Tuesday 31 October 2017

আব্দুল মাতিন ওয়াসিমঃ অভ্যাসের জাল

অভ্যাসের জাল

আব্দুল মাতিন ওয়াসিম

বহু দিন বাদে শুক্রবারে সরকারী ছুটি পড়েছে। তাই সকাল সকাল গোসল করে, পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে নামাজ পড়তে বেরিয়ে গেলো স়াবির। পাশের চার-তলা মহাম্মদি মসজিদে। তারা ক’জন বন্ধুবান্ধব দীর্ঘ ক’বছর যাবৎ সেই মসজিদেই নামাজ পড়ে। জুম্‌আর নামায শেষে স়াবির মসজিদ থেকে বেরিয়ে ডান দিকের উল্টো ফুটে জুসের দোকানটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো পাঞ্জাবির ডান পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে সুইচ অন করলো। তারপর একবার মাথা তুলে মসজিদের গেটের দিকে তাকালোদেখলো, নামাজিরা পিলপিল করে বেরোচ্ছে। আবার মাথা নামিয়ে মোবাইল ঘাঁটতে লাগলো। ভাবলো, ওরা বেরোলে আজ সবাই মিলে লসসি বা ম্যাংগো-শেক খাবে।

স়াবির ও তার বন্ধুরা, আসাদ-জ়োয়া-নাজ়িম-মুজাহিদ-শাহাবুদ্দিন প্রতি শুক্রবারে জুম্‌আর নামাজ শেষে তারা সকলে মিলে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়। কখনো চা-কফি, তো কখনো লসসি-জুস খায়। কোনো কোনো শুক্রবার হাতে সময় থাকলে সবাই মিলে কোথাও গিয়ে বিরিয়ানি খায়। যা-ই খাক না কেন, শেষে নাজ়িম এক বোতল বিস্‌লারি জল কেনে। ও বিস্‌লারি ছাড়া জল খায় না। আর তা নিয়ে সবাই বেশ মশকরাও করে। তারপর হইচই করতে করতে যে যার বাড়ি ফিরে যায়।

বেশ কিছুক্ষণ হয়ে গেল, কেউ বেরোচ্ছে না দেখে আরও একবার মসজিদের গেটের দিকে তাকালো স়াবিরএখন আর তেমন ভিড় নেই। মনে মনে ভাবতে লাগলো, এরা আজ কত দু’আ করছে রে বাবা। আসাদ এত কী চায়, গুণবতী-রূপবতী বউ পেয়েছে, ভালো চাকরি পেয়েছে, ওর পেট ভরবে না কোনোদিনআর ওদিকে নাজ়িম, ওর কান্নাকাটি শেষ হবে না। আর নাজ়িম না বেরোলে শাহাবুদ্দিনও বেরোবে না। কিন্তু মুজাহিদের কী হল, ও তো আমার মতোই আগে ভাগে বেরিয়ে আসে। আজ এত দেরী করছে...

হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেল স়াবিরঅভ্যাসের বোনা জাল ছিঁড়ে গুটি গুটি পায়ে একাকী ফিরতে লাগলো নিজ আবাসের দিকে। প্রায় দু’ বছর হল, নাজিম অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে পিএইচডি করতে। আসাদ এখন বর্ধমানে এক সরকারী স্কুলে চাকরি করে। মুজাহিদ চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় এমন মন দিয়েছে যে এখন ওর টিকি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। শাহাবুদ্দিনের অফিস এখন ধর্মতলায়। আর জ়োয়া স্বামী-সন্তান নিয়ে বর্ধমানে।

ক্লান্ত পায়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজেকে প্রশ্ন করলো, এভাবেই কি স্মৃতির ভ্রমর অভ্যাসের ডানায় ভর করে এসে অতর্কিতে কামড় দেয়, হূল ফোটায় অস্তরাগের ক্ষততে। আর সেই ক্ষত দ্বিগুণ করে তোলে মনের দাহকে। যা কোনো অলসক্ষণে, মনের অজান্তেই অশ্রু রূপে ঝরে পড়ে দগ্ধ মনোভূমিকে শান্ত করতে।

লিফটের পরিবর্তে অসাড় পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। ঈষৎ অবনত মস্তকে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তারপর পাঞ্জাবির বাম পকেট থেকে রুমালটা বের করে চোখ-মুখ মুছে কলিং বেল বাজালো...

কোলকাতা- ৩৯

No comments:

Post a Comment