিম্মা-র। কিন্তু হিতে বিপরীত হয়। বাধ্য হয়ে ফিরে
আসেন তিউনিসিয়া শহরে। এখানে-সেখানে বহু ছুটোছুটি
করেন। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। দিনদিন অবনতির দিকেই
এগোতে থাকে তাঁর শারীরিক অবস্থা। ফলে ৩রা
অক্টোবর ভর্তি হোন তালইয়ান হাসপাতালে। ছ’দিন পর ৯ই অক্টোবর সোমবার ভোর চারটায় ইহজীবনের মায়া ত্যাগ করেন। সেদিনই তাঁর মরদেহ তিউনিসিয়া সিটি থেকে তুযারে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং সেখানেই সমাধিস্থ
করা হয় তাঁকে।
কবিকে তিউনিসের দীপ্তি
এবং আরবির প্রতীচ্য উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। তার
কালজয়ী কবিতাসমূহের কারণে তাকে প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের সেতুবন্ধন হিসেবে অভিহিত করেছেন
আরবি কাব্যের বোদ্ধা সমাজ।
তাকে আরবি রোমান্টিক কবিতার পথিকৃৎদের অন্যতম গণ্য করা হয়। তিনি ছিলেন আধুনিক তিউনিসিয়ার সাহিত্যাকাশের উজ্জ্বল তারকা। প্রবাদ পুরুষ। লেখালেখিতে তিনি মিসরীয়
সাহিত্যিক ও ইসলামি সংস্কারক মুহাম্মদ আব্দুহুর দ্বারা অতি মাত্রায় প্রভাবিত ছিলেন। ১৯২৬ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তিনি ক্লাসিক ধর্মী ঐতিহ্যিক আরবি কবিতার অনুরক্ত ছিলেন। তবে তার সাথে তিনি ফ্রান্সীয় রোমান্টিকতার সংমিশ্রণে
প্রচণ্ড আগ্রহী ছিলেন। তার কবিতা পাঠে ডি-মাসেট,
লা-মারটিন, টি-গাশিয়ার প্রমুখ রোমান্টিক কবিদের প্রভাব অতিমাত্রায় লক্ষ্য
করা যায়।
কবির অত্যল্পকালে আমাদের
জন্য রেখে যাওয়া কবির শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে— ক. আগানি আল্-হায়াৎ (জীবনসঙ্গীত) ১৯৬৬ ২য় সংস্করণ, খ. আল্-খিয়াল আল্-শি’রি
ইনদাল আরব (আরবদের কাব্যকল্পনা) ১৯৬১, গ. রাসাইল আশ্-শাব্বি (শাব্বির পত্রাবলী) ১৯৬৬, ঘ. মুজাক্কারাত (স্মরণ), ঙ. সাদিকি (বক্তৃতা সংকলন)।
কবি আশ্-শাব্বি সাহিত্যের
প্রতি অতিমাত্রায় অনুরক্ত ছিলেন। বিশেষত আধুনিক সাহিত্যের
প্রতি তার অনুরক্ততা ছিলো প্রবল। তবে তা কোনোভাবে ইক্ল্যাসিক
সাহিত্য বা সাহিত্যিক ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে নয়। তার
লেখা প্রায় প্রতিটি কবিতাই যুগপৎ প্রাচীনত্ব ও আধুনিকতার সমন্বিত রূপ। আরবি প্রাচীন কবিতার মাত্রা, ছন্দ, বৃত্ত, তার কবিতায় রয়েছে আবার
আধুনিক কবিতার বিষয়বস্তু,
রসদ,
ঢঙ প্রভৃতিও সেখানে মূর্তিমান। তিনি
ছিলেন প্রকৃতপক্ষে প্রকৃতি প্রেমী চিরসবুজের কবি। প্রকৃতির
প্রতি তার নিখাঁদ ভালোবাসার শেষ ঠিকানা দেশ প্রেম। তাই
কবি আশ্-শাব্বিকে পোয়েট অফ ন্যাচার টু প্যাট্রিওটিজম বলা হয়ে থাকে।
চিরসবুজের কবি আশ্-শাব্বি
প্রকৃতির বন্দনা করেছেন চিরায়ত। তিউনিসিয়ার প্রাকৃতিক
সৌন্দর্যের ভূগোলকে উপস্থাপন করেছেন কবি দেশপ্রেমের নব মাত্রায়। মিন আগানি আল-রু‘আত (রাখাল সঙ্গীত) কবিতায় নিঃসীম প্রকৃতির সাথে দেশপ্রেমের যুগপৎ পথ চলার অনবদ্য
দৃশ্য এঁকেছেন অনুপম নান্দনিকতায়। কবি বলেছেন—
জীবনের বন্দনা- আসে সুবহে সাদিক
দোল খায় গাছেরা, স্বপ্ন দেখে সুপ্রভাতের
শিশির সিক্ত গোলাপ পাত্রে নিত্য নাচে প্রভাত
আলো হয় উপত্যকা, কেটে যায় তমসা রাত
সুবহে সাদিকের আগমনে দিগন্ত হয় দীপ্যমান
ফুলপাখি হাই তোলে আর সমুদ্র করে কলতান
এভাবেই পৃথিবী সজীব হয় জীবন বন্দনায়
তুমি সুখনিদ্রা ছেড়ে
ওঠো, পৌঁছে যাও নিজ ঠিকানায়।
এভাবেই প্রকৃতির বন্দনায়
নিরত কবি প্রকৃতিকে সৌন্দর্যমণ্ডিত ও কারুকার্যখচিত করে তোলেন পাঠক হৃদয়ে। তিউনিসিয়ার নিসর্গ প্রকৃতির বিমূর্ত প্রতিচ্ছবি তার অনেক কবিতায়ই
আমরা দেখতে পাই। তবে নিতান্ত প্রকৃতি বন্দনা কবির কবিতার শেষ কথা নয়। বরং সেখানেও দেশ, দেশমাতৃকা কবির কাছে অনেক বড় বিষয়। উপরুল্লেখিত
কবিতায় আমরা প্রভাত, শিশির সিক্ত গোলাপ, উপত্যকা, সমুদ্রের কলতান এ সবের
নিঃসীম সৌন্দর্য অবলোকন করি। কিন্তু কবি দেশ গঠনে
জাতিকে জাগাতে ভোলেননি। সুখনিদ্রা ছেড়ে জাতি গঠনে মনোনিবেশের অকৃত্রিম আহ্বান কবির নিখাঁদ
দেশপ্রেমের প্রতি ইঙ্গিত করে। এ কবিতার মাঝামাঝি দেশ
গঠনে কবির আকুতি যেনো দেশের প্রতি কঠোর দায়বোধেরই আর্তি।
তুলে ফেলো আগাছা, চাষ করো নতুনের
নলখাগড়ার বাঁশীর ওই ডাক শোনো গঠনের।
কী চমৎকার কবির আহ্বান! প্রকৃতি প্রীতির পশ্চাতে দেশপ্রেমের কী অনবদ্য নমুনা। দেশের প্রতি প্রেম কতোটা নিখাঁদ হলে এভাবে জাতিকে দেশের উন্নয়নে
আহ্বান করা যায়। কবির উপমা-উৎপ্রেক্ষাতেও রয়েছে
চমৎকারিত্বের যাদু। আগাছা মুক্ত নতুনের চাষাবাদ, নলখাগড়ার বাঁশীর আহ্বান
সত্যিই মনোমুগ্ধকর।
কবি আশ্-শাব্বি ছিলেন
স্বল্পায়ু। তার জীবন ছিলো মাত্র পঁচিশ বছরের। তার
সাহিত্যের খাজাঞ্চীও অতিকায় ছিলো না। তবে তার লেখা ছিলো মানোত্তীর্ণ। ডাক্তারী তথ্য মতে হার্টের অসুখে তার মৃত্যু হলেও মনে করা হয়
তার মৃত্যুর কারণ তিনটি- ক. দুর্বল হার্ট খ. বাল্যবান্ধবীর অকাল মৃত্যু
গ. ডাক্তারের পরামর্শ উপেক্ষা করা। কবি
সত্যিই ভালোবাসার কাঙাল ছিলেন। মা’তাম আল-হুব্ব (ভালোবাসার আর্তি) কবিতায় কবি আর্তনাদ করেছেন—
হায় আমি! কোন পাখি
কান্না শুনি হৃদয় উৎসারিত
প্রত্যুষেও নির্বাক অউদ্বেলিত
বিনম্র, বিষণ্ণ সে পাখি।
কী সে আমি জানি না!
নির্বাক বুলবুল শব্দহীন
নিষ্প্রাণ
জগৎ জোড়া সুখ্যাতি কলতান
নাকি মেঘের আড়ালে শুধুই
কান্না।
কেঁদেছি কতো ঘোর অমানিশা
কবরের আলাপন, দুঃখের আর্তি
আর্তির অনুরনন শুনেছি সবই
দুঃখ কাতর আমি সর্বদা।
দুঃখ, কষ্ট, জ্বরা ইত্যাদিতে জাতি
নিমজ্জিত। কবি জাতিকে নানাবিধ জ্বরা হতে মুক্তি দিতে উদগ্রীব। নতুন দিনের প্রতি, নতুন স্বপ্নের প্রতি কবির টান দুর্নিবার। আল-সাবাহ আল-জাদিদ (নতুন ভোর) কবিতায় নতুনের আহ্বানে কবির সুদীপ্ত আবেদন—
ভীরু কাপুরুষ এবার তুমি
থামো
কান্নার সময় শেষ, আহাজারিরও
উদয় হয়েছে নতুন সূর্যের
দাফন করেছি কষ্টের
গেয়েছি জীবনের জয়গান
ছেড়েছি অশ্রু
জামানার অবদান।
এভাবেই নতুনের জয়গান
গেয়েছেন কবি আশ্-শাব্বি এই কবিতার প্রতিটি ছত্রে। খাফিফ
ছন্দ মাত্রায় রচিত এই কবিতা আধুনিক তিউনিসিয়ায় কোরাস গানের মর্যাদা পেয়েছে। উদ্দীপ্ত জনতার মুখে মুখে তার এই কবিতার কোরাস উচ্চারিত হতে
শোনা যায়। কবিতার শেষে কবির আহ্বান—
বিদায় হে চিন্তা পর্বত
বিদায় হে কষ্ট কুহেলি
বিদায় হে হাবিয়া গিরিপথ
নৌকার বাদাম তুলেছি মহা
সমুদ্রে
নতুনের বিজয় সমাসন্ন
অস্পৃশ্য হোক পুরাতন, জ্বরা, জীর্ণ।
দেশ ও জাতির জন্য নিবেদিত
কবির কবিতাসমূহ এমন ঘন আবেগে জাতিকে আপ্লুত করে। উদ্যমী
করে। তিউনিসিয়ার সবুজ প্রকৃতিকে আরো এক নতুন সবুজের আগমনের জন্য প্রস্তুত
করে।
জীবনকে কে না ভালোবাসে। কবিও ভালোবাসতেন। তিনি জানতেন তার আর বেশি দিন বেঁচে থাকা হবে না। নিশ্চিত মৃত্যুতে জীবনের প্রতি উদগ্র ভালোবাসা কবিকে খানিকটা
বিচলিত করে। জীবনের আর্তি দুমড়ে-মুচড়ে কবি কণ্ঠে বেরিয়ে
আসে বিণা অবলীলায়—
ভালোবাসা! ভালোবাসা!
তুমিই আমার বিষণ্ণতা
কিংবা বিস্ময়
বিপদ কিংবা সংশয়
তুমিই আমার সঙ্গীত মূর্চ্ছণা
কষ্ট যন্ত্রণা
তুমিই আমার আসক্তি কিংবা
অশ্রু
রাগ, ক্রোধ, প্রত্যাশা, আভিজাত্য
আত্মসম্মান এমনকি আমার
অস্তিত্ব
আমার সবই তোমার জন্য
হে ভালোবাসা।
দেশ, জাতি ও জগতের প্রশ্নে
কবি অবশ্যই আশাবাদী। তবে নিজের প্রশ্নে কবি ভুগতেন হতাশায়। তার
জীবনের পরতে পরতে হতাশার ছায়া প্রলম্বিত। নিজের জীবন, পরিবার, সন্তানদের ভবিষ্যৎ ইত্যাদি
প্রশ্নে হতাশা কবিকে করে আরো হতাশ। অসংখ্য কবিতার নাম করা
যাবে যেখানে কবির হতাশা নানা মাত্রিকতায় রূপ পেয়েছে। শিকওয়া
আল-ইয়াতিম (ইয়াতিমের অভিযোগ) কবিতায় কবি নিজেকে ইয়াতিম
হিসেবে উপস্থাপন করে অনুযোগ করেছেন—
বিলাপ করেছি অর্থহীন
মাকে ডেকেছি নিরুত্তর
কষ্টের রাজ্যে আমি একা
একাই কেঁদেছি
কান্নার গোঙানি শুনেছি
একাই থেকেছি
আর বলেছি নিজেকে—
তোমার চুপ থাকাই শ্রেয়।
প্রকৃতির প্রতি দুর্বলতা
কবি আশ্-শাবির আজন্মের। এমনিতেই তিউনিসিয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। বাবার চাকুরির সুবাদে বাবার সাথে তিউনিসিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলের
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে। তিউনিসিয়ার
নির্মল, নির্ঝর প্রকৃতির প্রতি
ক্রমশ দুর্বল হতে থাকেন তিনি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের
বর্ণনায় প্রবৃত্ত হয় তার অবচেতন মন। তিউনিসিয়ার নিসর্গ প্রকৃতি
যেনো সুন্দরের পুজারি কবির অস্তিত্বের অংশে পরিণত হয়। প্রকৃতি
বৈ কবিতার অস্তিত্বকেই চিন্তা করতে পারতেন না। প্রকৃতির
বর্ণনাসমৃদ্ধ তার শতসহস্র শ্লোক রয়েছে। কবিতার দেশের নিসর্গ
প্রকৃতি দেখেছেন। তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজতে চাননি তিনি। বলেছেন—
একা আমি সুখী নই
পাহাড় বনানী বৈ
পাইন গাছের স্পর্শ বিনে
সুখ খুঁজে পাবো কই।
কবি এভাবেই পাহাড়, উপত্যকা, বন-বনানীর নিঃসীম সৌন্দর্যের মাঝেই জীবনের অর্থ খুঁজে পান। কবির বাল্যবান্ধবীর মৃত্যুর কথা আমরা আগেই জেনেছি। বান্ধবীর প্রতি কবির ভালোবাসা ছিল খনি আহরিত কাঁচা সোনার মতোই
খাঁটি। তাদের প্রেম ও বয়সের পরিণতির আগেই বান্ধবীর অকাল মৃত্যু কবিকে
চপেটাঘাত দেয়। কবি অসংলগ্ন জীবন যাপন শুরু করেন। যদিও
তার বয়স তখনও কুড়ি পেরুয়নি। সে সময়ে তার লেখা কবিতাগুলো
ছিল অনেকটা কাঁচা হাতের। তবে মর্ম বেদনা ও প্রেমানুভূতির যৌথ অনুপ্রবেশে তা ছিল মধুসঞ্চারী। বান্ধবীর স্মরণে কবির অভিব্যক্তি—
মরে গেছে তোমার ভালোবাসা
এই তার সমাধি
কাঁদো রে মন কাঁদো
কান্নায় পাও স্বস্তি।
কিংবা
আমার নয়ন দেখেছে তোমাকে
তোমার পদ সঞ্চালনার মূর্চ্ছণা
ত্রস্ত হয়েছে বিক্ষত
অন্তর
কেঁপেছে গোলাপ বৃন্ত।
সমূহ সৌন্দর্যের আকর
তুমি
স্ফীত বক্ষ, হরিণীর দৃষ্টি
বসনে-ভূষণে মাদকতা
কণ্ঠে দুরাগত শিঞ্জিনি।
কবির বান্ধবীর সাথে অভিসারের
বর্ণনায় মুগ্ধ হয় পাঠক সমাজ যখন তিনি বলেন—
এই বন তলে গাছের নিচে
জাইতুনের ছায়ায়
তোমাতে আমাতে হারিয়ে
গেছি
দু’জন দু’জনায়।
ডুবে যেতাম স্বপ্ন জালে
আকাশের নিচে বন তলে
ভুলে যেতাম বাঁচা-মরা
আশা যতো ঢাকা মখমলে।
কবি আশ্-শাব্বির মাঝে
পাওয়া যায় দ্বৈত স্বত্ত্বার অস্তিত্ব। দেশ, জাতি, জাতীয়তা ইত্যাদি প্রশ্নে
আমরা কবির মাঝে আশাবাদী স্বত্ত্বার উপস্থিতি টের পাই। কবি
দেশকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন,
দেশের উন্নয়নে স্বপ্নের জাল বুনেন। উন্নত
জাতি হিসেবে তিনি তিউনিসিয়দের বিশ্বদরবারে উপস্থাপন করতে প্রয়াসী হোন। এ নিয়ে কবির স্বপ্ন অন্তহীন। আশা
অফুরন্ত। কবির অসংখ্য কবিতায় এর দ্যোতনা বিদ্যমান। আবার নিজের জীবন, প্রেম,
ভালোবাসা,
চলৎ জীবনের আশু সমাপ্তির নিশ্চিত সম্ভাবনা, তীব্র আকাঙ্ক্ষা, অপূর্ণ বাসনা ইত্যাদি
বিষয়ে তিনি চরম হতাশাবাদী একজন কবি পুরুষ। তার অনেক কবিতায় এই হতাশা
ঝরে পড়েছে বারবার। হতাশা তার জীবনকে করেছে সংশয়াচ্ছন্ন। তার
এই দ্বৈত সত্ত্বা আমাদেরকে মনে করিয়ে দেয় তিনি যতোটা ছিলেন কবি তার চেয়ে বেশি ছিলেন
মানুষ। তিনি নিজেও তাই মনে করতেন। বলতেন—
আমার নিজস্ব অভিব্যক্তিই
আমার কবিতা। আর আমার কবিতাই আমার আপণ অভিব্যক্তি।
কবির এই দ্বৈত স্বত্ত্বার
মাঝেও একটি মজার বিষয় লক্ষণীয়। তা হলো— প্রত্যেক হতাশার শেষ প্রান্তে এসে তিনি আলোকের ফুলকি দেখতে পান। সে আলোক রেখায় তিনি হোন আশান্বিত। সবাইকে
জাগতে বলেন, নতুনের চাষ করতে বলেন। এখানেই কবি আশ্-শাব্বির স্বাতন্ত্রতা।
কবি আশ্-শাব্বির লেখার
বয়স খুবিই সংক্ষিপ্ত। তবুও লিখেছেন প্রচুর। তার
সমসাময়িক প্রায় সকল কবির মাঝে কবিতার মান ও সংখ্যা উভয় দিক বিচারে তার মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত। আশাবাদী বা হতাশাবাদী নয় আসলে তিনি ছিলেন জীবনবাদী কাব্যের প্রতিভূ। তিনি পাহাড়-বনানী, গাছ-পালা,
তরু-লতা, পাখ-পাখালি,
হেমন্ত-বসন্ত, গোধুলি-সন্ধ্যা,
জীবন-মৃত্যু, প্রেম-ভালোবাসা,
অভিসার-প্রণয়, দেশ-জাতি-ধর্ম, হতাশা প্রভৃতি বিষয়কে
আশ্রয় করে লিখেছেন। কিন্তু সবার উপরে স্থান দিয়েছেন দেশকে। দেশের মানুষকে। দেশের জন্য তার ভালোবাসা
ছিল অবারিত। তার সব কবিতাই ছিল দেশের জন্য উৎসর্গিত।
No comments:
Post a Comment