Thursday 22 April 2021

উমার বিন আল-খাত্তাব (রাঃ)



উমার ইব্‌নুল্‌ খ়াত়্ত়াব (রাঃ)

(৫৮৪  ৬৪৪ খ্রি)
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
 
উমার (রাঃ) ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা এবং প্রধান সাহাবীদের অন্যতম। আবু বাক্ (রাঃ)-এর মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় খলীফা হিসেবে দায়িত্ব নেন। উমর (রাঃ) ইসলামী আইনের একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। ন্যায়ের পক্ষাবলম্বন করার কারণে তাকে আল-ফারুক (সত্য মিথ্যার পার্থক্যকারী) উপাধি দেওয়া হয়। আমীরুল মুমিনীন উপাধিটি সর্বপ্রথম তার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে। ইতিহাসে তাকে প্রথম উমার হিসেবেও উল্লেখ করা হয়। সাহাবীদের মর্যাদার ক্ষেত্রে সুন্নীদের কাছে আবু বাক্ (রাঃ)-এর পর উমারের স্থান। তাঁর শাসনামলে খিলাফতের সীমানা অকল্পনীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়। এসময় সাসানীয় সাম্রাজ্য  বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের দুই তৃতীয়াংশ মুসলিমদের নিয়ন্ত্রণে আসে। তার শাসনামলে জেরুজালেম মুসলিমদের হস্তগত হয়। তিনি পূর্বের খ্রিষ্টান রীতি বদলে ইহুদিদেরকে জেরুজালেম-এ বসবাস ও উপাসনা করার সুযোগ দিয়েছিলেন।

ইসলাম ধর্ম গ্রহন
নবী (সাঃ)-এর নবুওয়াতের প্রথম পর্যায়ে উমার (রাঃ) ছিলেন ঘোর ইসলাম বিরোধীমক্কার নবদীক্ষিত মুসলিমদের উপর তিনি নির্যাতন চালাতেনতিনি ইসলামী আন্দোলনের বিরোধিতা করছিলেন বটে, কিন্তু পক্ষান্তরে ইসলামের প্রভাবে তাঁর শুভবুদ্ধি ক্রমশ উদয় হচ্ছিলরাসূল (সাঃ)-এর অজ্ঞাতসারে একদা তাঁর মুখে আল-কুরআনের আবৃত্তি শুনে তাঁর মনে ভাবান্তর ঘটার বর্ননা পাওয়া যায়একদিন ভগিনী ও ভগ্নীপতিকে ইসলামে গ্রহণের জন্য নির্দয়ভাবে শাসন করতে গিয়ে তিনি নিজেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং রাসূল (সাঃ)-এর নিকট উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের ফলে তাঁর জীবনের আমূল পরিবর্তন ঘটেপরবর্তীকালে তিনি ইসলামের সেবার অকল্পনীয় ইতিহাস সৃষ্টি করেন

খিলাফত লাভের পূর্বে
হিজরতের চার বছর পূর্বে যখন তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন তখন তার বয়স ছিল ছাব্বিশ বছরতার পর থেকে তিনি পূর্ন শক্তিতে ইসলামের সেবায় ঝাপিয়ে পড়েন। তার গোত্র বানু আদি ইব্‌নু কাআব হতে এই ব্যাপারে তিনি কোন সাহায্য পাননিমদিনায় তার ব্যক্তিগত উদ্যম এবং মনোবলের প্রভাবেই তিনি রাসূল (সাঃ)-এর প্রতিষ্ঠিত ইসলামী সমাজে মর্যাদা লাভ করেন, গোত্রীয় মর্যাদার কারণে নয়। সৈনিক হিসাবেও তার প্রভূত খ্যাতি ছিলতিনি বদর, উহুদ ও অন্যান্য যুদ্ধে যোগদান করেন। একাধিক বর্ণনায় আছে যে, কুরআনের কয়েকটি স্থানে উমার (রাঃ)-এর সমর্থনে ওহি অবতীর্ন হয়েছেসাহাবীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বে আবু বাক্‌র (রাঃ) উমার (রাঃ)-এর অগ্রগণ্য ছিলেন। উমার (রাঃ) বিনয় সহকারে তা স্বীকার করতেন এবং সর্বদা আবু বাক্‌র (রাঃ)-কে যথোপযুক্ত সম্মান করতেনরাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যুর পর উমার (রাঃ)-ই সর্বপ্রথম আবু বাক্‌র (রাঃ)-এর নিকট বায়আত করেন

খেলাফত লাভ ও শাসনকার্য
আবু বাক্‌র (রাঃ)-এর খিলাফাত কালে উমার (রাঃ)-ই ছিলেন তাঁর প্রধান উপদেষ্টা। মৃত্যুর পূর্বে তিনি উমার (রাঃ)-কেই তাঁর স্থলাভিষিক্ত মনোনীত করেন। অতঃপর সকল সাহাবা সর্ব-সম্মতভাবে উমার (রাঃ)-কে তাঁদের খলীফা রূপে গ্রহণ করেন। অতঃপর ঘরে-বাইরে উমার (রাঃ) যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন পূর্ব হতেই তিনি তার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন। মুসলিম রাষ্ট্রের পরিধি বৃদ্ধি করার জন্য যুদ্ধ করা তাঁর অভিপ্রেত ছিল না। নৌ-যুদ্ধ তাঁর দৃষ্টিতে অধিকতর অবাঞ্ছিত ছিল, কিন্তু মুসলিম শক্তিকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করার জন্য বদ্ধপরিকর বিরোধী শক্তিগুলির সাথে মুকাবিলায় তিনিই ছিলেন অধিনায়ক। যে সকল সেনাপতি মুসলিমদের প্রয়াসকে সাফল্যমণ্ডিত করেছিলেন তিনি ছিলেন তাদের সকলের নিয়ন্তা। এক্ষেত্রে তাঁর কৃতিত্ব সর্বজনবিদিত। ইসলামের স্বার্থে খালিদ (রাঃ)-এর ন্যায় একজন সুদক্ষ সেনাপতিকেও তিনি পদচ্যুত করেছিলেন এবং খালিদ (রাঃ)-ও এই পদচ্যুতি অবনত মস্তকে মেনে নিয়েছিলেন। এই ঘটনা তাঁর বলিষ্ঠ কৃতিত্বেরই পরিচায়ক। এই ঘটনা হতে রাসুল (সঃ)-এর সাহাবীদের (রাঃ) চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যেরও পরিচয় মিলে। আম্‌র ইবনুল 'আস (রাঃ)-এর মিসর বিজয়ের প্রস্তাবে সম্মতি দান করে তিনি খুবই দূর-দৃষ্টির পরিচয় দেন। তিনি রাসূল কারীম (সাঃ)-এর বিশিষ্ট সাহাবীদেরকে সম্ভ্রমবশত সাধারণ সরকারী চাকুরীতে নিয়োগ করতেন না। কিন্তু প্রয়োজন হলে গুরুত্বপূর্ন পদে তাদেরকে নিয়োগ করতে দ্বিধাবোধ করতেন না। আর এভাবেই ইরাক ও সিরিয়ার শাসনকর্তা হিসাবে তিনি কয়েকজনকে নিযুক্ত করেছিলেন। 

উমার (রাঃ)-এর সময়েই ইসলামী রাষ্ট্রের বাস্তব ভিত্তি স্থাপিত হয়। এ সময়েই অনেকগুলি ইসলামী বিধি-ব্যবস্থা বাস্তব রূপ লাভ করে। এগুলির পূর্ন রূপায়ন ঐতিহাসিক বিকাশ ধারা অনুসারে ক্রমে ক্রমে সাধিত হলেও এসবের সূচনা উমার (রঃ)-এর সময়েই হয়েছিল। যখনই কোন প্রশ্ন বা সমস্যার উদ্ভব হত, তিনি সাহাবীদেরকে (রাঃ) একত্রিত করে জিজ্ঞেস করতেন যে, এ ব্যাপারে নবী (সাঃ)-এর কোন উক্তি বা সিদ্ধান্ত আছে কিনা, অতঃপর তাদের সাথে আলোচনার ভিত্তিতে তিনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। কুরআন ও সুন্নাহ্‌ই ছিল তাঁর সংবিধান এবং বিশিষ্ট সাহাবী যথা আলী, আব্দুর রাহমান বিন আওফ (রাঃ) প্রমুখ ছিলেন তাঁর পরামর্শ সভার সদস্য। দীনতম নাগরিকও তাঁর কর্মের সমালোচনা করতে শুধু সাহসই করতেন না বরং উৎসাহিতও হতেন- এ ধরণের বহু নজির বিভিন্ন বর্ণনায় পাওয়া যায়। তাঁর জীবন যাপনের মান সাধারণ নাগরিকের অনুরূপ ছিল। এ বিষয়ে উমার (রাঃ)-এর দৃষ্টান্ত সত্যই বিরল ।

এছাড়া তাঁর শাসনামলে জিম্মি অর্থাৎ মুসলিম রাষ্ট্রের অমুসলিম নাগরিকগণের অধিকার সংরক্ষণ, সরকারি আয় জনগণের মধ্যে বণ্টনের জন্য দীওয়ান ব্যবস্থার প্রবর্তন, সামরিক কেন্দ্র যথা বসরা ও কুফা সামরিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা সম্পন্ন হয়। এবং এসব কেন্দ্র হতেই উত্তরকালে কয়েকটি বৃহৎ নগরীর সৃষ্টি হয়এতদ্বব্যতিত ধর্মীয়, পৌর এবং দণ্ডবিধি সঙ্ক্রান্ত বিশেষ বিধিও তিনি প্রবর্তন করেন। যথা তারাবীহ্র‌ সালাত জামাআতে সম্পন্ন করা, হিজরি সনের প্রবর্তন ও মদ্যপানের শাস্তি ইত্যাদি ।

আবু বাক্‌র (রাঃ) খালীফাতু রাসুলিল্লাহ বা রাসুলের প্রতিনিধি বলে অভিহিত হতেন। তদনুসারে উমার (রাঃ) ছিলেন রাসূলের খলীফার খলীফা। নবী (সাঃ) নেতা অর্থে সাধারণত আমীর শব্দ ব্যবহার করতেন এবং আরবদের মধ্যে এই শব্দের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। আর তাই ১৯ হিজরিতে তিনি আমীরুল্‌ মুমেনীন অর্থাৎ মুমিনদের নেতা উপাধি গ্রহণ করেন। সম্ভবত তিনি নিজকে রাসূল (সাঃ)-এর খলীফা বা স্থলাভিষিক্ত বলা বা মনে করাকে ধৃষ্টতারূপ গণ্য করতেন। বেশ কিছু বর্ণনায় বিবৃত হয়েছে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “আমার পর কেউ নবী হলে উমার নবী হতো ।

শাহাদত
উমার (রাঃ)-এর অন্তরে আল্লাহ্‌র ভয় ও ভক্তির মধ্যে দৃশ্যত ভয়ই ছিল প্রবলতর। তিনি যে সম্মান অর্জন করেছিলেন তা তাঁর চরিত্রগুণের কারনে, শারীরিক শক্তির জন্য নয়। যদি আবু উবায়দা (রাঃ) জীবিত থাকতেন তবে তাকেই তাঁর স্থলাভিষিক্ত রূপে মনোনীত করতেন, তাঁহার এরূপ ইচ্ছা প্রকাশের বিবরণ পাওয়া যায়। নবী (সাঃ)-এর সত্যিকারের সাহাবী এবং কুরআন ও সুন্নাহ্‌র পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসারী খলীফা রূপে মর্যাদার উচ্চ শিখরে সমাসীন থাকাকালে ২৬ জুল হিজ্জা ২৩ হিঃ মোতাবেক ৩ নভেম্বর ৬৪৪ খ্রিস্টাব্দে মুগীরাহ্‌ বিন শুবাহ্‌র অগ্নি উপাসক ক্রীতদাস আবু লুলুর ছুরিকাঘাতে শহীদ হন। ইতিহাসে বর্ণীত হয়েছে যে, উমার (রাঃ)-এর নিকট আবু লুলুতার মনিবের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে। উমার (রাঃ)-এর বিচারে অসন্তুষ্ট হয়ে সে ব্যক্তিগত আক্রোশের বশে অতর্কিতভাবে উমার (রাঃ)-কে আঘাত করে। মৃত্যুর পূর্বে উমার (রাঃ) ছয়জন বিশিষ্ট সাহাবীর নাম উল্লেখ করে পরামর্শক্রমে তাদের মধ্যে একজনকে খলীফা মনোনীত করার উপদেশ দেন। পরবর্তীতে তার ফলে উস্‌মান (রাঃ) খলীফা মনোনীত হন।

No comments:

Post a Comment