মক্কা বিজয় ও তার প্রভাব
মক্কা বিজয়ঃ
দীর্ঘ আট বছর পর হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) ৬৩০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে প্রায় ১০,০০০ হাজার সৈন্য বাহিনী নিয়ে মক্কা আক্রমনের জন্য অগ্রসর হন। পথিমধ্যে সমাবেশ দেখে কুরাইশগণ ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। মুসলমানগণ যখন মক্কা নগরে প্রবেশ করতে থাকেন, তখন ইকরামার নেতৃত্বে কিছু সংখ্যক কুরাইশ মক্কার দক্ষিণ ফটকে বাঁধা দান করে। কিন্তু মহাবীর খালিদের তরবারির সামনে কেউ স্থির থাকতে পারেন নি। ঐ সংঘর্ষে ২৪ জন কুরাইশ নিহত হয়, আর মুসলমানদের পক্ষে শহীদ হন ২ জন। সুতরাং বলা যায় মুসলমানগণ অল্প বিদ্রোহে মক্কা বিজয় করেন। বিরল।
বিভিন্ন প্রকার গুরুত্বপূর্ণ কারনের জন্য মুহাম্মদ (সাঃ) মক্কা অভিযানে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। তাঁর প্রধান কারণগুলি নিম্নে তুলে ধরা হলোঃ
মক্কায় ইসলামের প্রভাব মক্কা বিজয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ। মক্কায় তরুণ সম্প্রদায় হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সত্য প্রচারে আকৃষ্ট হয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হতে থাকে। বিশেষ করে খালিদ-বিন-ওয়ালিদ, আম্র-বিন-আল-আস্ এবং ওসমান-বিন-তালহা ইসলাম গ্রহণ করলে মহানবী (সাঃ) মক্কা বিজয়ে অধিক আগ্রহী হন।
কুরাইশগণ মাত্র দু-বছর হুদায়বিয়ার সন্ধি পালন করেছিল। এর পর তারা এ সন্ধি ভঙ্গ করে সকল মুসলমানদের প্রতি নানা অত্যাচারে লিপ্ত হয়। তাই মহানবী (সাঃ) কুরাইশদের নিকট সন্ধি ভঙ্গের প্রতিকার দাবি করলে কুরাইশরা এতে কর্ণপাত না করে সন্ধিকে বাতিল বলে ঘোষণা করে। এ কারণে মুহাম্মদ (সাঃ) মক্কা আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেন।
বদর যুদ্ধের পর থেকেই মক্কার অভ্যন্তরীন অবস্থার অবনতি ঘটে। গোত্রে গোত্রে কলহের কারণে তাঁদের শক্তির চরম ঘাটতি দেখা যায়। বস্তুত কুরাইশদের রাজনৈতিক অনৈক্য ও গোত্রস্বার্থ এবং তাঁদের শক্তির হ্রাস-ই মুহাম্মদ (সাঃ) কে মক্কা বিজয়ে ত্বরান্বিত করেছিল।
ইসলামের সূত্রপাত থেকে কুরাইশগণ মহানবী (সাঃ) এবং তাঁর অনুগামীদের উপর চরম নির্যাতন চালায়। তারা ছিল ইসলামের চিরশত্রু। তাই কুরাইশদের শত্রুতার চির অবসানকল্পে মহানবী (সাঃ) মক্কা বিজয়ের উপলব্ধি করেন।
যুদ্ধ এড়ানোর জন্য মহানবী (সাঃ) কুরাইশদের তিন-তিনটি প্রস্তাব সংকলিত একটি পত্রসহ শান্তিদূত প্রেরণ করেন। প্রস্তাবগুলি হলো— (১) অন্যায়ভাবে নিহত বনু খুজা’আহ্ গোত্রের লোকদের ক্ষতি পূরণ দিতে হবে। (২) বানু বাক্র সম্প্রদায়কে সকল প্রকার সাহয্য প্রদানে বিরত থাকতে হবে। (৩) হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তাবলী বাতিল ঘোষিত হবে।
মক্কা বিজয়ের মধ্যে দিয়ে মহানবী (সাঃ)-এর দীর্ঘ আকাঙ্খিত সাফল্যের বাস্তবায়ন ঘটে। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই এ বিজয়ের প্রভাব ও গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলামের বিস্তার এবং সমগ্র আরবের একত্রীকরণের জন্য মক্কা বিজয়ের প্রয়োজনীয়তা ছিল অপরিসীম। নিম্নে মক্কা বিজয়ের প্রভাব সম্পর্কে বর্ণনা করা হল—
মহনবী (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীগণ এতদিন আতঙ্ক ও ভয়ভীতির সঙ্গে ইসলাম প্রচার করতেন। মক্কা বিজয়ের ফলে ইসলাম এক অপ্রতিরোধ অদম্য মহাপ্লাবনের মতোই বাঁধা বন্ধনমুক্ত বিজয়ী শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। আরবের সকল গোত্র ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেন।
মক্কা বিজয়ের পর কাবা গৃহের পবিত্রতা পুনরায় ফিরে আসে। মহানবী (সাঃ) এর নির্দেশে কাবা ঘরে রক্ষিত ৩৬০ টি মূর্তি ভেঙ্গে ফেলা হয়। কাবা গৃহের পবিত্রতা ও গৌরব ফিরে আসে।
হিজরতের পূর্বে মক্কার মুসলমানগণ ভয়ে সবসময় আতঙ্কিত হয়ে থাকতেন। কুরাইশরা যেকোনো মূহুর্তে আক্রমণ করতে পারে, এ ভয়ে মুসলামনগণ রণ প্রস্তুতিতে থাকতেন। কিন্তু মক্কা বিজয়ের ফলে ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্র সকল বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে অপ্রতিদ্বন্দ্বি শক্তিতে রূপান্তরিত হয়।
সুদীর্ঘ ১৩ বছর যাবৎ হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এবং তাঁর অনুসারীগণ মক্কার কুরাইশদের চরম অত্যাচার ও নির্যাতনে স্বীকার হন। করুনার মূর্তপ্রতীক মহানবী (সাঃ) মক্কা বিজয় করে তিনি তাঁদের প্রতি কোনো প্রকার প্রতিহিংসামূলক আচরণ করেননি। তিনি তাদের প্রতি যে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টি দান করেন তা বিশ্বের ইতিহাসে সত্যিই বিরল।
মক্কা বিজয়ের ফলে কাবা গৃহের পবিত্রতা ফিরে আসে। কাবা গৃহের মূর্তি ভাঙ্গার সময় নবী (সাঃ)-এর কণ্ঠে ‘জাআল হাক্ ওয়া যাহাকাল্বাতল’ উচ্চারিত হয়ে থাকে। পৌত্তলিকতার সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ চিহ্নগুলি অপসারনের পর ইসলামের বিজয়ধ্বনি সমগ্র আরবে প্রতিধ্বনি হতে থাকে।
-আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
No comments:
Post a Comment