ব্যাংক ও ফকির সাহেব
বদিউর রহমান
বুধবার
২৭-১০-২০২১ কলেজস্ট্রীট ইউ বি আই ব্যাঙ্কে (বর্তমানে পি এন বি) বাধ্য হয়ে গিয়েছিলাম। ঠিক এক মাস আগে একই কাজের জন্য ওই ব্যাঙ্কে গিয়েছিলাম। ঘর থেকে বের হওয়ার মুহুর্তে ফোনে একটা মেসেজ এসেছিল। অনেকটা এই রকম “দশ হাজার টাকা আপনার এই অ্যাকাউন্টে
জমা হল। আপনার বর্তমান ব্যালান্স সাঁয়ত্রিশ
হাজার।” মেসেজে যে অ্যাকাউন্ট নাম্বার দেওয়া
হয়েছিল সে অ্যাকাউন্ট আমার নয়। চিন্তিত হলেও ওই মেসেজের কোন উত্তর দিইনি। ভাবলাম ব্যাঙ্কে তো পি পি এফ এবং আর
একটা কাজে যাবই তখন ব্যাংকের কর্মচারীদের মেসেজটা দেখিয়ে আমার কী করণীয় জেনে নেব। ওই ভয়ঙ্কর মেসেজটার জন্য অধ্যাপক আলি
সাহেবকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাঙ্কে যাই।
সর্বপ্রথম
আমার মেসেজটা এক ব্যাঙ্ককর্মীকে দেখাতেই তিনি বললেন “ফল্স মেসেজ। ব্যাঙ্কের মেসেজ এরকম হয় না। আপনি কোন উত্তর দেননি তো?” ‘না’ বললাম। বললেন ‘খুব বেঁচে গেছেন। সাবধানে থাকবেন। এসব ফোনের কখনো উত্তর দেবেন না।’ দ্বিতীয় কাজটা ছিল একটা ওই ব্রাঞ্চের
অ্যাকাউন্ট আমাদের পাড়া করুণাময়ী পি এন বিতে ট্রান্সফার করা। তার জন্য একটা দরখাস্ত লিখে নিয়ে গিয়েছিলাম। ব্যাঙ্কের ওই ভদ্রলোক লেখাটা পড়ে বললেন “সব ঠিকই আছে, তবে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ বলে একটু
চাপে আছি। সামনে মাসের গোড়ার দিকে কাজটা করে দেব।” ওনার ব্যক্তিগত ফোন নম্বর ও নাম লিখে দিলেন। অক্টোবোরের শুরুতে কয়েক দিন পর পর ব্যাঙ্কের ছুটি ছিল পূজা উপলক্ষে। পাঁচ তারিখ থেকে পাণ্ডুয়ায় ছিলাম। সেখানে ভীষণ ব্যস্তও ছিলাম। মোটামুটি ব্যস্ততা কাটিয়ে বারো অক্টোবর
সল্টলেক ফেরৎ আসি। তের তারিখ থেকে ব্যাঙ্কের ওই ভদ্রলোকের
ফোনে যোগাযোগ করে ব্যর্থ হই। আর পি পি এফের চেক দিয়েছিলাম এস বি আইয়ের। তারাও কোন মেসেজ দেয়নি। আদৌ টাকাটা পিএনবি-তে আমার পিপিএফ এ জমা হল কী না তখনও জানতে পারিনি।
তের অক্টোবর
থেকে আবার চার-পাঁচ দিন অতীব ব্যস্ততার দরুণ ব্যাঙ্কের ওই ভদ্রলোককে সেভাবে ফোন করতে পারিনি। যেদিন থেকে ফোন করি – উনি ফোন আর ধরেন না। বাধ্য হয়ে ভেবেছিলাম আমাকে স্ব শরীরে
যেতে হবে। তার মধ্যে আমার এক অন্যতম প্রিয় ছাত্র (বর্তমানে অধ্যাপক)-র বিয়েতে আমাদের উভয় স্বামী-স্ত্রীকে বিশেষ ভাবে উপস্থিত হওয়ার
আব্দার করাতে এবং তাঁর বাবা আমার ক্লাসমেট হওয়াতে এবং দীর্ঘ পনেরো-ষোল বৎসর পর তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের লোভে
ফুরফুরার কাছে আকুনি যেতে হয়। পরের দিন ছিল রবিবার। সোমবার ২৫-১০-২০২১ ব্যাঙ্কের কাজটা করব বলে মনস্থির করি। কথায় বলে “ম্যাল প্রপোথেস গড ডিসপ্রপোথেস।” সেদিন ২৪-১০-২০২১ সকাল সাতটায় আমার স্ত্রী মর্নিংওয়াকে গিয়েছিলেন। মোটর সাইকেল চড়ে দুই দুস্কৃতি আমার
স্ত্রীর গলার হারটা ছিনতাই করে পালায়। সেই ব্যাপারে থানা থেকে অফিসার আসেন। আধ ঘন্টার মধ্যে সাধারণ পোষাকের পুলিশ
আসেন। এমনকি সি.আই.ডির একটা গ্রুপও বিকেলে এসে হাজির। আর শুরু হয় মিডিয়ার লোকেদের আনা-গোনা। সকলেই প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেছেন যদি
কোন সূত্র বের করতে পারেন। রাত এগারটা পর্যন্ত ওই ভাবেই কাটে। ক্লান্ত, অবসন্ন হয়ে বিছানায় লম্বা হতে রাত একটা। দূর্ভাগ্যবশতঃ সেদিন রাত সাড়ে তিনটেয় আমার ঘুম ভেঙ্গে
যায়। ফজর পড়ে কিছুটা তেলাওয়াত করে ভোর পাঁচটায়
আজিজ সাহেবকে ফোনে পাই। মনের মানুষ হওয়ার জন্য দীর্ঘক্ষণ (প্রায় এক ঘন্টা) আলাপচারিতা চলে। তারপর আরও দুজনের সঙ্গে কথা বলে নিই। প্রায় সাড়ে ছটায় শঙ্কা ও অবসাদে ভারাক্রান্ত আমার স্ত্রী আমাকে ফোন হাতে দেখে ভিষণ ক্ষুন্ন হন। ইতিমধ্যে যে আমি দু’বার চা খেয়ে সিগারেট খেয়েছি উনি জানতে
পারলে আরও রাগান্বিত হতেন আমি নিশ্চিত। কিছুক্ষণ পর উনি চা করে দিলেন। আবারো খেলাম।
সোমবার
মানসিক ও শারীরিক যে ধকল গেছে আর অনভ্যাসের রাত্রি শেষের আগেই জেগে ওঠার কারণে আমার শরীরটায়
যেন ভার ভার লাগছিল। মাথাটাও যেন টলছিল। রাস্তায় বেরিয়ে কলেজস্ট্রীটের ব্যাংক যাওয়ার সাহস হল না। একজন ছাত্রকে সকাল দশটার দিকে আসতে
বললাম। সে এক ঘন্টার মধ্যে আসবার কথা দিল। আসছে না দেখে আমার বাড়ির কাছের পিএনবিতে
খোঁজ করলাম যে আমার অ্যাকাউন্টটা ট্রান্সফার হয়ে সেখানে কোন মেসেজ দিয়েছে কি না। কম বয়সী এক মহিলা এখন ব্রাঞ্চ ম্যানেজার। ধৈর্য সহকারে সব শুনে কম্পিউটারে সার্চ
করে বললেন “না সেরকম কিছু মেসেজ আসেনি। কলেজস্ট্রীট পিএনবি-র ভদ্রলোকের নাম ও ফোন নাম্বার দেখালাম। ওই মহিলা সেই নাম্বারে ফোন করে যথারীতি উত্তর পেলেন না। তখন কলেজস্ট্রীট ব্রাঞ্চের ম্যানেজারকে
ফোন করে তাঁর ব্রাঞ্চের ভদ্রলোককে ফোনটা ট্রান্সফার করতে বললেন। তিনি অপারগ বলে জানালেন। তখন ওই মহিলা দুটো ব্রাঞ্চের ই-মেল নাম্বার দিয়ে চিঠি দিতে বললেন। বাড়ি ফিরে ছাত্রর অপেক্ষা করতে লাগলাম। বেলা দেড়টার সময় মনস্থির করলাম আমি একাই যাব। নীচে আমার গাড়ির দরজা খুলে বসার সময়
আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মসিহুর রহমান সাহেবকে ফোন করি যে উনি বিশ্ববিদ্যালয়ে
সেদিন আসেবন কী না। বলেন “আজ যাবেন না।” আমি যাব শুনে বলেন “ওখানে কিছু ছাত্ররা বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। অধ্যাপকদের ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছে কী না
একটু জেনে নিই। ততক্ষণ একটু অপেক্ষা করুন।” দু-তিন মিনিট পর জানালেন “অধ্যাপকদের ঢুকতে বাধা দিচ্ছে না। লাল্টু আসেনি তবে শফিকে বলেছি আপনাকে
চা দেবে।” ফোনটা রেখে গাড়ি স্টার্ট দিতে যাব এমন
সময় যে ছাত্র আসার কথা দিয়েছিল সে তার নিজস্ব গাড়িতে হাজির। দেরী হওয়ার জন্য কিছু ওজর পেশ করলেন
আর তাঁর গাড়িতেই যেতে বললেন। শেষে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় পৌঁছালাম। কম্পিউটার বিশেষজ্ঞকে আমার তৈরী করা চিঠিটা দেখিয়ে স্ক্যান
করে মেল করতে বললাম। চিঠিটা তিনি আমার কম্পিউটার থেকে পাঠাতে চাইলেন। সেদিন আমি অন্যদিনের মত ল্যাপটপ ছাড়াই
গিয়েছিলাম। উনি বললেন ওটা হলে ভাল হোত। আমার কিউবিকলে সামনেই বসেছিলেন এক প্রাক্তন
ছাত্র (বর্তমানে একটা মেয়েদের কলেজের অন্যতম পপুলার অধ্যাপক)। তিনিও কম্পিউটারে যথেষ্ট পারদর্শি। তিনি বললেন কম্পিউটারে স্ক্যান করে
স্মার্ট ফোন দিয়েও মেল করা যাবে। উভয়কে চেষ্টা করতে বললাম। তারপর নব্য অধ্যাপকের সঙ্গে তাঁর গবেষণার বিষয় নাজিব মাহফুজ সম্পর্কে কথা হতে থাকে। প্রায় সাড়ে চারটেই উঠে পড়ি। বাড়িতে স্ত্রী একা বিশেষ করে যে সঙ্কটের
মধ্যে আছেন তাঁকে বেশিক্ষণ একা রাখতে সাহস পাইনি।
সেদিন
রাস্তাতেই মগরীবের আজান হল। বাড়ি পৌঁছে ছাত্রটির ইমামতিতে মগরীব আদায় করি। তাঁর মুখ থেকে সূরা ওয়াক্বেয়া এবং সূরা
মুল্ক শুনি। চা খেতে খেতে কথা হয়। তিনিও তাঁর স্ত্রী ও বাচ্চাদের জন্য বাড়ি ফিরতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। তাঁর কাছে বিভিন্ন বিষয় বিশেষ করে তাঁর
গবেষণা কেন্দ্রীক কথা জানতে চাই। চাপা বিরক্তির সঙ্গে বলেন “স্যার স্ত্রীকে আজ করোনা প্রতিষেধক ভ্যাকসিন দেওয়ালাম
তার জন্য জ্বর এসেছে। আজ অনুমতি দিন কাল ঠিক আসব।” কাউকেই ধরে রাখা যায় না। যেতে দিতে হয়।
পরের
দিন বুধবার (২৭-১০-২০২১)। আমি নিজে স্বগোতক্তি করতে থাকি ‘সেল্ফ হেল্প ইজ দ্য বেষ্ট হেল্প’। আজ আমাকে কলেজস্ট্রীট ব্যাঙ্কে যেতেই
হবে। কলকাতায় ইদানিং গাড়ির পার্কিং পাওয়া
যায় না। অটোতে তিনবার ভেঙ্গে ভেঙ্গে দশটা চল্লিশ
নাগাদ পৌঁছালাম কলেজস্ট্রীটের ব্যাঙ্কের কাছে। ব্যাঙ্কের সিঁড়ি ভাঙ্গার পূর্বে ভাবলাম
কিংকোং-এর হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকানের দরজার কাছে ফুটপাথের এক পাশে মেকশিফ্ট চায়ের দোকানে ঢুঁ মারলাম এক কাপ চায়ের
জন্য। সেখানে ছোট্ট বেঞ্চিতে বসা একজন ফকির
সাহেবকে মুখের মাস্ক সরিয়ে দিয়ে বসে বসে বিড়ি ফুঁকতে দেখি। বেঞ্চের অন্য প্রান্তে আমি সন্তর্পণে
যতদূর সম্ভব দূরত্ব বজায় রেখে বসি। দেখি চা-ওয়ালা গায়েব। ফকির সাহেব বিড়ির ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে
আমাকে বললেন “ও দুধ আনতে গেছে। আমাকে বিশ্বাস করে তো তাই বসিয়ে রেখে
গেছে।” বললাম ‘আপনাকে ফকির সাহবে দেখে বিশ্বাস করেছে?’ উত্তরে অনেক কিছু বললেন যার সারমর্ম
কিছুটা এরকম। “এই জলিল যে সে বান্দা নয়। এই এলাকার অনেকেই আমাকে চেনে এমনকি
চার চারটে থানার বড়বাবুরাও আমাকে চেনে। থানায় ডেকে বড় সাহেবরা আমাকে চা-সিগারেট খাওয়ায়।” তাঁর কথাগুলো শুনি আর অবাক হই। জিজ্ঞেস করি ‘তা থানায় যেতে হয় কেন?’ বললেন “রাস্তার অবুঝ কিছু পুলিশ নানা রকম সন্দেহ
করে আমায় থানায় নিয়ে যায়। আমি এই জালালের জালালি দেখাতেই সব বড় বড় পুলিশদের চক্ষু চড়ক গাছ। তখন চলে আমার খাতির।” আমি আরও অবাক। তিনি বলে চলেন “তা আমার জালালি কি আর এমনি হয়েছে মক্কা-মদিনা দশ বার গিয়েছি। পেলেনে বিড়ি পান খেতে দেয় না। আট দশ ঘন্টা পেচ্ছাব-পায়খানা চেপে রাখতে হয়। তাও যাই বাবার টানে।” বলি ‘ওখানে বাবার টান?” বললেন “তবে আরকি বলছি। আমি যে সে লোক নই আমার সঙ্গে যে সুস্থ
লোককে নিয়ে যাই তার পেলেন ভাড়া আমার জন্য অর্ধেক।” জিজ্ঞেস করি ‘তা সেখানে যাওয়ার যোগাযোগ করেন কী করে?’ বললেন “সে-সব খোঁজখবর রাখতে হয়। এই কলকাতাতেই সব আছে। আপনাকে আমার পছন্দ হলো ব’লে বলছি নয়লে আমার মতো খোঁড়া-ল্যাংড়ারা
জিজ্ঞেস করলে আমি তাঁদের বলি না।” বললেন “মৌলালির কাছেই রাস্তার ধারে একটা পার্ক
আছে। পার্কের উল্টো দিকে একদিকে হ্যান্ডিক্যাপদের
জন্য একটা আপিস আছে। জানেন তাদের কতগুলো পেলেন?” বলি জানি না তো’! বলেন “ন’টা।”
তিনি
বলে চললেন “ওরাই আমার পেলেনের ব্যবস্থা করে মক্কা পাঠায়। তা দশ দশ বার মক্কা-মদিনা গিয়েছি। বাবার ঠাঁই দেখে এসেছি।” আমি অবাক ‘বাবার ঠাঁই’ শুনে। আমাকে চুপ করিয়ে বললেন “পেলেনে বিড়ি খেতে দেয় না জানেন?” বলি ‘না জানা নেই’। দ্বিগুণ উৎসাহে বলে চলেন “আমি সারা ভারতবর্ষ ঘুরেছি। তারকেশ্বর মন্দির থেকে সব মাজার আমার
মুখস্থ। আজ আজমির থেকে ফিরে খড়গপুরে বাড়ি না
গিয়ে ভাবলাম কলকাতাটা ঘুরে যাই। নইলে সাধারণত আমি শুক্রবার কলকাতা আসি।” আরও বলে চলেন “কোনো ট্রেনে আমার টিকিট লাগে না। এইতো আজামির থেকে মেল ট্রেনে ফিরছি। চেকার বলল ‘এই ফকির সাব ইধার আও’। আমি হুঙ্কার দিয়ে বললাম “তুম ইধর আও। আমি সুন্দর বনে বনবিবির ওরসেও যাই। সুন্দর বনের বাঘের কথা জানি। আমি বাঘের মত গর্জে উঠি। অনেকেই ঘাবড়ে যায়। টিকিট চেকার আমার কাছে এসে বলে “এক সাইড মে আরামসে সো যাও। ঘাবরানা নেহি। হাম তো মাজাক কর রাহা থা।” বললেন “কিছু বুঝলেন?” বললাম ‘একটু আধটু বুঝলাম। আর একটু খোলসা করুন’। গর্বের হাসি ছড়িয়ে বললেন “আমি যে বিদ্যে জানি তাতে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খায়।” আমি বিস্ফারিত নেত্রে ফকির সাহেবকে
দেখতে থাকি। বলেন “আমার কাছে একটা জিনিষ আছে আপনাকে ভালো
লাগল ব’লে বলছি।” ইতিমধ্যে চা-ওয়ালাকে বলেছিলাম দু’কাপ স্পেশাল চা করতে। এক কাপ ওনাকে দিতে খুব প্রীত হলেন। বললেন “মনে হচ্ছে আপনি লোকটা ভাল। তবে অনেক ঝামেলা-সমস্যায় জড়িয়ে আছেন। শরীরও আপনার ভাল নেই। ব্যাথা-বেদনা আর অন্যান্য সমস্যায় জর্জরিত। আপনার বাড়িতেও শান্তি নেই।” আমি অবাক। আমার সম্বন্ধে এত কিছু উনি কী করে জানলেন! বললেন “আপনাকে একটা জিনিষ দেব আপনার সব সমস্যা
মিটে যাবে।” জিজ্ঞেস করলাম ‘ঘরে শান্তি ফিরবে?’ বললেন “অবশ্যই।” বললাম ‘স্ত্রী আমার বশীভূত হবে?’ বললেন “একেবারে ভেড়া হয়ে যাবে।” আমি বললাম ‘আপনার ওই জিনিষটার দাম কত?’ ধমক দিয়ে বললেন “দাম বলতে নেই জানেন না? সে যাইহোক অন্যদের কাছে একটু বেশি হাদিয়া
নিই, আপনি তার অর্ধেক একান্ন টাকা দেবেন।” একটা সিগারেট উনার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললাম ‘ব্যঙ্কের একটা কাজে এসেছি। ক’বার এলাম কাজটা এখনও হচ্ছে না’। উনি বললেন “দাঁড়ান আমার ওই জিনিষটা একবার ছুঁয়ে
যান। দেখি আপনার ওই আটকে যাওয়া কাজ হয় কি না।” উনাকে বললাম “মিনিট পনেরো বসুন। আরও চা-বিস্কুট খান। আমি পয়সা দিয়ে দেব।” ব্যাঙ্কের কাজে দেড় ঘন্টার বেশি লাগল। কিন্তু কাজগুলো হলো।
তাড়াতাড়ি
ব্যাঙ্কের সিঁড়ি দিয়ে নামলাম ফকির সাহেবের কাছ থেকে ওই অমূল্য জিনিষটা নিতে। সেটার কার্যকারিতার মধ্যে ঘরের শান্তির
এবং স্ত্রীকে বশিভূত করার জন্যে ওই রকম মোক্ষম জিনিষটার আমার আষু প্রয়োজন। চায়ের দোকানে এসে দেখি ফকির সাহেব চলে
গেছেন। চা ওয়ালা বলল “আপনি যাওয়ার পর ঠিক পনেরো মিনিট অপেক্ষা
করে চলে গেলেন।” জিজ্ঞেস করলাম “কোন দিকে গেল বলতে পারেন?” বললেন “তা খেয়াল করিনি।”
ফকির
সাহেবের মুখনিঃসৃত কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরছিলাম। উনি তো বলেছিলেন ‘ওই একান্ন টাকা উনি ব্যক্তিগত ভাবে
ভোগ করবেন না। ওই টাকা মক্কায় একটা ডেগ আছে তাতে চাল
কিনে দেবেন। দশটায় চাল দেবেন পরের দিন দশটায় সেই
চাল ফুটে এক ডেক হয়ে যাবে। সেই ফুটন্ত খিচড়ি থেকে এক মুঠো তুলে খাবেন। “হাত পুড়বে না।” কত আশ্চর্য কথা শুনলাম। আমার একটু ভুলের জন্য ওনার কাছ থেকে সেই তাবিজটা নেওয়া হল না। বাড়ি পৌঁছে স্ত্রীকে বলছিলাম। কাজের মাসিও শুনছিল। আমার স্ত্রী বললেন “আমার সদ্য হারানো গলার হারটার জন্যে
ওনাকে বললে না কেন?” কাজের মাসি বলল আমার জন্য একটা তাবিজ নিতে হত। বললাম দেখি শুক্রবার না হয় ওখানে এক
বার যাব। যদি দেখা পাই একটা নয় কয়েকটা তাবিজ
নেব। অনেকেরই তো অনেক সমস্যা। আশ্চর্য মলমের মত একটা তাবিজেই যদি
সব সমস্যার সমাধান হয় সেটা নিতে দোষ কি! ওই তাবিজের বহুবিধ গুনাগুণের শুধু কয়েকটা
উল্লেখ করলেই সেটা নেওয়ার জন্য অনেকেই হুমড়ি খেয়ে পড়বেন জানি। ডিমান্ড সাপ্লাই থিওরি অনুযায়ী আমিও
দু-পয়সা কামিয়ে নিতে পারি। এখন আমার প্রতি শুক্রবার কলেজস্ট্রীট এলাকায় ওই ফকির সাহেবকে খোঁজার ডিউটি চাপল। হয়ত আমার দশা হবে ‘খ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফেরে তাবিজ ফকির।’
বিঃ দ্রঃ
আমি সবিনয়ে
স্বীকার করিতেছি যে, আমি সত্যবাদী যুধিষ্ঠির নহি। আমি আদালতে অঙ্গিকার করিবার মত “সত্য বলিব সত্য ছাড়া মিথ্যা বলিব না” বলিয়া লেখনীর জন্য কোথাও অঙ্গিকার করি
নাই। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের বর্ণ
পরিচয় ও তাঁহার প্রথম ভাগ ও দ্বিতীয় ভাগও মনোযোগ সহকারে পড়া হয়
নাই। তাই “সদা সত্য বলিবে কদাচ মিথ্যা বলিবে না। যে মিথ্যা কথা বলে তাহাকে কেহ ভালোবাসে
না” ইত্যাদি সত্য কথাগুলি আমার উপর প্রযোজ্য নহে বলিয়া আমার বিশ্বাস। বরং ধরিয়া লইতে পারেন যে কিছুটা কমলাকান্তের
মত আফিমের ঘোরে না হোক অন্য তামাকের ঘোরে এই অধমের লেখনী সত্য হইতে কিছুটা হইলেও বিচ্যুত
হইয়াছে। স্বীকার করিতে বাধা নেই যে উপরোল্লিখিত
ফকির সাহেবকে চিত্রিত করিতে সযতনে শঠতা অবলম্বন করিয়াছি। তাঁহার সঠিক মূল্যায়ন না করিয়া আধ্যাত্মিক
মর্যদা সম্পন্ন অ অন্তরদৃষ্টি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব প্রতিপন্ন করিয়াছি। এমনটা করার উদ্দেশ্য আমার পাঠককুলের মনোরঞ্জন।
আমার
চাতুরি ধরিবার মত বহু জ্ঞানীগুণী পাঠক আছেন তিনারা ফকির সাহেবের জারিজুরি নিশ্চিত ধরিয়া
ফেলিয়াছেন। আমাকেও হয়ত ভুল ও দূষিত খবর পরিবেশন করার জন্য কাঠগড়ায় দাঁড় করাইতে পারেন। কর জোড়ে ক্ষমাপ্রার্থি। যদি আপনাদের অমূল্য সময় নষ্ট করিয়া
সত্যসন্ধানী হইতে চাহেন আমি ফকির সাহেবের যথাযোগ্য মূল্যায়ন করিব। এবং স্বীকার করি ধুঁয়াশার কুহেলিকা
না ছড়াইয়া নির্মল ও উজ্জ্বল সত্য উদঘাটিত করিব। সর্বশেষে সকলকে অনুরোধ করিব ‘ঠগ হইতে সাবধানে থাকিবেন’।।
সল্টলেক, কোলকাতা
০৩-১১-২০২১
স্যার,খোয়া যাওয়া হারের বিষয়টা অজ্ঞাত থেকে গেলো।
ReplyDeleteঅসাধারণ,সার্থক ছোট গল্প।