আবু বাক্র (রাঃ)-এর গুণাবলী ও
ইসলামের সংকটের মুহুর্তে তাঁর অবদান
সাহাবাদের মধ্যে সব চেয়ে বেশী মর্যাদাপূর্ণ ব্যক্তি হলেন আবু বাক্র (রাঃ)। বলা বাহুল্য আল্-কুর্আনে আবু বাক্র (রাঃ)-কে রাসূল (সাঃ)-এর “সাহেব” বা সাথী বলে অভিহিত করা হয়েছে। মাক্বী ও মাদানী জীবনে রাসূল (সাঃ)-এর শ্রদ্ধাভাজন বন্ধু ও ইসলামের পরম খেদমতকারী ছিলেন আবু বাক্র (রাঃ)। নবীজির প্রিয়তমা স্ত্রী মা আয়েশা (রাঃ)-এর পিতা। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন অমায়িক, সাবলীল, দৃঢ়, মিতব্যয়ি, দানশীল ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তি। কুরাইশদের সর্দার ও প্রথম সারির নেতাও বটে। কেবল ইসলাম গ্রহনের খাতিরে তাকে অন্য কাফের শ্রেনীরা অবাঞ্চিত করেছিল। মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ওফাতের পর যে চারজন খলিফা ইসলামের পতাকা অতি উচ্চে তুলে ধরেছিলেন তাদের মধ্যে আবু বাক্র (রাঃ) ছিলেন অন্যতম। তিনি নবী (সাঃ)-এর বাল্যবন্ধু ও খেলার সাথী ছিলেন।
মুহাম্মদ (সাঃ) যখন ইসলামের দাওয়াত প্রচার শুরু করলেন তখই আবু বাক্র (রাঃ) রা ইলাম ধর্ম গ্রহন করেন। আবু বাক্র (রাঃ) ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ইসলামের সেবায় নিজের জীবনকে বিলিয়ে দেন। আবু বাক্র (রাঃ) ইসলামের ইতাহাসে একজন ক্ষণজন্মা হিসেবে স্মরনীয় হয়ে থাকবেন। রাসূল (সাঃ)-এর ওফাতের পর আবু বাক্র (রাঃ) খোলাফায়ে রাশেদীনের প্রথম খলীফা হিসেবে ইসলামের এক সংকটময় মুহূর্তে ক্ষমতা গ্রহণ করেন।
একদিকে নব্যুয়তের প্রতি ইর্ষান্বিত বেদুইণদের হিংষা, অমুসলিমদের চক্রান্ত, ভন্ড নবীদের প্রাদুর্ভাব, অভ্যন্তরীণ গোলযোগ ও বিশৃঙ্খলা, বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন ও ধর্মদ্রোহী কার্যকলাপ, ভণ্ড নবীদের আবির্ভার ও বহিঃশত্রুর আক্রমন, ইহুদি ও খ্রিষ্টানদের ষড়যন্ত্র ইত্যাদি ইসলাম ধর্ম এবং নব প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্রকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেয়।
অপরদিকে সদ্য গ্রহন করা মুসলিম সমাজ মনোবৃত্তির পাছে পড়ে ইসলামকে বিকৃত ও কাটছাট করার লিপ্সায় লিপ্ত হয়ে জাকাত-ওশর সদকা ইত্যাদিকে অস্বীকার করে বসে। মোটকথা ভিতর ও বাহির থেকে ইসলামের এক চরমযূগসন্ধিক্ষনে আবু বাক্র (রাঃ)-এর খেলাফাতকাল আরম্ভ হয়। রাসূল (সাঃ)-এর ওফাতে উৎসাহ পায় চক্রান্তকারী বিধর্মীরা। রোম-পারস্য ও বেদুঈন সর্দারদের অশুভ চক্রান্তের মোকাবিলা করতে হয় আবু বাক্র (রাঃ)-কে। আর তিনি ত্রাণকর্তারূপে সকল বিরূপ পরিস্হিতির মোকাবিল করেন এবং ইসলাম ও মুসলিম জাতিকে মহান আল্লাহর রহমতে অনিবার্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেন।
মুহাম্মদ (সাঃ) ৬১০ খ্রিষ্টাব্দে আল্লাহর নিকট থেকে ঐশীবাণী লাভ করে উদাত্ত কণ্ঠে আল্লাহর একত্ববাদে বিশ্বাস স্হাপনের জন্য আহ্বান জানালে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে সর্বপ্রথম আবু বাক্র রা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি শুধু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেই ক্ষন্ত থাকেনি বরং নবী করীম (সাঃ) এর সাথে ইসলাম প্রচারেও আত্মনিয়োগ করেন। তার প্রচেষ্টায় ওসমান, যুবাইর, আবদুর রহমান ইবনে আউফ, সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) প্রমুখ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তিনি নবী (সাঃ)-এর মিরাজের ঘটনাকে সর্বাগ্রে এবং নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে ছিলেন। আর তাই তাকে রাসূল (সাঃ) “সিদ্দিক” উপাধিতে ভূষিত করেন।
আবু বাক্র (রাঃ) কুরাইশদের মধ্যে অন্যতম সম্পদশালী ব্যাক্তি ছিলেন। যিনি তার সমুদয় সম্পদ ইসলামের সেবায় উংৎসর্গ করে ‘আতীক উপাধি লাভ করেছিলেন। ধন-সম্পত্তি ইসলামের সেবায় উৎসর্গ করে আবু বাক্র (রাঃ) তৃপ্তিবোধ করতেন। এ প্রসজ্ঞে নবী (সাঃ) বলেছেন, আবু বাক্রের ধন-সম্পত্তি অপেক্ষা অন্য কারো সম্পদ অধিক উপকারে আসেনি । আবু বাক্র (রাঃ)-এর সম্পদ সাধারণত যুদ্ধের ব্যবস্থাপনায় ও দাসমুক্তির কাজে ব্যবহৃত হয়েছে।
আবু বাক্র (রাঃ) প্রকাশ্যভাবে ইসলাম প্রচারের জন্য কুরাইশদের দ্বারা অসংখ্যবার নির্যাতিত হয়েছেন। তবুও তিনি কখনো নবী করীম (সাঃ) এর সাহচর্য ত্যাগ করেন নি । বরং শত অত্যাচার র্নিযাতন সহ্য করে মহানবী (সাঃ)-এর পাশে থেকে তাকে ইসলাম প্রচারে সাহস ও উৎসাহ জুগিয়েছেন।
৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায় হিজরতের সময় আবু বাক্র (রাঃ) নবী (সাঃ)-এর সঙ্গী হিসেবে গমন করেন এবং সাওর পাহাড়ের গুহায় উভয়ে একত্রে আত্নগোপন করেন। নবী (সাঃ)-কে রক্ষা করতে তাঁর সাপের গুহা নিজ হাতে আটকে দেওয়ার কথা আমাদের সবার জানা।
নবী (সাঃ)-এর মৃত্যু সাহাবাদের জীবনে চরম অনাকাংঙ্খিত একটি ঘটনা, এ ঘটনার শোক ও আকাষ্মকিয়তায় সাহাবাদের মধ্যে চরম অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। অপরদিকে মুনাফিক্ব এবং অমুসলিম সমাজে নুতন ষড়যন্ত্রের পায়তারা দানা বেধে উঠেছিল। তেমনি ভাবে খিলাফতেকে কেন্দ্র করে চরম রাজনৈতিক অচলাবস্হার সৃষ্টি হয় । এ অচলাবস্হার ফলে নকল প্রতিষ্ঠিত ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলাম ধর্ম চরম হুমকূর সম্মুখীন হয়। এ অবস্হায় আবু বাক্র (রাঃ) তার অসাধারণ মেধা ও মননকে কাজে লাগিয়ে অন্যান্য বিশিষ্ট সাহাবীদের সংঙ্গে নিয়ে অচঅবস্হার শান্তিপূর্ণ সমাধান করেন। সকলের সম্মতিতে তিনি খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করে ইসলাম ধর্মও ইসলামী রাষ্ট্রকে বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেন।
গোত্র সর্দার প্রভাবশীল ভণ্ড নবী মুসায়লামাকে দমন করতে গিয়ে রক্তক্ষয়ী ইয়ামামার যুদ্ধে মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করলেও ৬০০ মুজাহিদ শহীদ হন। ওদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন কুরআনের হাফিজ। ফলে ভবিষ্যতে কুরআন সংরক্ষন হুমকির সম্মুখীন হয়। এমতাবস্হায় আবু বাক্র (রাঃ) উমার (রাঃ)-এর পরামর্শে জায়েদ বিন সাবিত (রাঃ)-কে কুরআনের বাণীগুলো সংগ্রহ করে পুস্তকাকারে লিপিবদ্ধ করার র্নিদেশ দেন। আর এই সংকলতি কুর্আনকে মুস্হাফুল্ আক্বার বা আল্-জামে’-ও বলা হয়। ইতিপূর্বে লিখিত কুর্আনের সকল আয়াতকে তিনি যোগ্য সাহাবাদের জামা‘আতের মাধ্যমে একত্রিত ও সংকলিত করেন।
মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ওফাতের পর ভণ্ড নবীরা মদিনাভিমুখে অগ্রসর হওয়ার প্রয়াস পেলে আবু বাক্র (রাঃ) ওদের দমনের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন। তিনি তাদেরকে আত্মসর্মপণ করার কঠোর নির্দেশ দান করেন। অন্যথায় যুদ্ধ অনিবার্য বলে ঘোষণা করেন। এ সময় তিনি নিজে প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অপরদিকে ওসমানকে ভন্ডনবী আসওয়াদকে দমনের জন্য সিরিয়া অভিযানের র্নিদেশ দান করেন। আসওয়াদ ছিল আনাস জাতির নেতা সে তার অনুচরদের নিয়ে দক্ষিণ আরবের ইয়েমন নগরে বাস করতো গ্রামের সরদারদের প্রভাবান্বিত করে আসওয়াদ এক বিরাট সৈন্যদল গঠন করে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। কিন্তু শেষ র্পযন্ত ওসমানের নেতৃত্বাধীন বাহিনীর হাতে তার মৃত্যু হয়।
আসওয়াদের মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে এবং মুসলমানদের রাজধানী মদিনা অবরুদ্ধ করার প্রয়াস পায়। আবু বাক্র (রাঃ) তাই মদিনা নগরীকে সুরক্ষিত করেন এবং সৈন্যবাহিনীকে ১১টি ভাগে বিভক্ত করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভণ্ড নবী ও ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে তাদের প্রেরণ করে। সেনাপতি খালিদ ৩৫০০ সৈন্য নিয়ে ভণ্ড নবী তোলায়হার বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তোলায়হা বনু তাইম বংশের উপর নির্ভরশীল ছিল। কিন্তু তায়িম বংশের নেতা আদি বিন হাতিম হযরত খালীদের পরার্মশে স্বীয় সম্প্রদায়কে তোলায়হার বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য বলেন। এভাবে খালিদ তোলায়হাকে র্দুবল করে ফেলেন এবং সহজেই পরাজিত করেন। তেলায়হা প্রথমত সাইবেরিয়াতে পলায়ন করে অবশেষে পুনরায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন।
আবু বাক্র (রাঃ)-এর আড়াই বছর খিলাফতকাল ইসলামের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মহানবী (সাঃ)-এর সহচর হিসেবে এবং নবী (সাঃ)-এর ওফাতের পর প্রথম খলিফা হিসেবে আবু বাক্র (রাঃ)-এর অবদান ছিল অপরিসীম। অরাজকতা, প্রতারণা, ভন্ডামি, ধর্ম ও দেশ দ্রেহীদের তিনি যোগ্যতার সাথে মোকাবিলা করে। তিনি নবী (সাঃ)-এর সাথে বদর, ওহুদ, খন্দক, তাবুক ও অন্যান্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং যুদ্ধের ব্যয়ভারের বড় একটা অংশ বহন করেন।
আবু বাক্র (রাঃ)-এর খেলাফত কালে মদিনা নগরীতে নবী (সাঃ)-এর বাণী শিক্ষা দেওয়ার জন্য সর্ব প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। আবু বাক্র (রাঃ) অনেক ক্রীতদাসকে নিজের অর্থ দিয়ে ক্রয় করে মুক্ত করে দেন। আবু বাক্র (রাঃ) ভণ্ড নবীদের পরজিত করে সমগ্র আরব উপদ্বীপে শন্তি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন।
স্বাধীনচেতা আরব জাতি ইসলামের কঠোর বিধি নিষেধ, কঠোর নৈতিক অনুশাসন ও সুশৃঙ্খল জীবনযাপন সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি। মুহাম্মদ (সাঃ)-এর ইন্তেকালের পর তারা উপর্যুক্ত বিধানসমূহের বিরুদ্ধে দলবদ্ধ বিদ্রোহ করে র্পূবর্বতী জীবন ধারায় ফিরে যায়। খলিফা আবু বাক্র (রাঃ) তাদের বিরুদ্ধে যথোপযুক্ত ব্যবস্হা গ্রহণ করে তাদেরকে ইসলামী জীবনধারায় ফিরিয়ে আনেন।
খলিফা হিসেবে আবু বাক্র (রাঃ)-এর অবদান সত্যিই অনবদ্য। অভ্যন্তরীণ বিশৃংঙ্খলা দূর, জাতীয় সংহতি অর্জন এবং ইসলামের প্রভাবসম্প্রসারণের পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করে তিনি পরবর্তী অগ্রগতির পথ সুগম করেন। ইসলামি জীবন ব্যবস্থা ও ইসলামি রাষ্ট্রের একনিষ্ঠ সেবা এবং বহুবিধ কৃতিত্বের জন্য তাকে ইলামের ত্রাণকর্তা বলা যায়। অধ্যাপক মূর-এর ভাষায়— “ইসলামের জন্মলগ্নে আবু বাক্র (রাঃ) বেদুঈন এবং মুর্তাদদের আক্রমণ থেকে ইসলামকে রক্ষা করেছেন”।
- আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
No comments:
Post a Comment