কায়রো ট্রিলজিঃ
প্রজন্ম-ক্রমে পরিবর্তনের ইতিবৃত্ত
১৯৮৮ সালে, সাতাত্তর বছর বয়সে, সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পান মিশরীয় ঔপন্যাসিক নাজিব
মাহফুয। আরব দুনিয়ায় তাঁর গভীর জনপ্রিয়তা অনেক আগে থেকেই ছিল,
নোবেল পাওয়ার পর তাঁর পরিচিতি হল সুদূরপ্রসারী
। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, প্রথম যে দিন তাঁর নাম শুনি,
তা ছিল ঘৃণা মিশ্রিত কলেবরে। তবে ধীরে ধীরে
অন্যান্যদের ন্যায় আমিও তাঁর মুগ্ধ পাঠকে পরিণত হই। বর্তমানে আমি তাঁর উপন্যাসে
সামাজিক ইস্যুগুলি নিয়ে গবেষণার কাজও করছি।
কায়রো ট্রিলজি তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি। এই উপন্যাসত্রয়ী তাঁকে
বালজাক, ডিকেন্স, টলস্টয় এবং গলসওয়ার্থির সমপর্যায়ে উপনীত করেছে। কায়রো
শহরের একটি বৃহৎবৃত্ত ও স্বচ্ছ্বল পরিবারকে ঘিরে তাঁর এই অনন্য সৃজন। রাস্তার নাম
আন-নাহ্সীন, সেই ব্যস্ত পথের ধারে বহুদিনের পুরনো এক দোকান।
মালিক আহমাদ আব্দ আল্-জাওয়াদ। নিজ বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী ও ক্রেতাদের নিকট তিনি সদাপ্রসন্ন ও কৌতুকপ্রবণ এক ব্যক্তিত্ব।
তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত। জীবনের অভিঘাতে স্কুলের গন্ডি পার করতে পারেন নি। তবে
ক্রেতা থেকে বন্ধুবান্ধব সকলে তাঁর বাক্ চাতুর্যে মুগ্ধ ছিল। তিনি পেশায় ব্যবসায়ী
ছিলেন, তবে তাঁর সামাজিক পরিচিতির গন্ডি কায়রোর
উচ্চপদস্থ আমলা, সফল আইনজীবী ও সম্পন্ন ভূস্বামী পর্যন্ত
বিস্তীর্ণ ছিল। কিন্তু শহরের অন্য প্রান্তে, বায়ন্ আল্-কাসরাইন্ সরণিতে নিজ গৃহে স্ত্রী-পুত্র-কণ্যাদের
নিকট তিনি ভিন্ন রকম; সেখানে তিনি উদাসীন স্বামী,
নিষ্ঠুর পিতা, দায়িত্বশীল, কিন্তু কঠোর গৃহকর্তা।
বড় বড় ঘর, কড়িবর্গার ছাদ, পুরনো আমলের ভারী আসবাবে ঠাসা একটি বাড়ীতে আব্দ আল্ জা্ওয়াদ
ও তাঁর পরিবারের বসবাস। সে বাড়ীটিতে একতলা-দোতলা, প্রশস্ত উঠোন, উঠোনের ধারে কুয়োতলাও রয়েছে —
তাছাড়া আরও আছে একটি ঝুল বারান্দা,
চতুর্দিক ঢাকা, কাঠের জাফরির উপর বিচিত্র নক্সায় ঘেরা। সেই
বারান্দায় দাঁড়িয়ে, জানালার খড়খড়ি এক চিলতে ফাঁক করে,
বাড়ির মহিলারা দেখে নিচের রাস্তায় প্রবাহমান
জনস্রোত, আরও দেখে কায়রো শহরে ফুটন্ত সকাল,
মন্থর দুপুর, কোলাহল-মুখর রাত্রির আনাগোনা। তাঁরা দেখে শুধুই
দেখে সেই মোহময় বাইরের জগৎকে, যে জগতের প্রত্যক্ষ অংশীদার বা সাক্ষী হওয়ার কোন অধিকার
তাঁদের ছিল না। তাই আয়েশা, খাদিজার গোপন দীর্ঘ নিঃশ্বাসে ভারী হয়ে ছিল সেই
পর্দানশীন ঝুল বারান্দাটি।
দুই মেয়ে আয়েষা ও খাদিজা, স্ত্রী আমিনা, তিন ছেলে ইয়াসিন, ফাহমি আর কামাল – এই হল আহমাদ আব্দ আল-জাওয়াদের পরিবার। এদের
ছোটবড় সুখ-দুঃখগুলি নিয়ে পরতে পরতে গড়ে ওঠেছে কায়রো ট্রিলজি। পরিবারের জ্যেষ্ঠ
পুত্র ইয়াসিন আব্দ আল্ জা্ওয়াদের প্রথম পক্ষের সন্তান;
তবুও সে সৎমা আমিনার আপ্লুত স্নেহ থেকে বঞ্চিত
হয়নি। পরিবারের আর চারটি ছেলেমেয়ের মতই, তার উপরেও বর্ষিত হয় আমিনার সস্নেহ সেবাযত্ন। যৌবনে পদার্পণ
করে সে পাশের বাড়ির সুন্দরী, ষোড়শী মরিয়মের সাথে প্রণয়ে আবদ্ধ হয়,
কিন্তু তাঁর রাশভারি পিতা কিছুতেই মরিয়মের
সঙ্গে তাঁর বিয়ে দিতে রাজি হননি। তার পর থেকেই ইয়াসিনের জীবন হয়ে দাঁড়ায় অলীক
সুখের হাতছানিতে বিভ্রান্ত, বিমূর্ত এক ট্র্যাজেডি । প্রেমহীন বিবাহে আবদ্ধ
হতে হয় তাঁকে। কামতাড়িত হয়ে অসংযত যৌনতার কাছে বার বার আত্মসমর্পণ করে নিজের সাথে
লড়াইয়ে হেরে যায় সে। একের পর এক শারিরীক সম্পর্ক তাকে যোগায় শুধুই সাময়িক
উত্তেজনার খোরাক। প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর নানা ওঠাপড়ার মধ্যে দিয়ে
প্রবাহিত হয় তাঁর অতৃপ্ত জীবন।
অন্যদিকে প্রৌঢ়ত্ব পার করে বার্ধক্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে
যায় আয়েষা ও খাদিজা দু-বোনই । প্রথম যৌবনে, খাদিজা ছিল গৃহকর্মনিপুনা; কিন্তু লাবণ্যহীণা এবং মুখরা এক যুবতী।
পাড়াপড়শির ধারণা, তার বরাতে ভাল বর জুটবে না। ঐ রকম কৃষ্ণবর্ণ
রূপহীনাকে কোন ভালোছেলে বিয়ে করবে? কিন্তু যৌবনোত্তর জীবনে স্বামী ও দুই ছেলে নিয়ে খাদিজারই
সংসার ছিল ভরাট ও স্বচ্ছ্বল। অপরদিকে রূপসী আয়েষার রূপ বয়সের সাথে সাথেই বিদায়
নিয়েছে। স্বামী ও সন্তানের মৃত্যুর পর তার জীবন জুড়ে এখন নিরন্ধ্র তমসা। সে ফিরে
এসেছে মা-বাবার কাছে। পারিবারিক ট্র্যাজেডির স্মৃতি তাকে তাড়া করে মুহুর্মুহু। এক
অদ্ভুত অতৃপ্তি সাঙ্গ করে সে ঘুরে বেড়ায় এঘর থেকে সে-ঘর। মাঝে মাঝে নিজের মনেই
বিড়বিড় করতে থাকে। গভীর রাত্রে আয়েষার ঘর থেকে ডুকরে ওঠা কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙ্গে
যায় বৃদ্ধা আমিনার।
আহমাদ আব্দ আল-জাওয়াদের ছোট ছেলে কামাল। তিনটি উপন্যাসজুড়ে
তাঁর উপস্থিতি বেশ উজ্জ্বল। খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে,
শৈশব ও কৈশোর অতিক্রম করে তার বড় হয়ে ওঠার কথা।
তাঁর পরিণত মানুষ হয়ে ওঠার চিত্রায়ন বেশ মনোগ্রাহী। তাঁর জীবনে পূর্ণতা-অপূর্ণতার
দোলাচল, অকৃতার্থ প্রেমের অভিঘাত অত্যন্ত গভীর মমতায়
তুলে ধরা হয়েছে। আর এরই দরুন ফুটে উঠেছে এক পরিব্যপ্ত মানবিকতা বোধ,
যা কায়রো ট্রিলজি-কে কালজয়ী সাহিত্যের মর্যাদা
দিয়েছে । অনেকের নিকট, এই উপন্যাস-ত্রয়ীর স্থান বিশ্বসাহিত্যের সেরা
সম্পদগুলির সাথে এক আসনে ।
অনেক সমালোচকই মনে করেন, নাজিব মাহফুয কামালকে নিজের আদলে গড়েছিলেন। বাস্তবে এই
উপন্যাস ত্রয়ী আত্মজীবনীমূলক। এক্ষেত্রে সমালোচকদের যুক্তি এই যে,
কায়রোর যে জামালিয়া অঞ্চলে ঔপন্যাসিকের জন্ম
সেখানেই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় পরিবারটির আদি বাসস্থান। তাছাড়া কায়রো ট্রিলজির
কাহিনীর শুরু ১৯১৯ সালের কোন একটি সময় থেকে। অনেকে অবশ্য বলেন কাহিনীর সূত্রপাত
১৯১১ সাল থেকে, মাহফুযের জন্মের বছর।
- আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
No comments:
Post a Comment