Saturday 17 June 2017

তালাক বিতর্ক ও ইসলামী দৃষ্টিকোণঃ কিছু কথা


তালাক বিতর্ক ও ইসলামী দৃষ্টিকোণঃ কিছু কথা
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
তালাককে, বিশেষত তিন তালাককে কেন্দ্র করে আশির দশকের সেই শাহ বানু ঘটনার পর থেকে বেশ ধুন্ধুমার লেগে রয়েছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠনগুলির মধ্যে। এসব দেখে মাঝেমাঝে মনের আকাশে উঁকি দেয় নানা জিজ্ঞাসা, নানা প্রশ্ন তালাক আদতে কী? বিতর্ক না বিতর্কের নিরসন? এর প্রয়োজনীয়তা কতটা? ইসলাম কেন বৈধ করল? এর সঠিক পদ্ধতিটাই বা কী, ইত্যাদি?  
তালাক কী এবং কেন?— তালাক হল বন্ধন ছিন্ন করার নাম, বিবাহ-বন্ধন। আর বিবাহ মানুষের প্রয়োজন; মানব-শৃঙ্খলকে অটুট রাখার জন্য। তাই আল-কুরআনের ভাষায় বিবাহ মানবজীবনের একটি ‘মিসাক্ব গালীয’ (বলিষ্ঠতম অঙ্গীকার) [সূরা আন্‌-নিসা ২১]। আর এই সম্পর্ককে মধুর ও স্থায়ী করার উদ্দেশ্যে বিয়ের পূর্বে একে অপরকে দেখার আদেশ ও অনুমতি দেওয়া হয়েছে। [তিরমিযি ১৮৭] আর বিয়ের পরে উভয়কে নিজ নিজ অধিকার স্পষ্ট রূপে জেনে পালন করার আদেশও দেওয়া হয়েছে। [তিরমিযি ১১৬৩, আবুদাউদ ১৮৩০] যাতে কেউ কোনো ভাবে বঞ্চিত না হয়। এছাড়া পরস্পরের ত্রুটিগুলি মার্জনা করে ভালো দিকগুলিকে মনে স্থান দেওয়া উচিৎ। এতে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পাবে। [সূরা আন্‌-নিসা ১৯, মুসলিম ২৬৭২] এবং মনে রাখা দরকার, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের অংশ। [সূরা আলে ইমরান ১৯৫] এমনকি পরস্পরের আচ্ছাদনও। [সূরা আল-বাক্বারা- ১৮৭] তাই যখনই এই বিশ্বাস ও ভাবনা থেকে তাঁদের উভয়ে বা কেউ একজন সরে দাঁড়ায়, তখনই দেখা দেয় সমস্যা, মন-মালিন্য, কলহ; এমনকি সন্দেহও। ধীরে ধীরে স্ফুলিঙ্গ রূপ নেয় অগ্নিকুণ্ডের। যাতে ভস্ম হয়ে যায় দুটো প্রাণী, দু’টি পরিবার এবং সন্তানদের ভবিষ্যৎ।
অতএব কোনো ক্ষেত্রে যদি মতানৈক্য দেখা দেয়, তাহলে উভয়ের উচিৎ পরিস্থিতির পর্যালোচনা করা। ভুলত্রুটি চিহ্নিত করা এবং শান্তভাবে তার সমাধান খোঁজা। প্রয়োজনে তাঁরা কোনো তৃতীয় ব্যক্তির সাহায্য নেবে বা পারিবারিক স্তরে সে-সম্পর্কে আলোচনা করবে। এ মর্মে স্বামী-পরিবারের লোকজনদের সেই স্ত্রীর প্রতি যত্নবান ও আন্তরিক হওয়া আবশ্যিক। [সূরা আন্‌-নিসা ১৯] আর স্মরণে রাখা ভালো যে আর যদি তোমরা তাদের উভয়ের মধ্যে বিচ্ছেদের আশঙ্কা করো তাহলে স্বামীর পরিবার থেকে একজন বিচারক এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন বিচারক পাঠাও। যদি তারা মীমাংসা চায় তাহলে আল্লাহ উভয়ের মিল করে দেবেন।” [সূরা আন্‌-নিসা ৩৫]
এর পরেও যদি বিতর্ক থেকে যায় তাহলে বিচ্ছেদের পথে যেতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ্ তাআলার নিকট বৈধ জিনিসের মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণ্য ও অপছন্দনীয় হচ্ছে তালাক [আবু দাউদ ১৮৬৩]। এবং যে মহিলা তার স্বামীর নিকট কোনো উপযুক্ত কারণ ছাড়াই তালাক চায় তার জন্য জান্নাতের সুগন্ধি হারাম (নিষিদ্ধ) করে দেওয়া হয়” [আবুদাউদ ১৮৯৯]। এছাড়া তিনটি ক্ষেত্রে সিরিয়াস হয়ে বা ঠাট্টা করে বলা সমান। সেগুলি হল— (ক) বিয়ে, (খ) তালাক (গ) এবং স্ত্রীকে এক বা দু’ তালাক দেওয়ার পর ফিরিয়ে নেওয়া [তিরমিযি ১১৮৪, আবুদুউদ ২১৯৪]      
তালাকের পদ্ধতি— খুব চিন্তা ভাবনা করেই তালাকের পথে পা বাড়ানো উচিৎ। কারণ, যেভাবে বিবাহ দু’টি অপরিচিত ব্যক্তিকে যুক্ত করে, একইভাবে তালাক সেই দু’জনকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। সুতরাং বিয়ের জন্য যেভাবে মাসের পর মাস কথাবার্তা ও আলাপ-আলোচনা করা হয়; পরিবারের বয়োজ্যষ্ঠদের এবং বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে পরামর্শ করা হয়। সবার সম্মতি নিয়ে বিশেষ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে বড়োদের উপস্থিতিতে বিবাহকার্য সম্পন্ন করা হয়। একইভাবে তালাকও হওয়া উচিৎ। [সূরা আল-বাক্বারা ২২৯] 
আর এক্ষেত্রে প্রথমে বকেয়া মোহর পরিশোধ করতে হবে। তারপরে স্ত্রীর ‘পবিত্র’ অবস্থায় মিলনের পূর্বে লিখিত বা মৌখিক ভাবে এক তালাক দেবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, তালাক শব্দটি বার বার বা তিন বার উচ্চারণ করার কোনো প্রয়োজন নেই। আর করলেও এক তালাকই গণ্য হবে, মাম ইবনে তাইমিয়া ও অন্যান্য আহলে হাদিস (সালাফি) বিদ্বানদের মতে। 
এরপর তিন (মাসিক) মাস হল ইদ্দত। এই তিন মাসের মধ্যে তাঁরা পরস্পরের নিকট ফিরে যেতে পারে; এ ক্ষেত্রে উভয়ের একই গৃহে অবস্থানের বিধানও রয়েছে, যাতে সুরাহার সম্ভাবনা প্রবল হয়। কিন্তু তিন মাস অতিক্রান্ত হবার পর স্বামী স্ত্রীকে ঘরে তুলতে পারবে না; আর যদি তুলতে চায় তাহলে স্ত্রীকে নতুন ভাবে মোহর দিয়ে বিয়ে করে ঘরে তুলতে হবে। তাই বিচ্ছেদের জন্য এক তালাকই যথেষ্ট বলে আমি মনে করি।
তবে কেউ যদি প্রয়োজন মনে করে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় তালাক দেওয়ার; তার জন্য উত্তম পদ্ধতি (তালাক আহ্‌সান) হল— স্বামী উপযুক্ত কারণে স্ত্রীকে এক তালাক দিল। তারপর ইদ্দতের মধ্যে (শুধু সাক্ষী রেখে) বা ইদ্দতের পরে (নতুন মোহর দিয়ে বিয়ে করে) পদ্ধতি অনুযায়ী তাকে আবার ফিরিয়ে আনল। কিছু মাস বা বছর সংসার করার পরে আবার সমস্যা দেখা দিল; আবারও স্বামী নিয়ম মেনে তাকে (দ্বিতীয়) তালাক দিল। ইদ্দতের ভেতরে বা পরে নিয়ম মেনে আবারও ফিরিয়ে আনল। কিছু মাস ও বছর একসাথে থাকার পরে আবারও নানা সমস্যা দেখা দিল। ফলস্বরূপ স্বামী আবার স্ত্রীকে (তৃতীয়) তালাক দিল। এই তৃতীয় তালাকের পরে স্বামী আর স্ত্রীকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না।     
হালালাহ— তালাকের মতোই ‘হালালাহ’ পদ্ধতিটিও ভ্রান্তির বেড়া জালে আবদ্ধ। এবং বর্তমান সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হালালাহ্‌র এই বিকৃত রীতিই প্রচলিত। যদিও শাশ্বত ইসলামে এভাবে চুক্তি করে হালালাহ করা বা করানো অবশ্যই ঘৃণ্য ও হারাম। এমনকি অভিশপ্তও [তিরমিযি ১১২০]। কেননা এর প্রকৃত ও বৈধ রীতিটি সম্পূর্ণ রূপে ভিন্ন। আর সেটি হল— কোনো ব্যক্তি স্ত্রীকে এক তালাক দিল, পরে ঘরে তুলে নিল। কিছু দিন, মাস বা বছর পর দ্বিতীয় তালাক দিল, পরে আবার ঘরে তুলে নিল। কিছু দিন, মাস বা বছর সংসার করার পর আবার মনমালিন্য হল, আবার তালাক দিল; এভাবে তিন তালাক দিয়ে ফেলল। এরপর আর ঘরে তোলার অবকাশ নেই; পরপর দু’টি সুযোগ সে ব্যবহার করে ফেলেছে। এবার তাঁদের মিলনের সব পথ বন্ধ। কিছু দিন-মাস বা বছর পরে সেই মেয়েটির অন্য একজনের সাথে বিয়ে হয়ে গেল। তার সাথে কিছু দিন সংসারও করল। কিন্তু কিছু দিন-মাস বা বছর পর তাঁদের সংসারও ভেঙে গেল। সেও (এক) তালাক দিল। মেয়েটি ইদ্দতের তিন মাস (মাসিক) অতিবাহিত করে ফেলেছে; এমত অবস্থায় যদি প্রথম স্বামীটি চায়, তাঁকে প্রস্তাব দিয়ে বিয়ে করতে পারে। তা বৈধ। কিন্তু এই কাজ যদি পরিকল্পনা করে সম্পাদন করা হয় তাহলে তা অবৈধ ও হারাম হবে।    
বিচ্ছেদের পদ্ধতিসমূহ— ইসলামে বিচ্ছেদের বেশ কয়েকটি পথ বাতলে দেওয়া হয়েছে; ভিন্ন ভিন্ন অবস্থার জন্য। যাতে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কারো প্রতি কোনো রকম অবিচার না হয়। (ক) প্রথম পদ্ধতিটি হল তালাক। এই অধিকার ইসলাম পুরুষদের দিয়েছে; কারণ তালাক সেই ব্যক্তির জন্য যে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে” [ইবনে মাজাহ্‌ ২০৮১]। (খ) দ্বিতীয় পদ্ধতি সমর্পিত তালাক। এই পদ্ধতির মাধ্যমে পুরুষ তালাকের নিজ অধিকার স্ত্রীকে সমর্পণ করে দেয়। আর যদি স্বামী এর জন্য কোনো শর্তারোপ করে তাহলে শর্ত পূরণের পর স্ত্রী তার এই অধিকার প্রয়োগ করে তালাক দিতে পারে। (গ) তৃতীয় পদ্ধতি খোলা’। এই পদ্ধতিও নারীর জন্য। যদি তার মনে হয় সে দাম্পত্য জীবনের অধিকার ও দায়িত্বসমূহ পালন করতে পারছে না, তাহলে সে স্বামীর নিকট বিচ্ছেদ চাইতে পারে। নারী মোহর ফিরিয়ে দেবে। আর সেই অর্থের বিনিময়ে পুরুষ তাকে তালাক দিয়ে দেবে। এরই নাম খোলা’। এছাড়া স্ত্রী বিচারকের কাছে গিয়ে উপযুক্ত কারণ দেখিয়ে নিকাহ ‘ফাসখ’ (বাতিল)-ও করাতে পারে।  
ইদ্দত— তালাকের পর ইদ্দত পালন করতে হয়। এবং এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে [সূরা আত্‌-তালাক ১]। ইদ্দত পালন ছাড়া দ্বিতীয় বিবাহ বৈধ নয়। এক বা দুই তালাকের পর (একে তালাকে রাজ্‌’য়ী বলা হয়, ইদ্দত স্বামীর ঘরেই পালন করবে) ইদ্দতের মধ্যে স্বামী আবার স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারে। তবে ইদ্দত পূর্ণ হয়ে গেলে নতুন করে বিয়ে করতে হবে। ঋতুবর্তীদের ক্ষেত্রে ইদ্দত তিনটি মাসিক [সূরা আল-বাক্বারাহ ২২৮], অঋতুবর্তীদের ক্ষেত্রে তিন মাস [সূরা আত্‌-তালাক ৪], আর গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে সন্তান প্রসব করা পর্যন্ত [সূরা আত্‌-তালাক ৪]।  
উপরের এই আলোচনার প্রেক্ষিতে আমি বিশ্বাস করি, তালাক সমাজ জীবনে কোনো অপ্রাসঙ্গিক বস্তু নয়; বরং এই বিধানের বৈধতা জরুরি তবে এর ব্যবহারিক পদ্ধতিটি যেন সুস্থ ও সঠিক নিয়ম মেনে সম্পাদিত হয় তার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। এবং সমাজকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। কেননা আইন করে বা ব্যান করে তিন তালাকের অপব্যবহার বন্ধ করা যাবে না। এই অপসংস্কৃতি থেকে মুক্তি পেতে হলে নারীপুরুষ সকলকে তালাকের সঠিক পদ্ধতি সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল করতে হবে; অন্যথায় আরও বিনা-তালাকে বিচ্ছেদের সাক্ষ্যি থাকবে সমাজ।

[পূবের কলম, ২০ ডিসেম্বর, ২০১৯-এর দ্বীনদুনিয়া-তে প্রকাশিত]

No comments:

Post a Comment