নবী (সাঃ)-এর মক্কা জীবন
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ৫৭০ খৃষ্টাব্দে ২৯শে আগস্ট (মতান্তরে ৯ বা ১২ই রাবিউল আউয়াল) সোমবারের দিন বিখ্যাত কুরাইশ বংশের হাসেমী গোত্রে জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতার নাম আব্দুল্লাহ, মাতার নাম আমিনা, পিতৃব্য আবু তালিব এবং দাদার নাম আব্দুল মুত্তালিব।
জন্মের দুই সপ্তাহের মধ্যে অভিজাত আরবের প্রথা অনুযায়ী শিশু মুহাম্মদ (সাঃ)-কে বিবি হালিমাকে দুধমাতা হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। বিবি হালিমার নিকট তিনি লালিত পালিত হতে থাকেন। এর পর ছয় বছর বয়সে বালক মুহাম্মদ (সাঃ) মাতা আমিনার তত্বাবোধানে আসেন। কিছু দিন পর তিনি তাঁর মাতাকে হারান। ইয়াতিম মুহাম্মদ (সাঃ) এ সময় অসহায় হয়ে পড়লে দাদা আব্দুল মুত্তালিব তাঁকে বুকে আঁকড়ে ধরেন। দুই বছর পর তিনিও মৃত্যু বরণ করেন। তখন চাচা আবু তালিব তাঁর অভিভাবক নিযুক্ত হন।
ষোল বছর বয়সে মুহাম্মদ (সাঃ) ‘হরবুল ফুজ্জার’ যুদ্ধের বীভৎস তাণ্ডবলীলা দেখে অত্যন্ত মর্মাহত হন। এর প্রতিকারের জন্য কনিষ্ঠ পিতৃব্য যুবাইর ও অন্য কয়েকজন উৎসাহী যুবককে নিয়ে ৫৯৫ খৃষ্টাব্দে ‘হিলফুল ফুযুল’ গঠন করেন। এ সমিতির অন্তর্গত ‘ফজল, ফাজেল, ফাজায়েল ও মোফাজ্জেল এ চারজন বিশিষ্ট সভ্যের নামানুসারে এটা ‘হিলফ-উল-ফুযুল’ নামে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ।
কোমল স্বভাব ও অমায়িক ব্যবহারের জন্য শৈশব থেকেই মহানবী (সাঃ)-কে সকলেই আন্তরীক ভাবে ভালোবাসতো এবং শ্রদ্ধা করতো। সত্যের প্রতি গভীর অনুরাগ, সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, ন্যায়পরায়নতা প্রভৃতি গুণাবলীর জন্য তিনি ‘আল-আমীন’ বা ‘বিশ্বাসী’ উপাধি লাভ করেছিলেন।
খাদিজা (রাঃ) ছিলেন আরবের এক ধনাঢ্য মহিলা। খাদিরা (রাঃ) মুহাম্মদ (সাঃ) এর সত্যবাদিতা ও মহানুভবতার সুখ্যাতি শুরে তিনি তাঁকে ডেকে আনেন। নবী (সাঃ) এর উপর ব্যাবসার ভার অর্পন করেন। কিছু দিনের মধ্যে ব্যাবসাতে প্রচুর লাভ হয়, খাদিজা (রাঃ) নবী (সাঃ) এর কর্মদক্ষতা, বিশ্বস্ততা ও কতিপয় অলৌকিক ঘটনা প্রতক্ষ করে খুব খুশি হন এবং তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব করেন। অতঃপর পিতৃব্য সম্মতিতে নবী (সাঃ) খাদিজা (রাঃ)-কে বিবাহ করেন।
বিবি খাদিজা (রাঃ)-কে বিবাহের পর নবী (সাঃ) দৌন্য-দারিদ্রের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে নিজেকে স্রষ্টার ধ্যানে নিয়োজিত করেন। এ সময় মক্কার অদূরে “হেরা” পর্বতের গুহায় আল্লাহ্র ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। ৬২০ খৃষ্টাব্দে রমজান মাসের ২৭ তারিখে তিনি জিব্রাইল (আঃ) মারফত আল্লাহ্র পক্ষ হতে প্রথম ওহী বা নবুওত প্রাপ্ত হন।
নবুওত প্রাপ্তির পর মুহাম্মদ (সাঃ) ইসলাম প্রচারে নেমে পড়েন। তিনি প্রচার করতে থাকেন “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ মুহাম্মাদুর্ রাসূলুল্লাহ” (আল্লাহ্ এক তিনি ছাড়া অন্য কোনো উপাস্য নেই, মুহাম্মদ (সাঃ) তাঁর প্রেরিত দূত)। প্রথম তিন বছর তিনি গোপনে ইসলাম প্রচার করেন। এ তিন বছরে মাত্র ৪০ জন লোক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করনে। নবুওতের চার বছর পর তিনি ধর্ম প্রচার করতে থাকেন।
ইসলামের প্রতি কুরাইশদের বিরোধিতার প্রধান কারণগুলি নিম্নে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল—
ইসলাম মানুষকে একমাত্র আল্লাহ্র উপাসনা করতে শিক্ষা দেয়, এতে মূর্তি পূজার কোনো স্থান নেই, বরং একে তীব্রভাবে বিরোধিতা করা হয়েছে। অপরদিকে মক্কার কুরাইশরা ছিল মূর্তি উপাসক। তারা যুগ যুগ ধরে মূর্তি পূজায় অভস্থ ছিল। পূর্ব-পুরুষদের ধর্ম ত্যাগ করতে তারা রাজী ছিলনা। সুতরাং তারা মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রতি ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং তাঁর সাথে শত্রুতা করতে থাকে।
ধর্মীয় কারনের সাথে সামাজিক কারনও জড়িত ছিল। কুরাইশগণ, পূর্ব প্রচলিত বৈষম্যের স্থলে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার ঘোর বিরোধি ছিল। ইসলাম ধর্ম কুরাইশদের অন্যায় অভিজাত্য খর্ব করায় তারা এর বিরুদ্ধে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব হয়েছিল সাম্য ও ভাতৃত্য প্রতিষ্ঠার জন্য, এটি ধনী ও নির্ধন, স্বাধীন ও পরাধীণ এবং উঁচু-নিচুর সকল প্রভেদ অস্বীকার করেছে। উদ্ধত, আভিজাত্য, গর্বী ও শ্রেণী মনোভাবাপন্ন কুরাইশদের নিকটে ইসলামের সামাজিক সাম্য ছিল অত্যন্ত বিরক্তিকর ও ঘৃণা-ব্যাঞ্জক।
ইসলামের প্রচার নৈতিক আদর্শ ও মূল্যবোধ পৌত্তলিক কুরাইশদের প্রচলিত রীতি-নীতির সম্পূর্ণ বিরোধি ছিল। ফলে ইসলামীক নীতি তারা মানতো না পারলে মুসলমানদের সাথে বিরোধ দেখা যায়। অপরদিকে মক্কার নগর-রাষ্ট্রে রাজনৈতিক কতৃত্বের স্থায়িত্ব ছিলনা। যাঁদের অর্থ ছিল এবং যিনি নগর-রাষ্ট্রের সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করতে পারতেন তারাই রাজনৈতিক কতৃত্ব ভোগ করতো।
ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুরাইশদের আক্রমণের অন্যতম কারন ছিল অর্থনৈতিক। মক্কা নগরীতে অবস্থিত কাবাগৃহের রক্ষণাবেক্ষণের দ্বায়িত্ব কুরাইশ পরিবারের উপর ন্যস্ত ছিল। একাজে প্রভূততাদের অর্থপার্জন হতো। ইসলামের বিজয় হলে তারা এ অর্থ থেকে ব্যাত্য হবেন ভেবে ইসলাম ও নবীর বিরুদ্ধে মারমুখী হয়ে ওঠে।
ইসলামের বিস্তৃতির সাথে সাথে কুরাইশদের অত্যাচার ও নিপীড়ন বেড়ে উঠে। নবদিক্ষিত মুসলমানদের উপর তারা চড়াও হয়ে উঠে। ওপর দিকে কুরাইশরা নবী (সাঃ)-কে বিভিন্ন রকম প্রলভোন দেখিয়ে ধর্ম ত্যাগ করার তাগিদা দেয়, অর্থ, নারী ও মক্কার কতৃত্ব দেওয়ার লোভ দেখায় কিন্তু নবী (সাঃ) কোরআনের আয়াত পড়ে তাদের উত্তর দেন— “(হে মুহাম্মদ সাঃ) তুমি বলে দাও, আমি তোমাদের মতোই একজন মানুষ। তবে (পার্থক্য এটাই যে) আমার নিকট ওহি আসে যে, তোমাদের উপাস্য একক অদ্বিতীয়। অতএব যারা নিজ প্রভুর সাক্ষাৎ লাভের আশা করে তারা যেন সৎ কর্ম করে এবং নিজ প্রভুর উপাসনায় অন্য কাউকে শরীক না করে।” [১৮/১১০]
কলমে- আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
No comments:
Post a Comment