এক অভাগীনি মায়ের চিঠি
আব্দুল মাতিন ওয়াসিম
[লোক মুখে শোনা কিছু গল্প ও কল্পকথা এর মূল ভিত্তি। আমি শুধু সেগুলোকে সাজিয়ে গুছিয়ে, তাকে আমার সীমিত শব্দ কাঠামোয় প্রকাশের প্রয়াস করেছি মাত্র।]
ক’দিন হল মা মারা গেছে। সেদিন মা’র ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে একটা খাম পেল সোহেল। কৌতূহলী দৃষ্টিতে দ্রুত খুলে ফেলল খামটা। বেরিয়ে আসল একটা বহু পুরানো খাতার পাতা; প্রায় হলদে রংয়ের; দু'টো ধাপে ভাঁজ করা; মা’র অসাড় হাতের লেখা। তাতে লেখা ছিল—
ক’দিন হল মা মারা গেছে। সেদিন মা’র ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে একটা খাম পেল সোহেল। কৌতূহলী দৃষ্টিতে দ্রুত খুলে ফেলল খামটা। বেরিয়ে আসল একটা বহু পুরানো খাতার পাতা; প্রায় হলদে রংয়ের; দু'টো ধাপে ভাঁজ করা; মা’র অসাড় হাতের লেখা। তাতে লেখা ছিল—
“খোকা, এই চিঠি যখন তোর হাতে পড়বে তখন আমি তোর কাছ
থেকে বহু দুরে চলে গেছি; যেখান থেকে কেউ কোনো দিন ফিরে আসে না।
খোকা, তুই এখন অনেক বড় হয়েছিস। শৈশব-কৈশোরের অনেক
কথাই তোর এখন আর মনে নেই। তাই এই চিঠিতে লিখে গেলাম তোর মনে না-থাকা সেই
কথাগুলো।
তুই তখন খুব ছোট। একবার তোর জ্বর হয়েছিল। তিন রাত ঘুমোতে
পারিনি আমি। তোকে বুকে আগলে বসেছিলাম। কারণ, যখনই তোকে বিছানায় শুইয়ে দিতাম তুই কেঁদে
উঠতিস। তোর বাবাও বলেছিলো তোকে শুইয়ে রাখতে; কিন্তু আমি পারিনি...!
আর তাই অনেক কথাই শুনতে হয়েছিল আমাকে তোর বাবার থেকে।
রাতে তোকে যখন বিছানায় শোয়াতাম, তুই
পেচ্ছাব করে বার বার বিছানা ভিজিয়ে দিতিস। আর আমি তোকে শুকনো জায়গায় শুইয়ে দিয়ে
নিজে পেচ্ছাবে-ভেজা জায়গায় শুয়ে থাকতাম।
তোর বাবা মারা গেল, তখন তুই সবে স্কুল যাওয়া আরম্ভ করেছিস। হাতে
তেমন পয়সাকড়ি নেই; অনেক কষ্টে সংসারটা চালাতে হয়েছে আমাকে। কতদিন
একটা ডিম ভেজে দু’ টুকরো করে তোকে দু'বেলা খাইয়েছি। এমনও
দিন গেছে, শুধু লবন-তেল দিয়ে তো কখনো কাঁচা লংকা-পেঁয়াজ দিয়ে ভাত খেয়েছি আমি। কিন্তু
তোকে বুঝতে দিইনি। একদিন, রান্না করার মতো চাল ছিল না ঘরে। কোনো উপায় না পেয়ে,
একবাড়িতে কাজ করে কিছু চাল এনে তোকে ভাত রেঁধে খাইয়েছিলাম...।
খোকা, হয়তো তুই ভুলে গেছিস। তোর ফাইনাল
ইয়ারের পরীক্ষার ফি দিতে হবে। হাতে টাকাপয়সাও নেই। কী
করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। শেষমেশ, তোর বাবার দেওয়া শেষ স্মৃতি হাতের বালা
দুটো বিক্রি করে তোর পরীক্ষার ফি দিয়েছিলাম।
ভাবছিস, এতো কথা তোকে কেন লিখে গেলাম...! এমন অনেক, অনেক
কথা আছে রে, যা লিখতে গেলে হয়তো খাতা শেষ হয়ে যাবে,
কিন্তু লেখা শেষ হবে না।
খোকা, তুই যখন বড় হলি। একটা ভালো চাকরি পেলি। তার কিছুদিন
পরে বিয়ে করলি...। আমরা তখন ভালোই ছিলাম।
একদিন ঘর থেকে কিছু টাকা চুরি হল। মনে আছে তোর খোকা? সেদিন
তুই আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলি, আমি তোর টাকার ব্যাপারে কিছু জানি কি না? তুই
আমাকে সরাসরি কিছু বলিসনি। তবে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, তুই আমাকে সন্দেহ করিস...! তার
কিছুদিন পর, তুই আমাকে ‘চোর’ অপবাদ দিয়ে রেখে গেলি অন্য একটি ঘরে। খোকা, সেই ঘরটিতে থাকতে আমার মোটেই ভালো লাগতো না; কেমন ভয়
করতো মনে। হয়তো ঘরটি তোদের থেকে অনেক দুরে ছিল তাই। খোকা,
তোকে একদিন বলেছিলাম, আমার একা থাকতে ভয় লাগে...। উত্তরে তুই
বলেছিলি, “সময় হলে, মরণ যে-কোনো জায়গায় আসবে।”
বয়সের কারণে হাঁটুর ব্যাথাটাও বেড়ে ছিল। তাই তোকে একদিন বলেও
ছিলাম, খোকা, আমাকে কিছু ওষুধ কিনে দিবি? তুই
বলেছিলি, এই বয়সে ওষুধ খেয়ে কিছু হবে না। ঠিক হওয়ার থাকলে এমনিই
ঠিক হয়ে যাবে। আমি তখন বিছানা থেকে উঠতে পারতাম না। শরীরে
ফোসকা পড়ে গেছিল। শরীর থেকে একটা পচা গন্ধ বের হত। কতো দিন যে
স্নান করিনি, তা ঠিক বলতে পারবো না।
খোকা, তোর ঘরটা ছিল আমার ঘর থেকে অনেক দুরে। কখন
আসতিস, কখন চলে যেতিস, আমি কিছুই জানতে পারতাম না। তবুও
পথের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। খোকা, তুই যখন ছোট ছিলি; আমি খেতে বসলে তোকে কোলে
নিয়ে খেতে বসতাম। কখনো তোকে চোখের আড়াল হতে দিতাম না রে...।
ছোটবেলা তুই যখন আমার কোলে পায়খানা করে দিতিস, তোর পায়খানা
পরিস্কার করতে আমার একটুও ঘৃণা লাগত না। কিন্তু ইদানীং তুই যখন আমার কাছে আসতিস, নাকে
রুমাল দিয়ে আসতিস। কেনোরে খোকা? আমার শরীর থেকে গন্ধ বেরতো বলে? আমাকে
কতো মাস যে এক কাপড়ে থাকতে হয়েছে, তা আমি ঠিক বলতে পারবো নারে...!
অনেক দিন পর, তুই যখন একবার আমাকে দেখতে এসেছিলি; আমার খুব
ইচ্ছে হচ্ছিল, তোকে একবার বুকে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু পারিনি; আমার
শরীরে যে অনেক ময়লা ছিল। পাছে তোর দামী শার্ট-প্যান্ট নষ্ট হয়ে যায়, এই
ভয়েতে তোকে বুকে নিতে পারিনি সেদিন!
এখানে কত বার এসেছিস তুই; কিন্তু একবারও জিজ্ঞেস করিসনি, “মা
তোমার কি কিছু খেতে মন চায়...?” আচ্ছা খাওয়ার কথা না হয় বাদই দিলাম। কতদিন হল, তোর
মুখে ‘মা’ ডাক শুনিনি, বল...!
খোকা, আমার কী অপরাধ ছিল রে? যে আমাকে তোর থেকে এত
দুরে রাখলি? কেনো রে খোকা? আচ্ছা তুই কি পারতিস না আমাকে তোর কাছে রাখতে? তুই
কি পারতিস না আমাকে একটা কাপড় কিনে দিতে? খোকা, তুই
কি পারতিস না আমাকে একবার ডাক্তার দেখাতে...?
আমাকে একটা ডাক্তার দেখালে হয়তো আরো কিছুদিন থাকতে পারতাম এই
পৃথিবীতে। আমি তোর কাছে তো পেট ভরে খেতে চাইনি রে খোকা। শুধু
চেয়েছিলাম মন ভরে ‘মা’ ডাক শুনতে।
খোকা, এখন তোর কাছে আমার একটাই অনুরোধ, শেষ অনুরোধও বলতে
পারিস— আমার এই চিঠিটা তোর সন্তানদের পড়ে শোনাবি। তুই
বৃদ্ধ হলে যাতে তারা তোর সাথে এমনটা না করে...!
ভালো থাকিস, খোকা!
ইতি
তোর অভাগিনী মা
No comments:
Post a Comment