Friday 30 December 2022

সম্পাদকীয়ঃ নাস্তিকের ধর্ম-সংকট


নাস্তিকের ধর্ম-সংকট
 
ধর্ম যেমন একটি সংস্কৃতি ও জীবন ব্যবস্থা। নাস্তিকতা তেমনি একটি সংস্কৃতি ও জীবন ব্যবস্থা। ধর্ম যেমন একটি দর্শন। নাস্তিকতাও একটি দর্শন। মানব সভ্যতার ইতিহাসকে ধর্ম এক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে। নাস্তিকতা ভিন্ন একটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে। ধর্ম ও নাস্তিকতা বিজ্ঞানকে বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করে। উভয়ের দাবি, বিজ্ঞান তাদের পৈতৃক উত্তরাধিকার। পৃথিবীর সকল ধর্মে বিশ্বাসীরা যেমন ঐক্যবদ্ধ নয়। নাস্তিকরাও ঐক্যবদ্ধ নয়। উভয়ের অসংখ্য দল ও উপদল আছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসে ধর্ম বিশ্বাসীরা অধিকাংশ সময় মূলস্রোতের শক্তি। নাস্তিকরা চিরকাল প্রান্তিক শক্তি। আধুনিক বিজ্ঞানীদের কত শতাংশ নাস্তিক আর কত শতাংশ ধর্মবিশ্বাসী সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য কোনো পরিসংখ্যান আছে বলে আমার জানা নেই। তবে বিজ্ঞানীরা যে সব জান্তা নয়, সেটাও মাথায় রাখতে হবে। ডারউইন বড়ো বিজ্ঞানী না আইনেস্টাইন; এবং ধর্ম বিষয়ে তারা কি অভিন্ন মত পোষণ করতেন— সেসবও ভেবে দেখার বিষয়।
 
পৃথিবীর সুদীর্ঘ ইতিহাসে নিকট অতীতে স্বঘোষিত নাস্তিকরা পৃথিবীর বিশাল একটি অঞ্চলে কিছু কাল শাসন করেছিল। তারা কত শান্তিপ্রিয় ও সৃজনশীল তা এখন প্রমাণিত হয়েছে। হাজার হাজার বছরের মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক শতাব্দী বা অর্ধশতাব্দী কিছুই না। ওই সব অঞ্চলের এক সময়ের গর্বিত নাস্তিকরা এখন আবার পূর্বপুরুষের ধর্মে ফিরে এসেছে। নাস্তিকরা এখন পৃথিবীর কোথাও ক্ষমতাসীন নয়। কোনো সমাজে মূলস্রোতের শক্তি নয়।
 
এ রাজ্যের বাঙালি নাস্তিকরা বাম শাসনামলে সমাজের মূলস্রোতের শক্তি রূপে সমাজে বেশ প্রভাব বিস্তার করেছিল। তবে তাদের অভিন্ন পরিচিতি ছিল না। হিন্দু নাস্তিক, মুসলিম নাস্তিক, ব্রাহ্মণ নাস্তিক ও দলিত নাস্তিক বলে তারা পরিচিত হয়েছিল। বাম সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী শ্রী সুভাষ চক্রবর্তী নিজেকে একবার ব্রাহ্মণ নাস্তিক বলে পরিচয় দিলে বাঙালি মুসলিম এক নাস্তিক বলেছিলেন, “না সুভাষ, ব্রাহ্মণ নাস্তিক, হিন্দু নাস্তিক ও মুসলিম নাস্তিক বলে কিছু হয় না।” জানি না, তার সেই পবিত্র প্রবচন হিন্দু নাস্তিকরা গ্রহণ করেছিল কিনা। তবে মুসলিম নাস্তিকরা তার নীতিকথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে ছিল। তারা মুসলিম সমাজ থেকে ধর্মের প্রভাব উৎপাটন করতে দারুন ভাবে সচেষ্ট হয়েছিল। এই নাস্তিকরা সে-সময় মসজিদ ও মাদ্রাসা কমিটির শীর্ষে বসে মসজিদ ও মাদ্রাসা ভিত্তিক মুসলিম সমাজের ঐক্য ও সংহতিকে চুরমার করে দিয়েছিল। মসজিদ ও মাদ্রাসার জমি ও সম্পদগুলো মুসলিম কমরেডদের সঙ্গে নিয়ে লুটপাট করেছিল। মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে আপস মীমাংসার একটি গ্রাম্য সমাজ ও সভা থাকে। তারা সেগুলোকে দখল করেছিল। তাদের আধিপত্য এতটাই অতিরঞ্জিত ছিল যে, এক সময় মুসলিম সমাজের অস্তিত্ব প্রায় বিপন্ন হতে বসেছিল। অন্যদিকে, হিন্দু সমাজে তাদের নাস্তিক্য প্রভাব তেমন শক্তিশালী ছিল না। প্রভাবশালীও ছিল না। তাদের শাসন কালে কোলকাতা শহরের পথে পথে হাজার হাজার হিন্দু বেদি ও মন্দির গড়ে উঠেছে। গ্রামে গ্রামে আর এস এস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের ও বজরঙ দলের শাখা গড়ে উঠেছে। বাবরি মসজিদ ভেঙে মন্দির বানানোর জন্য এখান থেকে হাজার হাজার ইঁট গেছে উত্তর প্রদেশে। আদবানিরা নির্বিঘ্নে হিন্দুদের সুড়সুড়ি দিয়ে বেড়িয়েছে। কোনো অসুবিধা হয়নি। কিন্তু কোনো মুসলিম মহল্লায় জামায়াতে ইসলামীর মোকামী শাখা গড়ে উঠেছে। তবলীগ জামাতের নিরীহ চিল্লা পার্টি মসজিদে এলে তাদের তৎপরতার শেষ ছিল না। তাদের বক্তব্যে রাজনীতি আছে কিনা তার বিশ্লেষণ হত। তখন বামপন্থী লোকাল কমিটি, জোনাল কমিটি, জেলা ও রাজ্য কমিটি থেকে জবাবদিহি চাওয়া হয়েছে মুসলিম নাস্তিক কমরেডের কাছ থেকে। মুসলিম সমাজের ধার্মিকতা ও মুসলিম সংগঠনের সক্রিয়তার জন্য মুসলিম কমরেডকেই দায় নিতে হতো। জবাবদিহি করতে হতো।
 
তাদের গালভরা দাবি ছিল, হিন্দু নাস্তিক বামপন্থীরা একক ও একমাত্র মৌলবাদ বিরোধী শক্তি।  সকলেই জানেন, তারা গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকে রাজ্যে হিন্দু তরঙ্গ রুখতে চুড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছিল। হিন্দু মৌলবাদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। তারা প্রায় সব সময় বলত, তারা হিন্দু ও মুসলিম বলে কাউকে বিচার করে না। তারা সকলকে মানুষ বলে বিবেচনা করে। কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি তাদের বৈষম্য ছিল ভয়ঙ্কর। মন্ত্রীসভায় তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল প্রতিকী। সাংগঠনিক ক্ষেত্রে তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল প্রতিকী। পশ্চিমবঙ্গের মাত্র দু’টি জেলায় মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। গত চল্লিশ বছর বামপন্থী প্রগতিশীল দল কোনো মুসলিমকে জেলা সভাপতি করেনি। কারণ তারা নাকি সাম্প্রদায়িকতাকে প্রোৎসাহিত করতে চায়নি। কিন্তু হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাতেও কখনো মুসলিম বামপন্থীদের সভাপতি অথবা গুরুত্বপূর্ণ পদে অভিষেক করেনি। তিন দশকের অধিক কাল ধরে তারা এই অপকর্ম করেছে। নির্বিঘ্নে। তারা তো মুসলিম নেতৃত্বের অস্তিত্বকে নির্মূল করে দিয়েছিল। কোনো মুসলিম ব্যক্তি মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব বিষয়ে প্রশ্ন তুললে তাকে মৌলবাদী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে তারা তার তীব্র নিন্দা করত। শুধু তাই নয়, তারা প্রশ্ন তুলতো, মুসলিম হলে মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থ বিষয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার হয় না। মুসলিম সম্প্রদায় যে প্রগতিশীল বামপন্থী হিন্দুদের নির্বাচিত করেছে তারাই তাদের আইনসম্মত প্রতিনিধি। এমনকি তারা সাচার কমিটির রিপোর্টকে ভুল ও ত্রুটিপূর্ণ প্রমাণ করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। যাক এসব প্রসঙ্গ। এত কথা বলার অর্থ নাস্তিকরা ধর্মবিশ্বাসীদের শুধু বিশ্বাসকে ঘৃণা করে না । তাদের শাসন ব্যবস্থাকেও ঘৃণা করে। নিন্দা করে। তাদের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে ঘৃণা করে।
 
আমাদের মুসলিম সমাজে কিছু তথাকথিত বামপন্থী নাস্তিক বেশ সক্রিয়। মুসলিম ও ইসলাম বিষয়ে তাদের ঘৃণা অত্যন্ত কদর্য। তাদের দুঃখ, তাদের পরিচিতির সঙ্গে মুসলিম ও ইসলাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। দূর্ভাগ্য এই জড়িয়ে যাওয়া এখন তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। তাদের গলগ্রহ হয়ে গেছে। তারা মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে এতো বলছে তাও তাদের সতীর্থ প্রগতিশীল নাস্তিক হিন্দুরা তাদের বিশ্বাস করে না। তাদের পরিচিতি গুলিয়ে দিচ্ছে। তারা এখন চরম সংকটে। এক দুর্ভেদ্য চক্রব্যূহে। আমার ধারণা, এই চক্রব্যূহ ভেদ করার তাদের কাছে এখন আর কোনো সুস্থ ও সম্ভাব্য উপায় ও অবকাশ নেই।
 
নুরুল ইসলাম নূরানি

No comments:

Post a Comment