বদিউর রহমান
মারা গেলেন অধ্যাপক অরুণ কুমার বসু। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্য বিভাগের অন্যতম ছাত্র দরদী অধ্যাপক অরুণ বাবু। তাঁর প্রচুর ছাত্র-ছাত্রী তাঁকে আজীবন স্মরণ করতে বাধ্য হবেন তাঁর পড়ানোর টেকনিকের জন্য। ব্লাক বোর্ডে তাঁর আর্টিস্টের মত লেখা গুলো অনেকের মনে পড়বে দীর্ঘদিন।
তাঁকে আমার মনে পড়ে আমার সঙ্গে তার মার্জিত ব্যবহারের জন্য। আমি তাঁকে অরুণদা বলে ডাকতাম। তাঁর সঙ্গ সেভাবে পেয়েছি তা নয় তবুও তাঁকে ইদানিং আমার ভীষন মনে পড়ে। আমি ১৯৮৩ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। তখন আমার দেশের বাড়ি পান্ডুয়া থেকে বিশ্ববিদ্যালয় সাড়ে দশটা থেকে পোনে এগারোটায় পৌঁছাতাম। আশুতোষ বিল্ডিং-এর তিন তলার প্রফেসর রুমের পুব দিকের সুইং ডোরটা দিয়ে ঢুকলে ডান দিকের একেবারে শেষ চেয়ারটা এবং তার পাশের চেয়ারটার দু’জন অধ্যাপককে প্রায় দেখতাম কাজে ডুবে আছেন। একজন অরুণদা আর দ্বিতীয় জন হলেন অধ্যাপক সুদীপ্তী ব্যানার্জি। পরে জেনেছিলাম যে ওরা দু’জনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্স বিভাগের পরীক্ষা সংক্রান্ত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সুসম্পাদন করে যান নিঃশব্দে ও নিরলস ভাবে। একদিকে যেমন অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে ওই সমস্ত কাজ করতেন অন্যদিকে ঠিক সেরকমই গুরুত্ব সহকারে নিতেন ছাত্রদের ক্লাস। তাছাড়াও কমার্স বিভাগের অ্যালুমুনীর কাজ এবং সেমিনার ইত্যাদিরও অনেক কাজ ওরা দু’জনে সামলাতেন অক্লান্তভাবে। ওনারা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে পরিশ্রম করেছেন কাজগুলো শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ বলে।
অরুণদা যে চেয়ারটায় বসতেন ঘটনাক্রমে তার ডান দিকে ছিল আমার একটা তালামারা ছোট্ট সেলফ্। আমি সেই সেলফ্ খোলার জন্য এগিয়ে গেলে অরুণদা খুব সন্তর্পনে তাঁর ছড়ানো কাগজপত্র গুছিয়ে নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। সদা হাস্য অরুণদা বলতেন “আমি কি একটু সরে বসব”? আমিই বরং কুন্ঠিত হয়ে বলতাম, “না না তার দরকার হবে না, আমার এক মিনিটের কাজ”। দেখতাম আবার তিনি নিমগ্ন হয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছেন বিভাগের কাজে। বলতে পারেন এই ছিল তাঁর নিত্য দিনের রুটিন।
কুটা কলেজস্ট্রিট শাখার টি-ক্লাবে আমাকে কিছু একটা লেখা শোনানোর প্রায়ই আদেশ থাকতো। বিদগ্ধ গুণীদের মাঝে বৌদ্ধিক আলোচনা থেকে হাজার মাইল দূরে আমার চেষ্টা ছিল মন হালকা করার মত সাধারণ কিছু লেখা। অনেকের মত অরুণদাকেও লক্ষ করেছি আমার হ-য-ব-র-ল শুনতে।
বন্ধুস্থানীয় কয়েকজন অধ্যাপক লেখা নিয়ে কখন সরস কখন নিরস মন্তব্য করতেন। টি-ক্লাবে একবার আমার একটা প্রেম সর্বস্য কবিতা পড়ার পর অধ্যাপক স্বপন প্রামাণিক মন্তব্য করেন “বদিউর এ বয়সে ও সব কি হচ্ছে”। আবার “ছাতা কাহিনী” শোনানোর পর অধ্যাপক লয়ের মন্তব্য “কোথা থেকে ঝাড়লেন”-ও হজম করতে হয়েছে। আমার দুর্ভাগ্য অরুণদার কোনো মন্তব্য কোনোদিন আমি পাইনি। তবে প্রশ্রয় ছিল আমাকে কিছু শোনাতে সুযোগ দেওয়ার। অন্তত এ ব্যাপারে তাঁর বিরোধিতা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের কমার্স বিভাগের বন্ধু বিদগ্ধ এবং খ্যাতনামা ব্যক্তিদের মধ্যে অনিল, বি.কে বসু, বি ব্যানার্জি, রতন খাসনবিস (পরবর্তীকালে ম্যানেজমেন্ট বিভাগে আলিপুর ক্যাম্পাসে চলে যান) এবং সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে আসতেন এম রহমান সাহেবকে দেখেছি বেশ কেতাদুরস্ত হয়ে থাকতে। বিশেষত শীতকালের তাদেরকে স্যুটেড-বুটেড হয়ে থাকতে দেখে বেশ ভালো লাগতো। তবে অরুণদা আজীবন খুব সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। আমার মনে হয় আকাশী রংটার প্রতি ওঁর একটা দুর্বলতা ছিল। ওঁর লেখা বই শুধু ছাত্রদের কাছে কেন অনেক অধ্যাপকের কাছেও উচ্চ প্রশংসিত। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের চাপানো কাজের ভারে অরুণদা নিজের পিএইচডি করার ফুরসত পাননি তার জন্য ইউজিসির নিয়মের গেরোয় আখেরে ওঁর ব্যক্তিগত ক্ষতি হয়। ছাত্রতুল্য অনেক ডিগ্রিধারীকে ওঁর প্রতি এক ধরনের অবজ্ঞা অনুমান করেছি টিচার্স রুমে কমার্স বিভাগ-এর মিটিংয়ে অরুণদার স্বর ছাপিয়ে উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখে। অরুণদা কতটা আহত হতেন, ব্যথা পেতেন জানিনা তবে পরে দেখেছি ওর ব্যবহারে তাদের প্রতি স্নেহের কোন অভাব তিনি রাখেননি। ওইরকম উদার মনস্ক মানুষের স্মৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি সভা করা হয় ৫ জুন ২০১৬ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে। পুরো হল কানায় কানায় ভর্তি হয়েছিল বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ও অশিক্ষক কর্মচারীদের উপস্থিতিতে। গুনমুগ্ধ মানুষজনের অভূতপূর্ব উপস্থিতি জানান দিচ্ছিল একজন সত্যিকারের মানুষের চলে যাওয়ার ব্যথা। অরুণদার শিক্ষক অধ্যাপক বি ব্যানার্জি ও অন্যান্য সহকর্মী শিক্ষকরা তাঁর ছবিতে ফুল মালা দিয়ে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেন, তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করেন। বিদগ্ধ শিক্ষকদের বক্তব্যে অরুণদার শিক্ষক জীবনের অনেক প্রসঙ্গ আলোচিত হয়। অরুণদার ছাত্র মালয়েন্দু সাহা অরুণদার স্মৃতিচারণা করতে উঠে বাকরুদ্ধ হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ম্যানেজমেন্ট বিভাগের অধ্যাপিকা শর্মিস্ঠার অবস্থাও হয় প্রায় তথৈবচ। তবে ওই বিভাগের স্বনামধন্য রতন খাসনবিশের বক্তব্য শুনে আমার মত অনেকেই থ হয়েগিয়েছি। অধ্যাপক খাসনবিশ অরুণদার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একদিন দু’জনের ফেরার কথা বলেছিলেন। অরুণদা সেদিন বলেছিলেন তার কলকাতা আগমনের কথা। তখন বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ তুঙ্গে। পাকসেনার মদতপুষ্ট রাজাকারদের তান্ডব চলছে পূর্বপাকিস্তানে বিশেষ করে যশোর, খুলনা, ফরিদপুর এলাকায়। নির্বিচারে হত্যালীলা চালিয়ে যাচ্ছিল ধর্মান্ধ রাজাকাররা।
অধ্যাপক অরুণ বসু বলে চলেন “প্রতিনিয়ত অবস্থা খারাপ হতে থাকে। পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে তাদেরকে সহমর্মিতা দেখানো এবং রক্ষা করতে কেউ এগিয়ে আসেননি। অবস্থা বেগতিক দেখে বাবা দেশ ছাড়ার সংকল্প করেন। একদিন শেষ রাতে বাড়ি ছেড়ে যৎসামান্য কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে বের হবার মুহূর্তে বাবা আমাদের সকলকে এগিয়ে যেতে বলে একটু পরে উনি আমাদের সঙ্গে রাস্তায় যোগ দেবেন বলেন”। অরুণ বাবু বলতে থাকেন, “মা ও আমরা পাঁচ ভাই-বোন কিছুদূর এগিয়ে বাবার অপেক্ষা করতে থাকি। মা সবিশেষ অধৈর্য হয়ে বড় ছেলে (অরুণ বাবু)-কে বলেন বাড়ি গিয়ে বাবাকে সঙ্গে করে নিয়ে এস। বাড়ির দরজার কাছে পৌঁছাতে তিনি দেখেন একদল রাজাকার তাঁর বাবাকে নৃসংশ ভাবে হত্যা করছে। চোখে দেখা যায় না রাজকারদের বর্বর হত্যালীলা। কিছুক্ষণের জন্য কিংকর্তব্য বিমূঢ় অরুণ বাবু পরমুহূর্তে তার মা ও অন্যান্য ভাই বোনদের রক্ষা করার তাগিদে আলো-আঁধারির মধ্যে পরিবারের সকলের কাছে ফিরে গিয়ে তিনি তাঁর মাকে বলেন, “দরকারী কিছু কাগজ পত্র খুঁজে নিয়ে বাবার আসতে একটু দেরি হবে, আমাকে বলেছেন তোমাদের সকলকে নিয়ে এগিয়ে যেতে”। ভারতের বর্ডার পৌঁছানো পর্যন্ত অরুণ বাবুর মায়ের অস্থিরতাকে কোনক্রমে সামাল দেন। শরণার্থী শিবিরে থাকাকালীন তার মা ও অন্যান্য ভাই-বোনেরা বাবার ভারতবর্ষে পৌঁছানোর সংবাদ পেতে আকুল হয়ে পড়েন। তিনি দিনের পর দিন তাঁর মাকে কোন ভাবে বুঝিয়ে শান্ত করে রাখেন। কিন্তু প্রতিদিন সকালে উঠে তাঁর মা স্নান করার পর যখন মাথায় সিঁথিতে সিঁদুর দিতেন তখন অরুণ বাবুর বুকটা টনটন করত। প্রায় দেড় বছর পর অরুণ বাবুদের বাংলাদেশের পাড়ার এক ভদ্রলোকের মুখে তাঁর মা জানতে পারেন তার স্বামী বর্বর ধর্মান্ধ রাজাকারদের হাতে কি নৃসংশ ভাবে খুন হন। সেদিন তাঁর মা নিজের সন্তান তরুণ বাবুর কাছে জানতে চান তিনি আগে ওই কথাটা তাঁর মাকে বলেননি কেন। তিনি প্রশ্ন করেন, “দেড় বৎসর ধরে বিধবা হওয়া সত্ত্বেও সধবার মতো হাতে নোয়া শাঁখা পরে এবং মাথায় সিঁদুর পরার পাপ করতে কেন দিল? কেন আমাকে পাপের ভাগী করলে?
অরুণদার মায়ের সেদিনের হাহাকার ছিল গভীর মর্মভেদী। ততোধিক গভীর অরুণদার তাঁর মায়ের জন্য। তিনি ভেবেছিলেন সর্বহারা উদ্বাস্তু হওয়ার পর মা হয়তো স্বামীর মৃত্যুর শোক সহ্য করতে পারবেন না। অরুণ বাবু তাঁর মাকে সাধারণ বেশে দেখে ভেতরে ভেতরে গুমরে উঠতেন। চাপা কান্নায় ভেতর থেকে মুষড়ে পড়তেন। প্রতিদিন চোখের পানি সামনে ভেসে উঠত তার বাবাকে হত্যা করার ক্রর দৃশ্য।
ওইরকম মর্মান্তিক ঘটনা শোনার পর বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। তৎক্ষণাৎ মনে হয়েছে ওঁর বাবার প্রতি রাজকারদের ওরকম অমানবিক আচরণের পরে আমাদের মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর বীতশ্রদ্ধ হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু অরুণ বাবুর ব্যবহারে কথাবার্তায় সেরকম কিছু কখনো পাইনি। আমার সঙ্গে হাসিমুখে অতীব সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য রক্ষা করে একজন স্বজনের মতো ব্যবহার করে গেছেন। ঘুণাক্ষরও জানতে দেননি তাঁর ব্যক্তিগত ব্যথার কথা। সে দিনের স্মৃতি সভায় যেভাবে তাঁর ব্যথায় ভারাক্রান্ত মনে ফিরেছিলাম আজ তাঁকে আমার বিনম্র শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে ভারমুক্ত হয়ে বলতে চাই এইরকম মহৎ মানুষজনই প্রাতঃস্মরণীয়, সর্বান্তকরণে তাঁর আত্মার কল্যাণ কামনা করি।
২৬-০৬-২০২০
স্যার এর কলমের তীক্ষ্ণতা হৃদয় চিরে আত্মা পর্যন্ত পৌঁছাতে সক্ষম।
ReplyDelete