উসমান (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে
বিদ্রোহের কারণ ও তাঁর হত্যা
হযরত ওসমানের উপর বিদ্রোহের প্রধান কারণগুলি নিম্নে আলোচনা করা হলো—
হযরত ওসমান (রাঃ) কুরাইশদেরকে হযরত ওসমান (রাঃ) এর আমলে কুরাইশ ও অকুরাইশ জনগণের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা গুরুতর রূপ ধারন করেছিল। এ প্রতিদ্বন্দ্বিতা বসরা, কুফা ও ফুস্তাতে চরম আকার ধারন করে। এ স্থানগুলি ছিল ওসমান (রাঃ) এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের কেন্দ্রস্থল। কুরাইশগণ সকলে ওসমান (রাঃ)-এর সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ্য হলে খলিফার কতৃত্ত্বে হস্তক্ষেপকারী আরব দলগুলিকে দমন করা সম্ভব হতো কিন্তু হাশেম বংশীয়গণ উমাইয়া বংশের ক্ষমতা-বরদাস্ত করতে না পেরে দুশমনদের পক্ষ সমর্থন করেছিল। প্রথম দুই খলিফার আমলে আনসার ও মোহাজেরদের সমন্বয়ে যে একটি দক্ষ শাসক গোষ্ঠী গড়ে উঠেছিল, ওসমান (রাঃ) –এর আমলেও তাও বিশেষ কার্যকর হতে পারেনি।
ওসমান (রাঃ)-এর শাসনামলে কুরাইশদের লোভনীয় সুযোগ-সুবিধা ও প্রতিপত্তি অনারব মুসলমান সম্প্রদায়সমূহ ঈর্ষান্বিত হয়ে ওঠে। ওসমান (রাঃ)-এর আমলে ইসলামী সাম্রাজ্যের ভিত্তিতে আরবীয় মুসলমানদের সমকক্ষতা দাবি করে, তারা আরবীয় মুসলমানদের শ্রেষ্ঠত্ব গ্রহণ করতে অসমর্থিত জানায় ও হযরত ওসমান (রাঃ)-এর দূর্বলতার সুযোগ নিয়ে বিদ্রোহে উসকানি দিতে থাকে।
কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা আরবদের একটি পরিচিত ঘটনা। পরবর্তী খলিফাদের আমলের কঠোর শাসনের এ কেন্দ্রবিমুখতা মাথাচাড়া দিতে সাহসী হয়নি। কিন্তু হযরত ওসমান (রাঃ)-এর দূর্বল শাসনামলে এটি প্রবল শক্তি সঞ্চয় করেছিল। বার্নাড লুইয়ের মতেঃ- “তাঁর (ওসমান) বিরুদ্ধে বিদ্রোহ কোনো ধর্মীয় বা ব্যক্তিগত কারণে হয়নি। এ বিদ্রোহ ছিল কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধে যাযাবরদের বিদ্রোহ”।
হযরত ওসমান (রাঃ) কাবা ঘরের অসমাপ্ত কাজ করার জন্য অগ্রসর হন এবং ভগ্ন বাড়ির মালিকেরা ক্ষতিপূরণ নিতে অস্বীকার করায় তাদের কারাগারে নিক্ষেপ করেন, এতে জনসাধারণ ক্ষিপ্ত হয়, অন্যদিকে বিভিন্ন দেশ কুরআনের বিভিন্ন প্রকার ভূল পাঠের কথা শুনে ত্রুটিযুক্ত কুরআন পুড়িয়ে ফেলেন। এতে জনগণ তাঁর প্রতি ক্ষেপে যায়।
স্বার্থপর কূটনীতিবিদ মারওয়ান ওসমান (রাঃ)-এর দূর্বলতার সুযোগে রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা করায়ত্ব করেন। মারওয়ান চক্রান্ত ও ধ্বংসাত্মক নীতি ওসমান (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও তাঁর হত্যার জন্য অনেকাংশ দায়ী ছিল।
ঈয়েমেনী ইহুদী ভণ্ড মুসলমান আব্দুল্লাহ ইবনে সাবাহ ব্যাক্তিস্বার্থে অপপ্রচার করেন যে, হযরত আলী (রাঃ) জাতিসূত্রে এবং বৈবাহিক সম্পর্কে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর একমাত্র প্রকৃত উত্তরাধিকারী। এ অপপ্রচার ওসমান (রাঃ)-এর হত্যা ত্বরান্বিত করে।
হযরত ওসমান (রাঃ)-এর হত্যার পিছনে যে সমস্ত কারণ ছিল তা নিম্নে তুলে ধরা হলো—
দুস্কৃতকারীদের ব্যাপক প্রচার কার্যের ফলে দেশের সর্বত্রই ওসমান (রাঃ)-এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা যায়। জোরালো প্রচার কার্যের ফলে মহানবী (সাঃ)-এর অনেক সাহাবা ঘটনার সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে মনে করেন যে, প্রাদেশীক শাসন কর্তাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সত্য। তারা এর প্রতিকারের উদ্দেশ্যে খলিফার কাছে আবেদন জানায় খলিফা প্রতিত্তুরে জানায়, প্রাপ্ত রিপোর্ট অনুযায়ী প্রাদেশীক শাসনকর্তারা ঠিকই কার্য করেছেন।
হজ্ব যাত্রার ছলে বসরা, কুফা ও মিশরের দুস্কৃতীরা মদিনায় এসে তাঁবু ঘাটায়। মদিনা বাসীদের সমর্থন লাভে ব্যর্থ হয়ে বিদ্রোহী নেতারা মিশরের শাসনকর্তাকে সরিয়ে তদস্থলে মুহাম্মদ বিন আবু বকর-কে নিয়োগ করার জন্য খলিফা অনুরোধ জানায়। এই অনুরোধ খলিফা অত্যন্ত ভদ্রতার সাথে মেনে নেন এবং তাদের হাতে মনোনীত লোকের নিয়োগ পত্র তুলে দেন।
কয়েকদিন পরে দুস্কৃতকারীদের তিনটি দলই একই দিনে এবং সময়ে মদিনাবাসীদের বিস্মীত করে মদিনায় উপস্থিত হয়। হযরত আলী (রঃ) তাদের এ আগমন সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তারা মিশরের শাসন কর্তার কাছে খলিফার লিখিত একটি মোহরযুক্ত চিঠি দেখায়।
হযরত আলী (রাঃ) দুস্কৃতকারী দলের নেতাদেরকে খলিফার নিকট নিয়ে গেলেন ওসমান (রাঃ) শপথ করে বললেন যে, তিনি এ পত্র লেখেননি অথবা এটা সম্পর্কে কিছু জানেন না। ষড়যন্ত্রকারীরা কোনো কিছু শুনতে রাজী হলনা। তারা খলিফার পদত্যাগ দাবি করল। খলিফা এর উত্তরে বলল, আমি পদত্যাগ করবোনা।
একদিন মসজিদে খলিফা ওসমান (রাঃ) বক্তৃতা দিতে যাচ্ছিলেন এমন সময় তাঁকে বক্তৃতা দিতে দেওয়া হয়না। তাঁকে লাঞ্ছিত করে পাথরের উপর পাথর মারতে থাকে, খলিফা বেহুশ হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে তাঁকে গৃহে নিয়ে গিয়ে অবরোধ করে রাখেন।
বিদ্রোহী আর অপেক্ষা করা সমীচীন মনে করলোনা। তারা খলিফাকে হত্যা করার জন্য তৎপর হয়ে উঠে। সম্মুখের দরজার দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে না পেরে প্রতিবেশীর গৃহের দেয়াল টপকিয়ে গৃহে প্রবেশ করে, ওসমান (রাঃ) তখন কুরআন পাঠ করছিলেন, এ অবস্থায় দুজন ব্যক্তি তাঁর উপর চড়াও হয় এবং হত্যা করে, তখন তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর ,সালটি ছিল,৬৫৬ খৃষ্টাব্দের ১৭ জুন।
খলিফার সরলা, সহিষ্ণুতা ও নিরীহ প্রকৃতিকে চক্রান্তকারীরা তাঁর দূর্বলতা ও অক্ষমতা মনে করে সমগ্র কুফা, বসরা ও মিশরের ষড়যন্ত্রের একটি দূর্গে জাল বিস্তার এবং বিদ্রোহ দেখা যায়, খলিফা যদি প্রথম থেকে দৃঢ়ভাবে এসব বিদ্রোহের মূলোৎপাটন করতো তাহলে কখনই একটি ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ সংঘটিত হয়ে ইসলামের সংহতি ধ্বংস করতে পারতনা, এবং খলিফাকে হত্যার একটি ঘৃণ্য নজিরও সৃষ্টি হতো না।
-আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
No comments:
Post a Comment